হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। হেলেনিস্টিক বা আলেকজান্দ্রীয় যুগে অতি দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছিল। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের বাণিজ্য ও শিল্পবিপ্লবের আগে এত দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তর আর ঘটেনি।

হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

 

হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

 

এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, আলেকজান্ডারের বিজয়ের পরে গ্রীকদের বাণিজ্য আর শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগরের পূর্ব অঞ্চলে সীমিত না থেকে, উত্তরে ডানিয়ুব থেকে দক্ষিণে ইথিওপিয়া এবং পূর্ব দিকে ভারত বা এমনকি চীন থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে গ্রীক বাণিজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য অল্প দিনের মধ্যে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাণিজ্য জাহাজের গতি এবং আকার বৃদ্ধি পেয়েছিল।

জাহাজগুলো সচরাচর ছিল ৮০ কিংবা ১০০ টন মালবাহী জাহাজ, তবে আরো বড় মালবাহী জাহাজও ছিল। বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে বড় বড় বন্দর, পোতাশ্রয় ও আলোকস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল, জলপথের সংস্কার করা হযেছিল, ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত খাল খনন করা হয়েছিল জাহাজ চলাচলের জন্য। দ্বিতীয়ত পারস্য সাম্রাজ্যের ধনভাণ্ডারগুলোতে জমা করা সোনারূপা বাজারে ছাড়া পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

এর ফলে অর্থবানরা শিল্প-বাণিজ্যে এবং ফটকাবাজিতে অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করল। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে এবং ধনভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্যে নতুন শাসকরা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সাধনে তৎপর হলেন। এ সকল কারণের ফলে এ যুগে বৃহদায়তন উৎপাদনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যবসা ও অর্থব্যবস্থার প্রসার ঘটে। আলেকজান্দ্রীয় যুগে রাষ্ট্রই ছিল প্রধান শিল্পপতি ও পুঁজিপতি।

নতুন অর্থনীতিতে কৃষির ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। নতুন শাসকরা আগেকার আমলে বড় বড় ভূস্বামীর জমি বাজেয়াপ্ত করে রাজকীয় সম্পত্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পরে এ জমিগুলোকে অনুগত অভিজাত এবং কৃষকদের কাছে পত্তন দেন এবং সর্বাধিক মুনাফালাভের ব্যবস্থা করেন। জমির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে কৃষকদের দুর্দশা বাড়লেও কৃষির ফলন বৃদ্ধি পেয়েছিল।

কোষাগারের ধনবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মিশর এবং সেলুকাসের সাম্রাজ্যের শাসকরা শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতিবিধান ও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। মিশরের টলেমী রাজবংশের শাসকরা প্রায় প্রত্যেক গ্রামে ও শহরে কারখানা স্থপন করেছিলেন। এদের মালিক ও পরিচালক ছিল রাষ্ট্র স্বয়ং। সেলুকাসের সাম্রাজ্যেও প্রায় অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবশ্য এ দুই রাষ্ট্রই ব্যক্তিগত মালিকানার অধীনে রেখেছিল।

তবে নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যবসার প্রসারের জন্যে সরকার থেকে উৎসাহ দেয়া হত। পোতাশ্রয়সমূহকে নির্মাণ ও উন্নত করা হয়, জলপথে পাহারা দেবার জন্য যুদ্ধজাহাজ পাঠান হয়, পথঘাট এবং খাল নির্মাণ করা হয়। তদুপরি টলেমী শাসকরা বিখ্যাত ভৌগোলিকদের নিয়োগ করতেন দূরাঞ্চলে যাবার নতুন পথ আবিষ্কারের জন্যে, যাতে নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ লাভ করা যায়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এসব ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে মিশর এক সুবিশাল বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন পণ্যের সমাবেশ ঘটে। আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে আরবদের কাছ থেকে মশলা, সাইপ্রাস থেকে তামা, আবিসিনিয়া ও ভারতবর্ষ থেকে সোনা, ব্রিটেন থেকে টিন, নুবিয়া থেকে হাতি ও হাতির দাঁত, স্পেন থেকে রূপা, এশিয়া মাইনর থেকে সুদৃশ্য কার্পেট, এমনকি চীন থেকে রেশমী বস্ত্র পর্যন্ত এসে জড়ো হত।

এ সকল পণ্যের ব্যবসা থেকে সরকার এবং বণিকরা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা অর্জন করত। হেলেনিস্টিক যুগে অর্থনৈতিক বিকাশের প্রতিফলন ঘটেছিল অর্থব্যবস্থার বিকাশে। এযুগে সোনা ও রূপার মুদ্রার ভিত্তিতে এক আন্তর্জাতিক মুদ্রা অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল এবং সমগ্র মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াতে মুদ্রা ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। প্রধানত রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ব্যাঙ্কও গড়ে উঠেছিল। ব্যাংকগুলো সব রকম ব্যাবসা বাণিজ্যে টাকা ধার দিত।

যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় যে হেলেনিস্টিক যুগ, অন্তত তার প্রথম দুই শতাব্দী ছিল সমৃদ্ধির যুগ। তবে সে সমৃদ্ধি সম্ভবত শাসকদল, অভিজাত শ্রেণী ও ব্যবসায়ী বণিকদের ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল। অন্তত কৃষক ও শ্রমিকদের জীবনে যে কোনো সমৃদ্ধিই আসেনি তা নিশ্চিত। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে এথেন্সের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকরা যে মজুরি পেত তা ছিল পেরিক্লিসের যুগের তুলনায় মাত্র অর্ধেক। অপর পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল।

হেলেনিস্টিক যুগে ক্রীতদাসের সংখ্যা সাময়িকভাবে কিছুটা কমেছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এ সময় মজুরি এত কম ছিল যে একজন ক্রীতদাসকে প্রতিপালন করার চেয়ে একজন শ্রমিক ভাড়া করা অনেক সস্তা ছিল। আলেকজান্দ্রীয় যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেক মহানগরীর সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও এ যুগে অধিকাংশ লোকই স্বভাবতই গ্রামে বাস করত।

তবে মানুষের মধ্যে শহরে যাওয়ার একটা প্রবণতা এ যুগে দেখা যায়। কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারই অবশ্য এ যুগের শহরে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। হেলেনিস্টিক যুগে নগরের সংখ্যা ও আয়তন এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে, তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকার অবস্থার সাথে তুলনা করা চলে। সিরিয়ার এ্যান্টিঅক নগরীর লোকসংখ্যা এক শতাব্দীর মধ্যে চারগুণ হয়ে যায়।

 

হেলেনিস্টিক যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি

 

হেলেনিস্টিক যুগের বৃহত্তম ও সবচেয়ে বিখ্যাত নগর ছিল আলেকজান্দ্রিয়া, তার লোকসংখ্যা ছিল ৫ থেকে ১০ লাখের মধ্যে। আকারে বা বৈভবে প্রাচীনকালের কোনো নগর, এমনকি রোম পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এ নগরীতে অপূর্ব সব সার্বজনীন ভবন এবং উদ্যান ছিল, একটি মিউজিয়াম তথা বিদ্যাপীঠ ছিল এবং একটি গ্রন্থাগার ছিল, যাতে সাড়ে সাত লাখ পুস্তক সংরক্ষিত ছিল। এ নগরী ছিল হেলেনিস্টিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধানতম কেন্দ্র।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment