আজকের আলোচনার বিষয় একক ও একান্নবর্তী পরিবার – যা পরিবারের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত, পরিবারের ধরনের একটি শ্রেণীকরণ হচ্ছে: বর্ধিত, একক এবং একান্নবর্তী। এই বিশেষ শ্রেণীকরণ অপরাপর শ্রেণীকরণ যেমন বিবাহ-পরবর্তী বিবাহিত দম্পতির অবস্থানের শ্রেণীকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
একক ও একান্নবর্তী পরিবার
বর্ধিত- পরিবার (extended family):
নৃবিজ্ঞানীরা বর্ধিত -পরিবার সম্বন্ধে নানাবিধ সংজ্ঞা তৈরি করেছেন। এই সংজ্ঞাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, বর্ধিত -পরিবারের সংজ্ঞায়নে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন দুটো বিষয়ের উপর: কেউ কেউ এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্বারোপ করেছেন “নিকট আত্মীয়ের” উপস্থিতির উপর।

তাঁদের সংজ্ঞা অনুসারে, বর্ধিত হচ্ছে সেই পরিবার যেখানে একত্রে বসবাস করছেন একটি বিবাহিত দম্পতি, তাদের সন্তানাদি এবং নিকট আত্মীয়। অপর কিছু নৃবিজ্ঞানী বর্ধিত -পরিবারের সংজ্ঞায়নে গুরুত্ব দিয়েছেন, “প্রজন্ম”-এর উপর। তাঁদের মতে বর্ধিত- পরিবার হচ্ছে সেটি যেখানে বিবাহিত দম্পতি, তাদের বিবাহিত এবং অবিবাহিত সন্তান, আর নাতি-নাতনী একত্রে বসবাস করেন। অর্থাৎ, তিন অথবা তারও অধিক প্রজন্মের একত্রে বসবাস হচ্ছে বর্ধিত -পরিবার। সাধারণত, পাশ্চাত্যে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় লেখা নৃবিজ্ঞানের পাঠ্যবইতে বর্ধিত এবং একক পরিবার * এই দুই ধরনের পরিবারের তুলনা হাজির করা হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে একক বা ছোট পরিবার নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি–ছোট পরিবার মানেই সুখী পরিবার। স্বামী, স্ত্রী এবং একটি কিংবা ২টি সন্তান। কয়েক দশক আগেও বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী নিয়ে ছিল যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকা-খাওয়া, হই-হুল্লোড়, আনন্দ-উৎসব এর মজাই আলাদা। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। শহুরে জীবনের ঢেউ গ্রামেও লেগেছে। গ্রাম থেকেও যৌথ পরিবার উঠে যেতে বসেছে।
এক সময় গ্রাম কিংবা শহরে অনেক যৌথ পরিবার দেখা যেত। মানুষের পুকুর ভরা মাছ ছিল, ক্ষেত জুড়ে ধান ছিল, গোয়াল ভরা গাভী ছিল, যৌথ পরিবারে অনেক সুখ সাচ্ছন্দ্য ছিল। অবস্থাভেদে প্রতিটি পরিবারে সদস্য ছিল ২০ হতে ৩০ জন। কোথাও আবার তার চেয়ে বেশী। পরিবারের কর্তার আদেশ সবাই মান্য করে চলতো। ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতো। বিবাহ বিচ্ছেদ হতো কম। পৃথিবী যতো এগিয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার তত কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা ও ঐতিহ্য।
যুগের হাওয়ায় যৌথ পরিবার ভেঙে যেতে যেতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন ৩ জন কিংবা ৪ জনে এসে ঠেকেছে। তদুপরি সবাই ব্যস্ত। এখনও যখন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একান্ত আলাপচারিতা দেখি, অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্মৃতিচারণ করেন। পরিপূর্ণ আনন্দ যে ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে নিহিত, অবলীলায় সবাই স্মরণ এবং স্বীকার করেন।
এখন তো যান্ত্রিক শহর জীবনে ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দ করে বিয়ে করলেই মা-বাবা বেশ খুশি হন। দিন দিন সামাজিক রীতিনীতি বদলাচ্ছে, মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের অনুশাসন কাঠামো। মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা যত বাড়ছে, জীবন যাপনের স্বাধীনতাও ততটাই ভোগ করতে চাইছে। পরিবারগুলো ভাঙছে। সমাজও তার আদল বদলাচ্ছে। জীবন যাপনের পুরনো রীতিগুলোও পাল্টাচ্ছে।
একক পরিবারে প্রত্যেকের গোপনীয়তা রক্ষা হয়। নিজের ইচ্ছে মতো চলা যায়। আয়-ব্যয় সঞ্চয় ভবিষ্যৎ নিজের মতো রক্ষিত হয়। কিন্তু যৌথ পরিবার হলো একটি বটবৃক্ষের মতো অর্থ্যাৎ যৌথ পরিবারের সুবিধা একক পরিবারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। যৌথ পরিবার হলে বিপদে-আপদে অনেককে পাশে পাওয়া যায়। সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয় যায়।
একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের সদস্যদের সবার একে অপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, আদর স্নেহ ইত্যাদি সবসময়ই অটুট থাকে। যে কোন বিপদে আপদে কিংবা উৎসব, পালা পার্বণে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদেরই সবচেয়ে বেশি সুবিধা এবং আনন্দ হয়।
যৌথ পরিবারের শিশুরা বড় হয় বড়দের দেয়া আদর, স্নেহ, মমতা, ভালবাসা ইত্যাদি নিয়ে। পরিবারের দাদা-দাদি, চাচা-চাচীদের উপস্থিতিতে যেসব শিশু বড় হয় তাদের স্বার্থপর হওয়ার সুযোগ কম থাকে। তাদের মানসিক বিকাশ ও বন্ধন হয় সুদৃঢ়। আবার যৌথ পরিবারের সদস্যরা কখনো নিজেকে একা অনুভব করেনা অথবা কোন হীনমন্যতায় ভোগে না।
যৌথ পরিবারের যে কোন কাজ, জিনিসপত্র ইত্যাদি সকলকিছুই সদস্যদের মাঝে ভাগাভাগি হওয়ার সিস্টেম দেখে এ পরিবারের শিশুরাও ছোট থেকেই উদার মনমানসিকতা নিয়ে বড় হতে শেখে, দায়িত্বশীল হতে শেখে। তাছাড়া, পারিবারিক সাপোর্ট বেশী থাকায় যৌথ পরিবারের চাকুরিজীবী মায়েদের জন্য অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
মানুষের আশা-আকাংখা, বেড়ে ওঠা সবকিছু ছিল সামগ্রিকভাবে পরিবার কেন্দ্রিক। যৌথ পরিবারে যে কোন সদস্যের চাহিদা পূরণ ছিল পারিবারিক সিদ্ধান্ত। নিজের সন্তানের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসত পরিবারের প্রধানের কাছ থেকে। দাদা, চাচা, মা, চাচী, চাচাত ভাইবোনরাও সমান অংশীদার ছিল পরিবারের যে কোন ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে। একে অপরের সাথে আলাপ আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।
পরিবারের যৌথ কাঠামো এই সামাজিক বন্ধন ও নৈতিক বন্ধন দৃঢ় করতো। বড়দের মান্য করা, প্রত্যেক সম্পর্ককে সম্মান করা, এসব কিছুই তারা শিখতো গুরুজনদের কাছ থেকে। সেই পারিবারিক সম্পর্ক এখন দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে। এখন চারপাশে জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। ফলে অসুখী দাম্পত্য জীবন, সন্তানের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে, চাওয়া-পাওয়া আর উন্নতির চক্রে ঘুরছে সবকিছু। পরিবার থেকে সন্তানরা সামাজিক অনুশাসন মূল্যবোধ না শিখায় ভাল মন্দ বুঝতে পারছে না।
ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালামের মতে,’যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন- বাবা, মা এবং শিক্ষক।’ বর্তমানে অনেক বাবা মা আত্মীয়-স্বজন থেকে আলাদা থাকার মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে চলেছেন। কতটা বোকা চিন্তা ভাবনা! আধুনিকতা মানেই নিসঙ্গতা নয়। একা একা যদি বসবাস করতে চান, তবে রবিনসনের মতো নির্জন দ্বীপে বসবাস করা শ্রেয়।
পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে চলে যাওয়ায় অভদ্রতা, অসম্মান করা আধুনিক ও স্মার্টনেস জ্ঞান বলে মনে করছে। ভদ্রতা, সম্মান করা এই সকল বিষয় পরিবারের কাঠামো দাদা-দাদী, ফুপু, চাচা-চাচীদের কাছ থেকে শিখবে। কিন্তু যৌথ থেকে একক পরিবারে রুপান্তরিত হওয়ার কারণে শিশুটি কাজের মানুষটির কাছে সার্বক্ষনিক থাকায় কিছুই শিখতে পারছে না। তাই শিশুর আদর্শিক জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন যৌথ পরিবার। আসলে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছি যৌথ পরিবারের সুবিধা ও ঐতিহ্য। শুধু মনে করিয়ে দেয় আমাদের সোনালী অতীত।
আরও দেখুনঃ