Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা?

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা?

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা?

আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা? – যা  সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন এর অর্ন্তভুক্ত, জ্ঞাতিত্বের তাত্ত্বিক পূর্বানুমান প্রসঙ্গে যে আলোচনা পূর্বের অংশে ছিল, সেটি ছিল প্রধানত জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের প্রত্যয় নিয়ে (“কাঠামো” বনাম “প্রক্রিয়া”, “স্বতন্ত্র পরিসর” বনাম “সমগ্র”)। এখন আরেকটি কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে; এই পূর্বানুমান নিয়ে যে সমালোচনা উঠেছে সেটি জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তিকে মৌলিকভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা?

 

 

রক্তের সম্পর্ক মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে: রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রা এক দলে, যাঁরা রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় নন তাঁরা অন্য দলে। প্রজনন হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক সত্য। প্রজননের প্রাকৃতিক সত্যতা প্রকাশের ভাষা হচ্ছে: আমরা “একই” রক্তের, “ওর আপন চাচা”. “আমার নিজের মা”। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, শিশুটি গর্ভে আসার মুহূর্ত থেকেই তার “আসল” আত্মীয় কারা তা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। শিশুটি পালক হলেও, “আসল” বাবা, মা, ভাই, বোনের ধারণা কার্যকরী যেহেতু, রক্ত সম্পর্ক হচ্ছে জ্ঞাতিত্বের ভিত্তি, এবং সেটি “আসল”।

জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার; কারা একই রক্তের তা গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে প্রতিষ্ঠিত; প্রতিষ্ঠিত এই সত্যটি অপরিবর্তনীয় (আমার “আসল” বাবা চিরদিনের জন্য আমার “আসল” বাবা)। জ্ঞাতি তত্ত্ব | এসব পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, এই ধারণাগুলো সকল সমাজের জন্য, সকল মানুষের জন্য সত্য। আরও ধরে নিয়েছিলেন যে, যেহেতু এগুলি প্রাকৃতিক সত্য (এর কোন নড়চড় নেই), সে কারণে বিভিন্ন সমাজে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণগুলোকে এই সত্য সাপেক্ষে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে।

সত্য-অসত্যের এই ধারণা নৃবিজ্ঞানে ছিল মজ্জাগত। এবং এগুলো প্রোথিত ছিল বৃহত্তর একটি পরিকাঠামোতে : আদিম সমাজ হচ্ছে অযৌক্তিক, অনুভূতিপ্রবণ, ঐতিহ্যবাহী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে যুক্তি নির্ভর, আলোকময় (enlightened), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর। হাল আমলের নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই কারণে নৃবিজ্ঞানে প্রায় শ’ খানেক বছর ধরে বিবর্তনবাদের “পিতৃত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞতা”র ধারণা শক্তিমত্তা অর্জন করে। মর্গান এবং আরও বহু নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, আদিম সমাজে পিতৃ পরিচয় জানা ছিল না।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কেবল মাত্র মায়ের পরিচয় নিশ্চিত ছিল যেহেতু তিনি গর্ভধারিণী এবং প্রসবকারী। বিবর্তনবাদীদের বক্তব্য ছিল, বিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে সন্তান প্রজননে পিতার শরীরী ভূমিকা সম্বন্ধে জ্ঞান তৈরী হয়। এই ব্যাখ্যার তীব্র সমালোচনা প্রথমে তোলেন লীচ, ১৯৬৮ সালের একটি প্রবন্ধে। খ্রিস্টীয় ধর্মে “কুমারী মাতা”র ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সন্তান প্রজননে পিতার ভূমিকার অস্বীকৃতিকে নৃবিজ্ঞানীদের “অজ্ঞানতা” হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং, তাঁদের প্রশ্ন করতে পারা উচিত কেন বিশেষ বিশেষ সমাজে এই তথ্যটি গুরুত্বহীন অথবা অপ্রাসঙ্গিক।

সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞানীদের বিবেচনায়, এই কেন্দ্রীয় তাত্ত্বিক পূর্বানুমান হচ্ছে পাশ্চাত্যীয়। নৃবিজ্ঞানী মেইগস ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, জনপ্রিয় মার্কিন দৃষ্টিতে গর্ভধারণের মুহূর্ত হতে জ্ঞাতিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে “আসল” জ্ঞাতি কে তা পূর্ব-নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। “আপন” বাবা শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে এই মতাদর্শে জৈবিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সংস্কৃতিতে বংশবৃত্তান্ত বা কুলুজীর ব্যাপারে রয়েছে মুগ্ধতা এবং অধিক আগ্রহ। মেইগস লেখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বইয়ের দোকানগুলোতে বর্তমানে অন্তত ৫০টি নিজ কুলুজি তৈরী করার গাইড বই পাওয়া যাবে।

পালিত সন্তানদের “নিজ”র বাবা-মা সন্ধান করার যে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, তা মেইগসের মতে, “আসল” জ্ঞাতি বন্ধন যে জন্ম হতে নির্ধারিত, এই ধারণার শক্তিমত্তা প্রমাণ করে। এই মতাদর্শ মতে, জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার। একই রক্ত হওয়ার সূত্রে যে বন্ধন তা, মার্কিন মতাদর্শে, অপরিবর্তনীয় এবং চিরকালের জন্য।

 

 

মার্কিন মতাদর্শ পাশ্চাত্যীয় মতাদর্শের অংশ। কিছূ নৃবিজ্ঞানী মনে করেন যে, পাশ্চাত্যীয় স্বাভাবিকত্বের ধারণা জ্ঞাতিত্বের ধারণায়নকে প্রভাবিত করেছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের মাঠ গবেষণা পদ্ধতি এই মতাদর্শকে ধারণ করে। এবং, এই গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণ, অপাশ্চাত্য সমাজের জ্ঞাতি সম্পর্কের বিবিধতাকে কেবলমাত্র অস্বীকার করেনি, পাশ্চাত্যীয় ধ্যান-ধারণা কে অপাশ্চাত্য সমাজে আরোপন করছে।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version