Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

গারো জনগোষ্ঠী পরিচিতি

গারো জনগোষ্ঠী পরিচিতি

আজকে আমরা আলোচনা করবো গারো জনগোষ্ঠী পরিচিতি নিয়ে। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে গারোরা, অন্তত নামে, বেশ সুপরিচিত। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় সাঁওতাল, কোল আর ভিলের পাশাপাশি ‘গারো” নামটি জুড়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ কবিতার মিলের খাতিরে ‘গারো’ নামটি ব্যবহার করা হয়ে থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট থেকে এটা বোঝা যায় যে, যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বাঙালি মানসে বিশেষ অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে, গারোরাও তাদের মধ্যে রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীকেই নজরুল আক্রমণ করেছিলেন।

গারো জনগোষ্ঠী পরিচিতি

 

ওই কবিতার বাণী ছিল, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই”। যাহোক, যে বিষয়টা এখানে প্রাসঙ্গিক, তা হল, গারো নামে অভিহিত জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেরা নামটি পছন্দ করেন না। ‘গারো’ শব্দের সুনির্দিষ্ট কোন নেতিবাচক অর্থ না থাকলেও বাঙালীদের দৃষ্টিতে তথাকথিত ‘আদিম’ জনগোষ্ঠীদের তালিকায় এই নাম বেশ আগে থেকে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণেই হয়তবা বাইরে থেকে |

চাপিয়ে দেওয়া নামটি নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের গারোদের অনেকের আপত্তি। তাঁদের অনেকেই অধুনা নিজেদের ‘মান্দি’ নামেই পরিচয় দেন। আক্ষরিক অর্থে ‘মান্দি’ অর্থ ‘মানুষ’। নিজেদের ভাষায় গারোরা নিজেদের অভিহিত করেন ‘আচিক মান্দি’ বা ‘পাহাড়ের মানুষ’ হিসাবে। সে সূত্রে সংক্ষেপে শুধু ‘মান্দি’ নামেই গারোদের আধুনিক পরিচিতি গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চলে গারো বা মান্দি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এছাড়া সিলেটসহ অন্যান্য জায়গায়ও কিছু সংখ্যক গারো রয়েছে। যেসব জেলায় গারো জনবসতি রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর ও নেত্রকোণা এবং সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভী বাজার।

১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুসারে বাংলাদেশে গারো জনসংখ্যা ছিল চৌষট্টি হাজারের কিছু উপরে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এক লক্ষের মত ছিল বলে গারোদের অনেকে মনে করেন এবং ওয়াকেবহাল গবেষকরাও সে অনুমান সমর্থন করেন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গারো জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের আবাস। ভৌগোলিক গুরুত্বের দিক থেকে মেঘালয়ের পূর্বাংশে অবস্থিত তুরা শহরকে গারো জনগোষ্ঠীর ‘রাজধানী’ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। বাংলাদেশের গারোদের তুলনায় ভারতে বসবাসরত গারোরা শুধু সংখ্যায় বেশী তাই নয়, শিক্ষা দীক্ষায়ও তারা তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে আছে।

যেমন, ভারতীয় লোকসভার একজন স্পিকার পি. সাংমা ছিলেন একজন গারো। অবশ্য বাংলাদেশেও গারোদের মধ্য থেকে একজন সাংসদ হয়েছেন (প্রমোদ মানখিন, ১৯৯১-৯৬), এবং আশা করা যায় যে পরেও কেউ না কেউ হবেন। এদেশের গারোদের মধ্যে শিক্ষার হার একেবারে খারাপ নয়, অল্পসংখ্যক শিক্ষিত গারো ব্যক্তি বিভিন্ন মর্যাদাশীল পদেও কর্মরত রয়েছেন। তবে সার্বিকভাবে এদেশের গারো জনগোষ্ঠী বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও আর্থসামাজিক সংকটের সাথে মোকাবেলা করেই টিকে আছে।

 

 

গারো জনগোষ্ঠী অধ্যায়ের সারাংশ:

যা গারো জনগোষ্ঠী এর অর্ন্তভুক্ত, বৃহত্তর ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চলসহ আশে পাশের আরো কিছু এলাকা জুড়ে বাংলাদেশে আনুমানিক প্রায় এক লক্ষ গারো বসবাস করে। গারোরা নিজেদেরকে ‘মান্দি’ হিসাবে অভিহিত করতেই বেশী পছন্দ করে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে গারোরা বহু শতাব্দী ধরে বাস করছে।

