আজকের আলোচনার বিষয় সমাজ নৃবিজ্ঞানীদের ধর্মীয় আচার – যা ধর্ম : মিথ ও আচার এর অর্ন্তভুক্ত, আচারকে (ritual) সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে বিশ্বাসের প্রথাবদ্ধ আচরিত রূপ হিসাবে (belief in action)। মিথ যদি হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি প্রধান আকর, তবে আচার হচ্ছে তার আচরণগত অভিব্যক্তির অন্যতম একটি ক্ষেত্র। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয় অন্যান্য প্রাত্যহিক বা সাধারণ কর্মকান্ড থেকে আলাদা ছকে, ভিন্ন আঙ্গিকে।
নৃবিজ্ঞানীদের ধর্মীয় আচার
আচারে অংশগ্রহণকারীদের সম্পন্ন করতে হয় নির্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিকতা, যেগুলির মাধ্যমে প্রতীকীভাবে ভিন্ন একটা জগতে তারা প্রবেশ করে। ধর্মীয় আচারের ক্ষেত্রে এই জগতটা হচ্ছে পবিত্রতার, অতিপ্রাকৃত সত্তা ও শক্তিসমূহের বলয়। এই জগতের সত্তাসমূহের সাথে যোগাযোগের মানসে বা সেখানকার শক্তিসমূহকে আয়ত্ত করার প্রয়াসে মানুষ আচার পালন করে। আচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় প্রতিটি আচরণ, অঙ্গভঙ্গী, উচ্চারণ ইত্যাদি বিশেষ প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। এজন্য আচারকে অনেকে ‘প্রতীকী কর্মসম্পাদন’ (symbolic action) বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
খ্রিস্টীয় ‘ম্যাস’ (mass) অনুষ্ঠানে গীর্জায় সমবেত উপাসকরা যে রুটিখন্ডগুলো খায়, বা হিন্দুরা পূজার যে প্রসাদ খায়, সেগুলো ঠিক ‘খাদ্য’ নয়। নিত্যকার আহার্য অন্যান্য খাদ্য থেকে সেগুলো প্রতীকীভাবে ভিন্ন। তেমনি মুসল্লীরা যখন নামাজের আগে অজু করে, সেটার সাথে সাধারণ প্রক্ষালনের পার্থক্য রয়েছে আঙ্গিক, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের দিক থেকে।
সাদা চোখে দেখলে বেশীর ভাগ আচারের কোন ব্যবহারিক তাৎপর্য নেই, এই অর্থে যে, আচার পালন না করেই বিভিন্ন কর্মকান্ড সমাপ্ত করা সম্ভব। যেমন, একটা নূতন বাড়ি বানানো শেষ করেই সেখানে বসবাস শুরু করা যায়, এজন্য মিলাদের আয়োজন করাটা প্রযুক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু অনেকের কাছে সামাজিক ভাবে তা কাম্য।
কোন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একটা মৃতদেহকে মাটি চাপা দেওয়া বা পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই কেউ তা করার কথা ভাবে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী যথাসময়ে কিছু আচার সম্পাদন করা জরুরী দৈব অনুগ্রহ, আশীর্বাদ, কৃপা ইত্যাদি লাভের জন্য। তবে সামাজিকতা রক্ষাও আচার পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
আচার অধ্যয়নে নৃবিজ্ঞানীরা ব্যাপকতর অর্থে এই ‘সামাজিকতা’র বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সকল সমাজেই এমন বহু আচার রয়েছে যেগুলোতে সমাজের বহু সদস্যের মিলিত অংশগ্রহণ রয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব আচার পালনের উপলক্ষ বা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এ ধরনের আচার সমাজের সদস্যদের যৌথতা ও সংহতি প্রকাশের ও লালনের প্রধান মাধ্যম।
আরও দেখুনঃ