Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান প্রশ্নের সম্মুখীন

আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান প্রশ্নের সম্মুখীন – যা  সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন এর অর্ন্তভুক্ত,  নৃবিজ্ঞানে এপর্যন্ত অনুশীলিত জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন চারটি পূর্বানুমানের উপর ভর করেছে। প্রথম তিনটি হ’ল :

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান প্রশ্নের সম্মুখীন

 

 

পূর্বানুমান ১

আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি মূলনীতি, সামাজিক জীবন জ্ঞাতি বন্ধন দ্বারা সংগঠিত। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন, অধিকাংশ আদিম সমাজে বংশীয় দল জ্ঞাতি বন্ধনকে সংগঠিত করে। পক্ষান্তরে, পাশ্চাত্য সমাজে অপরাপর প্রতিষ্ঠান আছে (যেমন কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র) যেগুলো সামাজিক জীবনের সাংগঠনিক মূলনীতি হিসেবে কাজ করে। আদিম সমাজের জ্ঞাতি ভিত্তিক দলের কাঠামো বুঝতে নৃবিজ্ঞানীরা ‘বহির্বিবাহ’ এবং ‘বিনিময়’-এর ধারণার সাহায্য নিয়েছেন। তাঁদের মতে, বিয়ে একটি বিনিময় ব্যবস্থা এবং বহির্বিবাহের মাধ্যমে একটি বংশীয় দল অপর একটি বংশীয় দলের সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে । এই সম্পর্ক স্থাপন, জ্ঞাতিভিত্তিক দলের পুনর্জন্ম নিশ্চিত করে।

পূর্বানুমান ২

 আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র পরিসর। বহু নৃবিজ্ঞানী (এবং মজার ব্যাপার হ’ল, তাঁরা বিরুদ্ধ তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির) মার্কিনী নৃবিজ্ঞানী নেপোলিয়ান শ্যানো’র সাথে একমত হবেন যে, জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে আদিম সামাজিক কাঠামোর “প্রাণ”। নৃবিজ্ঞানীরা যেহেতু ধরে নিয়েছিলেন যে, প্রতিটি আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব নামক নির্দিষ্ট কিছু আছে, এবং এটি সকল আদিম সমাজের সাংগঠনিক মূলনীতি, সে কারণে নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বাস্তবিক অর্থে, প্রতিটি সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র পরিসর (distinct domain)।

এভাবে দেখার কারণে, কিছু নৃবিজ্ঞানীর মনে হয়েছে যে, আদিম সমাজের অপর তিনটি ক্ষেত্র: রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্ম, গড়ে উঠে জ্ঞাতিত্ব বন্ধনের সাপেক্ষে । নৃবিজ্ঞানীদের সৃষ্ট এধরনের যুক্তি এবং ধ্যান-ধারণা, জ্ঞাতিত্বকে গড়ে তুলেছে আদিম সমাজের একটি কেন্দ্রীয় এবং “স্বতন্ত্র” পরিসর হিসেবে।

 

 

পূর্বানুমান ৩

 জ্ঞাতিত্ব মূলত কি? এই প্রশ্নের উত্তরে নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, জ্ঞাতিত্বের মূলে রয়েছে, মানুষের প্রজনন। প্রজনন হচ্ছে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক। প্রজনন হচ্ছে একটি সর্বজনীন সত্য: প্রতিটি সমাজে পেটে বাচ্চা আসা, মানুষের জন্ম গ্রহণ, বেড়ে ওঠা, এবং মৃত্যু, এগুলো ঘটে থাকে। শুধু ঘটে বললে চলবে না, একই প্রক্রিয়ায় ঘটে। এই বিষয়গুলো কেবলমাত্র সকল সমাজের জন্য সত্য নয়, একইভাবে সত্য। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, প্রজন্মের জৈবিকতা হচ্ছে জীববিজ্ঞানীদের “ক্ষেত্র”। জৈবিকতার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণ হচ্ছে নৃবিজ্ঞানীদের কর্মক্ষেত্র (তাঁদের “field”)। কিন্তু, প্রজনন যেহেতু মূলত জৈবিক, সে কারণে জৈবিকতা হচ্ছে মুখ্য (primary) এবং এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণ গৌণ (secondary)।

বিগত কয়েক দশকে নৃবিজ্ঞানে একটি মৌলিক বদল ঘটেছে, এই বদল অন্যান্য জ্ঞানকান্ডেও দেখা গেছে। বদলটি তত্ত্ব এবং জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology), দুটোকেই কেন্দ্র করে ঘটেছে। জটিল প্রসঙ্গে না ঢুকে, সহজভাবে বললে, এই বদলের কারণে মূলত দুই ধরনের পুনর্বিবেচনা করা চলে। এক, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যে সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যেমন, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, পরিবার গঠন ইত্যাদি, এসব বিষয়কে নতুন প্রত্যয়নের সাহায্যে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।

এর কিছু নমুনা আপনি এ পর্যন্ত উপস্থাপিত পাঠ সমূহে পেয়েছেন (উদাহরণস্বরূপ, ডেভিডফ এবং হল, হিলারি স্ট্যান্ডিং, এবং রায়না র‍্যাপের লিঙ্গ ও শ্রেণীর অন্তপ্রবিষ্টতা সম্পর্কিত আলোচনা)। দুই, আরও মৌলিক বিষয় প্রসঙ্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেগুলো হল: জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের মূলনীতি, মূলনীতি গড়ে উঠার ইতিহাস, মূলনীতি এবং পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিকতা, মাঠ-গবেষণা পদ্ধতি, পদ্ধতি ও উৎপাদিত জ্ঞানের সম্পর্ক ইত্যাদি।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে কিছু বদল ধীরে ধীরে ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু হতে থাকে। প্রথম একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী জ্যাক গুডি। তিনি প্রস্তাব করেন যে, জ্ঞাতি দলকে কাঠামো হিসেবে না দেখে এটিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত। তাঁর বিবেচনায়, গৃহস্থালী গঠন একটি কাঠামো নয়, এটি একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। কিছুদিন পর, জ্যাক গুডি, এডমান্ড লীচ এবং আরও কিছূ নৃবিজ্ঞানী জ্ঞাতিত্বকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার প্রবণতার সমালোচনা দাঁড় করান।

অজাচারের আলোচনা প্রসঙ্গে গুডি বলেন, অজাচারকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে, এটিকে স্থাপন করা উচিত বিষমকামী (heterosexual) সম্পর্কের সামগ্রিক পরিসরে যেখানে অজাচার অন্যান্য যৌন অপরাধের (যেমন ব্যভিচার, অবিবাহিত নারী-পুরুষের যৌন মিলন ইত্যাদি) মধ্যে একটি। একই ধারার পরামর্শ নৃবিজ্ঞানী রিভিয়ের বিয়ে প্রসঙ্গে দেন। তাঁর মতে, বিয়েকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করা উচিত। তিনি মনে করেন, বিয়েকে দেখা উচিত সমাজে নারী ও পুরুষের সামগ্রিক সম্পর্কের একটি দিক হিসেবে। বিয়ে হচ্ছে, তাঁর দৃষ্টিতে বিদ্যমান লিঙ্গীয় সম্পর্কের একটি ফলাফল মাত্র।

বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করার এই উদীয়মান ধারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে লীচের শ্রীলংকার কাজের কারণে। গুড়ি এবং রিভিয়ের যেখানে অজাচার এবং বিয়েকে সামগ্রিক লিঙ্গীয় সম্পর্কে স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, সেখানে লীচের বক্তব্য ছিল আরও দ্বিধাহীন। তিনি বলেন, “ভূমি এবং সম্পত্তির বাইরে জ্ঞাতিত্ব ব্যবস্থার ভিন্ন কোন অস্তিত্ব নেই”। পরবর্তীকালে, একই ধরনের বিশ্লেষণ ফরাসী কাঠামোবাদী মার্ক্সবাদী যেমন ইম্যানুয়েল টেরে, ক্লদ মেয়াসুর কাজের সাহায্যে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। টেরে এবং মেয়াসু জ্ঞাতিত্বকে দেখেন রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে।

