Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন

আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন

আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন

আজকের আলোচনার বিষয় আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন – যা  বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন এর অর্ন্তভুক্ত, নৃবিজ্ঞানীদের মতে আফ্রিকাই বয়স ভিত্তিক বিভাজনের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। এখানেই নানাবিধ ধরনে বয়সের সংঘ ধরা পড়েছে নৃবিজ্ঞানীদের কাছে। ই. ই. ইভান্স প্রিচার্ড নুয়ের সমাজের বয়স বিভাজন নিয়ে আলোচনা করেছেন (১৯৪০)। প্রিচার্ডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সমস্ত সাহারার দক্ষিণে অবস্থিত পূর্ব আফ্রিকার নুয়ের সমাজে যে কোন পুরুষের সঙ্গে অন্য সকল পুরুষের অবস্থানের তুলনা চলে। আর সেই তুলনাটা চলে বয়োজ্যেষ্ঠতা, সমবয়স এবং বয়োকনিষ্ঠতা দিয়ে।

এভাবেই নুয়ের সমাজের একদম ভিত্তির ব্যাপার এটা। নতুন বর্গে অভিষেক ঘটানো কোন কাগজে-কলমে লেখাপড়ার ব্যাপার নয়। একজন ছেলে তাঁর বাবার কাছ থেকে কিংবা চাচার কাছ থেকে যদি কোন অস্ত্র লাভ করেন, তাহলে এর মধ্য দিয়ে তিনি যোদ্ধাতে পরিণত হন। তাঁকে যদি একটা ষাঁড় দেয়া হয় তিনি রাখাল বা পশুচারক হয়ে যান। এভাবে তিনি বয়স্ক পুরুষ হবার স্বীকৃতি পেলেন।

 

 

আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন

একবার যখন তিনি এই কাজে অভিষিক্ত হলেন, সারা জীবনই সেই বয়স বর্গের সদস্য হয়ে রইলেন। তাঁর এই নতুন মর্যাদার কারণে তিনি কোন প্রশাসনিক কিংবা রাজনৈতিক-সামরিক কর্তৃত্ব পেলেন না, কিন্তু স্বীকৃতি পেলেন। কেবল একটা নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে যে, তিনি দুধ দোয়াতে পারবেন না। এ ছাড়া তিনি ঘর- গেরস্থালির কাজে অংশ নেবেন কতটা তাও খুবই শিথিলভাবে বলা থাকে।

অন্তত তাঁর বিয়ে অব্দি। কিছু নীতিমালা অবশ্যই থাকে। যেমন: কোন পুরুষ তাঁর সমবয়সী দলের কোন সদস্যের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করতে পারবেন না, কোন সম্পর্ক রাখাও সম্ভব নয়। যেহেতু মেয়েটি তাঁর ‘মেয়েতুল্য’। পুরুষ হয়ে ওঠার সাথে সাথেই কারো আচার-আচরণ এবং খাবার দাবারের কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তন হবে। এটা তাঁকে কোন সুযোগ দেবার জন্য নয়, নিয়ম।

বিস্তারিত বয়স বিভাজনের প্রসঙ্গে পূর্ব নাইজেরিয়ার আফিকপো ইবো-দের কথা বলা যায়। সেখানে প্রত্যেকটা আফিকপো গ্রামে পুরুষদের একটা সংগঠন দেখা গেছে ওগো। সকল বয়োপ্রাপ্ত পুরুষরা সমাজের সকল ধর্মীয়, নৈতিক এবং মনোরঞ্জনের অনুষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। একই সঙ্গে তাঁরা গ্রামবাসীর আচার-আচরণের নীতিমালাও বানিয়ে থাকেন। এই সমাজে বয়স সেটও বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। একই গ্রামে মোটামুটি তিন বছরের ব্যবধানে যাঁরা জন্মেছেন তাঁদের নিয়ে এই সেট গঠিত। নারী এবং পুরুষদের সেট আলাদা, তবে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে থাকেন।

