আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান। ১৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম পিউনিক যুদ্ধের শেষের পঞ্চাশ বছর আগে কার্থেজ রোমে তার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছিল, কিন্তু রোমের জন্য কোনো সামরিক হুমকি ছিল না।তা সত্ত্বেও, রোমান সিনেটের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি দল ছিল যারা কার্থেজের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল।একটি অজুহাত হিসাবে অবৈধ Carthaginian সামরিক পদক্ষেপ ব্যবহার করে, রোম একটি শাস্তিমূলক অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে।কার্থাজিনিয়ান দূতাবাসগুলি রোমের সাথে আলোচনার চেষ্টা করেছিল, যা তুচ্ছভাবে সাড়া দিয়েছিল।উত্তর আফ্রিকার বৃহৎ বন্দর শহর উটিকা, কার্থেজ থেকে প্রায় ৫৫ কিমি (৩৪ মাইল) উত্তরে, ১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে চলে যায়।সচেতন যে Utica এর পোতাশ্রয় কার্থেজের উপর যেকোন আক্রমণের জন্য ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে, সেনেট এবং রোমের পিপলস অ্যাসেম্বলি কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান
কার্থেজের বিরুদ্ধে অভিযান
মগ্র ইতালির অধীশ্বর হওয়ার পর রোমের স্বভাবতই দৃষ্টি পড়ে ভূমধ্যসাগরের অপর পারে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার বিশাল সমৃদ্ধিশালী নগরী কার্থেজের উপর। কার্থেজ নগরীকে শুধু নগরী বললে ভুল বলা হবে, প্রকৃতপক্ষে কার্থেজ ছিল একটি বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী। উত্তর আফ্রিকার টিউনিস্ থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের মালিকানা ছিল কার্থেজের অধীনে।
৮০০ অব্দে ফিনিসীয় উপনিবেশরূপে কার্থেজ নগরীর পত্তন হয়। খ্রিঃ পূঃ ৬০০ অব্দে কার্থেজীয়গণ তাদের মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শক্তিশালী ও সম্পদশালী জাতিরূপে গড়ে উঠে। কার্থেজের এই সমৃদ্ধির মূলে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলস্থ বাণিজ্যবন্দরগুলির সাথে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্পেন ও ব্রিটেনের রূপা ও তামার খনিগুলির সম্পদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে ও উত্তর আফ্রিকার অধীনস্থ এলাকাগুলির সম্পদ আত্মসাৎ করে কার্থেজ তার নিজস্ব পণ্যের সম্ভার গড়ে তোলে এবং এই পণ্য দেশ-বিদেশে চালান দিয়ে সে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। স্বাভাবিক কারণেই কার্থেজের বিপুল ঐশ্বর্য রোমের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই কার্থেজের সাথে রোমের তিনটি বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধগুলিকে পিউনিক যুদ্ধ বলা হয়।
কার্থেজের অধিবাসীদের রোমানগণ পিনি (অর্থাৎ ফিনিশীয়) নামে সম্বোধন করত। এই নাম থেকেই পিউনিক নামের উৎপত্তি। খ্রিঃ পূঃ ২৬৪ অব্দে কার্থেজের সাথে রোমের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ ছিল সিসিলির উপর উভয়ের দখল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কার্থেজ অবশ্য সিসিলির পশ্চিমাংশ আগেই অধিকার করে নিয়েছিল। এখন সে পূর্ব দিকের গ্রীক অধিকৃত সায়রাকিউজ ও মেসানার উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
কার্থেজের হাত থেকে সিসিলিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রোম কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তেইশ বছর স্থায়ী যুদ্ধে কার্থেজ শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় এবং সিসিলির অধিকার রোমের হাতে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রচুর ধনরত্নও রোমকে প্রদান করতে হয়।

সিসিলি দখলের পর রোমের লালসা আরও বেড়ে যায়। কার্থেজ কর্তৃক স্পেনে রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টাকে রোম তার উপর কার্থেজের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা বলে মনে করে এবং কার্থেজের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ ঘোষণা করে (২১৮ খ্রিঃ পূঃ)। এ যুদ্ধ সতেরো বছর ধরে চলে। কার্থেজীয়গণ তাদের বিখ্যাত সামরিক অধিনায়ক হ্যানিবল-এর অধীনে আপ্লস্ পর্বত অতিক্রম করে রোমের দিকে অগ্রসর হয়।
হ্যানিবল-এর বাহিনী ক্যানির যুদ্ধে (২১৬ খ্রিঃ পূঃ) রোমানদের পরাজিত করে সমগ্র ইতলীয় উপদ্বীপব্যাপী এক প্রচণ্ড বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। রোম তার মিত্রদের সহায়তায় বহু কষ্টে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু হ্যানিবল তাঁর নিজ দেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য ও সহযোগিতা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ইতালী ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হন। শেষ যুদ্ধে হ্যানিবল রোমের হাতে পরাজিত হন এবং এ পরাজয় কার্থেজের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত কার্থেজ শুধু মাত্র তার রাজধানী ও তৎসংলগ্ন আফ্রিকার কিছু অংশ ব্যতীত সমগ্র অধিকৃত সাম্রাজ্য রোমের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমের আগ্রাসী নীতি সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। ইতিমধ্যে কার্থেজ তার পূর্ব সমৃদ্ধির কিছুটা পূনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এটা রোমের পক্ষে সহ্য করা কঠিন ছিল।
১৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের সিনেট কার্থেজের প্রতি এই মর্মে নির্দেশ পাঠায় যে কার্থেজীয়গণ যেন তাদের রাজধানী পরিত্যাগ করে চলে যায় এবং সমুদ্রোপকূলের অন্তত দশ মাইলের মধ্যে তাদের কোনো চিহ্ন যেন না থাকে। একটি স্বাধীন জাতির পক্ষে এর চেয়ে অবমাননাকর আর কি হতে পারে? এ নির্দেশনামা ছিল কার্থেজীয়গণের প্রতি মৃত্যু-সংকেতস্বরূপ । স্বাভাবিকভাবেই কার্থেজীয়গণ এ নির্দেশ অমান্য করে এবং রোম তৃতীয় ও শেষবারের মতো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
তিন বছর ধরে (খ্রিঃ পূঃ ১৪৯-১৪৬) কার্থেজীয়গণ প্রাণপণে প্রতিরোধ করেও শেষ পর্যন্ত রোমানদের হাতে পরাজিত হল। পৃথিবীতে যতগুলি নৃশংস মর্মান্তিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এ যুদ্ধ তাদের অন্যতম। পরাজিত ও বিধ্বস্ত কার্থেজ নগরীর উপর রোমক বাহিনীর বিপুল জয়যাত্রা যে॥বিভীষিকার সৃষ্টি করে, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লেখা থাকবে।
পাইকারি গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর যারা অবশিষ্ট ছিল, তাদের ক্রীতদাসরূপে রোমে চালান দেওয়া হল। এককালের সমৃদ্ধিশালী কার্থেজ নগরীর কোনো চিহ্নমাত্র রইল না। রোমান সিনেট সদস্য ও দাসমালিকগণ অধিকৃত অঞ্চলের সমৃদ্ধ এলাকাগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল।
আরও দেখুন :