জাপানের ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জাপানের ইতিহাস

জাপানের ইতিহাস

 

জাপানের ইতিহাস

 

জাপানের ইতিহাস

দূর প্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে জাপানেই প্রাচীন সভ্যতা সবচেয়ে দেরিতে বিকাশ লাভ করে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। জাপান দ্বীপপুঞ্জ এশিয়ার পূর্ব উপকূলের পার্শ্ববর্তী হলেও, মূল ভূ-খণ্ডের একেবারে নিকটবর্তী নয়। কোরিয়া উপদ্বীপের কাছেই জাপান এশিয়ার উপকূল থেকে সবচেয়ে কম দূরবর্তী এবং এ দূরত্ব ১০০ মাইলেরও বেশি।

সমুদ্রগামী জাহাজের প্রচলন হওয়ার আগে জাপানের সাথে চীন বা এশিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেনি। এর ফলে দীর্ঘকাল পর্যন্ত জাপানের অধিবাসীরা চীনের সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। জাপান দ্বীপপুঞ্জ তিন হাজারেরও বেশি পর্বতসঙ্গল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে মাত্র চারটি দ্বীপ বড় আকারের এবং মোট ৬০০টি দ্বীপে লোকবসতি আছে। মূল দ্বীপের নাম হনশু, এ দ্বীপেই বর্তমান রাজধানী টোকিও এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক রাজধানী কিয়োতো অবস্থিত।

হনশুর উত্তরে হোক্কাইডো দ্বীপ এবং দক্ষিণে শিকোকু ও কিউশিউ দ্বীপ। কিউশিউ হচ্ছে কোরিয়া উপদ্বীপের ঠিক মুখোমুখি। জাপানের স্থলভাগের মোট আয়তন ১ লক্ষ ৪২ হাজার বর্গমাইল। অবশ্য এর শতকরা ৮০ ভাগ জমিই পার্বত্য ও বসবাসের অযোগ্য। জাপানের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। জাপান নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত, তবে উত্তর-দক্ষিণে এর বিস্তৃতি প্রায় ১৫ ডিগ্রী অক্ষাংশ বলে তার বিভিন্ন অংশে আবহাওয়ার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

জাপানে শীতকালে শীত তীব্র এবং গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত প্রচুর। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এশিয়া ভূখণ্ড ও বোর্ণিও, জাভা এবং ফিলিপাইন থেকে মানুষ এসে জাপানে বাস স্থাপন করে। পণ্ডিতদের মতে, চু-যুগে (১০২৭-২৪৯ খৃঃ পূঃ) কয়েক দফায় কোরিয়া ও অন্যান্য স্থান দিয়ে চীন থেকে মানুষের দল জাপানে যায়। বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডোতে যেসব আদিবাসী আছে তাদের কাছে পাওয়া নানা শিল্প নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, অন্তত ছয় হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ জাপানে এসেছিল।

জাপানে পুরান পাথরের যুগের শিকারি মানুষরা পদার্পণ করেছিল বলে জানা যায়নি। জাপানে প্রাপ্ত বাড়িঘর, মাটির পাত্র প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে, পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে নতুন পাথরের যুগের কৃষি সংস্কৃতির মানুষ জাপানে বাস স্থাপন করেছিল। কৃষিই ছিল আদিমতম জাপানিদের অর্থনীতির ভিত্তি। ক্রমশ অতি প্রাচীনকালেই জাপানে টাইব সমাজ অনেকগুলো ছোট ছোট ট্রাইবভিত্তিক রাজ্যের জন্ম দেয়।

বংশানুক্রমিক গোষ্ঠীপতিরা ছিল এসব রাজ্যের শাসক। শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাতরা জমির মালিকানা নিজেদের হাতে জড়ো করেছিল। তাদের নিচে ছিল কৃষক ও কারিগরদের অবস্থান এবং সকলের নিচে ছিল ভূমিদাসদের স্থান। মনে থাকতে পারে যে, আদি নবোপলীয় সংস্কৃতিতে সমাজের শ্রেণীবিভাগ ছিল না। কিন্তু জাপানে চীন থেকে চু-যুগে বা তার কাছাকাছি সময়ে যে নতুন মানুষরা এসেছিল তারাই সম্ভব সাথে করে ব্রোঞ্জযুগের শ্রেণী বিভাগের ধারণা ও কলাকৌশল জাপানে নিয়ে এসেছিল।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই মধ্য জাপানের ইয়ামাতো গোষ্ঠী হনশু দ্বীপের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে এবং গোষ্ঠীর শাসক নিজেকে সম্রাটরূপে ঘোষণা করেন। অবশ্য খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে এসেই প্রকৃতপক্ষে এ গোষ্ঠীর শাসক সর্বোচ্চ সম্রাটরূপে পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেন। চীনের ইতিহাসের চিন ও হান যুগে কোরিয়ার মাধ্যমে চীনের ব্রোঞ্জযুগের সংস্কৃতি জাপানে এসে পৌঁছায়। হান যুগে (খ্রিঃ পূঃ ২০৬-২২০ খ্রি) কোরিয়ার অংশবিশেষের উপর চীনের আধিপত্য বিস্তৃত হয়।