এই সেটগুলোর একেবারে স্বতন্ত্র দায়িত্ব পড়ে যখন কোন ভোজ বা উৎসব দেখা দেয়। বয়স বর্গ হচ্ছে এই ধরনের বয়স সেটের একটা সম্মিলিত রূপ। এর অনেকগুলি সামাজিক-অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব আছে। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং জবাবদিহিতার সম্পর্ক রয়েছে এই বয়স বর্গের সদস্যদের। বয়স সেট সাধারণভাবে গ্রামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, আর বয়স বর্গ গ্রামের এবং অনেক গ্রামের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। নারীদের বয়স সেটগুলোকে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল বলে মনে করেছেন গবেষক নৃবিজ্ঞানীরা। কিশোরী মেয়েদের সমবয়সী দল আছে। তবে সাধারণত বিয়ের পর বিবাহিত মেয়েদের সমবয়সী সংঘই তৎপর। ১৯৪০ সাল থেকে সেখানে গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন এবং গ্রামীণ ইউনিয়নও গড়ে উঠেছে। 

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কারিমোজোং-দের বয়স সেট থেকে দেখা যায় এখানে জ্ঞাতি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কাজ করে এই সংঘ। এরা উগাণ্ডার একটা জাতি। এখানে এক একটা প্রজন্মে ৫টি করে বয়স সেট থাকে। পুরুষদের প্রজন্মের এই ৫টি বয়স সেট তৈরি হয়ে গেলেই তাঁরা তাঁদের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্তাদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয় এই প্রজন্ম বা বয়স বর্গ।

এভাবে একটি প্রজন্ম যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন. বিচার কাজ পরিচালনা করতেন – তাঁরা কার্যত অবসরপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। এই সমাজে বয়স সেটের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্বীকৃত। ব্রাজিলের শাভাক্তে জাতির মধ্যে আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলেদেরকে ‘আইবুড়োদের ঘরে’ (bachelor hut) পাঠানো হয়ে থাকে। এখানে বছর পাঁচেক কাটানোর পর তাঁরা ‘যুবক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারেন। ওই বাসস্থানে থাকতে থাকতেই শিখতে হবে কিভাবে অস্ত্র বানাতে হয়, কিংবা শিকার করতে হয়। এ রকম উদাহরণ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া সম্ভব নৃবিজ্ঞানের গবেষণা থেকে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন দেখা যায়, একটা সমাজ থেকে আরেকটা একেবারেই ভিন্ন।

নৃবিজ্ঞানের এই সব গবেষণা লক্ষ্য করলে দেখা যায় বয়স ভিত্তিক বিভাজনের বেলায় নামকরণ নিয়ে নানা বিভ্রান্তি আছে। বয়স সেট এবং বয়স বর্গ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা সবক্ষেত্রে পরিষ্কার হয়নি, | একটার সঙ্গে অন্যটার পার্থক্যও বোঝা কঠিন হয়। কোন কোন লেখায় বয়স ভিত্তিক বিভাজন না বলে | বয়স ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট। এই সব সমাজে ইউরোপীয় | শাসন আসবার পর কি ধরনের বদল ঘটেছে তা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা খুব কম নৃবিজ্ঞানী করেছেন। বিশেষত যাঁরা বয়স ভিত্তিক সংগঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন। ইউরোপের শাসনে সমাজের সর্বত্র বদলেছে।

ফলে অনুমান করা যায় বয়স ভিত্তিক সংগঠন কিংবা বিভাজনের মধ্যেও মৌলিক বদল এসেছে। এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট করেছেন আরেক নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ। তিনি সুদানের ডিংকা সমাজের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বুঝিয়েছেন। এই সমাজে গবেষণা করেন আরেক নৃবিজ্ঞানী লিয়েনহার্ট। লিয়েনহার্টের কাজ ধরে তালাল আসাদ বিশে ষণ করেছেন কিভাবে ডিংকা সমাজের বয়সের বিভাজনে ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করেছে। উপনিবেশ স্থাপনার আগে অর্থাৎ ডিংকা সমাজে বৃটিশ শাসন চালু হবার আগে এক বয়স বর্গ থেকে অন্যটায় উত্তরণ ছিল ‘পাকা হয়ে ওঠা’। এর জন্য তাঁরা একটা শব্দ ব্যবহার করতেন ‘লো তোয়েং’।

 

 

এর সামাজিক মানে ছিল অভিজ্ঞতা অর্জন – করা, জ্ঞানী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যকার ধ্যান-ধারণায় এমন পরিবর্তন ঘটেছে যে বয়স বর্গের গুরুত্ব একেবারেই আগের মত থাকল না। আর ওই শব্দটার মানে বদলে গিয়ে দাঁড়াল ‘প্রগতিশীল হয়ে ওঠা/আধুনিক হয়ে ওঠা। বয়সের দিক থেকে বুজুর্গ হয়ে ওঠার আর কোন মানে থাকল না ওই সমাজে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version