Tag Archives: মানুষের ইতিহাস

মানুষের ইতিহাস

আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস

আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস

 

 

আমেরিকা মহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস

১৪৯২ খৃষ্টাব্দে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা যখন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করে তখন তারা সেখানে বহুসংখ্যক আদিবাসীর সাক্ষাৎ পায়। আমেরিকার আদি বাসিন্দারা আমাদের দেশে রেড ইণ্ডিয়ান নামে পরিচিত। আমেরিকার আদিবাসী রেড ইণ্ডিয়ানদের সভ্যতা-সংস্কৃতির স্তর সর্বত্র এক রকম ছিল না।

অধিকাংশ অঞ্চলের আদিবাসীরা ছিল পশু শিকারি, কোনো কোনো অঞ্চলের আদিবাসীরা ছিল কৃষি সংস্কৃতির মানুষ। আবার উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো অঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলের লোকেরা প্রাচীন মিশরের ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতার সমতুল্য সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এ আমেরিকা মহাদেশে প্রথম মানুষের আবির্ভাব কি করে ঘটেছিল এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতিক ও সুউচ্চ সভ্যতার সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিল তা পণ্ডিতদের সামনে এখনও এক সমস্যারূপে বিরাজ করছে। আমেরিকাতে যে ধরনের বানর আছে তা বিবর্তনের দিক থেকে এশিয়া আফ্রিকার বানরের চেয়ে প্রাচীনতর পর্যায়ের। আমেরিকায় পিকিং মানুষের পর্যায়ের মানুষের কোনো ফসিল পাওয়া যায়নি।

আমেরিকাতে যেসব মানুষের ফসিল বা কঙ্কাল পাওয়া গেছে তা সবই আধুনিক মানুষের। এর অর্থ হচ্ছে আমেরিকাতে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক মানুষের উদয় ঘটেনি। আর আমেরিকাতে যদি মানুষের উৎপত্তি স্বতন্ত্রভাবে না ঘটে থাকে তাহলে মানুষ নিশ্চয়ই পুরাতন বিশ্ব অর্থাৎ এশিয়া-আফ্রিকা বা ইউরোপ থেকে সেখানে গিয়েছে। উত্তর গোলার্ধে এশিয়া ও আমেরিকা মহাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বেরিং প্রণালী।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ জায়গায় উত্তর-পূর্ব এশিয়ার উপকূল থেকে উত্তর আমেরিকার আলাস্কার দূরত্ব পঞ্চাশ মাইলেরও কম। এ জায়গায় যে-কোনো মেঘমুক্ত ও কুয়াশামুক্ত দিনে এশিয়ার উপকূলে দাঁড়িয়ে আমেরিকার তীর ভূমিকে দেখতে পাওয়া যায়। তা ছাড়া এর মধ্যে দ্বীপমালাও রয়েছে।
এশিয়া থেকে আমেরিকা জলপথে যেতে হলে এ জায়গায় একসাথে পঁচিশ মাইলের বেশি যেতে হয় না। কুড়ি-পঁচিশ হাজার বছর আগে অবশ্য জলপথে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তখন ছিল বরফ যুগ।

উত্তর-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যবর্তী এ জলপথ তখন সম্ভবত বরফে আচ্ছন্ন ছিল। বরফের পথ পার হয়ে এশিয়ার শিকারি যুগের মানুষদের পক্ষে বাইসনের পালের পিছন পিছন এশিয়া থেকে আমেরিকায় চলে যাওয়া সে সময় কোনো কঠিন কাজ ছিল না। বস্তুত, এখনকার অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, আমেরিকা মহাদেশে প্রথম মানুষ গিয়েছিল এশিয়া থেকে, বরফে ঢাকা বেরিং প্রণালী পার হয়ে এবং আলাস্কার মধ্য দিয়ে।

এশিয়া থেকে আমেরিকাতে যে একবারই মাত্র একদল মানুষ প্রবেশ করেছিল তা হযতো নয়। পণ্ডিতরা মনে করেন, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ দলে দলে এশিয়া থেকে আমেরিকায় প্রবেশ করেছে।

 

 

আমেরিকাতে যে বিভিন্ন ধরনের ফসিল পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতেই পণ্ডিতরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বিভিন্ন সময়ে আমেরিকাতে প্রবেশ করেছে। আমেরিকাতে প্রবেশ করার পর বিভিন্ন দলের মানুষ উত্তর আমেরিকার নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, অনেক মানুষের দল কালক্রমে পানামা যোজক পার হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রবেশ করে। শেষ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকার উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দু পর্যন্ত আমেরিকার আদিবাসীরা ছড়িয়ে পড়ে।

কত আগে আমেরিকাতে এশিয়া থেকে মানুষ প্রবেশ করেছিল সে বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে মানুষের কঙ্কাল, নিহত পশুর হাড় প্রভৃতির বয়স নিরূপণ করে কোনো কোনো পণ্ডিত স্থির করেছেন যে, প্রায় পনের হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম আমেরিকা মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। তবে কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, মানুষ ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বছর আগে উত্তর আমেরিকায় প্রথম পদার্পণ করেছিল।

আরও দেখুন :

প্রাচীন ভারতের নগর জীবন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন ভারতের নগর জীবন। পৌরাণিক বৈদিক বৌদ্ধ সাহিত্যে ও রামায়ণ , মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্য থেকে ভারতবর্ষে অবস্থিত জনপদ প্রভৃতির বিশাল তালিকা পাওয়া যায় । বিশেষত মানুষের আবাসভূমির নাম হল নগর ও জনপদ। প্রাচীনকালে কোন কোন গ্রাম আর নগর মিলে একটি জনপদ অর্থাৎ রাজ্যে পরিণত হত। সমস্ত জনপদের শাসনতন্ত্র করতো সেই সময়কার রাজারা। জনপদ গুলির পৃথক পৃথক রাজ্যের রাজা থাকতো তারা ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে এক রাজ্যের রাজা অন্য রাজ্যে আক্রমণ করে বিজয় লাভ করত এবং আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা প্রকাশ করত। ঠিক তেমনি কিছু প্রাচীন ভারতের নগর ও জনপদ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল।

প্রাচীন ভারতের নগর জীবন

 

 

প্রাচীন-ভারতের নগর জীবন

প্রায় অর্ধশতাব্দীরও কিছু পূর্বে ব্রিটিশভারতের (বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদাড়োতে এবং পাঞ্জাবে মন্টগোমারি জেলার হরপ্পাতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যে ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়, তাতে জানা যায় যে মিশর, ব্যবিলনিয়া প্রভৃতি সভ্যতার সমসাময়িক এক ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা পাঁচ হাজার বছরেরও পূর্বে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল।

এ ধ্বংসস্তূপের আবিষ্কার ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণা একেবারে পাল্টে দেয়। বৈদিক সভ্যতাকেই ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন সভ্যতা বলে যে ধারণা এতদিন চলে এসেছিল, নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে তা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছিল বলে এ সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়। মাটির অভ্যন্তরে ধ্বংসস্তূপের স্তরবিন্যাস লক্ষ্য করে যে কালপর্ব নির্ণয় করা হয়েছে তাতে অনুমান করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মধ্যে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ সভ্যতা ছিল মূলত নগরসভ্যতা।

 

 

কাঞ্চি:-

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর উত্তরে চেন্নাইয়ের খুবই কাছে অবস্থিত কাঞ্চি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত পতঞ্জলির ভাষ্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে কাঞ্চির নাম। পল্লবদের রাজধানী ছিল এই শহর যা বর্তমানে কাঞ্চীপুরম নামে পরিচিত তবে এই শহরটি আজও বর্তমান।

মিথিলা :-

এই শহর নেপালের সীমান্তে অবস্থিত যার উত্তরে মুজাফরপুর ও দ্বারভাঙ্গা জেলায় মিলিত হয়েছে। রামায়ণের উল্লেখ অনুসারে নিমি নামে এক রাজা মিথিলার রাজবংশ পত্তন করেন। মিথিলার সকল রাজাদের বংশ কে জনক বংশ বলা হত। রামায়ণে উল্লেখ আছে যে সীতা মিথিলার এই ভূমি থেকেই তার পিতা জনকের হাতে উঠে এসেছিলেন। তবে বর্তমানে মিথিলায় ললিত নারায়ন নামে একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্গীসমা মন্দির রয়েছে।

কাশী:-

পুরাণ অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ বছর পূর্বে সুহােত্রপুত্র কাশ্য উক্ত নগরের পত্তন করেন। কাশী রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল তিনশাে যােজন পর্যন্ত। এর রাজধানী ছিল বারাণসী (বেনারস)।বারাণসী বিশ্বের প্রাচীনতম নগর । কাশ্যের নামানুসারে কাশী নামকরণ হয়। পরবর্তীকালে কাশীরাজ বারণা বারাণসী’ নামে এক দেবীর প্রতিষ্ঠা করলে কাশী ও বারাণসী এক হয়ে যায়। প্রাচীন যুগে কাশী ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। বরুণা ও অসি নদীর সংগমে হিন্দুদের এই স্থান দুটি একত্রিত হয়ে বারাণসী নামকরণ হয়। কাশীতে বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণাদেবীর মন্দির রয়েছে। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত সংস্কৃত কলেজ এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় যা BHU নামে পরিচিত। দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বমহিমায় আজও বিরাজ করছে।

উজ্জয়িনী:-

এটি বর্তমানে মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতের মােড়শ মহাজনপদের মধ্যে অন্যতম অবম্ভীর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। মৌর্য শাসনের প্রাণকেন্দ্র ও বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। চম্বলের শাখা শিপ্রা নদীর তীরে মালভূমির উপত্যকায় উজ্জয়িনী অবস্থিত।‘মেঘদূত’ গীতিকাব্যে মহাকবি কালিদাস তাঁর এই নগরীর নাম উল্লেখ করেছেন।

রাজগৃহ:-

রাজগৃহ ষােড়শ মহাজনপদের অন্যতম প্রধান জনপদ । মহাভারতে দেখা যায় জরাসন্ধের রাজধানীর নাম ছিল গিরিব্রজ। পরবর্তীকালে মগধের রাজধানী রাজগৃহ, যা বর্তমানে নালন্দার নিকটবর্তী রাজগীর নামে পরিচিত (দক্ষিণ বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা)। মহাকাব্য, পুরাণ এবং বৌদ্ধ-সাহিত্যে এর উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয় হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন-এর বর্ণনাতেও এই নগরের রাজগীরের শান্তি শতরূপা মন্দির উল্লেখ রয়েছে।

কপিলাবস্তু :-

গৌতম বুদ্ধের নাম জড়িয়ে আছে কপিলাবস্তু এই স্থানটির সঙ্গে । গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি। এই স্থানটি কপিলাবস্তু থেকে ১৭ কিমি দূরে নেপালের তরাই অঞ্চলে অবস্থিত। স্থাপত্যের নিদর্শনরূপে অশােকের স্তম্ভলিপি রয়েছে এখানে। কপিলাবস্তু শাক্যদের রাজধানী ছিল। ভগবান বুদ্ধ এই শাক্যকুলে জন্মগ্রহণ করেন। পালি সাহিত্যে কপিলাবস্তু থেকে ভ্রমক্রমে নামটিকে কখনও কপিলাবস্তু বলা হয়েছে। এই নগর উত্তরপ্রদেশের বস্তী জেলার নিপ্ৰাহ্বা গ্রামে অবস্থিত । ফা-হিয়েন এই স্থান বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র বলে বর্ণনা করেছেন।

 

 

মথুরা:-

যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত যা ভারতের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। কংসের গৃহে শ্রীকৃয়ের জন্মভূমিতে শাক্য রাজাদের আমলে গড়ে ওঠে প্রথম শ্রীকৃষ্ণুমন্দির। দ্বিতীয়বার চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের দ্বারা নির্মিত ১০১৭ খ্রিস্টাব্দের মন্দির গজনীর মামুদ ধ্বংস করেন। তৃতীয় মন্দিরটি মহারাজ বিজয় পালের নির্মিত ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার লােদি ধ্বংস করেন। চতুর্থ মন্দিরটি রাজা রাজাবীর সিংহের গড়া, ঔরঙ্গজেব ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি ধ্বংস করেন এবং ওই স্থানে তিনি নির্মাণ করেন।

শ্রাবস্তী:-

শ্রাবন্তী একটি ঐতিহাসিক স্থান । শ্রাবস্তী কোশলের রাজধানী ছিল ।কোশল রাজ্যের উত্তরে নেপালের পার্বত্য অঞ্চল, উত্তরপ্রদেশের গােন্ডা ও বহরাইচ জেলার সংযােগস্থলে অবস্থিত শ্রাবস্তী। রামায়ণে উল্লিখিত রাজধানী অযােধ্যা, এটি ছিল ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত। এটি ছিল প্রাচীনযুগের বিশিষ্ট বাণিজ্যকেন্দ্র, সেজন্য বৌদ্ধ ও জৈনগণ এই নগরে প্রচারকেন্দ্র স্থাপন করেন। এই নগরের উপকণ্ঠে জেতবন বিহারে গৌতম বুদ্ধ দীর্ঘকাল অবস্থান করেছিলেন। মহাবীর ও এই শ্রাবন্তীতে এসেছিলেন।

বিদিশা :-

মধ্যপ্রদেশের বেত্রবতী ও বেশ নদীর সংগমস্থলে বিদিশা অবস্থিত। প্রাচীন বিদিশার নাম বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে ভিলসা’ হয়েছে। বিদিশা হল বেসনগরের পূর্বরূপ। পূর্বমালবের রাজধানী। মহাভারতের সময় এটি মহম্মদ গড় করদ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে অশােক ভিলসা ও সাঁচির স্তুপ পড়া করেন।

লঙ্কা:-

দক্ষিণ ভারতের সাগর পারে রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কাপুরী অবস্থিত ছিলরামায়ণে উল্লিখিত, যা লকা নামে পরিচিত এবং পরবর্তীকালে সিংহল নামে পরিচিত হয়। যার আধুনিক নাম শ্রীলঙ্কা। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বীপটি রাষ্ট্রপে পরিগণিত হয় ।

মালব :-

বিন্ধ্যাচলের উত্তরে রাজস্থানের দক্ষিণে মধ্যভারতের অন্তর্গত মালভূমির নাম হল মালব। মালব বা মল্ল নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের মক্কায় অবস্থিত বুদ্ধ মন্দির সময় বসবাস করত। এই জাতি পরবর্তীকালে মালব ও দক্ষিণ মালাবার মালয়ালমে গিয়ে বসবাস করত।

মগধ:-

প্রাচীন মগধদেশ আধুনিক বিহারের দক্ষিণাংশে পাটনা-গয়া অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হর্ষঙ্ক বংশীয় বিম্বিসার (আনুমানিক ৫৪৬-৪৯৪ খ্রিস্টপূর্ব) মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাজা বিম্বিসার গিরিব্রজের উপকণ্ঠে রাজগৃহ (রাজগীর) নগর স্থাপন করে সেখানে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মগধের নালন্দা ছিল জ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। কিন্তু কালক্রমে নালন্দা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

অযােধ্যা :-

মহাভারত অনুসারে এই থানটি ছিল পৌরাণিক রাজা ঋতুপর্ণের রাজধানী। অযােধ্যা এই নামটির মধ্যে বা স্থানটির মধ্যে ব্ৰত্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নির্দেশ করে বলেই স্থানটির মধ্যে পবিত্রতা অনুভূত হয়। এই পবিত্র স্থানটি সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত। এর প্রাচীন নাম ছিল সাকেত। রামায়ণের কালে এটি ছিল দশরথাদি রাজাদের রাজধানী। পাঞ্জাবের ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে মদ্রদেশ অযােধ্যার প্রসিদ্ধ মন্দির অবস্থিত।

গান্ধার:-

গান্ধার বর্তমান পাকিস্তানের পেশােয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি অঞলে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ অব্দে পারসিক সম্রাট দায়ুস দ্বারা পর্বতে খােদিত গিরিলেখতে গান্ধার নাম উল্লেখিত হয়েছে। মহাভারতের গান্ধারী গান্ধারের রাজকন্যা ছিলেন এবং শকুনী ছিলেন গান্ধারের রাজপুত্র। পেশােয়ারের নিকট পুষ্করাবতী এবং রাওয়ালপিণ্ডির নিকট তক্ষশিলা গান্ধারের দুটি রাজধানী ছিল। কিন্তু অশােকের সময় তক্ষশিলা অঞ্চলটি সম্ভবত গারের অন্তর্গত ছিল না। বৌদ্ধ যুগে গান্ধারে সর্বপ্রথম বুদ্ধের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। গান্ধার শিল্প, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে রােমান শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

 

আরও দেখুন :

ওশেনিয়ার ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ওশেনিয়ার ইতিহাস

ওশেনিয়ার ইতিহাস

 

 

ওশেনিয়ার ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপসমূহকে একত্রে নাম দেওয়া হয়েছে ওশেনিয়া (Oceania)। অবশ্য জাপান, ফিলিপাইন ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপসমূহকে এ হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়। আবার ওশেনিয়ার সাথে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপসমূহকে যোগ দিয়ে একত্রে অস্ট্রেলেশিয়া বলা হয়। ওশেনিয়া বলতে বোঝায় :

(১) অস্ট্রেলিয়া ও টাসমানিয়া

(2) মেলানেশিয়া দ্বীপসমূহ

(৩) মাইক্রোনেশিয়া দ্বীপসমূহ

(৪) পোলিনেশিয়া দ্বীপসমূহ।

মেলানেশিয়া নামের অর্থ কৃষ্ণ দ্বীপ দ্বীপের অধিবাসীদের কালো রঙের জন্যই এ নামকরণ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে অবস্থিত নিউগিনি থেকে শুরু করে পূর্ব দিকে ফিজি দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বীপগুলি মেলানেশিয়া নামে পরিচিত। মেলানেশিয়ার অন্তর্গত অন্যান্য দ্বীপ হল ঃ বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জ, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, নিউ হেব্রাইডিস দ্বীপপুঞ্জ, লয়ালটি দ্বীপপুঞ্জ ও নিউ ক্যালেডোনিয়া দ্বীপপুঞ্জ। মেলানেশিয়ার উত্তরাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে মাইক্রোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ।

মাইক্রোনেশিয়া নামের অর্থ ছোট ছোট দ্বীপ; দ্বীপগুলির ক্ষুদ্র আকৃতির জন্য এ নাম দেয়া হয়েছে। মাইক্রোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মারিয়ানাস্, ক্যারোলিনস্, মার্শাল ও গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জ। পোলিনেশিয়ার দ্বীপসমূহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। পোলিনেশিয়া নামের অর্থ হল ‘অনেক দ্বীপ’। ১৭ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমা থেকে ১১ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার মধ্যে এ দ্বীপগুলি ছড়িয়ে রয়েছে।

উত্তরে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড ও পূর্বে ইস্টার দ্বীপ— এ তিনটিকে যোগ করলে যে ত্রিভুজের উৎপত্তি হবে, তার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিকেই পোলিনেশিয়া দ্বীপাবলী বলা হয় হাওয়াইয়ের অবস্থান হল ১৫৫ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমা ও ২০ ডিগ্রী উত্তর অক্ষরেখার ছেদ বিন্দুতে এবং ইস্টার দ্বীপের অবস্থান হল চিলির পশ্চিমে ১১৯ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার উপর)।

পোলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপ হল ৪ টোঙ্গা, সামোয়া ও ফিনিক্স দ্বীপপুঞ্জ (নিউজিল্যাণ্ড-এর মোটামুটি উত্তরে অবস্থিত) এবং সোসাইটি ও মারকুইসাস দ্বীপপুঞ্জ (নিউজিল্যাণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে, মাঝ প্রশান্ত মহাসাগরে)। সুপরিচিত দ্বীপ তাহিতি সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস আলোচনাকালে আমরা উল্লেখ করেছি যে, সেখানে ১৫-২০ হাজার বছর আগে শিকারি মানুষরা গমন করেছিল।

ওশেনিয়ার দ্বীপসমূহে মানুষ গিয়ে বাস স্থাপন করেছিল আরও পরে, নবোপলীয় যুগে। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া ওশেনিয়ার সব দ্বীপেই নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এসব সমাজে এশিয়া-ইউরোপের সভ্য সমাজের উচ্চতর সংস্কৃতি গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয়রা এ সকল দ্বীপে গিয়ে পৌঁছায় তখনও ঐ সব দ্বীপবাসীরা নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতিতেই আবদ্ধ ছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তবে ওশেনিয়ার দ্বীপবাসীরা স্থানীয় অবস্থা অনুযায়ী নতুন কলাকৌশল আয়ত্ত করেছিল। তারা মাছ শিকারের উন্নত কৌশল আয়ত্ত করেছিল এবং ছোট ছোট নৌকায় চড়ে সমুদ্রে বিচরণ করতে শিখেছিল। পোলিনেশীয়রা সমুদ্রের ঢেউ পর্যবেক্ষণ করে তার ভিত্তিতে সমুদ্রের মানচিত্র তৈরি করেছিল। লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি কাঠি সাজিয়ে তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা ঐ মানচিত্র তৈরি করত। এ মানচিত্র নিয়ে দিকচিহ্নহীন বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে তারা অনায়াসে চলাফেরা করত।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পোলিনেশিয়ার মোট লোকসংখ্যা ছিল দশ লক্ষ। কিন্তু ইউরোপীয়দের থেকে সংক্রামিত রোগে এবং তাদের অত্যাচারের ফলে ১৯০০ শতকের মধ্যেই পোলিনেশিয়ার অধিবাসীদের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ লোপ পেয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইস্টার দ্বীপ ও আরও কয়েকটি দ্বীপের সংস্কৃতি ছিল ওশেনিয়ার অন্যান্য দ্বীপের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। বস্তুত, ইস্টার দ্বীপের সংস্কৃতির রহস্য পণ্ডিতদের খুবই আশ্চর্য করেছে।

ইস্টার দ্বীপটি কোথাও ১৫ মাইলের বেশি চওড়া নয় এবং এর আয়তন মাত্র ৪৬ বর্গমাইল। ১৭৭২ সালের ইস্টার সানডেতে (রবিবারে) যখন ওলন্দাজরা এ দ্বীপটিকে আবিষ্কার করে তখন এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। দ্বীপের অধিবাসীরা নবোপলীয় কৃষি সংস্কৃতিবই মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এ দ্বীপে বহুসংখ্যক বিশাল পাথরের মূর্তি এবং নানাপ্রকার চিহ্ন খোদাই করা কাঠের ফলক পাওয়া গেছে।

বিশাল পাথরের বেদীর উপর স্থাপিত এ সকল মূর্তি ছিল ১২ থেকে ১৫ ফুট উঁচু এবং কোনো কোনো মূর্তির ওজন ছিল ৫০ টন (প্রায় ১৩৫০ মণ। এসব মূর্তি কারা তৈরি করল, কেমন করে বহন করে আনল তা এক রহস্য। মূর্তি ছাড়াও ইস্টার দ্বীপে পাথরের বাড়ি, পাথরের বেদী, আধা পিরামিডজাতীয় স্থাপত্য ইত্যাদি দেখা গেছে। স্থানীয় আদিবাসীরা বলেছিল যে, মূর্তিগুলিকে পাথরের নুড়ির উপর স্থাপন করে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হত এবং গাছের ছাল দিয়ে তৈরি দড়ির সাহায্যে টেনে দাঁড় করানো হত।

স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুসারে, অন্যত্র থেকে তাদের পূর্বপুরুষ এসে এ দ্বীপে বাস স্থাপন করেছিল। দ্বীপটি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত চিলি দেশটি থেকে ২ হাজার মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। আমেরিকা মহাদেশের ইন্‌কা বা আজটেক সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত কোনো মানুষের দল ইস্টার দ্বীপে এসে বাস স্থাপন করেছিল কি না এবং তারাই ঐ পাথরের মূর্তির সৃজক কি না সে বিষয়ে পণ্ডিতরা একমত হতে পারেননি।

ইস্টার দ্বীপের আদি অধিবাসীরা আজ বিলুপ্তির পথে। ইউরোপীয়রা সেখানে যাওয়ার একশ বছরের মধ্যে ঐ দ্বীপের আদিবাসীদের সংখ্যা ৪ হাজার থেকে কমে ১৭৫-এ এসে দাঁড়ায়। ১৮৮৮ সালে চিলি এ দ্বীপটিকে দখল করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের এক প্রান্তে হটিয়ে দিয়ে বাকি অংশকে ভেড়ার চারণভূমিতে পরিণত করে। ১৯৫২ সালে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০ জন।

 

 

অস্ট্রেলেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়াকে বাদ দিলে বাকি থাকে তার এশীয় দ্বীপসমূহ; যথা, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ফিলিপাইন। এ সকল অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস অস্ট্রেলিয়া বা ওশেনিয়ার মতো অপরিবর্তিত থাকেনি। সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও প্রভৃতি দ্বীপে খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে প্রাচীন ভারতীয় উপনিবেশ ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিলিপাইনেও প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আরও দেখুন :

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

 

 

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

১৬০০ খ্রিস্টাব্দের সমকাল থেকেই ইউরোপীয় নাবিক-পর্যটকরা অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। ১৬২৪ সালে ওলন্দাজ (হল্যাণ্ডের) নাবিক আবেল টাসম্যান অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপটিকে আবিষ্কার করেন; তাঁর নামানুসারে দ্বীপটির নাম দেয়া হয়েছে টাসমানিয়া। কিন্তু ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুকু অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে পদার্পণ করার পর থেকেই ইউরোপীয়রা ক্রমশ অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে শুরু করে।

অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি ইন্দোনেশীয় দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিশাল দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মহাদেশ, আকারে ইউরোপের পৌনে একভাগ। এর আয়তন প্রায় ৩০ লক্ষ বর্গমাইল; পূর্ব-পশ্চিমে তার বিস্তৃতি মোটামুটি ২৪০০ মাইল ও উত্তর দক্ষিণে ২০০০ মাইল। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পুরোপুরি দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত এবং মোটামুটি ১০ থেকে ৪০ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত।

অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগ প্রায় সবটাই মরুভূমি। আর বাকি অংশের মধ্যেও তৃণভূমিই প্রধান-বৃষ্টিপাত কম বলে সেসব অঞ্চলে ঘাস ছাড়া কিছু জন্মায় না। উত্তর এবং উত্তর— পূর্বের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরক্ষীয় বৃষ্টিপাতের দরুন বনভূমি আছে। অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরাও প্রধানত উত্তর ও পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলেই বেশি সংখ্যায় বাস করত। শুষ্ক ও মরু অঞ্চলে আদিবাসীরা ছিল নগণ্য পরিমাণে। ইউরোপীয়রা যখন প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে শুরু করে তখন ১৭৮৮ সালে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ।

ইউরোপীয়দের উৎপীড়নে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ১৯৪৭ সালে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৭ হাজার। অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা বর্তমানে পশ্চিম ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অনুর্বর অঞ্চলে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করছে। পণ্ডিতরা জানতে পেরেছেন যে একদা অস্ট্রেলিয়া পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ অর্থাৎ সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি দ্বীপের মাধ্যমে এশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। বহু কোটি বছর আগে এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এ কারণে অস্ট্রেলিয়াতে অনেক পুরান জাতের প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায় যা এশিয়া-ইউরোপে অনেক আগে লুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে টিকে আছে। আবার অস্ট্রেলিয়াতে প্লাটিপাস নামে এক ধরনের অগুজ স্তন্যপায়ী আছে যারা ডিম পাড়ে কিন্তু বাচ্চাকে স্তন্য পান করায়। সেখানে ক্যাঙারু নামে আরেক ধরনের আধা স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে যারা ভ্রূণ অর্থাৎ অর্ধ পরিণত বাচ্চার জন্ম দেয়; এ বাচ্চারা মায়ের উদরসংলগ্ন একটি থলিতে আশ্রয় নেয় এবং মায়ের স্তন্য পান করে বড় হয়।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে ইউরোপীয়রা গিয়ে মানুষ এবং কুকুর ছাড়া কোনো প্রকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাক্ষাৎ পায়নি। গরু, ঘোড়া, শূকর, বিড়াল, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি আমাদের অতি পরিচিত স্তন্যপায়ী প্রাণী অস্ট্রেলিয়াতে আগে ছিল না, ইউরোপয়ীরা এ সকল প্রাণী সেখানে নিয়ে গেছে। এর অর্থ হল এশিয়া বা আফ্রিকায় স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটার আগেই অস্ট্রেলিয়া অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

তাই সেখানে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী যেতে পারেনি। ১৫-২০ হাজার বছর আগে এশিয়া থেকে শিকারি যুগের আদিম মানুষ নৌকায় চড়ে সাথে করে পোষা কুকুর নিয়ে গিয়েছিল বলেই অস্ট্রেলিয়াতে মানুষ ও কুকুর পৌঁছেছিল। প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, প্রায় সাত কোটি বছর আগে পৃথিবীতে সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যবর্তী পর্যায়ের প্রাণী হল প্লাটিপাস, ক্যাঙারু প্রভৃতি আধা-স্তন্যপায়ী প্রাণী।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অস্ট্রেলিয়া এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ফলেই মাত্র সেখানে ক্যাঙারু প্রভৃতি প্রাণী টিকে আছে, অবশিষ্ট পৃথিবীতে আধা-স্তন্যপায়ীরা লোপ পেয়েছে। X (অনুরূপ কারণে অবশ্য আমেরিকা মহাদেশেও অন্য কয়েক ধরনের আধা-স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে।) এ বিচার থেকে সহজেই বোঝা যাবে যে, অন্তত সাত কোটি বছর আগেই অস্ট্রেলিয়া এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

ফলে এশিয়া থেকে ১৫-২০ হাজার বছর আগে যখন শিকারি যুগের মানুষ ডোঙ্গা, ভেলা প্রভৃতি আদিম জলযানের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে পৌঁছায় তখন তারা অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এশিয়া আফ্রিকা-ইউরোপের মানুষ এর পর যে সকল সভ্যতা-সংস্কৃতি অর্জন করেছে তার কোনো সংবাদ অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে পৌঁছায়নি। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সময় ঐ আদি অস্ট্রেলীয়রা বৃহত্তর মানবসমাজের কাছ থেকে যেটুকু সংস্কৃতি নিয়ে যেতে পেরেছিল তাই ছিল তাদের প্রাথমিক সম্বল।

ঐ আদি সংস্কৃতি ছিল শিকারি যুগের সংস্কৃতি বা পুরাতন পাথরের যুগের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির বিবরণ আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে প্রদান করেছি। বস্তুত, অস্ট্রেলিয়ার শিকারি সমাজের আচরণ থেকেই আমরা আদিম সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা শিকারি যুগের সংস্কৃতি নিয়ে সেখানে গিয়েছিল এবং শিকারি যুগেই তারা আটকে ছিল। এমনকি কৃষিকাজ পর্যন্ত তারা আবিষ্কার করতে পারেনি।

এ জন্য অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মগজে বা বুদ্ধিতে তারা আমাদের মতোই আধুনিক মানুষ, কিন্তু এ ধরনের যুগান্তকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক আবিষ্কার কোনো একটা বিচ্ছিন্ন জাতি করতে পারে না। সমগ্রভাবে মানবসমাজই মাত্র এ রকম আবিষ্কার সাধনে সক্ষম। বৃহত্তর মানবসমাজের ব্যাপক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পশ্চিম এশিয়ার কোনো এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলেই সেখানে কৃষি, পশুপালন ও অন্যান্য নবোপলীয় আবিষ্কার সাধন সম্ভব হয়েছিল।

পশ্চিম এশিয়ার মানুষ বিশেষ বুদ্ধিমান ছিল বলেই ঐ সব আবিষ্কার করতে পেরেছে একথা ভাবা ঠিক নয়। আসলে ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের দরুন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেছিল। এ সকল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা যেখানে কেন্দ্রীভূত হয়।

সেখানে যদি অনুকূল সামাজিক পরিস্থিতি থাকে তবেই সেখানে নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, সমাজ সংগঠন ইত্যাদির আবিষ্কার হতে পারে। নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন সংস্কৃতি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হওয়ার পর তা অন্যত্র সহজেই বিস্তার লাভ করতে পারে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতির পক্ষে পৃথক পৃথকভাবে নতুন করে ঐ সব আবিষ্কার সাধন সম্ভব নয়। কারণ ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন জাতির অভিজ্ঞতার পরিসর বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে খুব কম।

এ কারণেই পশ্চিম এশিয়া থেকে নবোপলীয় কৃষি সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল তখন তা এমনকি এশিয়া থেকে চার হাজার মাইল দূরে হাওয়াই দ্বীপে পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূলের নিকটবর্তী নিউগিনি রূপে পর্যন্ত নবোপলীয় কৃষি সংস্কৃতি পৌঁছেছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তার আগেই এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছিল বলে সেখানে নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতির উদ্ভব হয়নি।

এ কারণেই নিউগিনির মানুষ মাটির পাত্রের ব্যবহার জানে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা জানে না। কারণ মাটির পাত্র নির্মাণের কৌশল মানুষ আবিষ্কার করেছিল নবোপলীয় যুগে অর্থাৎ আজ থেকে আট-দশ হাজার বছর আগে, আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সেখানে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ১৫-২০ হাজার বছর আগে। মাটির পাত্র এবং কুমোরের চাক আমাদের কাছে যত সাধারণ বা তুচ্ছই মনে হোক না কেন, অনুকূল পরিবেশে মানবসমাজ একবারই তার আবিষ্কার করতে পেরেছিল।

তারপর থেকে অনুকরণের মাধ্যমে এর নির্মাণকৌশল সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। কোনো বিচ্ছিন্ন মানবগোষ্ঠীর পক্ষে দ্বিতীয় বার স্বতন্ত্রভাবে মাটির পাত্র নির্মাণ বা কুমোরের চাক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, বা তা সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের দৃষ্টান্ত নিয়ে এ কথাটা অনুধাবন করতে পারলে আমরা মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে একটা সত্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হব।

এ সত্য হল, কোনো জাতি বা গোষ্ঠী যদি বৃহত্তর মানবসামজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনুন্নত সংস্কৃতির স্তরে আটকে থাকে তবে উচ্চতর সমাজের সংস্পর্শ বা সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বা নিজ প্রচেষ্টায় উচ্চতর পর্যায়ের সমাজে উত্তরণ সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা বহু হাজার বছর ধরে শিকারি সমাজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল, এ গণ্ডি ছাড়িয়ে উচ্চতর অর্থাৎ কৃষি বা পশুপালক সমাজের পথে অগ্রসর হওয়ার কোনো প্রবণতা বা লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।

 

 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা বা ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলতার বাধার দরুনও অনেক জাতি পারিপার্শ্বিক জগৎ বা বৃহত্তর মানব জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। যেমন, আমাদের দেশের অনেক উপজাতি উন্নততর সভ্যজাতির ভৌগোলিক সংস্পর্শে থাকলেও, সামাজিক রীতিনীতির রক্ষণশীলতার প্রাচীর দ্বারা বিচ্ছিন্ন বলে উন্নত জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

আরও দেখুন :

জাপানের ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জাপানের ইতিহাস

জাপানের ইতিহাস

 

 

জাপানের ইতিহাস

দূর প্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে জাপানেই প্রাচীন সভ্যতা সবচেয়ে দেরিতে বিকাশ লাভ করে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। জাপান দ্বীপপুঞ্জ এশিয়ার পূর্ব উপকূলের পার্শ্ববর্তী হলেও, মূল ভূ-খণ্ডের একেবারে নিকটবর্তী নয়। কোরিয়া উপদ্বীপের কাছেই জাপান এশিয়ার উপকূল থেকে সবচেয়ে কম দূরবর্তী এবং এ দূরত্ব ১০০ মাইলেরও বেশি।

সমুদ্রগামী জাহাজের প্রচলন হওয়ার আগে জাপানের সাথে চীন বা এশিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেনি। এর ফলে দীর্ঘকাল পর্যন্ত জাপানের অধিবাসীরা চীনের সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। জাপান দ্বীপপুঞ্জ তিন হাজারেরও বেশি পর্বতসঙ্গল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে মাত্র চারটি দ্বীপ বড় আকারের এবং মোট ৬০০টি দ্বীপে লোকবসতি আছে। মূল দ্বীপের নাম হনশু, এ দ্বীপেই বর্তমান রাজধানী টোকিও এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক রাজধানী কিয়োতো অবস্থিত।

হনশুর উত্তরে হোক্কাইডো দ্বীপ এবং দক্ষিণে শিকোকু ও কিউশিউ দ্বীপ। কিউশিউ হচ্ছে কোরিয়া উপদ্বীপের ঠিক মুখোমুখি। জাপানের স্থলভাগের মোট আয়তন ১ লক্ষ ৪২ হাজার বর্গমাইল। অবশ্য এর শতকরা ৮০ ভাগ জমিই পার্বত্য ও বসবাসের অযোগ্য। জাপানের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। জাপান নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত, তবে উত্তর-দক্ষিণে এর বিস্তৃতি প্রায় ১৫ ডিগ্রী অক্ষাংশ বলে তার বিভিন্ন অংশে আবহাওয়ার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

জাপানে শীতকালে শীত তীব্র এবং গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত প্রচুর। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এশিয়া ভূখণ্ড ও বোর্ণিও, জাভা এবং ফিলিপাইন থেকে মানুষ এসে জাপানে বাস স্থাপন করে। পণ্ডিতদের মতে, চু-যুগে (১০২৭-২৪৯ খৃঃ পূঃ) কয়েক দফায় কোরিয়া ও অন্যান্য স্থান দিয়ে চীন থেকে মানুষের দল জাপানে যায়। বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডোতে যেসব আদিবাসী আছে তাদের কাছে পাওয়া নানা শিল্প নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, অন্তত ছয় হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ জাপানে এসেছিল।

জাপানে পুরান পাথরের যুগের শিকারি মানুষরা পদার্পণ করেছিল বলে জানা যায়নি। জাপানে প্রাপ্ত বাড়িঘর, মাটির পাত্র প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে, পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে নতুন পাথরের যুগের কৃষি সংস্কৃতির মানুষ জাপানে বাস স্থাপন করেছিল। কৃষিই ছিল আদিমতম জাপানিদের অর্থনীতির ভিত্তি। ক্রমশ অতি প্রাচীনকালেই জাপানে টাইব সমাজ অনেকগুলো ছোট ছোট ট্রাইবভিত্তিক রাজ্যের জন্ম দেয়।

বংশানুক্রমিক গোষ্ঠীপতিরা ছিল এসব রাজ্যের শাসক। শাসকগোষ্ঠী এবং অভিজাতরা জমির মালিকানা নিজেদের হাতে জড়ো করেছিল। তাদের নিচে ছিল কৃষক ও কারিগরদের অবস্থান এবং সকলের নিচে ছিল ভূমিদাসদের স্থান। মনে থাকতে পারে যে, আদি নবোপলীয় সংস্কৃতিতে সমাজের শ্রেণীবিভাগ ছিল না। কিন্তু জাপানে চীন থেকে চু-যুগে বা তার কাছাকাছি সময়ে যে নতুন মানুষরা এসেছিল তারাই সম্ভব সাথে করে ব্রোঞ্জযুগের শ্রেণী বিভাগের ধারণা ও কলাকৌশল জাপানে নিয়ে এসেছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই মধ্য জাপানের ইয়ামাতো গোষ্ঠী হনশু দ্বীপের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে এবং গোষ্ঠীর শাসক নিজেকে সম্রাটরূপে ঘোষণা করেন। অবশ্য খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে এসেই প্রকৃতপক্ষে এ গোষ্ঠীর শাসক সর্বোচ্চ সম্রাটরূপে পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করেন। চীনের ইতিহাসের চিন ও হান যুগে কোরিয়ার মাধ্যমে চীনের ব্রোঞ্জযুগের সংস্কৃতি জাপানে এসে পৌঁছায়। হান যুগে (খ্রিঃ পূঃ ২০৬-২২০ খ্রি) কোরিয়ার অংশবিশেষের উপর চীনের আধিপত্য বিস্তৃত হয়।

এরপর কোরিয়া থেকে চীনের সংস্কৃতির নানা উপাদান এসে জাপানে পৌঁছাতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চীন থেকে লোহার কারিগরি জাপানে এসে পৌঁছায়। একই সময়ে দলে দলে চৈনিক ও কোরীয় কারিগর, তাঁতি, কুমোর, পটুয়া, অভিজ্ঞ কৃষক ও রেশম চাষী জাপানে আগমন করে। এ ছাড়া চীনের চিকিৎসাবিদ্যা, ঔষধবিদ্যা, সামরিক বিজ্ঞান প্রভৃতিও জাপানে এসে পৌঁছায়।

জাপান ১০০ থেকে ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোরিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে একটা অঞ্চল অধিকার করে ছিল এবং কোরিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপও করেছিল। এ সময়েই পঞ্চম শতাব্দীতে চীনের লেখনপদ্ধতি ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম কোরিয়ার মাধ্যমে জাপানে এসে পৌঁছায়। এ সময়ে দলে দলে চীনা বিদ্বান জাপানে এসে চীনা ভাষা ও লেখন পদ্ধতি এবং চীন সাহিত্যের সেরা সৃষ্টি— তার কবিতা, দর্শন, ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার প্রচলন করেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লেখনপদ্ধতি আয়ত্ত করার ফলে জাপানের সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হল যে চীনের কাছ থেকে লেখনপদ্ধতি অর্জন করার ফলে পরবর্তীকালে তার সভ্যতার বিকাশ অনেকাংশে ব্যাহতও হয়েছে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, চীনের লেখন পদ্ধতি হচ্ছে মূলত চিত্রলিপিভিত্তিক বা ভাবব্যঞ্জক। জাপান লেখন পদ্ধতি আয়ত্ত করার অন্তত এক হাজার বছর আগে পশ্চিম এশিয়ায় ও গ্রীসে বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল।

জাপান যদি অন্য সূত্রে বর্ণমালা অর্জন করতে পারত তবে তার পক্ষে লেখা এবং পড়ার কাজটা অনেক সহজ হত। বিশেষত জাপানী ভাষা ধ্বনিগতভাবে চীনা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে চীনা ভাবব্যঞ্জক অক্ষর দিয়ে জাপানি ভাষা লেখা খুব কঠিন ছিল। জাপান অবশ্য চীনা লেখনপদ্ধতিকে বহুলাংশে সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত করে নিজেদের ভাষার উপযোগী করে নিয়েছে। তথাপি, জাপানী ভাষায় লিখতে শেখা।

এখন পর্যন্ত খুব দুঃসাধ্য রয়ে গেছে। অবশ্য, প্রাচীন ভারত থেকে যে বৌদ্ধ সন্নাসীরা জাপানে গিয়েছিলেন তাঁরা গোপনে একটা বর্ণমালাভিত্তিক লেখন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। আমরা দেখতে পেলাম, জাপানের প্রাচীন সভ্যতার আদি উৎস প্রত্যক্ষভাবে চীন। কিন্তু উল্লেখ করা দরকার যে, জাপান এক আশ্চর্য গুণে তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সব বৈদেশিক উপাদানকেই পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে।

 

 

জাপান চীনা লেখনপদ্ধতিকে, বৌদ্ধ ধর্মকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে। এমনকি চীনের শিল্প, সাহিত্য, কাব্য, স্থাপত্য, নাট্য ও দৃশ্যকাব্য প্রভৃতিকে নিজেদের প্রয়োজন ও ঐতিহ্য অনুসারে রূপান্তরিত করে গ্রহণ করেছে।

জাপান তার সভ্যতার আদি ও মূল উপকরণ চীন-কোরিয়া থেকে সংগ্রহ করলেও, নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রমের গুণে জাপানিরা তার বিকাশ সাধন করে আধুনিক জগতে নিজেদের জন্য একটা অনন্য স্থান করে নিতে পেরেছে। জাপানের পরবর্তী ইতিহাস মধ্যযুগের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আরও দেখুন :

কোরিয়ার ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কোরিয়ার ইতিহাস। প্রাচীন প্রস্তরযুগীয় কোরীয় উপদ্বীপ মঞ্চুরিয়ার সূচনা আজ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি বছর আগে। প্রাচীন কোরিয়ান মৃৎশিল্পের সূচনাকাল ছিল ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এবং নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে এবং এরপর পর্যায়ক্রমর ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জ যুগ এবং প্রায় ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লোহার যুগের সূচনা হয়। পৌরাণিক হিসাব অনুসারে, সামগুক যুগে বর্ণিত গোজেসেওন (ওল্ড জোসেওন) রাজ্য ২৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ মঞ্চুরিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

কোরিয়ার ইতিহাস

 

 

গিজা জোসেওনের রাজ্যটি খ্রিষ্টপূর্ব ১২ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আধুনিক যুগে এবং পুরাণকথায়ও এর অস্তিত্ব এবং ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গোজোসনের প্রথম লিখিত ঐতিহাসিক রেকর্ডটি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর। ‘জিন’ রাজ্যটি দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গঠিত হয়। দ্বিতীয় শতাব্দীতে, গিজা জোসনকে উইমান জোসেন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়, যা শতাব্দীর শেষের দিকে চীনের হান রাজবংশ দ্বারা পতিত হয়। যার ফলস্বরূপ গোজেসেওন রাজ্যেরও পতন ঘটে এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের সূচনা হয়, যা প্রাচীন তিন-রাজ্যের সময়কাল থেকে লোহার যুগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

৬৭৬ সালে একক সিলা না হওয়া পর্যন্ত, প্রথম শতাব্দী থেকে, কোরিয়ার তিন রাজ্য (৫৭ খ্রিস্টপূর্ব-৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) হিসেবে পরিচিত গোগুরিও, বেকজি এবং সিলা উপদ্বীপ এবং ম্যানচুরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। ৬৯৮ সালে, বেলহের রাজা গো তৎকালীন গোরিও রাজ্যের অঞ্চলগুলোতে বেলহে রাজ্য (আধুনিক বোহাই সাগর) প্রতিষ্ঠা করে, যা বেলহে এবং সিলার সাথে, উত্তর-দক্ষিণ রাজত্বকাল (৬৯৮-৯২৬) পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

ওয়াং জিওনের গরিয় বংশের একত্রিকরণের শেষের সাথে সাথে নবম শতাব্দীর শেষের দিকে, সিলাকে পরবর্তী তিন রাজ্যের (৮৯২-৯৩৬) মধ্যে বিভক্ত করা হয়। এদিকে, খাইতিলিয়ো রাজবংশের আক্রমণের পরে বেলহের পতন ঘটে এবং বেলহের রাজকুমার গরিয়োর কাছে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন এবং সেখানে রাজকুমারকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয় এবং ওয়াং জিওনের শাসক পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এইভাবে গোগুরিয়োর দুটি উত্তরাধিকারী রাজ্যকে একত্রিত করে। গরিয়োর সময়কালে আইন প্রণনয়ন করা হয়, একটি সিভিল সার্ভিসেস সিস্টেম চালু করা হয়, এবং বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা হয়। যাইহোক, ১৩ শতকের দিকে মঙ্গোল রাজবংশের বিভিন্ন প্রচারণাও ১৪ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গরিয়োর প্রভাব বিস্তার করে।

১৩৯২ সালে জেনারেল ই সিং-গেই একটি অভ্যুত্থানের পর জোসেয়ান রাজবংশ (১৩৯২-১৯১০) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ১৩৮৮ সালে গরিয় রাজবংশকে উৎখাত করেছিল। রাজা সেজং দ্য গ্রেট (১৪১৮-১৪৫০) রাজবংশীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করেন এবং বহু প্রশাসনিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারকার্য পরিচালনা করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ‘হ্যাঙ্গুল’,কোরিয়ান বর্ণমালা তৈরি করে।

প্রায় দুই শতাব্দী ধরে শান্তির সময় উপভোগ করার পর, জোসেয়ান রাজবংশকে ১৫৯২ থেকে ১৬৩৭ সাল পর্যন্ত বিদেশি আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়। এই আক্রমণগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল কোরিয়ায় জাপানি আক্রমণ, যা জোসেনের রাজবংশের প্রথম যুগের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চীনের মিং রাজবংশের যৌথ বাহিনী এবং জোসেও রাজবংশের এই জাপানি আক্রমণগুলি এড়ানোর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়। পরবর্তীতে, জোসন ধীরে ধীরে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন এবং বদ্ধ হয়ে পড়ে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আধুনিকীকরণের জন্য এবং ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসনের আওতায় জোসেওন কোরিয়াকে বিদেশী শক্তির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ১৮৯৫ সালে সম্রাট মায়ংসংশংকে হত্যার পর, দংহাক কৃষক বিপ্লব, এবং ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৫ সালের গাবো সংস্কারসমূহ, কোরিয়ান সাম্রাজ্য (১৮৯৭-১৯১০) এর উত্থান ঘটায় এবং সামাজিক সংশোধন ও আধুনিকীকরণের সংক্ষিপ্ত কিন্তু দ্রুত সময়ের সূচনা করে। যাইহোক, ১৯০৫ সালে, কোরিয়ার সাম্রাজ্য একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়ান সাম্রাজ্যকে সংযুক্ত করে।

১৯১২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে কোরিয়া প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর নির্বাসনে থাকা কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার দ্বারা সংহত প্রতিরোধ আন্দোলন ও কোরিয়ার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেশী ম্যানচুরিয়া, চীন এবং সাইবেরিয়ার বিভিন্ন সংস্থা ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কোরিয়ায় এই সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, জোটের দেশগুলি উত্তর অঞ্চলে (সোভিয়েত দ্বারা সুরক্ষিত) এবং একটি দক্ষিণ অঞ্চল (প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত) বিভক্ত হয়। ১৯৪৮ সালে ক্ষমতাসীনরা একক সরকার গঠনের ব্যাপারে একমত হতে ব্যর্থ হলে এই অংশটি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার আধুনিক রাষ্ট্রগুলি তে পরিণত হয়। “কোরিয়া প্রজাতন্ত্র” দক্ষিণ ও দক্ষিণ ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলীয় পশ্চিমাঞ্চলে এবং উত্তরে “গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া” সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সমর্থন সহ উপদ্বীপটি দুইটি ভাগে বিভক্ত হয় ৩৮ তম সমান্তরাল বা ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা সীমানারেখায়। উত্তর কোরিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী কিম -উল- সুং কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে দেশটিকে পুনর্মিলিত করার প্রচেষ্টায় ১৯৫০ সালে কোরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেন। প্রচুর পরিমাণে ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৯৫৩ সালে সংঘর্ষের অবসান ঘটে। ২০১৮ সালের মধ্যে উভয় দেশ কোরিয়ার যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করার জন্য চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে কাজ করার জন্য সম্মত হয়। ১৯৯১ সালে উভয় রাজ্য জাতিসংঘে গৃহীত হয়।

যুদ্ধের পর উভয় দেশ মূলত সামরিক শাসনের অধীনে ছিল, তবুও দক্ষিণ কোরিয়া অবশেষে স্বাধীন হয়ে উঠে। ১৯৮৭ সাল থেকে এখানে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে। দক্ষিণ কোরিয়ান অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে এবং দেশটিকে পশ্চিমা ইউরোপ, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ রাজধানী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে সম্পূর্ণভাবে উন্নত করা হয়েছে মনে করা হয়।

উত্তর কোরিয়া কিম পরিবারের চারপাশের ব্যক্তিত্বদের সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে সার্বভৌমত্বপূর্ণ সামরিক শাসন বজায় রেখেছে। অর্থনৈতিকভাবে, উত্তর কোরিয়া বিদেশী সাহায্য উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল রয়ে গেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ হওয়ার পর, সেই সাহায্যটি হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ সীমিত হয়ে পড়ে।

 

পুরাতন প্রস্তরযুগ:

কোরিয়ান উপদ্বীপে “হোমো ইরেক্টাস” হতে পাওয়া কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি, যদিও একটি নমুনা রিপোর্ট করা হয়েছে। প্যালিওলিথিক যুগের টুল-রাইটিং নিদর্শন বর্তমানে উত্তর হ্যামিওং, দক্ষিণ পিয়ংগান, গিয়োংগি এবং কোরিয়া উত্তর ও দক্ষিণ চুংচোং প্রদেশে পাওয়া গেছে,যা প্যালিওলথিক যুগের অর্ধ মিলিয়ন বছর আগে এসেছে, যদিও এটি প্রায় ৪০০,০০০ বছর আগে বা ৬০০,০০০-৭০০,০০০ বছর আগে শুরু হতে পারে।

নব্যপ্রস্তুরযুগ:

প্রায় ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাচীনতম পরিচিত কোরিয়ান মৃৎশিল্পটি মেসোলিথিক পিট-কম ওয়েয়ার সংস্কৃতির প্রমাণ (অথবা ইউংগিমুন পোটারি) যা জেজু আইল্যান্ডের উপদ্বীপ জুড়ে পাওয়া যায়। জিউলমুন মৃৎশিল্প, বা “চিরুনি-প্যাটার্ন মৃৎশিল্প”, ৭০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পর পাওয়া যায় এবং কোরিয়ার উপদ্বীপের পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এটি ঘনীভূত হয়, যেখানে আমা-দং নামে বহু প্রাগৈতিহাসিক বসতি বিদ্যমান ছিল। জিউলমুন পাত্রী মৌলিক নকশা এবং মঙ্গোলিয়া, সমৃদ্ধ নদী মঞ্চুরিয়া, জাপানের জ্যামনক্লুচার এবং দক্ষিণ চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইয়ুতে অনুরূপ রূপ ধারণ করে।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি প্রমাণ করে যে মুমুন যুগে মৃৎশিল্পের সময় কৃষি সমাজগুলি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতার প্রাথমিকতম রূপ আবির্ভূত হয়েছির(১৫০০-৩০০ খ্রি .পূ)

দক্ষিণ কোরিয়াতে আদি মুমুন যুগের মানুষজন (১৫০০-৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) প্রচুর পরিমাণে ফসল দিয়ে শুষ্ক-ক্ষেত্র ও ধান ক্ষেতের কৃষি গ্রহণ করেছিল। মধ্য মুনুন যুগে (৮৫০-৫৫০খ্রি:পূ:) বড় বড় বা প্রধানদের নেতৃত্বে প্রথম সমাজের আবির্ভাব ঘটে এবং প্রথম দর্শনীয় অভিজাত কবরটি ( ৫৫০-৩০০ খ্রি:পূ:) থেকে শনাক্ত করা যেতে পারে। ব্রোঞ্জ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মধ্য মুনুন যুগ ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনুষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সমাজে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সঙ্গগুকরি, ডায়পাইঅঙ্ক, ইগম-ডং, এবং অন্য বিভিন্ন জায়গার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নির্দেশ করে যে মুমুন যুগ প্রথম যেখানে সরদারি প্রথার উত্থান হয়, বিকাশ হয় এবং একসময় ধসে পড়ে।। দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য বৃদ্ধি, স্থানীয় দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি, এবং ব্রোঞ্জ ও লোহা ধাতব পদার্থের প্রবর্তনের জন্য ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে মুমুন যুগের সমাপ্তি ঘটে।

গোজোসিওন রাজ্য:

জিন রাষ্ট্রের দক্ষিণে এবং ম্যানচুরিয়া উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত গোজোসিওন ছিল প্রথম কোরিয়ানন রাজ্য।

গোজোসিওনের কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ডাঙ্গুনের নাম সামগুক ইউসা (১২৮১) এবং অন্যান্য মধ্যযুগীয় কোরিয়ান বইগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উল্লেখ্য, বিভিন্ন বর্ণনা অনুসারে,কথিত আছে দেশটি ২৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডাঙ্গুনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ডাঙ্গুন স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও এর কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না যে এটি এই কথাকে সমর্থন করে। কিন্তু এটি কোরিয়ান জাতীয় পরিচয় বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে চীনের সাং রাজবংশের একজন রাজকুমার গিজা নামক স্থানে গিজা জোসেনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে, এর অস্তিত্ব নিয়ে বিংশ শতকে দিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, এবং বর্তমান যুগেও সেই সময়কালের নিদর্শন বা বিষয় উপলব্ধি করার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ঐতিহাসিক গোজোসিওনের রাজত্বটি প্রথম বার সপ্তম শতকের প্রথম দিকে চীনা রেকর্ডগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। চতুর্থ শতাব্দীর দিকে গোজোসিওন এমন অবস্থায় উন্নীত হয়েছিল যারর জন্য তার অস্তিত্ব চীনে সুপরিচিত হয় এবং এই সময়ের কাছাকাছি এর রাজধানী পিয়ংইয়ং এ সরানো হয়।

১৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, গোজোসিওনের রাজা জুন,ইয়্যান অঞ্চল থেকে উইমান নামে একজনকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেন। পরে উইমান ১৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিদ্রোহ করে এবং জুন কোরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণে পালিয়ে যান। ১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, হান বংশোদ্ভূত উইমান জোসনান্দ উত্তর কোরিয়া উপদ্বীপে চারটি কমান্ডার স্থাপন করেন। কয়েক দশকের মধ্যেই পশ্চিমাঞ্চলে তিনটি কমান্ডার বাহিনীর পতন ঘটে বা তারা পিছু হটতে শুরু করেছিল, কিন্তু লেল্যাং কমান্ডাররা চার শতাব্দী ধরে, ৩১৩ সালে গোগুরিয়েও দ্বারা দখলের আগ পর্যন্ত চলমান চীনা রাজবংশের সাথে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময়ের কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গিয়েছিল।

জিন রাজ্য:

প্রায় ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, জিন নামক একটি রাষ্ট্র কোরিয়ান উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশে উত্থিত হয়। জিন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে এটি হান চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং জাপানের ইয়ইয়ি তে হস্তান্তরিত করে। ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে জিন ত্রি-হান নামে খ্যাত তিন রাজ্যের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে সংঘবদ্ধ ছিল।

আলেকজান্ডার ভোভিন এবং জুহা জানুহুনেন সহ বেশ কয়েকজন ভাষাবিদ উল্লেখ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার উপদ্বীপের বড় অংশগুলিতে জাপানিক ভাষায় কথাবার্তা বলা হতো। ভভিনের মতে, এই “উপদ্বীপীয় জাপানিক ভাষা” কোরিয়ান ভাষা (সম্ভবত হান-শাখার অন্তর্গত) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। সুতরাং জিন-ভাষাটি জাপানের সাথে সম্পর্কিত ছিল। Janhunen ও উল্লেখ করেন প্রাথমিকভাবে বাকজিতেও নতুন কোরিয়ান ভাষা আসার আগে সেখানকার মানুষজন জাপানিজ ভাষায় কথাবার্তা বলতেন।

ধাতুবিজ্ঞান:

কোরিয়ায় ব্রোঞ্জ যুগ প্রায় ৯০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু হয়েছিল,যদিও ব্রোঞ্জ যুগের রূপান্তরটি প্রায় ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পর শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে ব্রোঞ্জ ড্যাগারস, আয়না, গহনা এবং অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। চাল, লাল মটরশুটি, সয়াবিন এবং বাগানের চাষ করা হত সেসময় এবং উপদ্বীপের বিভিন্ জায়গায় আয়তক্ষেত্রাকার পিট-হাউস এবং ক্রমবর্ধমান বড় ডলম্যান সমাধি পাওয়া যায়। সমসাময়িক রেকর্ডগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বে গেজোজোন প্রাচীরযুক্ত শহরগুলির সামন্তবাদী শহর থেকে কেন্দ্রীয় রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে চতুর্থ শতাব্দীতে কোরিয়াতে লোহার সংস্কৃতির সূচনা হয় আজকের উত্তর রাশিয়ার সামুদ্রিক প্রদেশের প্রভাবের কারণে।

আদিম-তিন রাজ্য:

প্রটো-থ্রি কিংডমস বা আদিম তিন রাজ্যের সময় কাল, কখনও কখনও বেশ কয়েকটি রাজ্যের সময়কাল (열국 시대) বলে বিবেচনা করা হয়। কোরিয়ার তিন রাজ্যের উত্থানের সময় গোগুরিও, সিলা এবং বেকজে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং গোজোসনের পতনের পর ঘটেছিল । এই সময়ের মধ্যে গোজোজোন এর প্রাক্তন অঞ্চল থেকে অনেক রাজ্য উদ্ভূত হয়। এই রাজ্যের মধ্যে, বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল Dongbuyeo এবং Bukbuyeo।

বোয়িও এবং অন্যান্য দক্ষিণের রাজ্য:

গোজোসনের পতনের পর, বুয়েও আজকের উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ মঞ্চুরিয়া দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে ৪৯৪ পর্যন্ত গোগুরিয়োর দ্বারা শোষিত হয়েছিল এবং কোরিয়া থ্রি কিংডমগুলির দুজন গোগুরিয়েও এবং বেকজে উভয়ই নিজেদের বিবেচনা করেছিলেন তারা পরবর্তী উত্তরাধিকারী।

যদিও রেকর্ডগুলি অস্পষ্ট এবং দ্বন্দ্বপূর্ণ, তবে মনে হয় ৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ডংবুইয়েও (পূর্ব বুয়েও) চারপাশে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। এজন্য মূল বুয়েওকে মাঝে মাঝে বুকবুয়েও (উত্তর বুয়েও) বলা হত। জোলবন বুয়েও গোগুরিয়োর পূর্বসূরী ছিলেন, এবং ৫৩৪ সালে, বেক্জে নিজের নাম নাম্বুয়েও (সাউথ বুয়েও) রাখেন।

ওকেজিও একটি উপজাতীয় রাজ্য ছিল যা উত্তর কোরিয়ার উপদ্বীপে অবস্থিত ছিল এবং গোজোসনের পতনের পর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওকেজি তার পতনের আগে গোজোসনের অংশ ছিল। এটি প্রতিবেশী রাজ্যের হস্তক্ষেপের কারণে সম্পূর্ণরূপে উন্নত রাষ্ট্র হয়ে ওঠতে পারেনি। ওকিজো গোগুরিয়োর উপরাজ্য হয়ে ওঠে এবং অবশেষে পঞ্চম শতাব্দীতে গওয়াঙ্গেতেও তাইওয়ানের দ্বারা গোগুরিয়েও যুক্ত হন।

উত্তর কোরিয়ার উপদ্বীপে অবস্থিত ডঙ্গেই আরেকটি ছোট রাজ্য ছিল। ডঙ্গেই ওকেজিও সীমান্তে, এবং দুটো রাজ্যের গোগুরিয়োর ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের উপরাজ্য হওয়ার একই ভাগ্য সম্মুখীন হয়েছিল। ডঙ্গেইও তার পতনের আগে গোজোজেনের প্রাক্তন অংশ ছিল।

সামহান:

সাম-হান (삼한, 三 韓) উল্লেখ করা হয় মহন, জিনহান ও বাইওনের এর সংঘবদ্ধ সম্মেলন। দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান উপদ্বীপে এটি অবস্থিত। সাম-হান দেশ কঠোরভাবে আইন দ্বারা শাসিত ছিল যেখানে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মহন ছিল বৃহত্তম যা ৫৪ টি রাজ্য নিয়ে গঠিত ছিল এবং এজন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করত মহন । বায়োহন ও জিনহান উভয়ই ১২ টি রাজ্য নিয়ে গঠিত, যার ফলে সমা-হানের মোট রাজ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৮টি । শেষ পর্যন্ত চতুর্থ শতাব্দীতে বাকেজি, সিলা ও গায়া এই সংঘবদ্ধ রাজ্যত্রয় দখল করে।

গোগরিয়েও:

গোগুরিয়েও ৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুমং (পরবর্তীকালে রাজকীয় নাম ডংমিওংসিয়ং নামে হিসেবে চিহ্নিত) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে, রাজা টেযো সরকারকে কেন্দ্রীয়করণ করেন। রাজা সোসুরিমের রাজত্বের সময়ে ৩৭২ সালে বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করা হয়।কোরিয়ার মধ্যে গোগুরিয়েও ই ছিল প্রথম যে রাজ্য বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে।

গোগুরিয়ও (কোগুরিও নামেও উচ্চারণ করা হয়) গরিয়ও নামেও পরিচিত ছিল (কোরিও হিসেবেও উচ্চারণ করা হয়) এবং অবশেষে আধুনিক কোরিয়া নামকরনের উৎস হয়ে ওঠে।

গোগুরিয়েও পঞ্চম শতাব্দীতে তার শক্তি অর্জন করে এবং পূর্ব এশিয়ায় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং মহান শক্তিগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। যখন গাঁংগেটো গ্রেট এবং তার পুত্র, জংশু, প্রায় দেশটিকে প্রসারিত করেন তখন আন্তর মঙ্গোলিয়ার অংশগুলি ম্যানচুরিয়ার সমস্ত, রাশিয়ার অংশ, এবং বর্তমান শহর বেকজে থেকে সিউলে যুক্ত করেন। গোগুরিয়েও গাঁঙ্গগেটো এবং জাংসু এর মধ্যে একটি সুবর্ণ যুগের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, তিনি তাদের সময়কালে বেকজে ও সিলাকে পরাজিত করেছিলেন এবং কোরিয়া থ্রি কিংডমগুলির সংক্ষিপ্ত একত্রীকরণ অর্জন করেছিলেন এবং সর্বাধিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। কোরিয়ান উপদ্বীপ। জংসুর দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে গোগুরিয়োর তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণতা স্থাপন করে।

গোগুরিও একটি অত্যন্ত সামরিকবাদী রাষ্ট্র ছিল;কোরিয়ান উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণে লড়াই করার পাশাপাশি গোগুরিওও বিভিন্ন চীনা রাজবংশের সাথে অনেক সামরিক সংঘর্ষের শিকার হয়েছিল, বিশেষত গোগুরিয়ে-সুই যুদ্ধ, যা গোগুরিয়েও পরাজিত করেছিল। দশ মিলিয়ন পুরুষের বিশাল শক্তি সুই রাজবংশের পতনের ক্ষেত্রে অবদান রাখে।

৬৪২ সালে শক্তিশালী জেনারেল ইয়োন গেসোমুন একটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন এবং গোগুরিয়োর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। জবাবে, চীনের সম্রাট তান তাইজং গোগুরিয়োর বিরুদ্ধে একটি প্রচারণা চালান, কিন্তু পরাজিত হন এবং পিছু হটতে শুরু করেন। ত্যাং তাইজংয়ের মৃত্যুর পর, তার পুত্র সম্রাট তং গাউজং কোরিয়ার রাজধানী সিলার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন এবং গোগুরিয়োর উপর আবার আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু গোগুরিয়োর শক্তিশালি প্রতিরক্ষা পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন এবং ৬৬২ সালে পরাজিত হন। যাইহোক, ৬৬৬ সালে ইওন গেসোমুন একটি প্রাকৃতিক কারণের কারণে মারা যান এবং গোগুরিওর সার্বিক অবস্থা তার পুত্র এবং ছোট ভাইয়ের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে সংঘর্ষের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার বড় ছেলে টাঙ্গান ও তার ছোট ভাই সিলাকে অপহরণ করে। ৬৬৭ সালে টাঙ্গ-সিল্লা জোট একটি নতুন আক্রমণ চালায়, যার সাহায্যকারী ইয়েওন ন্যামসেইং সাহায্য করেছিলেন এবং ৬৬৮ সালে গোগুরিয়েওকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

গোগুরিয়োর পতনের পর, টং এবং সিলা তাদের জোট শেষ করে কোরিয়ান উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণে লিপ্ত হয়। সিলার বেশিরভাগ কোরিয়ান উপদ্বীপের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনে সফল হন, যখন টাং গোগুরিয়োর উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলিতে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেন। যাইহোক, গোগুরিয়োর পতনের ৩০ বছর পর, ডেই জয়য়েং নামে একটি গোগুরিও জেনারেল বেলির কোরিয়ান-মোহে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বেশিরভাগ প্রাক্তন গোগুরিও অঞ্চলের ট্যানের উপস্থিতি সফলভাবে বহিষ্কৃত করেছিলেন।

 

কোরিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কোরিয়া উপদ্বীপটি এশিয়ার পূর্ব উপকূলে, চীনের মাঞ্চুরিয়ার পূর্ব অঞ্চল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব প্রান্ত থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত। উপদ্বীপটি ৫২৫ মাইল লম্বা ও গড়ে প্রায় ১৫০ মাইল চওড়া।

নানা কারণে বর্তমান পৃথিবীতে কোরিয়া দেশটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাচীন কালেও এ দেশটি সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী ছিল। চীনের নৈকট্যের দরুন কোরিয়া অতি প্রাচীন কালেই চীন সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আবার জাপানে চীনের সভ্যতার নানা উপাদান পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কোরিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

পুরান পাথরের যুগ এবং নতুন পাথরের যুগের কোরিয়া সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। প্রবাদ অনুসারে, ১১২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিজা নামক এক চীনা ঔপনিবেশিক কোরিয়ায় এসে স্থানীয় রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করেন। তিনি কোরিয়ায় এক উন্নত সভ্যতার প্রবর্তন করেন। ১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন সাম্রাজ্য কোরিয়ার উত্তরাংশ জয় করে সেখানে চারটি উপনিবেশ স্থাপন করে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে কোরিয়া অঞ্চলে তিনটি রাজ্যের উদয় হয়। একটি চীন অধিকৃত উত্তর অংশে; একটি দক্ষিণ-পূর্ব কোরিয়ায় এবং তৃতীয়টি দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। সর্ব দক্ষিণের একটা ক্ষুদ্র অঞ্চল প্রথম শতাব্দী থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত জাপানের অধিকারে ছিল বলে অনুমান করা হয়।

 

 

পূর্বোক্ত তিনটি রাজ্য প্রায় ৭০০ বছর ধরে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিল। মধ্যযুগে কোরিয়ার সভ্যতার অতি অপরূপ বিকাশ ঘটেছিল। এ সময়ে কোরিয়ায় চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ইতিহাস ও কৃষিবিদ্যার চর্চা বিকাশ লাভ করেছিল।

 

আরও দেখুন :

মায়া, আজটেক, ইনকা সভ্যতার উৎপত্তি প্রসঙ্গে

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মায়া, আজটেক, ইনকা সভ্যতার উৎপত্তি প্রসঙ্গে

মায়া, আজটেক, ইনকা সভ্যতার উৎপত্তি প্রসঙ্গে

 

 

মায়া, আজটেক, ইনকা সভ্যতার উৎপত্তি প্রসঙ্গে

আমরা দেখতে পেলাম, আমেরিকা মহাদেশে আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্রভাবে মিশর ব্যবিলন প্রভৃতি ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতার অনুরূপ কয়েকটা সুউচ্চ সভ্যতা উদিত হয়েছিল। আমেরিকা মহাদেশে এ ধরনের অত্যুচ্চ সভ্যতার উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে দুই ধরনের মত প্রচলিত রয়েছে। কারও কারও মতে, আমেরিকাতে এ সকল সভ্যতার উদয় স্বতন্ত্রভাবে ঘটেছিল।

আবার কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে, পুরাতন পৃথিবীর ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতার প্রভাবেই আমেরিকাতে মায়া, আজটেক ও ইনকা সভ্যতার উদয় ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, পশ্চিম এশিয়া ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতার সাথে আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতাসমূহের কিছু কিছু সম্ভাব্য যোগসূত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন, ইন্‌কা রাজ্যের নানা স্থানে মিশরের মতো মৃতদেহ থেকে মমি তৈরি করা হত।

আবার, মায়া আজটেক সভ্যতায় চাকাওয়ালা গাড়ি বা কুমোরের চাকের ব্যবহার ছিল না, কিন্তু মেক্সিকোর কোনো কোনো কবরের মধ্যে চাকাওয়ালা খেলনাগাড়ি পাওয়া গেছে। সমাজে চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন না থাকা সত্ত্বেও করবের মধ্যে চাকাওয়ালা খেলনাগাড়ির উপস্থিতি খুবই আশ্চর্যের। অনুমান করা চলে, প্রাচীন কোনো সভ্যতার অনুকরণে এ খেলনা নির্মিত হয়েছিল। এ সকল নিদর্শন ছাড়াও আরেকটা হিসাব আছে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

প্রাচীন মিশর ও ব্যবিলনীয় সভ্যতার উদয় ঘটেছিল ব্যাপকসংখ্যক মানুষের সুদীর্ঘকালের কর্মপ্রচেষ্টার পটভূমিতে। অপরপক্ষে আমেরিকাতে স্বল্পকালের মধ্যে এবং স্বল্প পরিসরের মধ্যে এত উচ্চ সভ্যতার উদয় ঘটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। যেমন, ব্যবিলনে ব্যবসা-বাণিজ্যের এত ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল যে তার হিসাব রাখার প্রয়োজন থেকে গণিতের উন্নতি এবং অঙ্কপাতন পদ্ধতির আবিষ্কারকে কোনো আশ্চর্য বিষয় বলে মনে হয় না।

ব্যবিলনীয়রা ৬০-ভিত্তিক গণনাপদ্ধতি এবং শূন্যের অর্থবোধক একটা চিহ্ন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। অথচ, মায়াদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য সামাজিক কার্যকলাপ খুব ব্যাপক না হওয়া সত্ত্বেও তারা অতি সহজে ২০-ভিত্তিক গণনাপদ্ধতি এবং শূন্যের আবিষ্কার সাধন করল এটা অতি আশ্চর্যের ব্যাপার।

 

 

তাই এটা খুব অসম্ভব নাও হতে পারে যে, এশিয়া থেকেই ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতার বীজ আমেরিকাতে গিয়েছিল। তবে এ বিষয়ে এখনও নিঃসংশয়ে কিছু বলা চলে না।

আরও দেখুন :

ইনকা সভ্যতা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ইনকা সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকাস্থ  পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায়, খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তা ইনকা সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। ইনকা শব্দের অর্থ “সূর্য দেবতার সন্তান” (Son of the Sun)। কোস্কোর অধিপতি বা ইনকা সম্রাট কে সূর্য দেবতার সন্তান হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সেই থেকেই স্পেনীয়রা সাম্রাজ্যটির নাম দেয় “ইনকা সাম্রাজ্য”। আজ এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।

ইনকা সভ্যতা

 

 

ইনকা সভ্যতা

আমরা গুয়াতেমালা ও মেক্সিকোর সভ্যতা তথা উত্তর আমেরিকার মায়া এবং আজটেক সভ্যতার কথা আলোচনা করেছি। ইন্‌কা নামক এক জাতি দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলে প্রায় অনুরূপ উচ্চমানের এক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, ইতিহাসে তা ইন্‌কা সভ্যতা নামে পরিচিত হয়েছে।

পেরু অঞ্চলে ইনকাদের আবির্ভাবের আগেও সেখানে সভ্যতা-সংস্কৃতির উদয় ঘটেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে জানা গেছে যে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে প্রাগৈতিহাসিক কালে বিভিন্ন রেড ইণ্ডিয়ান উপজাতির মানুষ বাস করত। খ্রিস্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এ আদিম মানুষরা গৃহ ও পিরামিড নির্মাণ, উৎকৃষ্ট মাটির পাত্র নির্মাণ, জলসেচ প্রভৃতির কৌশল আয়ত্ত করেছিল।

ঐ সময়ের অল্পকাল পরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে ১৩ হাজার ফুট উপরে আন্দিজ পর্বতের উপত্যকায় অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিরা আরেক সুউচ্চ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এ মানুষরা যেসব বিশাল পাথরের নগরী গড়ে তুলেছিল তার ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। কালক্রমে এ সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, কিন্তু এর বিলুপ্তির কারণ এখনও জানা জায়নি।

খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ইন্‌কা নামে পরিচিত একদল মানুষ আন্দিজ পর্বতের মধ্যভাগে এসে বাস স্থাপন করে। ইন্‌কা শব্দের অর্থ হচ্ছে “সূর্যের সন্তান”। ইনকারা ক্রমশ যুদ্ধ করে তাদের রাজ্যের পরিধি বাড়াতে শুরু করে। শেষ পর্যায়ে, ১৪৩৮ থেকে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ইন্‌কা রাজ্য আন্দিজ পর্বতের উপর প্রায় ২৭০০ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে ইনকা রাজ্য স্পেনীয় আক্রমণে হয়ে গিয়েছিল।

স্পেনীয় আক্রমণের আগে ইন্‌কা রাজ্য বর্তমান পেরু, ইকোয়েডর, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলির এক বড় অংশ জুড়ে অবস্থিত ছিল। ইনকাদের শাসক ছিল সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন “সাপা ইন্‌কা” অর্থাৎ “একমাত্র ইন্‌কা”। ইনকারা অন্যান্য উপজাতির মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের দাসে পরিণত করেছিল। অবশ্য সাধারণ ইনকা ও দাসের অবস্থাতে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সাধারণ ইনকা ও দাস-ভূমিদাসদের উপর রাজত্ব করত প্রকৃতপক্ষে পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণী।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সাস এবং ইনকা কৃষক কারিগররা যে বিপুল সম্পদ উৎপন্ন করত, অভিজাত শ্রেণী তার অধিকাংশই আত্মসাৎ করত নিজেদের সুখভোগের জন্য। কৃষিই ছিল ইন্‌কা সংস্কৃতির ভিত্তি। পাহাড়ের গায়ে তারা ফসল ফলাত। পাহাড়ের গায়ে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু দেওয়াল তুলে তারা খাঁজ সৃষ্টি করত এবং সে খাঁজ মাটি দিয়ে ভরত। এ মাটির উপর তারা শস্যের চাষ করত। ইনকারা প্রধানত ভুট্টা, আলু, মরিচ, তরিতরকারি, নানাপ্রকার লতাগুল্ম প্রভৃতির চাষ করত।

ষোল শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ বা এশিয়াতে আলু অজানা ছিল: দক্ষিণ আমেরিকা থেকেই আলু পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল। ইন্‌কা রাজ্যে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। ইনকারা পশুপালনের কৌশল আয়ত্ত করেছিল। লামা, আলপাকা প্রভৃতি প্রাণীকে তারা পোষ মানিয়েছিল। এ দু’টি প্রাণীই উটজাতীয়। আলপাকা আকারে ভেড়ার সমান, লামা আরেকটু বড়। ইন্‌কারা লামাকে ভারবাহী পশু হিসেবে ব্যবহার করত।

তবে মায়া আজটেকদের মতো ইনকারাও চাকাওয়ালা গাড়ির ব্যবহার জানত না। আলপাকার লোম থেকে ইনকারা পশমী কাপড় বুনত। লামা এবং আলপাকার দলের বড় অংশই ছিল সাপা ইন্‌কার সম্পত্তি। ইনকারা কাপড় বুনতে পারত, মাটির সামগ্রী বানাতে পারত এবং সোনা, তামা প্রভৃতি ধাতুর সুন্দর সুন্দর সামগ্রীও বানাতে পারত। ইন্‌কারা সুবিশাল ও মজবুত পাথরের বাড়ি বানাতে পারত। ইনকারা রাস্তা, বাঁধ ও সেতু নির্মাণে দক্ষ ছিল।

রাজধানী কুজকো থেকে ইন্‌কা রাজ্যের সর্বত্র বড় বড় চওড়া রাস্তা গিয়েছিল। নদী, ঝরনা ইত্যাদির উপর দিয়ে ইনকারা সেতু নির্মাণ করত; তার অধিকাংশই ছিল ঝুলন্ত সেতু। ইনকারা জলপথে যাতায়াত ব্যবস্থারও উন্নতি সাধন করেছিল। তারা ভেলা, ডোঙ্গা নৌকা এবং পালতোলা নৌকার সাহায্যে জলপথে যাতায়াত করত। ইন্‌কারা সমুদ্র পথে মেক্সিকোর সাথে যোগাযোগ রাখত বলে অনুমান করা হয়।

যোগাযোগ ব্যবস্থার এত উন্নতি সত্ত্বেও অবশ্য ইন্‌কাদের বাণিজ্য ব্যবস্থা বিশেষ উন্নত ছিল না। ব্যবসা বলতে পণ্য বিনিময় ব্যবস্থারই প্রচলন ছিল, তবে ইনকারা কড়িকেও মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করত বটে। ইনকাদের কোনো লেখনব্যবস্থা ছিল না, তবে তারা সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য এক প্রকার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। তার নাম কিপু, বাংলায় বলা চলে গ্রন্থিলিপি। ইনকারা দড়িতে গিট বেঁধে বেঁধে সেটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাত।

 

 

দড়ির মধ্যে গিঁটের অবস্থান দেখে অন্যেরা লিপির অর্থ উদ্ধার করত। এরই নাম কিপু। ইকারা পঞ্জিকার ব্যবহার আয়ত্ত করেছিল। তারা ৩৬৫ দিনে বছর গণনা করত। তারা বছরকে বারটি মাসে এবং মাসকে চারটি সপ্তাহে বিভক্ত করত। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে স্বার্থলোভী স্পেনীয় সৈনিক পিজাবোর আক্রমণে ইনকাদের প্রাচীন সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছিল।

 

আরও দেখুন :

আজটেক সভ্যতা

আজটেক সভ্যতা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় আজটেক সভ্যতা

আজটেক সভ্যতা

 

 

আজটেক সভ্যতা

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে টোলটেক নামক এক জাতির মানুষ উত্তর দিক থেকে এসে মেক্সিকো উপত্যকা অধিকার করে। মায়াদের সংস্পর্শে এসে টোলটেকরা তাদের সংস্কৃতি আয়ত্ত করে এবং মায়াদের অনুকরণে সুন্দর সুন্দর নগর গড়ে তোলে। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে টোলটেক এবং তাদের সমগোত্রীয় অন্যান্য জাতির মানুষরা এক বড় রাজ্য গড়ে তোলে। এর কিছুকাল পরেই আজটেক নামক জাতি উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মেক্সিকোতে আগমন করে।

১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে আজটেকরা বর্তমান মেক্সিকো নগরীর কাছে এক হ্রদের মধ্যে বাস স্থাপন করে। এর পর তারা মেক্সিকোর অন্যান্য উপজাতিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। পনের শতকে আজটেকদের এ রাজ্য সারা মেক্সিকো জুড়ে বিস্তৃত হয়। আজটেকদের রাজ্য শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো উপসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আজটেকরা ছিল যুদ্ধপ্রিয় জাতি। তাদের সুশিক্ষিত যোদ্ধার দল সর্বদা প্রস্তুত থাকত।

এ সৈন্যদের সাহায্যে আজটেকরা তাদের প্রতিবেশী দেশসমূহকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে। রাখত। তবে আজটেকদের এ প্রতিপত্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি, কারণ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় সেনাপতি কর্টেজের আক্রমণে আজটেক সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
আজটেকদের শাসনকর্তা ছিলেন এক সর্বক্ষমতাময় রাজা। তাঁর সমর্থনকারী ছিল সেনাবাহিনী, পুরোহিত এবং অভিজাতগণ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আজটেকরা অনবরত যুদ্ধ করে অসংখ্য যুদ্ধবন্দী ধরে আনত। যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যককে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হত, অন্যান্যদের দাসে পরিণত করা হত। মায়াদের মত আজটেক সমাজেও দাসের প্রচলন ছিল। আজটেক সমাজে স্বাধীন মানুষরা কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে নিচের শ্রেণীতে ছিল সাধারণ কৃষক ও ভূমিদাসরা। এরা যা উৎপাদন করত তার এক বৃহৎ অংশ রাষ্ট্র আত্মসাৎ করত পুরোহিত, সেনাবাহিনী ও অভিজাতদের পরিপোষণের জন্য।

আজটেক সভ্যতার ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ। আজটেকরা কোকো, রবার, টমেটো, ভুট্টা প্রভৃতির চাষ করত। এ সকল গাছ এবং ফল ও শসা আমেরিকা থেকেই অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করেছে। আজটেকদের রাজ্যে জমির বিশেষ অভাব ছিল। তাই তারা হ্রদের মধ্যে কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করে তাতে ফলের চাষ করত। আজটেকদের সমাজে চারু ও কারুশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। আজটেকরা সুন্দর সুন্দর মাটির পাত্র ও মূর্তি, ধাতুর ভাস্কর্য, অলঙ্কার, অস্ত্র প্রভৃতি নির্মাণের কাজে দক্ষতা অর্জন করেছিল।

আজটেকরা সুন্দর কাপড় বুনতে পারত। আজটেক সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটেছিল। পালকের ফাঁপা নলের ভিতর সোনার রেণু ভরে তাকে আজটেকরা মুদ্রারূপে ব্যবহার করত। আজটেকরা এক ধরনের লেখনপদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। সম্ভবত ওলমেক অথবা মায়াদের কাছ থেকে তারা এ লিপি লাভ করেছিল। আজটেকরা মায়াদের পঞ্জিকাকেও গ্রহণ করেছিল।

 

 

মায়াদের মতো আজটেকরাও প্রত্যেক নগরে পিরামিড, মন্দির ও বিশাল ভবন নির্মাণ করত। তারা খাল এবং বাঁধও নির্মাণ করতে পারত। আজটেকদের স্থাপত্যশিল্প ও ভাস্কর্যের প্রায় সকল নিদর্শন স্পেনীয় সেনাপতি কর্টেজের আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

আরও দেখুন :

মায়া সভ্যতা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মায়া সভ্যতা

মায়া সভ্যতা

 

 

মায়া সভ্যতা

মায়া সভ্যতা ছিল আমেরিকা মহাদেশের সমস্ত সভ্যতাসমূহের মধ্যে উচ্চতম সভ্যতা। খ্রিস্টের জন্মের অন্তত এক হাজার বছর আগে মায়া জাতির মানুষরা গুয়াতেমালা ও মেক্সিকো অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে। খ্রিস্টের জন্মের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই মায়ারা তাদের রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে অপূর্ব সব নগর গড়ে তুলেছিল।

তবে পণ্ডিতদের মতে মায়া সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে বিকাশ লাভ করেছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। ৩১৭ থেকে ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকে বলা হয় মায়া সভ্যতার আদি পর্ব। এরপর দক্ষিণাঞ্চলের মায়া সভ্যতায় অবক্ষয়ের লক্ষণ দেখা দেয় এবং মায়া সভ্যতার মূল কেন্দ্র উত্তরে ইউকাতান উপদ্বীপ অঞ্চলে চলে যায়। ৯৮৭ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালকে বলা হয় মায়া সভ্যতার শেষ পর্যায়। এ সময়ে স্থাপত্য এবং শিল্পকলা নবজীবন লাভ করেছিল।

মায়া সভ্যতা অনেকগুলি নগররাষ্ট্র নিয়ে গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেক নগররাষ্ট্র গড়ে উঠত একটা নগর ও তার চারপাশের জমি নিয়ে। রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন আইন, শাসন বিচার ও ধর্মীয় বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পুরোহিত ও সেনাপতিগণ ছিলেন এ শাসকের ঘনিষ্ঠ সহচর। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছিল। মায়াদের রাজ্যে ধাতু বিশেষ ছিল না, মায়ারা মায়া রাষ্ট্রে তাই প্রতিবেশী উপজাতিদের কাছ থেকে ধাতু সংগ্রহ করত। মায়াদের রাজ্যে কোকো গাছের বিচি মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হত।

সমাজে বণিক, কারিগর ও অবস্থাপন্ন কৃষকদের স্থান ছিল পুরোহিত, সেনাপতি প্রভৃতি অভিজাতদের নিচেই। মায়া সমাজে ক্রীতদাসের প্রচলন ছিল। মায়াদের সমাজে সবচেয়ে নিচের স্তরের মানুষ ছিল ভূমিদাস ও ক্রীতদাসগণ। মায়াদের রাজ্যে দাসদের কঠোর পরিশ্রম করতে হত, কারণ সেখানে ভারবাহী পশু বা ঢাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ছিল না। মায়া রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই ছিল কৃষক, তারা নগরের বাইরের জমিতে চাষ করত।

মায়ারা বন কেটে জমি পরিষ্কার করত এবং জলসেচের সাহায্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করত। মায়ারা চাষের কাজ খুব ভাল জানত। তারা ভুট্টা, কোকো, বিভিন্ন ফল, শাক সবজি, মরিচ, তুলা প্রভৃতির চাষ করত। ভুটা ছিল তাদের প্রধান খাদ্যশস্য। মায়া কারিগররা চমৎকার কাপড় বুনতে পারত, গয়না ও অস্ত্র বানাতে পারত এবং হাড়, কাঠ ও পাথরে খোদাই করতে পারত। মায়া রাজ্যে ধাতুর অভাব থাকায় মায়ারা অসিডিয়ান নামে একপ্রকার কাচতুল্য পাথর দিয়ে পাত্র, হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত।

মায়াদের জীবনে ধর্মের অত্যধিক আধিপত্য ছিল। মায়াসমাজে পুরোহিতরা ছিল। খুবই ক্ষমতাশালী। সমস্ত সার্বজনীন ভবন নির্মাণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল। পুরোহিতদের। শিক্ষা বলতে ছিল ধর্মশিক্ষা এবং লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল পুরোহিতদের কবলিত। মায়াদের ধর্মে নরবলির প্রথা ছিল। মায়াসমাজে লেখনপদ্ধতির প্রচলন ছিল। মায়াদের লিপি ছিল চিত্রলিপি অথবা ভাবব্যঞ্জক লিপি। মায়াদের লিপির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মায়াদের লেখার বিষয়বস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল ধর্মবিষয়ক ও সন-তারিখ সংক্রান্ত। প্রতি কুড়ি বছর অন্তর মায়া পুরোহিতরা একটা পাথরের দেওয়াল নির্মাণ করে তাতে পূর্ববর্তী কুড়ি বছরের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করে রাখত। মায়া পুরোহিতরা ধর্মীয় প্রয়োজনে পঞ্জিকার হিসাবও আবিষ্কার করেছিল এবং এ পঞ্জিকা তারা পাথরের চাকতিতে লিপিবদ্ধ করে রাখত। এ ছাড়া মায়ারা সার্বজনীন ভবনে, স্মৃতিস্তম্ভে, মন্দিরে, গয়নায়, পাত্রের গায়ে এবং পুস্তকে বিভিন্ন কথা লিখত।

মায়াদের বই বিশেষ এক ধরনের কাগজ দিয়ে তৈরি হত এবং এসব বইকে কাগজের পাখার মতো ভাঁজ করে রাখা চলত। মায়াসমাজে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা যথেষ্ট বিকাশ লাভ করেছিল। মায়াসমাজে এক রকম অঙ্কপাতন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল যা অনেকটা আমাদের ব্যবহৃত অঙ্কপাতন পদ্ধতির মতোই। আমাদের গণনা পদ্ধতি ১০-ভিত্তিক, আর মায়াদের গণনা পদ্ধতি ছিল ২০-ভিত্তিক। আমাদের মতো মায়ারাও শূন্যের (0) ব্যবহার জানত।

অবশ্য মায়াদের শূন্যচিহ্ন দেখতে আমাদের মতো ছিল না। আমরা যখন চার অঙ্কের কোনো সংখ্যা লিখি তখন ডান দিক থেকে বাঁ দিকে প্রথম স্থানের একক ১, দ্বিতীয় স্থানের একক ১০. তৃতীয় স্থানের একক ১০০ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মায়াদের প্রথম স্থানের একক ১, দ্বিতীয় স্থানের একক ২০। ফলে মায়াদের হিসাবে ৩৭ লিখলে তার অর্থ দাঁড়াবে ৩ ঙ ২০ + ৭ = ৬৭। তবে মায়াদের অঙ্কপাতন পদ্ধতি আমাদের মত নিখুঁত ছিল না।

কারণ তারা ২০-ভিত্তিক অঙ্কপাতন পুরোপুরি অনুসরণ করত না। যেমন, আমাদের পদ্ধতিতে শতকের স্থানের মান হচ্ছে ১০০ অর্থাৎ ১০৪১০, মায়াদের হওয়া উচিত ছিল ২০ ২০ =৪০০; কিন্তু মায়ারা যে কারণেই হোক তৃতীয় স্থানের স্থানিক মান ধরত ৩৬০। এটা ছিল ত্রুটিপূর্ণ।  মায়ারা তাদের লেখনপদ্ধতি ও গণিতবিদ্যাকে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চার সাথে যুক্ত করেছিল এবং এ সবকিছুর সহযোগে একটা নিখুঁত পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে সমর্থ হয়েছিল।

মায়ারা তাদের পঞ্জিকায় বছরের যে দৈর্ঘ্য নিরূপণ করেছিল তা প্রায় আমাদের মতোই নিখুঁত ছিল। মায়াদের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে মায়াদের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল সুউচ্চ পিরামিড, বিশাল সোপানশ্রেণী, অতি অপরূপ মন্দির প্রভৃতি। নগর চত্বরের চারপাশে এ সকল পিরামিড ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ করা হত। মন্দিরের চত্বর প্রভৃতিতে সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য স্থান পেত।

 

 

মায়া ভাস্কররা শুধুমাত্র পাথরের হাতিয়ার ও যন্ত্রের সাহায্যে এত সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য সৃষ্টি করতে পারতেন ভাবলে অবাক হতে হয়। এ ছাড়া রঙিন পাথর এবং সোনা ও রূপার বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর সামগ্রীও মায়ারা তৈরি করতে পারত। বস্তুত মায়া শিল্পকলা প্রাচীন মিশরের শ্রেষ্ঠ শিল্পকলার সাথে তুলনীয়। শেষ পর্যায়ে মায়া সভ্যতা অনেকগুলি স্বাধীন নগরের সমষ্টি হিসাবে টিকে ছিল।

শেষ পর্যন্ত মায়া নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিবাদ ও গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। এর ফলে ত্রয়োদশ শতকের পর থেকে মায়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির পতন ঘটে। স্পেনীয় উপনিবেশকরা যখন ষোল শতকে এখানে আসে তখন তারা এ অঞ্চলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা দেখতে পায় এবং মায়া রাজ্যকে সহজেই জয় করে নেয়।

আরও দেখুন :