এরপর কোরিয়া থেকে চীনের সংস্কৃতির নানা উপাদান এসে জাপানে পৌঁছাতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চীন থেকে লোহার কারিগরি জাপানে এসে পৌঁছায়। একই সময়ে দলে দলে চৈনিক ও কোরীয় কারিগর, তাঁতি, কুমোর, পটুয়া, অভিজ্ঞ কৃষক ও রেশম চাষী জাপানে আগমন করে। এ ছাড়া চীনের চিকিৎসাবিদ্যা, ঔষধবিদ্যা, সামরিক বিজ্ঞান প্রভৃতিও জাপানে এসে পৌঁছায়।

জাপান ১০০ থেকে ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোরিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে একটা অঞ্চল অধিকার করে ছিল এবং কোরিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপও করেছিল। এ সময়েই পঞ্চম শতাব্দীতে চীনের লেখনপদ্ধতি ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম কোরিয়ার মাধ্যমে জাপানে এসে পৌঁছায়। এ সময়ে দলে দলে চীনা বিদ্বান জাপানে এসে চীনা ভাষা ও লেখন পদ্ধতি এবং চীন সাহিত্যের সেরা সৃষ্টি— তার কবিতা, দর্শন, ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার প্রচলন করেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লেখনপদ্ধতি আয়ত্ত করার ফলে জাপানের সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হল যে চীনের কাছ থেকে লেখনপদ্ধতি অর্জন করার ফলে পরবর্তীকালে তার সভ্যতার বিকাশ অনেকাংশে ব্যাহতও হয়েছে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, চীনের লেখন পদ্ধতি হচ্ছে মূলত চিত্রলিপিভিত্তিক বা ভাবব্যঞ্জক। জাপান লেখন পদ্ধতি আয়ত্ত করার অন্তত এক হাজার বছর আগে পশ্চিম এশিয়ায় ও গ্রীসে বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল।

জাপান যদি অন্য সূত্রে বর্ণমালা অর্জন করতে পারত তবে তার পক্ষে লেখা এবং পড়ার কাজটা অনেক সহজ হত। বিশেষত জাপানী ভাষা ধ্বনিগতভাবে চীনা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে চীনা ভাবব্যঞ্জক অক্ষর দিয়ে জাপানি ভাষা লেখা খুব কঠিন ছিল। জাপান অবশ্য চীনা লেখনপদ্ধতিকে বহুলাংশে সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত করে নিজেদের ভাষার উপযোগী করে নিয়েছে। তথাপি, জাপানী ভাষায় লিখতে শেখা।

এখন পর্যন্ত খুব দুঃসাধ্য রয়ে গেছে। অবশ্য, প্রাচীন ভারত থেকে যে বৌদ্ধ সন্নাসীরা জাপানে গিয়েছিলেন তাঁরা গোপনে একটা বর্ণমালাভিত্তিক লেখন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। আমরা দেখতে পেলাম, জাপানের প্রাচীন সভ্যতার আদি উৎস প্রত্যক্ষভাবে চীন। কিন্তু উল্লেখ করা দরকার যে, জাপান এক আশ্চর্য গুণে তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সব বৈদেশিক উপাদানকেই পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে।

 

জাপানের ইতিহাস

 

জাপান চীনা লেখনপদ্ধতিকে, বৌদ্ধ ধর্মকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে। এমনকি চীনের শিল্প, সাহিত্য, কাব্য, স্থাপত্য, নাট্য ও দৃশ্যকাব্য প্রভৃতিকে নিজেদের প্রয়োজন ও ঐতিহ্য অনুসারে রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে।

জাপান তার সভ্যতার আদি ও মূল উপকরণ চীন-কোরিয়া থেকে সংগ্রহ করলেও, নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রমের গুণে জাপানিরা তার বিকাশ সাধন করে আধুনিক জগতে নিজেদের জন্য একটা অনন্য স্থান করে নিতে পেরেছে। জাপানের পরবর্তী ইতিহাস মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

Leave a Comment