নারীবাদী নৃবিজ্ঞানীদের কাজের জোয়ার আরম্ভ হয় ১৯৬০-এর শেষ এবং ১৯৭০-এর প্রথম দিকে। এটি এখনও চলমান। নারীবাদীরা জ্ঞাতিত্বকে বৃহত্তর লিঙ্গীয় সম্পর্কের বাইরে দেখতে রাজি নন; সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা লিঙ্গীয় সম্পর্কের সাথে যুক্ত করেছেন শ্রেণীগত সম্পর্ক (উদাহরণস্বরূপ রায়না র‍্যাপ, হিলারী স্ট্যান্ডিং)। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী অবস্থান থেকে লিঙ্গ, শ্রেণী এবং নরবর্ণ – বৈষম্যের এই তিন

প্রধান মূলনীতির অন্তপ্রবিষ্টতা অনুসন্ধান করা প্রয়োজনীয়। জ্ঞাতিত্বের স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থা নিয়ে তাত্ত্বিক অসন্তোষের সুরাহা লীচ একভাবে করেছিলেন। ফরাসী কাঠামোবাদী মার্ক্সবাদী মেয়াসু এবং টেরে করেছিলেন আরেকভাবে। তাত্ত্বিক এই অসন্তোষকে আরও উচ্চতর জায়গায় ঠেলে দিলেন মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ডেভিড শাইডার। তিনি বলেন, জ্ঞাতিত্বকে স্থাপন করতে হবে সামগ্রিক “সংস্কৃতির” প্রেক্ষিতে। শ্লাইডারের দৃষ্টিতে এটি জরুরী কারণ তা না হলে আমাদের পক্ষে সংস্কৃতির সামগ্রিক বিন্যাস বোঝা সম্ভব হবে না ।

“কাঠামো”র পরিবর্তে জ্ঞাতিত্বকে সমাজ জীবনের একটি “প্রক্রিয়া” হিসেবে বিবেচনা করার কারণে নতুন ধরনের গবেষণা কাজ ও লেখালেখি আরম্ভ হয়। পুরোনো দৃষ্টিতে গবেষণার বিষয় হত পরিবারের কাঠামো এবং এটির ভূমিকা। নতুন দৃষ্টিতে ভিন্ন ধরনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল: পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া, এ প্রক্রিয়ায় পরিবার ও জ্ঞাতি দল বাদে আর কোন কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত, সামাজিক প্রতিষ্ঠান কি উপায়ে পুনরুৎপাদনকে সংগঠিত করে ইত্যাদি। পূর্বে নৃবিজ্ঞানীরা যেখানে অর্থনীতিকে প্রত্যয়ন করতেন একটি “ব্যবস্থা” হিসেবে, নতুন ধারণায়নের ফলে নৃবিজ্ঞানীরা এটিকে দেখা আরম্ভ করলেন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে (উদাহরণস্বরূপ, হিলারি স্ট্যান্ডিং)।

 

 

প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক কাজে সচরাচর এধরনের জিজ্ঞাসা দেখা যেত: অমুক সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জ্ঞাতি এবং বংশীয় দলের ভূমিকা কি? উৎপাদন এবং বিনিময় প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে নতুন ধারার কাজে নৃবিজ্ঞানীরা জিজ্ঞাসা তোলেন জ্ঞাতি ও বংশীয় দল, এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কিভাবে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত। কোন একটি সমাজের “জ্ঞাতি ব্যবস্থা”র প্রতি মনোনিবেশ করার পরিবর্তে নতুন ধারার কাজে রত নৃবিজ্ঞানীরা জ্ঞাতিত্বকে তাদের কাজে অন্তর্ভুক্ত করছেন। ধরুন, যিনি কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদী রূপান্তর নিয়ে কাজ করছেন, তিনি জ্ঞাতি বন্ধন কিভাবে এই রূপান্তরের ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে সেটির উপর গুরুত্ব আরোপ করছেন।

জ্ঞাতিত্বকে সামাজিক জীবনের অংশ হিসেবে দেখার কারণে খোদ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের চেহারা বদলে গেছে। পঞ্চাশ ষাট বছর পূর্বের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের বই শুধুমাত্র জ্ঞাতিত্বের চার্ট, ডায়াগ্রাম, ছকে পরিপূর্ণ থাকত (“জ্ঞাতি বীজগণিত”) সাম্প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যেহেতু টেকনিকেল না (নিয়ম-ব্যবস্থা,  পদাবলী ব্যবস্থা) সে কারণে বইগুলো হয় আরও আলোচনা-ভিত্তিক ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version