আজকের আলোচনার বিষয় নরবর্ণের ভিত্তিতে বর্গীকরণ – যা বর্ণবাদের সম্পর্ক এর অর্ন্তভুক্ত, নরবর্ণ প্রসঙ্গে ধারণা গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই একটি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট হতে হবে, তা হ’ল, এটি হচ্ছে একটি পরিকাঠামো। পরিকাঠামোর অর্থ কি? একটি চিত্র বা ছবিকে যেমন বাঁধাই করা হয় ফ্রেমের সাহায্যে, ঠিক একইভাবে বিশ্বের মানুষজনকে বাঁধাই করা হয় নরবর্ণের ধারণার সাহায্যে।
এই ধারণা মানুষকে বিভিন্ন ভাবে আলাদা করে, আবার একত্রীভূত করে, এদের নির্দিষ্ট স্থানে সন্নিবেশিত করে। এই বিভাজনের ফলাফল হচ্ছে পরিকাঠামো (ছবির বাঁধাই) যা আমাদের মজ্জাগত হয়; এবং আমাদের দৃষ্টি ও অনুভূতি-উপলব্দিকে দিক্-নির্দেশনা দান করে। উদাহরণ দিই, কেন আপনি বা আমি কালো মানুষ দেখলে “নিগ্রো” বলি? কেন অন্য কিছু – যেমন ধরুন, “খুব সুন্দর দেখতে, মনে হয় চেহারাটা – একদম খোদাই করা” কিংবা “দেখলেই ঈর্ষা হয়, মনে হয় ঈশ্বর যদি আমাকে ওভাবে গড়তেন” অথবা “চোখ দুটো দেখলে মনে হয় সারা বিশ্বের মায়া ওতে লুকানো” – প্রায় কখনোই মাথায় আসে না ।
নরবর্ণের ভিত্তিতে বর্গীকরণ
কেন কণ্ঠে একটু আধটু তাচ্ছিল্যের ভাব থাকে? এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলে বুঝবেন কেন ইদানিং কালে নৃবিজ্ঞানীরা “পরিকাঠামো” শব্দটি ব্যবহার করছেন যা অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবিক ধারণা। বাস্তবিক এই যে, ব্যক্তির মাথায় এগুলো গেঁথে থাকে ।পরিকাঠামো সৃষ্টির ইতিহাস আমাদের জানতে হবে: কোন্ বিশেষ প্রেক্ষিতে এটি একটি পরিকাঠামো হিসেবে দাঁড়ায়, এই পরিকাঠামো কি উপায়ে শক্তিমত্তা অর্জন করে, এই পরিকাঠামো সৃষ্টির সাথে বৈষম্যের কোন সম্পর্ক ছিল বা আছে কিনা ইত্যাদি। পরিকাঠামো হিসেবে দেখার বিষয়টি যে সকল নৃবিজ্ঞানীরা জরুরী মনে করছেন, তাঁরা বলছেন, নরবর্ণকে যদি পরিকাঠামো হিসেবে না দেখি তাহলে যে বর্গ (category)-গুলো এই পরিকাঠামো দ্বারা সৃষ্ট, সেগুলোকে মনে হবে স্বতঃসিদ্ধ, প্রকৃতি-প্রদত্ত।
মনে হবে “আসলেই তো, মানুষের চামড়া’র রঙ তো হয় কালো অথবা সাদা, নাক হয় খাড়া অথবা চ্যাপ্টা, চুল হয় কোঁকড়া অথবা সোজা” ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, নরবর্ণগত বিভাজন ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে এবং বিষয়টি “কালো চোখ”, “খর্বকায়” এত সহজ, সরল কিছু নয়। এ ধরনের সরলীকৃত চিত্রকে ভেদ করার লক্ষ্যে নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা দাঁড় করাচ্ছেন যা বিশ্লেষণের রাস্তা তৈরি করে। প্রথমত, নৃবিজ্ঞানীদের অভিমত হল: যে কোন জনগোষ্ঠীর সকল মানুষের গায়ের রঙ, দৈর্ঘ্য কিংবা চেহারা-সুরত ও শারীরিক আকার-আকৃতি একইরকম নয়। একথা বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীর জন্য সত্য।
কিন্তু এসত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা সম্পর্কে কিছু গৎবাঁধা ধারনা (stereotype) তৈরি হয়েছে যা কিনা সেই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার ভিন্নতাকে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোন একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে করে তোলে সমগ্র জাতির সাধারণ চিহ্ন বা স্মারক (“চীনা চোখ”, “চ্যাপ্টা নাক”)। –
নরবর্ণ বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝে থাকি শুধুমাত্র মুখাকৃতি এবং শারীরিক বৈশিষ্টাবলী। যেমন কিনা উপরে উল্লেখিত। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপে জন্মানো নরবর্ণের ধারণা কেবলমাত্র তা নয়। নরবর্ণের ধারণায় শারীরিক বৈশিষ্টাবলীর সাথে মিশ্রিত হয়ে আছে বুদ্ধি, সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। নরবর্ণের প্রধান পাঁচটি বর্গ তৈরি করা হয় যথা ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, ইথিওপীয়, আমেরিকান এবং মালয়। সকল বৰ্গ সমমর্যাদার না, এগুলো স্তরায়িত। এই স্তরায়নে ককেশীয়রা – ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা’র জনসমষ্টি, যারা – “শ্বেতাঙ্গ” হিসেবে পরিচিত – সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত। –
পনের হতে সতের শতক, এ সময়কালে, ইউরোপীয় দেশের নৌ-অভিযানের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক উপস্থিতির বিশ্বব্যাপী বৈচিত্র্য উন্মোচিত হতে থাকে। মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক বৈচিত্র্যের এই বিশালতা ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা “আবিষ্কার”-এর আগে ধরা পড়েনি। পনের শতকের সাগর- পথের এই অভিযান যুক্ত করে নতুন ও পুরাতন পৃথিবীকে। আরো পরবর্তী সময়কালের নৌ-সফর, পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক বৈচিত্র্যের চিত্রকে সামগ্রিকতা দান করে। যেমন, সতের শতকের প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো একাধিক অনুসন্ধানী সফর।
সাগর পথের অভিবাসন এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষজনের জোরপূর্বক স্থানান্তরের ফলে, এমনধরনের সম্প্রদায় ঘনিষ্ঠ নৈকট্যে আসে, যারা পূর্বে প্রতিবেশী ছিল না। ভৌগোলিক বিষয়টি এই আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেখা গেছে, কোন একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভিন্ন-ভিন্ন জাতি বা বর্ণের মানুষজন বসবাস করলেও তাদের মধ্যকার শারীরিক গঠনের ভিন্নতা ক্রমান্বিক।
শারীরিক গঠনের এই ক্রমান্বিকতা ইউরোপীয় অভিযানের কারণে উল্টে যায় এবং ইউরোপে বিদ্যমান খ্রিস্টীয়-প্রধান মানুষ অ-ইউরোপীয় অঞ্চলের মানুষজনের মুখাকৃতির বৈচিত্র্যে, ধাক্কা খায়। এই বৈচিত্র্যকে বোঝার জন্য, সামাল দেয়ার জন্য, “নরবর্ণ” নামক ধারণা জন্মায়।
মাথায় রাখা জরুরী যে, মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক উপস্থিতির বৈচিত্র্য বাস্তব, কিন্তু পাঁচ-ধরনের নরবর্ণের যে ছাঁচ বা পরিকাঠামো সৃষ্টি করা হ’ল তা এই বৈচিত্র্যের জটিলতাকে বুঝতে সাহায্য করে না। এই ছাঁচ কেবল শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের একটি নরবর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করে না। উপরন্তু তাদের, বিশ্বের আর সকল নরবর্ণের তুলনায়, সকল ক্ষেত্রে বুদ্ধি-বিবেচনা, যুক্তিক্ষমতা, সৌন্দর্য, দৈহিক শক্তি ইত্যাদি – উৎকৃষ্ট হিসেবে – প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবেই সৃষ্ট হয় নরবর্ণের ধারণা, এবং ঘটে বর্ণবাদের উত্থান ।
চৌদ্দ শতক, এবং তার পরবর্তী শতকের, ঘটনাবলী বিশ্বকে নরবর্ণে বিভাজিত করে তোলে। ইউরোপীয় অভিযানের পূর্বে, জাতিভিত্তিক উৎকর্ষের ধারণা যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান ছিল না, তা নয়। প্রাচীন গ্রীকদের ধারণা ছিল মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলের অন্য সকল জনগোষ্ঠী বর্বর, কেবলমাত্র তারা নিজেরা “সভ্য”। কিন্তু, তারা সভ্যতার সাথে শারীরিক গঠন এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা যুক্ত করেনি। নীল উপত্যকার কৃষ্ণকায় নুবিয়ানরা গ্রীকদের দৃষ্টিতে ছিল সভ্য। পক্ষান্তরে, উত্তরের শ্বেতাঙ্গ ইউরোপবাসীরা তাদের দৃষ্টিতে ছিল বর্বর। দক্ষিণ এশীয় জাতিবর্ণ (caste) -ভিত্তিক সমাজে, জাতিবর্ণ স্তরায়িত।
অনেকটা নরবর্ণের মতনই। নিচু জাতের যারা, তারা বস্তুগত ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা বিদ্যমান। চামড়ার রঙ জাতিবর্ণের ভিত্তি নয়। ঘন রঙের উচ্চবর্ণ যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি হালকা রঙের নিচুবর্ণের অস্তিত্বও বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মানুষের পুনর্জন্ম ঘটে,এবং বহুবার।