ঔপনিবেশিক ও সামন্ত শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তারা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছে, তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও এদেশের গারোরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। গারো সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তাদের প্রথাগত মাতৃসূত্রীয় জ্ঞাতি ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় সন্তানরা মাতৃকুলের সদস্য বলে বিবেচিত হয় এবং মায়েদের গোত্র-পদবী ব্যবহার করে।

এছাড়া গারো সমাজে প্রথাগতভাবে পুরুষরা বিয়ের পর স্ত্রীর পরিবারে বা স্ত্রীর গ্রামে নূতন বাসস্থানে থাকতে যেত, এবং পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা পারিবারিক সম্পত্তির মূল উত্তরাধিকারী হিসাবে গণ্য হত। তবে সময়ের প্রবাহের এসব প্রথাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে।

গারোদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক প্রসার। তাদের মধ্যে সাক্ষরতার হারও অনেক বেড়েছে, এবং কৃষি-নির্ভর গ্রামীণ জীবন ছেড়ে অনেকে শহরাঞ্চলে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।

 

 

গারোদের ইতিহাস

 

যারা গারো জনগোষ্ঠী এর অর্ন্তভুক্ত, প্রায় এক হাজার বছর বা তারও আগে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে গারো পাহাড়ের পাদদেশে গারোদের পূর্বসূরীরা বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিল বলে অনুমান করা হয়। সুভাষ জেংচাম লিখিত ‘বাংলাদেশের গারো সম্প্রদায়’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে সুসং দুর্গাপূরে গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যেখানে গারো রাজা ও দলনেতাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।

ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ গারো জনবসতি ঢাকা জেলার সাভার, ধামরাই, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর; টাংগাইল জেলার বাসাইল, কালিহাতি, ঘাটাইল প্রভৃতি এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। তবে মোগল আমলে গারোদের পশ্চাদপসারণ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি আরো সংকুচিত হয়ে পড়ে।

ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে গারোরা প্রতিবেশী অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সাথে মিলে বিক্ষিপ্তভাবে শতবর্ষ ধরে বিদ্রোহ ও সংগ্রাম চালিয়েছিল (১৭৭৫-১৮৮২)। গারোদের এই প্রতিরোধ ও সংগ্রামে প্রথমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছপাতি নকমা নামের একজন গ্রাম প্রধান। পরবর্তীতে এক পর্যায়ে শেরপুর অঞ্চলের করম শাহ নামক একজন ফকিরের প্রচারিত বাউল ধর্মমতও জমিদারদের শাসন-শোষণে পিষ্ট অনেক গারোদের সংগঠিত করতে সহায়তা করেছিল।

ব্রিটিশ শাসকরা সামরিক অভিযান চালিয়ে, অত্যাচার নির্যাতনের মাধ্যমে, অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গারোদের সশস্ত্র সংগ্রামকে দমন করেছিল, তবে তাদের মুক্তিকামী চেতনাকে চিরতরে ধ্বংস করতে পারে নি। তারই প্রমাণ আমরা পাই ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, যে যুদ্ধে গারোরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নিয়েছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

গারোদের মাতৃসূত্রীয় জ্ঞাতি ব্যবস্থা

 

মাতৃসূত্রীয় জ্ঞাতি ব্যবস্থা – যা গারো জনগোষ্ঠী এর অর্ন্তভুক্ত, গারোদের একটি সামাজিক বৈশিষ্ট্য তাদেরকে অনন্যতা দিয়েছে, সেটা হল তাদের ‘মাতৃসূত্রীয়’ জ্ঞাতি ব্যবস্থা (matrilineal kinship system ) । বাংলাদেশে গারোরা ছাড়া একমাত্র খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুরূপ ব্যবস্থা বিদ্যমান। গারোদের ‘মাতৃসূত্রীয়’ জ্ঞাতি ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়ার আগে এখানে প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার।

বইপত্রে গারো সমাজকে ‘মাতৃতান্ত্রিক” হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তবে মাতৃতন্ত্রের (matriarchy) ধারণা ব্যবহারে কিছুটা বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায়, বিশেষ করে এটিকে পিতৃতন্ত্রের (patriarchy) বিপরীত হিসাবে গণ্য করা হলে। পিতৃতন্ত্র বলতে শুধু এটাই বোঝায় না যে সন্তানদের বংশ পরিচয় পিতার সূত্রে নির্ধারিত হয়, বরং পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পারিবারিক পরিসরে পিতার থাকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এবং সমাজে সাধারণভাবে নারীদের উপর পুরুষদের কর্তৃত্ব স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত।

ঠিক এর বিপরীত অবস্থা কোন সমাজে পরিলক্ষিত হয় নি যেখানে সমাজের সর্বস্তরে পুরুষদের উপর নারীরা কর্তৃত্ব করে। বরং ‘যোদ্ধা”, “গ্রাম-প্রধান’ প্রভৃতি ভূমিকায় পুরুষদেরই সচরাচর দেখা যায়। কাজেই এই সমস্ত বিষয় বিবেচনায় নিলে গারো বা অন্য কোন বিদ্যমান সমাজকে ‘মাতৃতান্ত্রিক’ হিসাবে অভিহিত করা যথার্থ নয়।

মাতৃসূত্রীয় বা মাতৃকুলক্ৰমিক জ্ঞাতি ব্যবস্থায় সন্তানদের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয় মায়ের সূত্রে। নামের শেষে ‘সাংমা’, ‘রেমা’, ‘মানখিন’, ‘দ্রং’ প্রভৃতি উপাধি প্রচলিত। এই উপাধিসমূহ মূলতঃ গোত্রবাচক। প্রথাগতভাবে গারোদের সকলের কাছে মাতৃকুলের পরিচয়টাই অগ্রগণ্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজন গারো নামের শেষে ‘সাংমা’ লিখবে, যদি তার মা ‘সাংমা’ হয়ে থাকে। গারো ভাষায় মাতৃকুলকে বলা হয় ‘মাহারি’। জন্মের পর সন্তানরা মায়ের মাহারির সদস্য বলে গণ্য হয়। একই মাহারিতে বিয়ে নিষিদ্ধ। প্রথাগতভাবে গারো মেয়েরা বিয়ের পরে নিজের বাড়ি বা গ্রামেই বসবাস করত, তাদের স্বামীরা নিজ মাতৃকুল ও গ্রাম ছেড়ে স্ত্রীদের সাথে ঘর করতে আসত।

এই প্রথা পালনের ব্যাপারে আধুনিক গারোদের অনেকের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করা গেলেও তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। গারোদের মাতৃসূত্রীয় জ্ঞাতি ব্যবস্থার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত। প্রথাগতভাবে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসাবে মেয়েদের মধ্যে একজনকে (সাধারণত সর্বকনিষ্ঠা কন্যা) নির্বাচিত করা হত, গারো ভাষায় যাকে ‘নকনা” বলা হয়। তবে পারিবারিক সম্পত্তির উপর নকনার প্রথাগত অধিকারকে ঠিক ‘ব্যক্তি মালিকানা’ হিসাবে দেখা যায় না, বরং তাকে দেখা যায় সে সম্পত্তির ‘হেফাজত-কারী” হিসাবে।

যাহোক, এই প্রথার সুযোগ নিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালীদের কেউ কেউ গারো মেয়ে বিয়ে করে তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়। এ ধরনের সমস্যাসহ নূতন প্রজন্মের গারোদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে ‘নকনা’ প্রথা কিছুটা শিথিল হয়েছে। তবে বিভিন্ন পরিবর্তন সত্ত্বেও গারো সমাজের মাতৃসূত্রীয় কাঠামো এখনো বহাল রয়েছে, এবং এই সমাজে নারীরা ঠিক পুরুষদের উপর কর্তৃত্ব না করলেও তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট মর্যাদা ও স্বাধীনতা ভোগ করে।

 

গারোদের সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক অবস্থা

 

যারা গারো জনগোষ্ঠী এর অর্ন্তভুক্ত, ভাষাবিজ্ঞানীদের শ্রেণীকরণ অনুসারে গারোদের ভাষা তিব্বতী-বর্মী ( Tibeto- Burman ) ভাষা পরিবারের ‘বোড়ো-গারো’ শাখার অন্তর্গত। কোচ, হাজং, রাজবংশী প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর আদি ভাষা থেকে শুরু করে বোড়ো, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর ভাষাও এই শাখার অন্তর্গত।

বাংলাদেশের গারোরা এখনো তাদের মাতৃভাষা ধরে রেখেছে, যদিও এর চর্চা মূলতঃ কথ্যরূপেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য এদেশে খুব সীমিত আকারে গারো ভাষার লিখিত চর্চাও রয়েছে, তবে এক্ষেত্রে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাবে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতই গারোরাও প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার শিকার। অবশ্য সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোণার বিরিশিরিস্থ ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী’ এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখছে।

এছাড়া বহু বছর যাবত রেডিও বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্র থেকে গারো ভাষায় ‘সাল গিত্তাল’ (নূতন সূর্য) নামক একটি অনুষ্ঠান নিয়মিত প্রচারিত হয়ে আসছে।ঐতিহ্যগতভাবে গারোদের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল কৃষি-নির্ভর গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে ঘিরে। শহুরে প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী অনুষ্ঠানে এই ‘সনাতনী গারো সংস্কৃতি’র অনেক উপাদান এখনো নৃত্য-গীত-বাদ্য প্রভৃতির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।

তবে এ ধরনের ‘মঞ্চায়িত’ সংস্কৃতি অনেকটাই খন্ডিত, মূল থেকে বিচ্ছিন্ন বা ক্ষেত্রবিশেষে সাম্প্রতিককালে উদ্ভাবিত। নৃবৈজ্ঞানিক অর্থে ‘সংস্কৃতি’ যে অনেক ব্যাপকতর বিষয়, দৈনন্দিন জীবনের অনুশীলনে নিহিত একটি জীবন্ত, চলমান ব্যবস্থা, এ উপলব্ধি আপনার নিশ্চয় হয়েছে। কাজেই কখনো যদি টিভিতে বা মঞ্চে গারোদের ‘ঐতিহ্যবাহী কমলা-তোলা নাচ’ জাতীয় কিছু দেখেন, তাহলে একটু তলিয়ে দেখবেন আদৌ সেটা ‘ঐতিহ্যবাহী’ কিছু কিনা, বা হয়ে থাকলেও কবে কিভাবে কাদের দ্বারা সেই ঐতিহ্যের চর্চা শুরু হয়েছে।

অন্যান্য জনগোষ্ঠীদের মধ্যে যেমন, তেমনি গারোদের মধ্যেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে চলছে। অর্থাৎ গারো সংস্কৃতিও স্থির, পরিবর্তনহীন কোন বিষয় নয়। গারোদের মধ্যে সংগটিত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে ধর্মের প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্রিটিশ আমল থেকে মিশনারীদের প্রচেষ্টার সূত্রে গারোদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশের গারোদের মধ্যে অধিকাংশই বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। অল্পসংখ্যক যারা ধর্মান্তরিত না হয়ে পূর্বের বিভিন্ন বিশ্বাস ও আচার এখনো অনুসরণ করছে, গারোদের মধ্যে তারা ‘সাংসারেক’ নামে পরিচিত।

অবশ্য যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে, তারা যে সাংস্কৃতিকভাবে পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়েছে, পূর্বের কোন আচার-বিশ্বাস ধরে রাখে নি, একথা বলা যায় না। যেমন, ‘মাতৃসূত্রীয়’ গোত্র ব্যবস্থার অনেক উপাদান সমকালীন খ্রিস্টান গারোরাও এখনো ধরে রেখেছে। অতীতে গারোদের জীবিকার মূল উৎস ছিল জুমচাষ ও বনজ সম্পদ আহরণ, তবে বর্তমানে বাংলাদেশের গারোদের মধ্যে জুমচাষের প্রচলন নেই। জুমচাষের পরিবর্তে স্থায়ী চাষাবাদ, ফলের বাগান প্রভৃতির উপর অনেকে নির্ভর করে। তবে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের জের ধরে গারো-অধ্যুষিত এলাকাসমূহের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সরকারের বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন।

এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়ও গারোদের অনেকে ভূমি ও ভিটামাটি হারিয়েছে। ফলে গারোদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অবশ্য তাদের মধ্যে সাক্ষরতার বেশ প্রসার ঘটেছে, এবং সেসূত্রে অনেকে শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকায়, অভিবাসিত হচ্ছে। তবে অভিবাসী গারোদের অনেকেই মূলতঃ স্বল্প আয়ের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত – নার্স, গার্মেন্টস-কর্মী, উচ্চবিত্ত এলাকার গৃহ-কর্মী প্রভৃতি হিসাবে। অবশ্য উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত ছাত্রছাত্রী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত চাকুরিজীবীরাও কিছু রয়েছে এদের পাশাপাশি। এই অভিবাসিত গারোরা সামগ্রিকভাবে কতটা কিভাবে নূতন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে, তার উপর কিছুটা হলেও নির্ভর করবে গারো সমাজ ও সংস্কৃতির আগামী দিনের স্বরূপ।

Exit mobile version