জ্ঞাতিত্ব প্রেক্ষিতকরণ

আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্ব প্রেক্ষিতকরণ – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের বিষয়গুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে ঘিরে। এই যেমন ধরুন, বাবা-মা, বিয়ে, ঘর-সংসার, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, পরিবার, সন্তান জন্মদান, শরীরী সম্পর্ক, পিতৃ পরিচয় – আরো অনেক কিছু। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যেসব বিষয় ঘিরে গঠিত সেসব বিষয় আপনার, আমার, আমাদের সত্তা, পরিচিতি, মূল্যবোধ, দৈনন্দিন জীবন-যাপন, কার্যকলাপ, ঠিক-বেঠিকের ধারণা, নীতি-নৈতিকতা এসবকে বিশ্লেষণের খাতিরে, বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করে।

প্রেক্ষিত বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট স্থান-কাল । তার মানে, “পরিবার” এর কথা উঠলে কোন সমাজের পারিবারিক সম্পর্কের কথা বলছি, তা স্পষ্ট করা জরুরী । আবার, একই সমাজের কথা বললেও যেমন ধরুন বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ কোন – সময়কালের কথা বলছি, তার সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যিক ।

 

জ্ঞাতিত্ব প্রেক্ষিতকরণ

 

জ্ঞাতিত্ব প্রেক্ষিতকরণ

বিষয়টিকে আরো খোলাসা করি। বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে ধরুন, “বিয়ে” নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন উঠবে: কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে? বৃটিশরা এদেশে আসার আগে নাকি পরে? সাম্প্রতিককালের গবেষণায় জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের প্রায় দুইশত বছরের শাসনামলে এমন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণার সূত্রপাত ঘটায় যা এদেশের মানুষজনের জীবনধারায় (way of life বা culture) মৌলিক বদল আনে।

ঔপনিবেশিক শক্তি শুধুমাত্র অর্থনীতি বা রাজনীতির ক্ষেত্রে বদল ঘটায়নি। পরিবার, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, বিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানে বদল ঘটিয়েছে। অথবা, বিষয়টাকে এভাবে বলা যায়, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বড় ধরনের বদল ঘটিয়েছে (প্রতিষ্ঠান গঠন, নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি) যা এদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে। এবং, গভীর ও সামগ্রিক বদল করে তুলছে আবশ্যিক, অনিবার্য। এর প্রভাব এদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও প্রতিফলিত হয়েছে। এবং বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী চলে যাবার পরও তাদের প্রদত্ত ব্যবস্থা টিকে আছে।

এই প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজনীয়। প্রথমত, বৃটিশ উপনিবেশকালের প্রভাব “ভালো”, বা “মন্দ” দিয়ে বোঝা যাবে না। বিষয়গুলো অত সহজ, সরল নয়। আরো তলিয়ে দেখা, গভীরভাবে দেখা জরুরী। দ্বিতীয়ত, পরিবার, বিয়ে, বংশ-পরিচয় এ সকল বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতি বা অর্থনীতি – সম্পর্কযুক্ত।

কিন্তু মনে রাখা জরুরী যে, এই আন্তঃসম্পর্ক সহজ এবং সরল নয়, বরং জটিল। ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রত্যক্ষ। তৃতীয়ত, সমাজে যে বিভাজনগুলো বিদ্যমান, যেমন ধরুন শ্রেণী ও জাতিগত বিভাজন, আরো ধরুন, ধর্মীয় ভিন্নতা – এগুলো জ্ঞাতি সম্পর্ককে (উদাহরণস্বরূপ, বিয়ে), জ্ঞাতিভিত্তিক – প্রতিষ্ঠানকে (উদাহরণস্বরূপ, বংশ) ভিন্নতা দান করে। একই দেশের বাসিন্দা হলে কি হবে, গরিব পরিবারের সন্তানের ভূমিকা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের ভূমিকা থেকে ভিন্ন। গরিব পরিবারের সন্তান অল্প বয়স হতে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির কাজ করেন। অথবা, নিজ ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন পক্ষান্তরে, মধ্যবিত্ত সন্তান দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবারের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

একই দেশের বাসিন্দা হলে কি হবে, মান্দাই (যাদের বাঙ্গালিরা নেতিবাচক গারো নামে ডাকেন)-দের বংশধারা মাতৃসূত্রীয়, আর বাঙ্গালিদের হচ্ছে পিতৃসূত্রীয়। বাঙ্গালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কাজিন-বিবাহ নিষিদ্ধ কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে এর প্রচলন রয়েছে। আবার, বাঙ্গালি হিন্দু কি বাঙ্গালি মুসলমান, মধ্যবিত্ত শ্রেণী মাত্রই সন্তান অল্প বয়স থেকে আয়করী ভূমিকা গ্রহণ করে না। এক কথায় বললে, বিভিন্ন সূত্র (শ্রেণী, জাতি, ধর্ম) জ্ঞাতিসম্পর্ককে ভিন্নতা, আবার সমরূপতা দান করে। আবার একই সাথে লক্ষ্যণীয়, শ্রেণী, জাতি, ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও, গড়ে সকল জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা, তাদের নিজ জনগোষ্ঠীর নারীদের তুলনায় ক্ষমতাশালী।

এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বদল রাতারাতি ঘটে না, আবার সকল ক্ষেত্রে একইভাবে বা সমভাবে বদল ঘটে না। চতুর্থত, জ্ঞাতিসম্পর্ক অনড়, অটল, অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। এগুলো বদলায়। বদলের ধরন কি তা অনুসন্ধানযোগ্য। অনুসন্ধান না করে ঢালাও ভাবে কিছু বলা ঠিক নয়। এসব বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে পরবর্তী পাঠগুলোতে আলোচিত হবে।

কথা হচ্ছিলো জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে যেসব বিষয় পঠিত তা কিভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, আমাদের সত্তা, আত্ম-পরিচিতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে বিজড়িত। এই বিজড়ন বিষয়গুলো বোঝার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সমস্যা তৈরী করতে পারে। ধরুন, একজন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী যখন তাঁর বিষয় নিয়ে কথা বলেন, তখন তার কথা আমরা নিরঙ্কুশ ভাবে মেনে নেইনি। তিনি ইলেকট্রন, প্রোটনের সংজ্ঞা দিতে চাইলে তাঁর সাথে আমরা বিতর্কে নামি না।

ধরে নিই তিনি যা বলছেন তা বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান এবং সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞান স্বল্প, সীমিত। কিন্তু সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জ্ঞাতি সম্পর্ক বিষয়াদির ক্ষেত্রে, যেহেতু আমরা সকলেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, অথবা জন্মগ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে করি এবং নির্দিষ্ট পারিবারিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, আমরা নিজের বা নিজেদের ধারণা, নিজের বা নিজেদের কার্যকলাপ ঠিক এবং সবচাইতে গ্রহণযোগ্য, স্বাভাবিক বলে মনে করে থাকি।

 

জ্ঞাতিত্ব প্রেক্ষিতকরণ

 

ভিন্ন ধরনের কিছু শুনলে আমরা ধাক্কা খাই, হয়তো বা আতঙ্কিত হই। ধরুন, “বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব তার মায়ের”; “মায়ের স্নেহ, পরিচর্যা না পেলে বাচ্চা হয় বেয়াড়া অথবা রুগ্ন হয়ে উঠতে বাধ্য” – এই ধারণা ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো বিমূর্ত (abstract) বা দূরের নয়। বাচ্চা মানুষ – করার দায়িত্ব আসলে কার – এ বিষয়ে আমাদের দৃঢ় ধারণা আছে, যা আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের – অংশ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment