প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম। সুমেরীয় ধর্ম ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার প্রথম সাক্ষর সভ্যতা সুমেরের অধিবাসীগণ কর্তৃক আচরিত ও অনুসৃত ধর্ম। সুমেরীয়রা মনে করত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের জন্য দায়ী তাদের দেবদেবীরা।

প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম

 

প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম

 

প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম

লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত সুমেরীয় পুরাণকথাগুলি মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল (এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম পুরাণকথাটি হল গিলগামেশের মহাকাব্য; এটি সুমেরীয় এবং ধারাবাহিকভাবে ভাঙা মৃৎফলকে লিখিত)। আদি সুমেরীয় কিউনিফর্ম ব্যবহৃত হত প্রধানত নথিরক্ষণের কাজে। আদি রাজবংশীয় যুগের শেষভাগেই প্রথম ধর্মীয় রচনার উদ্ভব ঘটে। সেই যুগে ধর্মীয় রচনা বলতে ছিল মন্দির প্রশস্তিসূচক স্তোত্রাবলি এবং নাম-শুব (উপসর্গ + “নিক্ষেপ করা”) নামে পরিচিত “জাদুমন্ত্র”-এর একটি রূপ এই ফলকগুলি নির্মিত হত কাদাপাথর বা পাথরে এবং এক ধরনের ছোটো কুড়ুলের মাধ্যমে তাতে প্রতীক ইত্যাদি অঙ্কন করা হত।

কিউনিফর্ম লিপি বিশ্বের প্রাচীন লিপিগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেক ভাষাবিদ মনে করেন, কিউনিফর্ম লিপি মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিকের চেয়েও পুরনো। ইংরেজিতে একে বলে Cuneiform script। এর অর্থ গোঁজ আকৃতি। এই লিপির আকৃতি কীলক বা ছোট্ট তীরের মতো হওয়ার কারণে এদের কিউনিফর্ম বা কীলক লিপি বলা হয়। সুমেরীয়রা এর আবিষ্কারক। এটি আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বে ব্যবহৃত লিপি। কাদামাটির চার কোনা পাতে লেখার পর আগুনে পুড়িয়ে একে স্থায়ী করা হতো।

এটি প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় ব্যবহার করা হতো। হামুরাবির আইনবিধি এই লিখন পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করা হয়। কিউনিফর্ম বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রের সমন্বয়ে লেখার পদ্ধতি। এটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে গঠিত কোনো বর্ণমালা নয় এবং এতে নির্দিষ্ট বা ধরাবাঁধা কোনো অক্ষরও নেই।

নির্দিষ্ট অক্ষরের পরিবর্তে ৬০০ থেকে ১০০০-এর মতো কীলক আকৃতির শব্দ বা তাদের অংশের শেপ ব্যবহার করে লেখা হতো। সুমেরীয়দের পর আক্কাদিয়ানরাও তাদের ভাষা লেখার জন্য এই লিখন পদ্ধতি গ্রহণ করে। প্রাচীন যুগে কিউনিফর্ম খুবই জনপ্রিয় লিখন পদ্ধতি ছিল। সুমেরীয় ও আক্কাদিয়ান বাদে অ্যাসিরিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান, এব্লেইট, আমোরাইট, অ্যালামাইট, হাত্তিক, হুররিয়ান, উরার্তিয়ান, হিট্টাইট, লুউইয়ান ভাষা এই লিখন পদ্ধতিতে লেখা হতো। কিউনিফর্ম লিপিকে প্রথম সংস্কার করেন পারস্য সম্রাট দারিয়ুস।

প্রাচীন সুমেরে ‘কিউনিফর্ম’ লিপির প্রচলন ছিল একথা আগেই বলা হয়েছে। এটা ছিল অক্ষরভিত্তিক বর্ণলিপি। এ লিপি কখন আবিষ্কৃত হয়েছিল তা বলা কঠিন তবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি (প্রায় ৩৫০০ খ্রিঃ পূঃ) থেকে এর ব্যবহার দেখা যায়। কিউনিফর্ম লিপির যে সব প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে সেগুলো স্পষ্টতই বিভিন্ন বস্তু ও প্রাণীর প্রতীক।

এ বিষয়ে তাই কোনো সন্দেহ নেই যে, চিত্রলিপি থেকেই কিউনিফর্ম লিপির উদ্ভব ঘটেছিল। এ সব চিত্র-প্রতীক ক্রমশ ধ্বনিব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে অর্থাৎ এক একটা চিত্র দিয়ে এক একটা ধ্বনির সমষ্টিকে বোঝানো শুরু হয়েছে। চিত্রগুলোও ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার ধারণ করেছে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

যেমন, চিত্রলিপিতে যেটা মানুষের মাথা ছিল, ক্রমে তা রূপান্তরিত হয়ে এমন কতগুলো রেখায় পর্যবসিত হল যে, না বলে দিলে বোঝার জো নেই যে সেটি মানুষের মাথা। কিন্তু সুমেরীয়রা বা ব্যবিলনীয়রা এ রেখাগুলোকেই মানুষের মাথা হিসাবে শিখত এবং তাই বলত। অবশ্য, সুমেরীয় ভাষায় ঐ শব্দটি ছিল ‘কা’ এবং মানুষের মাথার প্রতীকটিকে কিউনিফর্ম লিপিতে ‘কা’ ধ্বনিটির প্রতীক হিসেবেই নেয়া হত।

 

প্রাচীন সুমেরে কিউনিফর্ম

 

প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ কিউনিফর্ম ফলক বা ট্যাবলেট পাওয়া গেছে। এই লিপির পাঠোদ্ধারের সূচনা করেন আইরিশ পাদ্রি এডওয়ার্ড হিংকস। বেশির ভাগ ট্যাবলেট সাংসারিক সাধারণ হিসাব বা শস্য গণনার জন্য ব্যবহৃত হতো। তাদের মধ্যে কিছু শিলালিপিতে প্রাচীন মেসোপটেমীয় জীবনের সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এর বাইরে জটিল জ্যোতির্বিদ্যার গণনায় ব্যবহৃত হতো কিছু কিউনিফর্ম। ব্যাবিলনীয়দের তিনটি কিউনিফর্ম থেকে সবচেয়ে প্রাচীন রন্ধন প্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়। এই বিশেষ শিলালিপিতে স্টিউ ও সুপের জন্য ২৫টি রেসিপি (মাংস ও নিরামিষ উভয়), কিছু নির্দেশাবলিসহ বর্ণনা রয়েছে। তবে কোনো পরিমাপ বা কত সময় রান্না করতে হবে, তা লেখা নেই। বর্তমানে ব্রিটিশ জাদুঘরসহ বার্লিন, ইরাক, তুরস্ক ইত্যাদি দেশের জাদুঘরেও কিউনিফর্ম ট্যাবলেট সংরক্ষিত আছে।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment