নৃবিজ্ঞানী সর্বপ্রাণবাদ

আজকের আলোচনার বিষয় নৃবিজ্ঞানী  সর্বপ্রাণবাদ – সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা এর অর্ন্তভুক্ত, ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টায়লর (সংস্কৃতির একটি ধ্রুপদী সংজ্ঞার প্রণেতা হিসাবে যাঁর নাম আগেই উল্লেখিত হয়েছে) সর্বপ্রাণবাদের ধারণা নিয়ে আসেন। ইংরেজী animism শব্দটি এসেছে ল্যাটিন animus থেকে, যার অর্থ আত্মা (সে হিসাবে animism-এর বাংলা ‘আত্মাবাদ’ বা সে জাতীয় কিছু করা যেত, তবে এখানে পূর্বপ্রণীত পারিভাষিক প্রতিশব্দ ‘সর্বপ্রাণবাদ’ অনুসৃত হচ্ছে)।

টায়লরের মতে সকল সংস্কৃতিতেই আত্মা বা আত্ম-সদৃশ অন্যান্য সত্তার ধারণা কোন না কোন আকারে দেখা যায়। এর ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, সকল ধর্মের মূলে রয়েছে এই বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ, অর্থাৎ আত্মার ধারণায় বিশ্বাস, যাকে তিনি animism হিসাবে অভিহিত করেন।

 

নৃবিজ্ঞানী সর্বপ্রাণবাদ

 

নৃবিজ্ঞানী  সর্বপ্রাণবাদ

টায়লর ধর্মের একটি সরল সংজ্ঞাও দিয়েছেন, তাঁর মতে ধর্ম হল “বিভিন্ন আত্মা-রূপীয় সভায় বিশ্বাস’ (belief in spirit beings)। আত্ম-রূপীয় সত্তা বলতে টায়লর আত্মা তথা বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত, অশরীরী সত্তা যেমন ভূত- প্রেত, দেব-দেবী, ইশ্বর প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। টায়লরের মতে আত্মার ধারণা ছিল আদিম মানুষদের একটি উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন, ধর্মের বিবর্তনের প্রথম ও প্রধান সোপান। তিনি তাঁর Primitive Culture গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, আত্মার ধারণার সম্প্রসারিত রূপ হিসাবেই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভূত-প্রেত দেব-দেবী প্রভৃতির ধারণা ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের উৎপত্তি ঘটেছে।

টায়লর যুক্তি দেখান যে, স্বপ্ন, মৃত্যু, মুর্ছা যাওয়া ইত্যাদির মত কিছু সাধারণ ও সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়েই নিশ্চয় আদিম মানুষেরা আত্মার ধারণা উদ্ভাবন করে। মানুষ মাত্রেরই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা হয়। স্বপ্নে মানুষ যেসব অভিজ্ঞতা লাভ করে, সেগুলোর সবকিছু জাগ্রত অবস্থার দৈনন্দিন ঘটনার সাথে মেলে না।

মানুষ স্বপ্নে যেন ভিন্ন একটা জগতে বিচরণ করে। স্বপ্নে অনায়াসে দূরবর্তী কোন স্থানে ঘুরে আসা যায়, আকাশে উড়ে বেড়ানো যায়, এমনকি মৃত ব্যক্তিদেরও সাক্ষাত মেলে। তার মানে প্রত্যেক মানুষের দেহের ভেতরেই নিশ্চয় এমন একটি দ্বিতীয় সত্তা বাস করে, যা আমরা ঘুমিয়ে থাকলে রক্তমাংসের দেহের বাইরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে। মুর্ছা যাওয়া হল সাময়িকভাবে এই সত্তার দেহত্যাগ, আর মৃত্যুর বেলায় তা ঘটে চিরতরে।

এমন অনেক ‘আছরের’ ঘটনাও ঘটে যখন একজন ব্যক্তি হঠাৎ ভিন্ন কারো মত আচরণ করতে থাকে, যেনবা তার মধ্যে অন্য কারো অশরীরী উপস্থিতি রয়েছে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে এভাবেই স্বপ্ন, মৃত্যু প্রভৃতি বিষয়ের ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াসে ‘আত্মা’র ধারণার আবির্ভাব ঘটে বলে টাইলর মনে করেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

টায়লরের তত্ত্ব অনুযায়ী আত্মার ধারণার ভিত্তিতে ধর্মের একটি প্রাথমিক রূপ হিসাবে ‘পূর্বপুরুষ পূজা’র (ancestor worship) আবির্ভাব ঘটে, যেখানে গোষ্ঠী ভিত্তিক সমাজের সদস্যরা নিজ নিজ গোষ্ঠীর মৃত পূর্বসূরীদের আত্মাসমূহের সন্তুষ্টি বিধান ও সহায়তা লাভের লক্ষ্যে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে। আবার বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে এই ধারণার বিকাশ ঘটে যে, শুধু মানুষেরই আত্মা নেই, অন্যান্য প্রাণীরও আত্মা রয়েছে, এমনকি জড়বস্তুর ভেতরেও আত্মা-রূপীয় সত্তা থাকতে পারে।

এ ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক পর্যায়ে গড়ে ওঠে ‘প্রকৃতি পূজা’ (nature worship), যে ব্যবস্থায় চারপাশের জীবজন্তু, গাছপলা প্রভৃতি মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে (‘প্রকৃতি পূজা’ কথাটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর, কারণ এটি দিয়ে যে ধরনের বিশ্বাসকে বোঝানো হচ্ছে সেগুলোতে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে নিহিত বলে কল্পিত অতিপ্রাকৃত সত্তাসমূহই আসলে মানুষের কাছে ভীতি, ভক্তি বা পূজার বিষয়)।

টায়লরের মতে ‘প্রকৃতি পূজা’র আরো অগ্রসর ধাপে এসে মানুষ আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃষ্টি, অগ্নি প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের মধ্যে বিভিন্ন দেব-দেবীর সন্ধান পায়। এভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার বিকাশের সাথে সাথে বিশ্বজগতকে জানার-বোঝার নিরন্তর প্রয়াসের ফলশ্রুতি হিসাবে বহুইশ্বরবাদের (polytheism) পরবর্তী পর্যায়ে একেশ্বরবাদ (monotheism) এসেছে বলে টায়লর মনে করেন। একেশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাসে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একক, অদ্বিতীয় ইশ্বরের ধারণা লক্ষ্য করা যায়। তবে একেশ্বরবাদী বিশ্বাসেও আত্মার ধারণা তথা ফেরেস্তার মত গৌণ অতিপ্রাকৃত সত্তার স্থান রয়েছে। সে হিসাবে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ অতীতে ফেলে আসা কোন স্তর নয়, বরং সকল সমকালীন ধর্মেই মিশে আছে।

টায়লরের তত্ত্বের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে এই যে, শুধুমাত্র জীবন ও জগত সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, একথা মনে করার কোন কারণ নেই। ধর্ম মানুষের অন্যান্য চাহিদাও মেটায়। এছাড়া তথাকথিত আদিম সমাজসমূহের মধ্যেও ‘সর্বশক্তিমান ইশ্বর’-এর ধারণা বিরল নয়। সেদিক থেকে বিভিন্ন সমাজকে ধর্মীয় বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে ফেলার প্রয়াস প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে পড়ে।

 

নৃবিজ্ঞানী  সর্বপ্রাণবাদ

 

তবে টায়লরের সকল অনুমান যদি ঠিক নাও হয়, তাঁর বিশ্লেষণের পুরোটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। বিবর্তনবাদবিরোধী নৃবিজ্ঞানীরাও একটি মৌলিক প্রত্যয় হিসাবে সর্বপ্রাণবাদের ধারণা ব্যবহার করেন, যা ধর্মের নৃবিজ্ঞানে টায়লরের অবদানের স্বীকৃতি। আবার সর্বপ্রাণবাদ যে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের একমাত্র বা প্রধানতম ভিত্তি, একথাও বলা যায় না। এক্ষেত্রে ভিন্ন একটি মৌলিক প্রত্যয় হিসাবে ‘মহাপ্রাণবাদে’র ধারণার প্রতি এবার আমরা নজর দেব।

 

সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা অধ্যায়ের সারাংশ

 

সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা অধ্যায়ের সারাংশ:

আজকের আলোচনার বিষয় সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা অধ্যায়ের সারাংশ – সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা এর অর্ন্তভুক্ত, ধর্মের উৎপত্তি ও আদিরূপ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ ও ‘মহাপ্রাণবাদ’ প্রত্যয়দ্বয় প্রবর্তিত হয়। সর্বপ্রাণবাদ বলতে টায়লর বুঝিয়েছেন আত্মা ও অনুরূপ অন্যান্য অতিপ্রাকৃত সত্তা সংক্রান্ত বিশ্বাসকে, যেটাকে তিনি ধর্মের ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

 

সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা অধ্যায়ের সারাংশ

টায়লরের মতে আত্মার ধারণার সম্প্রসারিত ও সর্বোচ্চ বিবর্তিত সংস্করণ হচ্ছে সর্বশক্তিমান এক ইশ্বরের ধারণা। টায়লরের তত্ত্বের বিপরীতে ম্যারেট দাবী করেন যে, অতিপ্রাকৃত সত্তার ধারণায় উপনীত হওয়ার আগে আদিম মানুষ প্রথমে প্রকৃতিতে পরিব্যাপ্ত এক ধরনের শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করেছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মেলানেশীয়দের মধ্যে প্রচলিত ‘মানা’র ধারণা হচ্ছে এরকম একটি উদাহরণ। ‘মানা’কে কোন দৈব সত্তার নিয়ন্ত্রণাধীন হিসাবে দেখা হয় না, বরং এটা হচ্ছে এমন একটা শক্তি যা মানুষ বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে বা ঘটনাচক্রে আয়ত্ত করতে পারে। এ ধরনের বিশ্বাসকে ‘মহাপ্রাণবাদ’ বলা হয়। ‘সর্বপ্রাণবাদ’ ও ‘মহাপ্রাণবাদ’ প্রত্যয় যে ধরনের বিশ্বাসকে নির্দেশ করে, সে ধরনের বিশ্বাস বাস্তবে শুধুমাত্র তথাকথিত আদিম সমাজ সমূহের মধ্যেই সীমিত নয়, বরং সমকালীন প্রেক্ষিতেও লক্ষ্য করা যায়।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment