সুমেরীয় ধর্ম

সুমেরীয় সভ্যতা, যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান দক্ষিণ ইরাক) বিকশিত হয়েছিল, শুধু আইন, প্রশাসন ও কৃষ্টিতে নয়, ধর্মীয় বিশ্বাসেও অগ্রগামী ছিল। তাদের ধর্মে সেই সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। মিশরীয়দের মতো সুমেরীয়দের জীবনেও ধর্ম ছিল কেন্দ্রবিন্দু, যা তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করত।

 

সুমেরীয় ধর্ম

 

বহুদেবতা বিশ্বাস

সুমেরীয়রা বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস করত। প্রত্যেক দেবতা নির্দিষ্ট কোনো প্রাকৃতিক শক্তি, কাজ বা জীবনের ক্ষেত্রের অধিপতি ছিলেন। প্রধান দেবতা ও দেবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • শামাশ (Shamash) – সূর্যের দেবতা; আলো ও উত্তাপের মাধ্যমে পৃথিবীতে জীবনদান করতেন, তবে অতিরিক্ত তাপে ফসল ও মাটি পুড়িয়ে ক্ষতিও করতে পারতেন।
  • এনলিল (Enlil) – বায়ু ও বৃষ্টির দেবতা, কৃষি ও আবহাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
  • ইশতার (Ishtar) – প্রেম, উর্বরতা ও নারী জাতির প্রতীক, যুদ্ধ ও শক্তির সঙ্গেও যুক্ত।
  • নার্গাল (Nergal) – পাতালপুরীর ও ধ্বংসের দেবতা, তবে তিনিই রোগব্যাধি দূর করার ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করা হতো।
  • ন্যান্সে (Nanse) – অনাথ ও বিধবার রক্ষাকর্ত্রী, দুঃস্থদের সহায়ক এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক।

সুমেরীয় দেবতাদের মানবীয় চরিত্র ছিল—তারা সুখ-দুঃখ অনুভব করত, প্রেম-ঘৃণা প্রকাশ করত, এমনকি ভুল করত। এই মানবিক বৈশিষ্ট্য দেবতাদের মানুষের কাছে ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল, তবে তাদের ইচ্ছা অপ্রত্যাশিত ও অনিশ্চিত হওয়ায় ভয়ও জাগাত।

 

ইহজগৎকেন্দ্রিক জীবনদর্শন

সুমেরীয় ধর্মের মূল কেন্দ্র ছিল এই পৃথিবী—তারা বিশ্বাস করত জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি ও সাফল্য এখানেই লাভ করতে হবে।

  • পরকাল সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল অস্পষ্ট—মৃত আত্মারা অল্প কিছু সময়ের জন্য এক ছায়াময়, নিরানন্দ পাতালপুরীতে অবস্থান করে তারপর চিরতরে বিলীন হয়ে যায়।
  • স্বর্গ নরকের ধারণা বা মৃত্যুর পরে পুনর্জন্মের বিশ্বাস তাদের ধর্মে ছিল না।
  • মিশরীয়দের মতো তারা জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি, পিরামিড বা মমি তৈরির প্রথা অনুসরণ করেনি; বরং সাধারণভাবে মৃতদেহ মাটির নিচে কবর দেওয়াই ছিল প্রচলিত।

 

ধর্মীয় আচার সমাজকল্যাণ

সুমেরীয়রা দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত প্রার্থনা ও আচার-অনুষ্ঠান করত, যার লক্ষ্য ছিল—

  • কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধি
  • ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি
  • সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা

তাদের ধর্মসঙ্গীতে দেবতাদের সত্যপ্রিয়, ন্যায়বান মঙ্গলসাধক হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, একইসঙ্গে তাদেরকে মিথ্যার উস্কানিদাতা, বিবাদ সৃষ্টিকারী হিসেবেও দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দেবতারা ছিলেন দ্বৈত স্বভাবসম্পন্ন—একইসঙ্গে কল্যাণকারী ও ক্ষতিকারক।

 

সৃষ্টিতত্ত্ব প্লাবনের কাহিনী

সুমেরীয় ধর্মের একটি বড় দিক ছিল তাদের সৃষ্টিতত্ত্ব। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী—

  • দেবতা মার্দুক (Marduk) মানুষকে মাটি ও এক পৌরাণিক ড্রাগনের রক্ত মিশিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন।
  • পরে মানুষের আচরণে বিরক্ত হয়ে তিনি একবার মহাপ্লাবন ঘটান, যা পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণ ধ্বংস করে।
  • এই প্লাবন ও সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনী পরবর্তীকালে হিব্রু ধর্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলেছিল এবং বাইবেলের নোয়ার প্লাবনের গল্পের সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যায়।

 

সাংস্কৃতিক প্রভাব

সুমেরীয় ধর্ম শুধু মেসোপটেমিয়া নয়, পরবর্তী সভ্যতাগুলোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। হিব্রু, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয়দের অনেক ধর্মীয় কাহিনী ও বিশ্বাস সুমেরীয় উৎস থেকে গৃহীত।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সুমেরীয় ধর্ম প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এটি কেবল আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় প্রথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমাজব্যবস্থা, কৃষি, বাণিজ্য, আইন, সাহিত্য এবং শিল্পকলায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাদের বহুদেবতা বিশ্বাস, মানবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দেব-দেবীর ধারণা, ইহজগৎকেন্দ্রিক জীবনদর্শন এবং সৃষ্টিতত্ত্ব-ভিত্তিক কাহিনীগুলো পরবর্তী অনেক সভ্যতার ধর্মীয় ঐতিহ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যদিও তাদের পরকাল-ধারণা ছিল অস্পষ্ট ও সীমিত, তবুও সুমেরীয় ধর্ম মানুষের পার্থিব জীবন, সাফল্য ও সামাজিক সমৃদ্ধির প্রতি এক গভীর মনোযোগের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

Leave a Comment