Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

অবস্থান্তরের আচার

অবস্থান্তরের আচার

আজকের আলোচনার বিষয় অবস্থান্তরের আচার – যা ধর্ম : মিথ ও আচার এর অর্ন্তভুক্ত, বিভিন্ন ধরনের আচারের মধ্যে একটা বিশেষ শ্রেণীর আচার নৃবিজ্ঞানীদের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেছে যেগুলোকে বাংলায় অবস্থান্তরের আচার (rites of passage) বলা যেতে পারে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে, এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় উপনীত হয়, বদলে যায় তার সামাজিক ভূমিকা বা পরিচিতি।

এই অবস্থা বদলের সময়গুলোতে – শিশুর নাম করণ, একজন নারী বা পুরুষের বিয়ে, ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ, ইত্যাদি বহু উপলক্ষে–বিভিন্ন যেমন, একটা আচার পালন করা হয়। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী ভ্যান গেনেপ প্রথম লক্ষ্য করেন যে, বিভিন্ন সমাজে পালিত অবস্থান্তরের আচারসমূহের কিছু সাধারণ কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

অবস্থান্তরের আচার

 

 

এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উপনীত হওয়ার মাঝপথে কিছু সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মধ্যবর্তী একটা অবস্থা পেরুতে হয়, যেখানে তার বা তাদের অবস্থা, ভূমিকা, পরিচিতি কিছুটা দ্ব্যর্থবোধক–ঠিক এখানেও না ওখানেও না এমন একটা অবস্থা। গায়ে হলুদ হচ্ছে, এমন একজন নারী ঠিক আর দশটা অবিবহাতি নারীর মত নয়, তবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিবাহিতা হিসাবেও গণ্য করা যায় না।

কিছু সময়ের জন্য এই যে একটা মধ্যবর্তী অবস্থা পেরুতে হয়, সেটাকে liminal stage হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে (liminal কথাটি এসেছে limen থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে দ্বারপ্রান্ত বা দোরগোড়া–ঘরে ঢোকার মুখে বা ঘর থেকে বেরুনোর পথে দরজার চৌকাঠের নীচের যে অংশ আমরা পেরুই–যেটা ঠিক ঘরের ভেতরেও না, পুরোপুরি বাইরেও না)।

ভ্যান গেনেপ লক্ষ্য করেন যে, যে ব্যক্তিকে ঘিরে অবস্থান্তরের আচার পালিত হয়, তাকে প্রথমে প্রতীকী ভাবে প্রাথমিক অবস্থা (initial stage) থেকে বিযুক্ত বা বিচ্ছিন্ন করা হয়, এধরনের প্রতীকী কর্মকান্ড হল বিচ্ছিন্নকরণের আনুষ্ঠানিকতা (rites of separation)। পরবর্তীতে নূতন অবস্থায় প্রবেশকে চিহ্নিত করার জন্য সম্পন্ন হয় আরো কিছু প্রতীকী কর্মকান্ড, বরণমূলক বা পুনরেকত্রীকরণের আনুষ্ঠানিকতা (rites of reintegration), যেগুলোর পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উপনীত হয় চূড়ান্ত অবস্থায় (final stage), যখন নূতন একটি ভূমিকা বা পরিচয়ে সে আবার সমাজ জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহে শামিল হতে পারে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিচ্ছিন্নকরণের আনুষ্ঠানিকতার পর পুনরেকত্রীকরণমূলক আনুষ্ঠানিতা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অবস্থান করে মধ্যবর্তী অবস্থায় (liminal stage), যেখানে তাকে আহার-পরিধান-চলন- বলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। অবস্থান্তরের আচার অনেক সময় দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যেখানে বহু ব্যক্তি একই সাথে নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উপনীত হয়।

অনেক সমাজে একই গ্রাম বা এলাকায় বসবাসরত একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমার কিশোর-কিশোরীদের ঘিরে কিছু আচার (initiation rites) পালিত হয়, যেগুলোর শেষে তারা সমাজে প্রাপ্তবয়স্কের মর্যাদা পায়। যেমন, পূর্ব আফ্রিকার কাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের আচারের অংশ হিসাবে একটা নির্দিষ্ট বয়সের কিশোরদের নির্ধারিত একটা দিনে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাদের সবাইকে নগ্ন অবস্থায় রেখে মাথা ও শরীরের অন্যান্য স্থানের চুল কামিয়ে ফেলা হয়, এবং এরপর তাদের সবার খত্না করা হয়। এভাবে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে কিশোররা আবার যখন গ্রামে ফেরে, তখন তাদের সবার নূতন নাম থাকে, তারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের জন্য অনুমোদিত সকল কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারে।

দলীয় অবস্থান্তরের আচারের মধ্যবর্তী অবস্থা চলাকালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সাম্য, সহমর্মিতা ও যৌথতার নিবিড় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নৃবিজ্ঞানী ভিক্টর টার্নার এই অবস্থাকে কমিউনিটাস (communitas) হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। হজ্জ্ব পালনরত বা পুণ্যস্নানে সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন একই বেশে একই আচারে অংশ নেয়, তখন তাদের সকলের মধ্যে একধরনের যুথবদ্ধতা ও সরল মানবিক চেতনার ব্যাপ্তি বিরাজ করে।

 

 

এই অবস্থাই হল কমিউনিটাস। যে কাগুরু কিশোররা একই সাথে নগ্ন ও মুন্ডিত অবস্থায় বয়োপ্রাপ্তির আচারে অংশ নিচ্ছে, তারা সবাই সাময়িকভাবে হলেও একই সামাজিক তলে অবস্থান করছে, তাদের মধ্যে সামাজিক পার্থক্যের চাইতে মিল ও সমতাই বেশী প্রকট হয়ে দেখা দেয়। টার্নার মনে করেন, অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক অসম কাঠামোর বিপরীতে ক্ষণস্থায়ীভাবে হলেও সাম্য, সহমর্মিতা ও যৌথতার একটা প্রতি-কাঠামো তৈরী করা।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version