নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা |

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

 

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

 

 

নৃবিজ্ঞান কি ধরনের বিজ্ঞান?

“নৃবিজ্ঞান’ হল ইংরেজী ‘এ্যাগ্রোপলজি’-র (anthropology) বাংলা প্রতিশব্দ। এ্যান্থোপলজি কথাটির মূলে রয়েছে একটি গ্রীক শব্দ এ্যাক্সোপস’ ( anthropos), যার অর্থ মানুষ। সংস্কৃত শব্দ ‘নৃ’ মানেও তাই। কাজেই ‘নৃবিজ্ঞান’ কথাটির অর্থ দাঁড়ায় মানব বিষয়ক বিজ্ঞান’ (উল্লেখ্য, বাংলায় এ্যাগ্রোপলজির প্রতিশব্দ হিসাবে মানব বিজ্ঞান কথাটি কেউ কেউ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা বহুল প্রচলিত নয়)।

তবে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আরো অনেক শাস্ত্র বা জ্ঞানকান্ড রয়েছে, যেগুলোও কোন না কোনভাবে মানব বিষয়ক বিজ্ঞান বটে। কাজেই শুধুমাত্র ‘মানব বিষয়ক বিজ্ঞান’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করলে নৃবিজ্ঞানকে আলাদা করে চেনা যায় না। নৃবিজ্ঞানের বিশেষত্ব এই যে, মানব বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় এর বিষয়বস্তু ব্যাপকতর পরিধিসম্পন্ন ও অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ।

নৃবিজ্ঞানে একাধারে মানব সত্তার জৈবিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়, এবং তা করতে গিয়ে এর অনুসন্ধিৎসার ক্ষেত্র বিস্তৃত রয়েছে এক বিশাল পটভূমি জুড়ে, যার আওতায় পড়ে সুদূর প্রাগৈতিহাসিক | অতীত থেকে শুরু করে এ যাবত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যত ধরনের মানবগোষ্ঠী বাস করে গেছে বা করছে, সবাই।

‘নৃবিজ্ঞান’-এর পরিবর্তে ‘নৃতত্ত্ব’ কথাটি আপনাদের কাছে অধিকতর পরিচিত হতে পরে। ‘এ্যাগ্রোভসজি’র প্রতিশব্দ হিসেবে শেষোক্ত শব্দটি বাংলা ভাষায় চালু রয়েছে দীর্ঘতর সময় ধরে (ক্ষেত্রবিশেষে ‘নৃবিদ্যা’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে)।

আপনি হয়তবা লক্ষ্য করেছেন যে, বাংলা ভাষায় রচিত অনেক বইপুস্তক বা পত্রপত্রিকায় বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য’ বা ‘নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস’ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করা হয়, যেগুলি দিয়ে সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্ট্য বা প্রাগৈতিহাসিক অতীত সংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচনায় নিয়ে আসা হয়। এক্ষেত্রে ‘নৃতাত্ত্বিক’ বিশেষণটা এমন সব বিষয়কে |

নির্দেশ করে যেগুলো নিয়ে নৃবিজ্ঞানের কোন কোন শাখায় বিশেষ করে দৈহিক নৃবিজ্ঞান ও প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানে–হয়ত একসময় ব্যাপক গবেষণা বা লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র এসব বিষয় দিয়ে নৃবিজ্ঞানের পুরো পরিচয় পাওয়া যায় না। সেদিক থেকে ‘নৃতত্ত্ব’ পদটি, বা এর বিশেষণরূপ ‘নৃতাত্ত্বিক’, যেভাবে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, তা সমকালীন প্রেক্ষাপটে যথার্থ নয়।

এ্যান্ড্রোপলজির অপেক্ষাকৃত পুরানো প্রতিশব্দ ‘নৃতত্ত্ব’ বাংলা ভাষায় যে সময় চালু হয়েছিল, তখন ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এমন একটা ধারণা ব্যাপকভাবে চালু ছিল যে এটি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যেখানে মূলতঃ মানব জাতির উৎপত্তি ও বিবর্তন, বিভিন্ন ধরনের মানবগোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য, এবং “আদিম’ সমাজ বা সংস্কৃতি অধ্যয়ন করা হয়।

এ ধরনের ধারণা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না, কারণ বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত মূলতঃ উল্লিখিত বিষয়গুলোর উপরই ‘নৃতাত্ত্বিক গবেষণা ও লেখালেখির ঝোঁক বেশী। ছিল।। তবে সময়ের সাথে সাথে এই প্রবণতা পাল্টে গেছে, এবং নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুকে অনেকটাই ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সমকালীন প্রেক্ষাপটে নৃতত্ত্ব মানেই মানুষের উৎপত্তির ইতিহাস বা আদিম সমাজ অধ্যয়ন, একথা আর বলা যায় না।

এখনকার নৃতত্ত্ববিদদের অনেকেই অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানীদের মতই সমকালীন বিভিন্ন ধরনের সমাজ, তাদের সংস্কৃতি-অর্থনীতি- রাজনীতি ইত্যাদি নানান বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করছেন। আর এই পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ‘নৃতত্ত্ব’র বদলে ‘নৃবিজ্ঞান’ই ‘এ্যান্থ্রোপলজি’র প্রতিশব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ বিষয় পড়ানো শুরু হওয়ার সময় থেকে। একইভাবে নৃবিজ্ঞান চর্চার সাথে যুক্ত শিক্ষক-গবেষকরা ‘নৃতত্ত্ববিদ’-এর বদলে ‘নৃবিজ্ঞানী’ হিসাবেই নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন।

সাধারণভাবে বলা যায়, সমকালীন প্রেক্ষাপটে নৃবিজ্ঞান হচ্ছে বিভিন্ন উপবিভাগ সম্বলিত এমন একটি জ্ঞানকান্ড যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানুষ’কে অধ্যয়ন করে। আগেই বলা হয়েছে, নৃবিজ্ঞানে একাধারে মানব সত্তার জৈবিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়।

একটি প্রজাতি হিসেবে মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে শুরু করে অতীত ও বর্তমানকালের বিভিন্ন ধরনের মানব সমাজের সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন নৃবিজ্ঞানে করা হয়। বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশাল পরিধির অধিকারী এই জ্ঞানকান্ডের স্বভাবতই রয়েছে বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ক্ষেত্র। তবে দেশ-কাল ভেদে এই উপবিভাগগুলোর নামকরণ ও শ্রেণীকরণে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।

মার্কিন ধারার নৃবিজ্ঞানে সচরাচর চারটি প্রধান উপবিভাগ চিহ্নিত করা হয়, এগুলি হল, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান, ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান ও দৈহিক নৃবিজ্ঞান। অনেকে অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানকে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানেরই দুটি শাখা হিসাবে গণ্য করেন এবং ethnology বা জাতিতত্ত্ব নামে এর আরেকটি শাখা চিহ্নিত করেন।

ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় ধারার নৃবিজ্ঞানে ‘সংস্কৃতি” ধারণার চাইতে ‘সমাজ’ ধারণার উপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ফলে এই প্রেক্ষিতে ‘সামাজিক নৃবিজ্ঞান’ কথাটি অধিকতর প্রচলিত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত নৃবিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বরাবরই বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ ছিল, কাজেই স্থান- কাল ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারা-উপধারার মধ্যে সবক্ষেত্রে কোন সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা যায় না।

সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের অনেক স্থানেই মার্কিন ধারার সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও ব্রিটিশ ধারার সামাজিক নৃবিজ্ঞানকে মূলতঃ একই বৃহত্তর ধারার অন্তর্গত হিসাবে গণ্য করা হয়, যাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান হিসাবে অনেকে অভিহিত করে থাকেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান তথা নৃবিজ্ঞানের অন্যান্য উপবিভাগের সাথে অন্যান্য জ্ঞানকান্ডের মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে বিষয়-ভিত্তিক গবেষণার অনেক বিশেষায়িত ক্ষেত্র, যেমন, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান, রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান, ধর্মের নৃবিজ্ঞান, প্রতিবেশগত নৃবিজ্ঞান, চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান, ফলিত নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি।

নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী

বিভিন্ন নামে অভিহিত নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ধারার মধ্যে সাধারণভাবে কিছু অভিন্ন যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। এগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ধারণার ব্যবহার, সমগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, মাঠকর্ম ও তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এসব মিল নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোকে একত্রে একটি সমন্বিত ও স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত জ্ঞানকান্ড হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে।

