আজকের আলোচনার বিষয় বর্তমান বাংলাদেশে কৃষকদের অর্থনৈতিক দশা – যা কৃষক আর্থব্যবস্থা এর অর্ন্তভুক্ত, একদিকে, কৃষক নগদ বিক্রির জন্য ফসল উৎপাদন করছেন। সারা পৃথিবীতে এই পরিবর্তন কৃষকদের কোন স্বনির্ভর ব্যবস্থা চালু রাখেনি। অন্যদিকে, বিশেষভাবে বাংলাদেশের কৃষকেরা উৎপাদনের বিনিময়ে খুব সামান্য জিনিস যোগাড় করতে পারেন। তা দিয়ে কোনমতেই জীবন নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের কৃষকদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার প্রশ্ন। যে প্রক্রিয়ায় কোন সামাজিক গোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে সহায়-সম্পদহীন হয়ে পড়ে তাকে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া বলে। বাংলাদেশের কৃষকেরা খুব দ্রুত নিঃস্ব শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছেন।
বর্তমান বাংলাদেশে কৃষকদের অর্থনৈতিক দশা
কৃষকদের নিয়ে যে সকল গবেষক কাজ করেছেন তাঁরা আর্থিক অবস্থা ও সম্পদ বিবেচনা করে কৃষকদের মোটামুটি ৪ ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হচ্ছে: ধনী কৃষক, মধ্য কৃষক, গরিব বা ক্ষুদ্র কৃষক এবং নিঃস্ব কৃষক। বুঝবার সুবিধার জন্য খোরাকী ধরে এগোনো যেতে পারে। ধনী কৃষকদের জমি থেকে যে পরিমাণ ফসল বা আয় আসে তা সারা বছরের প্রয়োজন থেকে উদ্বৃত্ত। মধ্য কৃষকদেরও সারা বছরের খোরাকী জমি থেকেই আসে। কেবল তাই নয় ধনী কৃষকদের আয়ের উৎস কেবলমাত্র জমি নয়। এদের অনেকেরই নানারকম ব্যবসা বাণিজ্যে টাকা লগ্নী করা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সেসব ব্যবসা কৃষি সংক্রান্ত।
যেমন, সার, কিটনাশক কিংবা সেচের ব্যবসা। আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্য নানান ধরনের ব্যবসা। এর মধ্যে সুদে টাকা খাটানোর কাজও আছে। ফলে এই বর্গের কৃষকদের কৃষিক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বা অন্য কোন বিপর্যয়ের শিকার হতে হয় না। ধনী কৃষক কিংবা মধ্য কৃষকেরা জমিতে সরাসরি শ্রম দেন না। বরং তাঁরা জমি বর্গা কিংবা বন্ধক দেন অন্যান্য কৃষকদের।
সাধারণভাবে গরিব কৃষকেরা, কখনো কখনো মধ্য কৃষকেরা এইসব জমি বর্গা বা বন্ধক নিয়ে থাকেন। গরিব কৃষকেরা জমিতে নিজেদের শ্রম সরাসরি প্রয়োগ করে থাকেন। আর নিঃস্ব কৃষকদের এমন কোন পুঁজি হাতে থাকে না যা দিয়ে তাঁরা জমি বর্গা নিতে পারেন। তাঁরা আসলে কৃষিক্ষেত্রে কামলা খাটেন। বাংলাদেশের সরকারী নথিতে এবং অন্যান্য সাহিত্যে এঁদেরকে ভূমিহীন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে সিংহভাগ এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। এঁদের সংখ্যা নিয়ে সরকারী নথি এবং গবেষকদের হিসেবের মধ্যে বিরাট গরমিল আছে। কিন্তু এটা প্রায় পানির মত পরিষ্কার যে দিন দিন এই ধরনের কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে।
জমির কাজে শ্রম দেবার বিষয়টা ভাবলে কৃষকের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি হয়। জমির মালিক হলেই কি তাঁকে কৃষক বা চাষী বলা যাবে? বাংলাদেশের গ্রামে একটা কথা চালু আছে: ‘চাষা যে চাষ করে।’ সেই হিসেবে গরিব এবং নিঃস্ব বা ভূমিহীন কৃষকেরাই হচ্ছেন চাষী। দিন দিন এই বর্গের কৃষকের সংখ্যাবৃদ্ধি থেকে এট বোঝা যায় যে কৃষিক্ষেত্রে যে সকল নীতিমালা চালু আছে তা কৃষকের স্বার্থের বিপক্ষে। বাংলাদেশের গ্রামে কামলা খাটার কাজও এখন অনেক সীমিত। ফলে গ্রামের ভূমিহীন কৃষকদের বিশাল দল প্রতিবছর শহরে পাড়ি জমায়। এইসব নিঃস্ব কৃষকেরা শহরে নানারকম পেশায় নিয়োজিত থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে চলেছেন।
যেমন, রিক্শা চালানো, ছোট পান বিড়ির দোকান চালানো, কাগজ কুড়ানো, নানাবিধ খুচরা কামলা খাটার কাজ, ইদানিং কালে নির্মাণ শ্রমিক ইত্যাদি। শহরে এইসব পেশা খুবই অনিশ্চিত। কিন্তু নিরুপায় ভূমিহীনদের আর কোন অবলম্বন নেই। বাংলাদেশের সরকারসমূহ সব সময় আশ্বাস দিয়ে এসেছে যে সরকারী খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি বণ্টন করে দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ কখনোই নেয়া হয়নি। উপরন্তু এজমালি যে জলাশয়গুলি মৎস্যজীবীদের একটা ভরসার জায়গা ছিল, বাংলাদেশে গত কয় বছরে সেগুলোও লীজ দেয়া হচ্ছে। ভূমিহীন কৃষকেরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় রুখে দাঁড়িয়েছেন।
পরবর্তী ইউনিটে (দেখুন ৭ নম্বর ইউনিটের ৪ নম্বর পাঠ) এ নিয়ে আলোকপাত করা হবে। যে সকল ভূমিহীন গ্রামে আছেন তাঁদের মধ্যে এনজিও নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিঃস্ব কৃষকদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে একটা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গড়ে তোলা। প্রধানত কুটির শিল্প ভিত্তিক কাজ এতে হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ব্র্যাক, আশা, প্রশিকা ইত্যাদি এনজিও’র কথা বলা যায়। দেশী এ সকল এনজিও’র পাশাপাশি বিদেশী অনেক এনজিও এই একই কাজ চালাচ্ছে।
আরও দেখুনঃ