আজকের আলোচনার বিষয় ট্যালকট পারসন্স : শিল্পোন্নত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক অণু পরিবার – যা লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক এর অর্ন্তভুক্ত, মার্কিনী সমাজ বিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্সের বক্তব্য ছিল : অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্ঞাতি দলের গুরুত্ব আন্তঃসম্পর্কিত।
কোন সমাজ যখন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও জটিল হয়ে ওঠে, যখন সেই সমাজে নানান ধরনের পেশা দেখা দেয়, শহরাঞ্চল ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে ওঠে, এবং গ্রামীণ এলাকা হয়ে যায় ছোট, কলকারখানা যখন বৃদ্ধি পায়, এক কথায়, সমাজ যখন শিল্পোন্নত হয়ে ওঠে, তখন জ্ঞাতিত্বের পরিধি সংকুচিত হয়ে যায়। বৃহত্তর জ্ঞাতি দলের পরিবর্তে দেখা যায়, পিতৃতান্ত্রিক অণু -পরিবার (স্বামী, স্ত্রী ও তাদের নিজেদের সন্তান)।
ট্যালকট পারসন্স : শিল্পোন্নত সমাজের পিতৃতান্ত্রিক অণু পরিবার
এই অণু পরিবারের ভূমিকা সীমিত এবং সীমাবদ্ধ। সন্তানদের লালন-পালন এবং বিবাহিত দম্পতির ব্যক্তিক বিকাশ – অণু পরিবার শুধুমাত্র এই দুটি কার্য পালন করে থাকে। পারসন্সের ভাষায় “আদিম” সমাজে জ্ঞাতি দল যে বিস্তৃত ও পরিব্যাপ্ত ভূমিকাদি পালন করে থাকে, শিল্পোন্নত সমাজে তা ঘটতে দেখা যায় না। তার কারণ হ’ল, রাষ্ট্র, এবং অপরাপর প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, অফিস, ব্যাংক, বীমা, কারখানা ইত্যাদি) এই ভূমিকাগুলো পালন করে। এ কারণেই, পারসন্স বলছেন, শিল্পোন্নত সমাজে দেখা দেয়, “বিচ্ছিন্ন অণু পরিবার”।
উপরে আলোচিত তত্ত্বগুলো বহু নৃবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছে। যদিও প্রত্যেক তাত্ত্বিক নির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন: পার্সন্সের “বিচ্ছিন্ন অণু পরিবার”, ম্যালিনোস্কির “বৈধতার মূলনীতি”, মেয়ার ফোর্টসের “মা-ও-শিশু যুগল” – তবুও তাঁদের বিশ্লেষণরীতির কিছু মিলের জায়গা আছে। প্রথমত, তাঁরা (এবং আরো অনেকে) ধরে নেন, জ্ঞাতিত্বের পরিধি এবং গুরুত্ব শিল্পোন্নত/পাশ্চাত্য সমাজে অণু পরিবারে সীমিত হয়ে যায়।
এই ধারণা শুধু ট্যালকট পারসন্সের নয়। বহু নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানী বহু কাল ধরে নিয়েছিলেন যে, আদিম/অনুন্নত সমাজে আছে বিস্তৃত জ্ঞাতি ব্যবস্থা, আর শিল্পোন্নত/পাশ্চাত্য সমাজে আছে শুধু অণু পরিবার। এই ধারণা খুবই শক্তিশালী। এবং এখনও, বহু মহলে বর্তমান। দ্বিতীয়ত, আপনারা দেখেছেন কিভাবে ম্যালিনোস্কি এবং মেয়ার ফোর্টস পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের সর্বজনীন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।
হাল আমলের তাত্ত্বিকদের সমালোচনা হচ্ছে, এ ধারণাগুলো পাশ্চাত্য সমাজ নির্ভর। তাঁদের বক্তব্য: পাশ্চাত্য নৃবিজ্ঞানীরা নিজ সমাজের স্বাভাবিকত্বের ধারণার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। বিষয়টা এজন্য আরো বেশি আশ্চর্যের কারণ এ দুইজন, এবং তাঁদের অনুসারী আরো বহু নৃবিজ্ঞানী, এমন সমাজে কাজ করেছেন যেখানে তাঁরা যা লিখেছেন তার ঠিক উল্টোটাই বিদ্যমান। যেমন ধরুন, মিয়ানমারের লাখের জনগোষ্ঠী। তাদের ধারণা হচ্ছে, সন্তান সৃষ্টিতে বাবার ভূমিকা মুখ্য।
মা হচ্ছেন পাত্র শুধু, পুরুষ এই পাত্রে সন্তান রাখেন। স্পষ্টতই, মেয়ার ফোর্টসের “মা-ও-শিশু” যুগল তত্ত্ব এই সমাজের জন্য অর্থবহ নয়। মাতৃত্ব এবং পিতৃত্বের ধারণা বাদেও, এই দুই নৃবিজ্ঞানী যেভাবে নারীকে গৃহী পরিসর এবং পুরুষকে আইনী- রাজনৈতিক পরিসরের সাথে যুক্ত করেছেন, তাও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। তৃতীয়ত, শ্রেণী, লিঙ্গ এবং অপরাপর বৈষম্যের সম্পর্ক, এদের কাজে অনুপস্থিত। তাঁদের গবেষণা পড়ে মনে হয়, সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অথবা স্বার্থ, প্রতিরোধ, আন্দোলন, এগুলো কোথাও, কখনও ঘটে না, সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আরও দেখুনঃ