এছাড়া অনেক জায়গায়, বিশেষ করে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, নৃবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নৃবিজ্ঞানের একাধিক শাখার উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ফলে এখনো অনেক নৃবিজ্ঞানীই তাঁদের গবেষণা ও লেখালেখিতে এক ধরনের সমন্বিত ‘নৃবৈজ্ঞানিক’ দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণের চেষ্টা করেন। নীচে একটি সমন্বিত জ্ঞানকান্ড হিসাবে নৃবিজ্ঞানের উল্লিখিত প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হল।

সংস্কৃতির ধারণার তাৎপর্য : নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতেই ‘সংস্কৃতি’ একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শুধু সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে নয়, দৈহিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান ও ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানেও সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত অর্থে সংস্কৃতি বলতে যা বোঝাত–নৃত্য, সঙ্গীত | ইত্যাদি–নৃবিজ্ঞানীরা তার থেকে ভিন্ন ও ব্যাপকতর অর্থে শব্দটি ব্যবহার শুরু করেছিলেন বেশ আগে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টায়লর সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে: ‘সংস্কৃতি হচ্ছে সেই জটিল সমগ্র, যার আওতায় পড়ে জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নৈতিকতা, আইন, প্রথা |

এবং অন্য যে কোন কর্মদক্ষতা ও অভ্যাস যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জন করে’। টায়লর পরে অন্য নৃবিজ্ঞানীরা মিলে সংস্কৃতির শতাধিক সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তাদের কাছে এই ধারণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নৃবিজ্ঞানে সংস্কৃতির ধারণার দুই ধরনের তাৎপর্য রয়েছে। একদিকে | একটি প্রজাতি হিসাবে জীবজগতে মানুষের অনন্যতা বোঝানোর জন্য সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয়: নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষেরই রয়েছে সংস্কৃতি ধারণ করার ক্ষমতা, এবং এই |

সাধারণ অর্থে মানুষ মাত্রই সংস্কৃতিসম্পন্ন (এই সাধারণ অর্থে ইংরেজীতে সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয় একবচনে, যা অনেক সময় বড় হাতের C দিয়ে লেখা হয়: Culture)। অন্যদিকে বিভিন্ন মানব সমাজের ভিন্নতার সূচক হিসাবেও সংস্কৃতির

ধারণা ব্যবহার করা হয়: প্রতিটা সমাজেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু রীতি-নীতি, আচার-প্রথা ইত্যাদি, অর্থাৎ সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট নিজস্ব রূপ। কাজেই সমাজ ভেদে সংস্কৃতিরও ভিন্নতা দেখা যায় (এই অর্থে ইংরেজীতে সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয় বহুবচনে, যা লেখা হয় ছোট হাতের c দিয়ে cultures) ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সমগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গী: নৃবিজ্ঞানের কোন একটি বিশেষায়িত ধারায় মানব জীবনের নির্দিষ্ট কোন দিক অধ্যয়নের উপর নজর দেওয়া হলেও সাধারণত তা বিচ্ছিন্নভাবে করা হয় না, বরং মানব জীবনের একটা দিক কিভাবে অন্যান্য দিকগুলোর সাথে সম্পর্কিত, তাও দেখার চেষ্টা করা হয়। কাজেই বলা হয় যে, নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্রবাদী বা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গী (holistic perspective) অনুসরণের চেষ্টা করেন, অর্থাৎ তারা মানুষ ও তার সংস্কৃতি বা সমাজের কোন অংশকে খন্ডিতভাবে না দেখে সমগ্রের আলোকে সেটাকে অনুধাবনের চেষ্টা করেন।

মাঠকর্ম : ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন শাখার নৃবিজ্ঞানেই মাঠকর্ম অর্থাৎ প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন, দৈহিক নৃবিজ্ঞানীরা মানব জীবাশ্মের সন্ধানে বা প্রাণীজগতে মানুষের নিকটতম প্রজাতিদের সামাজিক আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য মাঠকর্ম সম্পাদন করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীরা খননকার্যের মাধ্যমে অতীতের কোন জনপদের সন্ধান পেলে সেখান থেকে বিস্তারিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এক একটা সমাজের বিস্তারিত বিবরণ তৈরী করেন। এভাবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিটা শাখাতেই ক্ষুদ্র পরিসরে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হয়।

তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী : নৃবিজ্ঞানের সকল শাখাতেই বিভিন্ন কালের ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত উপাত্তসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন করা হয়। বিভিন্ন কালের ও বিভিন্ন স্থানের মানুষদের জৈবিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেন কি কি বৈশিষ্ট্য সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এবং কি কি বৈশিষ্ট্য শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডের মধ্যে একমাত্র নৃবিজ্ঞানেই দেখা যায় স্থান ও কালের দিক থেকে মানব বৈচিত্র্যের সমগ্র পরিধিকে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ কোন আলোচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করার প্রচেষ্টা।

উপরের আলোচনায় নৃবিজ্ঞানের সনাতনী বৈশিষ্ট্যসমূহের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানে একথাও যোগ করা দরকার যে, নৃবিজ্ঞানকে মানব বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান বলার রেওয়াজ থাকলেও বাস্তবে অবশ্য প্রায় কোন নৃবিজ্ঞানীকেই বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এর সকল শাখায় সমান জ্ঞান বা আগ্রহ নিয়ে বিচরণ করেন।

অতীতে যখন নৃবিজ্ঞানীদের নজর কেন্দ্রীভূত ছিল তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠীসমূহের প্রতি, তখন হয়ত একই নৃবিজ্ঞানী নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে একাধারে তাদের প্রাক-ইতিহাস থেকে শুরু করে ভাষা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি অধ্যয়ন করতেন। তবে এ ধরনের উদাহরণ বর্তমানে বিরল।

অতীতে আদিম বলে বিবেচিত বিভিন্ন সমাজ অধ্যয়নের ব্যাপারে আগ্রহের ব্যাপকতা নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে যতটা সমন্বিত রাখতে সহায়তা করেছিল, বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। কাজেই সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বিরাজ করছে, যে কারণে ‘নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী’ বলে অভিন্ন কোন কিছু আছে, এ ব্যাপারে সকল নৃবিজ্ঞানী হয়ত সহজে একমত হবেন না।

সারাংশ

‘নৃবিজ্ঞান’ হল ইংরেজী এ্যান্ড্রোপলজি’-র (anthropology) বাংলা প্রতিশব্দ। এ্যান্ড্রোপলজি কথাটির মূলে রয়েছে একটি গ্রীক শব্দ ‘এ্যান্থো পস’ (anthropos), যার অর্থ মানুষ। সংস্কৃত শব্দ ‘নৃ’ মানেও তাই। কাজেই ‘নৃবিজ্ঞান’ কথাটির অর্থ দাঁড়ায় ‘মানব বিষয়ক বিজ্ঞান’ । মানব বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় এর বিষয়বস্তু ব্যাপকতর পরিধিসম্পন্ন ও অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ। সমকালীন প্রেক্ষাপটে নৃবিজ্ঞান হচ্ছে বিভিন্ন উপবিভাগ সম্বলিত এমন একটি জ্ঞানকান্ড যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানুষ’কে অধ্যয়ন করে।

নৃবিজ্ঞানে একাধারে মানব সত্তার জৈবিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়। একটি প্রজাতি হিসেবে মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে শুরু করে অতীত ও বর্তমানকালের বিভিন্ন ধরনের মানব সমাজের সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন নৃবিজ্ঞানে করা হয়।

বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশাল পরিধির অধিকারী এই জ্ঞানকান্ডের স্বভাবতই রয়েছে বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ক্ষেত্র। মার্কিন ধারার নৃবিজ্ঞানে সচরাচর চারটি প্রধান উপবিভাগ চিহ্নিত করা হয়, এগুলি হল, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান, ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান ও দৈহিক নৃবিজ্ঞান। ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় ধারার নৃবিজ্ঞানে ‘সংস্কৃতি’ ধারণার চাইতে ‘সমাজ’ ধারণার উপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ফলে এই প্রেক্ষিতে ‘সামাজিক নৃবিজ্ঞান’ কথাটি অধিকতর প্রচলিত।

 

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

 

সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান তথা নৃবিজ্ঞানের অন্যান্য উপবিভাগের সাথে অন্যান্য জ্ঞানকান্ডের মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে বিষয়-ভিত্তিক গবেষণার অনেক বিশেষায়িত ক্ষেত্র, যেমন, অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞান, রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান, ধর্মের নৃবিজ্ঞান, প্রতিবেশগত নৃবিজ্ঞান, চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান, ফলিত নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি। বিভিন্ন নামে অভিহিত নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ধারার মধ্যে সাধারণভাবে কিছু অভিন্ন যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। এগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ধারণার ব্যবহার, সমগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, মাঠকর্ম ও তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment