আজকের আলোচনার বিষয় অজাচার সম্বন্ধে প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা – যা বিয়ে অজাচার এর অর্ন্তভুক্ত, অজাচার নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা হিসেবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, মানুষ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করে না যেহেতু এতে পরবর্তী প্রজন্মের উপর নেতিবাচক জেনেটিক প্রভাব পড়তে পারে। এবং এ কারণে অজাচার নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা হয়। কিছু নৃবিজ্ঞানীও এ ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, কিন্তু এটি বহু নৃবিজ্ঞানীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
তাঁদের প্রশ্ন হচ্ছে: এই প্রথা অনুসরণ করলে যে দীর্ঘমেয়াদে মনুষ্য প্রজাতি জেনেটিকেলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে (বংশগত অসুস্থতা এবং সেকারণে অধিক হারে মৃত্যুবরণ) – এই তথ্য বিভিন্ন সমাজের মানুষজন কিভাবে জানলেন? যে সকল নৃবিজ্ঞানী বলে থাকেন জেনেটিক কারণে অজাচারের নিষেধাজ্ঞা পালন করা হয়ে থাকে – তাঁরা এই যৌক্তিক আপত্তির – কোন সদুত্তর দিতে পারেন না। শুধু তাই নয়, যাঁরা এই অবস্থানের সমালোচনা করে থাকেন, তাঁরা আরো কিছু জিজ্ঞাসা তোলেন, যেমন, যদি সকল সমাজের সকল মানুষ এটা জেনেই থাকে যে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে করলে পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হতে পারে তাহলে কেন কিছু সমাজে কাজিন বিবাহ প্রচলিত? কাজিন বিবাহ দুই ধরনের: “আড়া-আড়ি” এবং “সমান্তরাল”।
অজাচার সম্বন্ধে প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
“আড়া-আড়ি কাজিন” বিয়ে বলতে বোঝায় ফুপাতো-মামাতো ভাই বোনের বিয়ে। চাচাতো এবং খালাতো ভাই বোন “সমান্তরাল কাজিন”, এবং এদের মধ্যে বিয়ে বহু সমাজেই নিষিদ্ধ। কিন্তু কথা হচ্ছে, আড়া-আড়ি হোক কি সমান্তরাল, জৈবিক দিক থেকে দুই ধরনের কাজিনই সমানভাবে নিকট আত্মীয়। তবে এটা উল্লেখ করা জরুরী যে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে তা জেনেটিকেলি ক্ষতিকর, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন। বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদির চূড়ান্ত অভাব সত্ত্বেও মরগান এবং মেইনের তত্ত্বের সাহায্যে জেনেটিক ব্যাখ্যা উনিশ শতকে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
উনবিংশ শতকের অপর কিছু তাত্ত্বিকগণের মতে যেমন স্পেনসার এবং লুববক অজাচার নিষেধাজ্ঞার উৎস হচ্ছে প্রাচীনকালে – – জঙ্গী উপজাতিদের জোরপূর্বক কনে-আনার প্রথা। ডুর্খাইমের মতে অজাচার নিষেধাজ্ঞা আরো ব্যাপকতর নিষেধাজ্ঞার সাথে যুক্ত ঋতুস্রাবের রক্ত। একই গোত্রের সদস্যের জন্য গোত্রের সদস্যের রক্তের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ। ডুর্খাইমের মতে অজাচার নিষেধাজ্ঞার উৎসের মূলে আছে এই বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ।
মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের সাহায্যেও অজাচার নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে । যেমন কিনা হ্যাভেলক এলিস এবং ওয়েস্টারমার্ক-এর তত্ত্ব। এলিস এবং ওয়েস্টারমার্কের মতে, “প্রাকৃতিক বিমুখতা” (natural aversion) হচ্ছে অজাচার নিষেধাজ্ঞার কারণ। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়ে উঠলে অথবা যাদের সাথে জন্ম থেকে পরিচয়, তাদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করাটা, এলিস এবং ওয়েস্টারমার্কের মতে, অস্বাভাবিক। এ ধরনের তত্ত্বও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। প্রথমত, যদি বিমুখতা স্বাভাবিকই হয়ে থাকে তাহলে কেনই বা নিষেধাজ্ঞা? নিষেধাজ্ঞার তো তাহলে প্রয়োজন পড়ে না।
দ্বিতীয়ত, কিছু নৃবিজ্ঞানীর মতে: কিছু সমাজে বহু জ্ঞাতি বিবাহ-সঙ্গী হিসেবে নিষিদ্ধ যাদের সাথে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেনি। এটি স্বাভাবিক বিমুখতা তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। আবার, এও ব্যাখ্যা করা যায় না কেন কিছু সমাজে এমন ধরনের জ্ঞাতিতে বিবাহ অনুমোদিত যাদের সাথে ছোটবেলা থেকে পরিচয় ( যেমন কিনা আড়া-আড়ি কাজিন বিয়ে )।
একই ধরনের আপত্তি তোলা হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে বিমুখতা নয়, “আকর্ষণ”-ই স্বাভাবিক। তাঁর তত্ত্ব মতে অজাচার নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন দেখা দেয় যেহেতু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকে পড়ে অজাচারের প্রতি। অজাচার জন্ম দিতে পারে দ্বন্দ্ব- সংঘাতের; একারণেই অজাচার সকল সমাজে নিষিদ্ধ। ফ্রয়েড এ প্রসঙ্গে টেনে এনেছিলেন পিতৃ-হত্যা প্রসঙ্গ: তাঁর মতে, মাতাকে যৌনভাবে পেতে চাওয়ার উদ্দেশ্যেই আদিযুগে পিতাকে হত্যা করা হয়। পিতাকে হত্যা করার অপরাধ বোধ থেকেই অজাচার প্রথার জন্ম।
বিংশ শতকের নৃবিজ্ঞানে অজাচারের কারণসমূহ খোঁজার প্রচেষ্টা ভিন্ন মোড় নিয়েছিল। গবেষকগণ সমাজত্ত্বীয় (sociological) ব্যাখ্যা খোঁজেন। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তাঁরা জৈবিক, মনোবৈজ্ঞানিক অথবা বিবর্তনবাদী যুক্তি উপেক্ষা করেন। নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কি এবং অন্যান্যদের মতে, অজাচার নিষেধাজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বিধি-নিষেধগুলো পালন না করা হলে একক পারিবারিক সম্পর্ক – বিশেষ করে কর্তৃত্বের সম্পর্ক – চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। অথবা, যদি এ ধরনের যৌনমিলনের ফলে সন্তান জন্মায় তাহলে জ্ঞাতি পদাবলী ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু সমালোচকরা এই তত্ত্বের ত্রুটি দেখিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। তাঁদের কথা হল, কর্তৃত্ব-সম্পর্কের ভাংচুর অথবা জ্ঞাতি পদাবলীর ওলট-পালট এ সব তো পরের ব্যাপার। ম্যালিনোস্কি মূলত যা বলতে – চেয়েছেন তা হ’ল, একক পরিবার গড়ে উঠেছে অজাচার নিষেধাজ্ঞা থেকে। এবং সেক্ষেত্রে, মৌলিক এবং কেন্দ্রীয় প্রশ্ন থেকেই যায়, কেনই বা অজাচার নিষিদ্ধ?
আরও দেখুনঃ