পুনর্জন্ম ঘটে একই আত্মার, কিন্তু সেই আত্মা একই জাতে জন্মগ্রহণ নাও করতে পারে। যিনি কিনা ইহ-জন্মে শূদ্র, তিনি পরজন্মে ব্রাহ্মণ হিসেবে জন্মাতেও পারেন। কে আগামীতে কোন জাতে জন্মগ্রহণ করবে তা নির্ভর করে তার কৃত কাজের উপর। নরবর্ণের বিশ্বকরণের পূর্বে, দাসত্বের ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা গেছে। বহু অঞ্চলে দাস এবং প্রভু, এদের শারীরিক গঠন বা মুখাকৃতির কোন ভিন্নতা ছিল না। দেখা গেছে যে, দাসত্ব যে কোন সম্প্রদায়ের ভাগ্যে ঘটেছে। আবার এও দেখা গেছে যে, দাসের সন্তানেরা কয়েক প্রজন্ম পরে, প্রভু জাতির সাথে মিশে গেছে।
চৌদ্দ শতক পরবর্তী ইউরোপ-প্রবর্তিত নরবর্ণ ব্যবস্থা দক্ষিণ এশীয় জাতিভিত্তিক বিভাজন, অথবা দাস এবং প্রভু ব্যবস্থা হতে খুব ভিন্ন। পূর্বতন ব্যবস্থাগুলোর সাথে তুলনা করলে মৌলিক ফারাক চোখে পড়ে । নরবর্ণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, এটা সার্বিক মানবজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নরবর্ণের পরিকাঠামোতে আছে অল্প কিছু বর্গ, সাধারণত শুধুমাত্র পাঁচটি। এই পাঁচটি মূল বর্গের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে কিছু উপ-বর্গ, এবং মিশ্র-বর্গ (পিতা, মাতা যদি ভিন্ন নরবর্ণের হয়ে থাকেন তাহলে তাদের সন্তানদের মিশ্রবর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। নরবর্ণের পরিকাঠামো অসমতাকে শক্তিশালী করে, সর্বব্যাপৃত করে। এই অসমতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক; ক্ষেত্র বিশেষে আইনগত। নরবর্ণীয় বিভাজনের ফলে দেখা দেয় বর্ণবাদ।
নৃবিজ্ঞানী রজার স্যানজেক-এর ভাষায় বর্ণবাদ হল: সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শিক। বর্ণবাদ মানুষের আত্ম-উপলব্ধি এবং অপরের প্রতি উপলব্ধিকে নরবর্ণীয় চিন্তার ভিত্তিতে আকৃতি দান করে (“নাহ্, আমি দেখতে সুন্দর না। আমার চোখগুলা চীনা-চীনা” কিংবা “টল ফিগার…… দেখতে একদম বিদেশীদের মতন”)। বর্ণবাদ প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ, এটি এক প্রজন্ম হতে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। বর্ণবাদ এক ব্যক্তির সাথে আরেক ব্যক্তির আচরণ এবং আরও বৃহৎ পরিসরে সামাজিক আচরণকে প্রভাবিত করে, নির্ধারণ করে।
বর্ণবাদ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে: যেমন দৈনন্দিন জীবনে, তেমনি জ্ঞানচর্চায়। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরেও বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এর সবচাইতে ভাল উদাহরণ। কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে আছে বহু ধরনের বর্ণবাদ: স্থানিক বর্ণবাদ (“কালো মেয়ে ঘরে আনব না”), জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক বর্ণবাদ (“দেশ পরিচালনার মত বুদ্ধি ও দক্ষতা পাহাড়িদের নেই”) এবং অঞ্চল-ভিত্তিক বর্ণবাদ (“খেলাধুলা আর গান বাজনা আফ্রিকানরা ভাল পারে অন্যসব বিষয়ে তারা পিছিয়ে”)।
তাঁরা মনে করেন, এক এক জায়গার সংস্কৃতি এক এক ধরনের বর্ণবাদকে গঠন করেছে। আবার কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, স্থানিক পর্যায়ের বর্ণবাদ (“পাহাড়িদের নাক চ্যাপ্টা”) ১৪ শতক হতে গঠিত বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদের অংশ, তারই স্থানিক প্রতিবিম্ব। দৃষ্টিভঙ্গি দুটি ভিন্ন হলেও বড়সড় মিলের জায়গা আছে। শ্বেতাঙ্গ বর্ণ সবসবময় কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ হতে উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অপর সকল বর্ণ (“বাদামী”, “চকলেটি”, “হলদে জাতি”) এই দুই বর্ণের মাঝামাঝি স্তরে স্থান পেয়েছে।
আরও দেখুনঃ