বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে ড. অতুল সুর তার “বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন” বইয়ে লিখেছেন :- বাঙালী বলতে আমরা মাত্র তাদেরই বুঝি যাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং যারা বাঙলাদেশে এক বিশেষ সংস্কৃতির বাহক। তার মানে, বাঙলার এক স্বকীয় ভাষা ও এক বিশেষ সংস্কৃতি আছে।

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় - ড : অতুল সুর [ Dr. Atul Sur ]
ড : অতুল সুর [ Dr. Atul Sur ]
বাঙলার স্বকীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা। অন্যান্য রাজ্যের ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। এ ভাষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল বাঙলার আদিম অধিবাসীরা। তারা যে প্রাকৃ-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা, বাংলাভাষার অন্তভুক্ত এই গোষ্ঠীর লোকদের ভাষার শব্দসমূহের প্রাচুর্য তার সাক্ষ্য বহন করছে। এই নরগোষ্ঠীর ভিত্তির ওপরই পরবর্তীকালে অন্যান্য নরগোষ্ঠীসমূহ স্তরীভূত হয়েছিল। এই অন্যান্য নরগোষ্ঠীর অন্তভুক্ত ছিল দ্রাবিড়-ভাষাভাষা, আর্য-ভাষাভাষী জাতিসমূহ ইত্যাদি। এদের সকলেরই ভাষা বাংলাভাষার অন্তভুক্ত হয়ে গিয়েছে।

[ বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ]

প্রাকৃ-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোকরাই বাঙলার প্রকৃত আদিবাসী। তারা যে ভাষায় কথা বলে তাকে ‘অস্ট্রিক’ ভাষা বলা হয়। ‘অস্ট্রিক’ বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, এই ভাষার বিস্তৃতি ছিল পঞ্জাব থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। ভারতে এই ভাষার বর্তমান প্রতিভূ হচ্ছে ‘মুত্তারী’ ভাষা—যে ভাষায় সাঁওতাল, ভীল, কুরুথ, কোরওয়া, জুয়াড, কোরফু প্রভৃতি উপজাতিরা কথা বলে। যদিও ‘অস্ট্রিক’ ভাষার শব্দ ভারতের সব ভাষার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, তবুও বাংলাভাষায় এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। তবে বাংলাভাষাও এদের ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে ।

‘অস্ট্রিক’-ভাষাভাষী লোকদের পরে এদেশে এসেছিল, দ্রাবিড়-ভাষাভাষী লোকরা। তারা ক্রমশ মিশে গিয়েছিল আদিম ‘অস্ট্রিক’-ভাষাভাষী লোকদের সঙ্গে। দ্রাবিড়-ভাষাভাষী লোকদের পর এসেছিল আর্য ভাষাভাষী এক নর গোষ্ঠী। এরা ইউরোপের ‘আলপাইন’ নরগোষ্ঠীর সমতুগ। ভারতের বর্তমান জনতার মধ্যে এদের অস্তিত্ব প্রকাশ পায় পশ্চিমে বারাণসী থেকে পূর্বে বাংলাদেশ পর্যন্ত। তবে বাঙলাদেশেই এই নরগোষ্ঠীর বংশধরদের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষিত হয়।

সেজন্য মনে হয় তারা সমুদ্রপথেই বাঙলাদেশে এসেছিল এবং পরে এখানে বসতি স্থাপনের পর ক্রমশ পশ্চিমদিকে উত্তরপ্রদেশের পূর্বপ্রাস্ত পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতে এসেছিল আর্য-ভাষাভাষী আর এক নরগোষ্ঠী। তারা উত্তর-পশ্চিমের সীমান্তপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে পঞ্চনদের উপত্যকায় বসবাস শুরু করেছিল। এরাই রচনা করেছিল ঋগ্বেদ।

এরা ক্রমশ পূর্বদিকে নিজেদের বিস্তৃত করেছিল বিদেহ বা মিথিলা পর্যন্ত। এখানে এসেই তারা প্রতি হত হয়েছিল প্রাচ্যদেশের লোকদের কাছে। প্রাচ্যদেশের লোকরা ছিল এক পৃথক সংস্কৃতির বাহক এবং শৌর্যবীর্যে তারা ছিল বৈদিক আর্যদের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ।

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় - অতুল সুর
বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – অতুল সুর

আগেই বলা হয়েছে যে, প্রাচ্যদেশের আদিম অধিবাসীরা ছিল ‘অস্ট্রিক’-ভাষা ভাষী গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের প্রাকৃ-দ্রাবিড় বা আদি-অস্থাল বলা হয়। এদের আদি-অস্ত্রাল বলবার কারণ হচ্ছে এই যে অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে এদের মিল আছে। দৈহিক গঠনের মিল ছাড়। অস্ট্রেলিয়ার খাদিম অধিবাসীদের সঙ্গে এদের রক্তের মিলও আছে।

মানুষের রক্ত সাধারণত চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয় – ‘ও’, ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘এ-বি’। ভারতের প্রাকৃ-দ্রাবিড় ও অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসী এই উভয়ের রক্তেই ‘এ’ এমটিলোজেনের (‘A’ Agglutinogen) শতকরা হার খুব বেশী। তা থেকেই উভয়ের রক্তের সাদৃশ্য বোঝা যায়। এদের দৈহিক গঠনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা খর্বাকার ও এদের মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি। নাক চওড়া ও চ্যাপটা, গায়ের রঙ কালো, মাথার চুল ঢেউ-খেলানো।

তিনে ভেলী জেলায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে সকল মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে এই শ্রেণীর খুলিও আছে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা ‘নিষাদ’ জাতির উল্লেখ পাই। সেখানে বলা হয়েছে যে এরা অনাস, এদের গায়ের রঙ কালো ও এদের আচার-ব্যবহার ও ভাষা অদ্ভূত। হতরাং প্রাচীন সাহিত্যের ‘নিষাদ’রাই যে আদি-অরালগোষ্ঠীর কোনও উপস্থাতি সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।

মনে হয় এই মুলজাতির এক শাখা দক্ষিণভারত ত্যাগ করে ইন্দোনেশিয়া মেলেনে শিয়ায় যায় এবং গিয়ে উপস্থিত হয়। বর্তমানে দক্ষিণ মধ্যভারতের উপজাতিদের অধিকাংশই আদি-অস্ত্রালগোষ্ঠীর লোক। আদিবাসীদের মধ্যে লোধা, ভূমিজ, মহালি, মুত্তা, উপজাতিসমূহও এই অন্তর্ভুক্ত। এ হিন্দুসমাজের তথাকথিত ‘অস্ত্যজ’ জাতিসমূহও এই লোক।

দ্রাবিড় ‘ভূমধ্যীয়’ বা ‘মেডিটেরেনিয়ান’ নরগোষ্ঠীর লোক বলা হয়। আকৃতি মধ্যমাকার এদের গড়ন পাতলা, নাক ছোট ময়লা। আদি-মিশরীয়দের সঙ্গে জাতির মিল আছে। আদিতান্ন সমাধিপাত্রে দক্ষিণভারতের সমাবিস্তূপগুলিতে যে সকল কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, তাদের ‘ভূমধ্যীয়’ নরগোষ্ঠীর লোক। বর্তমানে গোষ্ঠীর লোকদের দক্ষিণভারতেই প্রাধান্য দেখা যদিও অনুমান করবার সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে যে, একসময় এদের বিস্তৃতি উত্তরভারত পর্যন্তও ব্যাপ্ত ছিল। বলা বাহুল্য, এরা ভূমধ্যসাগরীয় উপকুল অঞ্চলসমূহ থেকেই এদেশে এসেছিল। খুব সম্ভবত সাহিত্যে উক্ত এই গোষ্ঠীরই লোক ছিল।

লোকেরা আলপীয় Alpine) (২) নর্ডিক Nordic)। গোষ্ঠীর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমূলক প্রভেদ মাথার আকার। আলপীয়রা হ্রস্ব-কপাল জাতি, আরনটিকরা দীর্ঘ-কপাল জাতি। মালভূমিতে বাস করলে দৈহিক লক্ষণ পায়, হ্রস্ব-কপাল গোষ্ঠীর লোকরা সেইসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল।

অনুমান করা যে, মধ্য-এশিয়ায় যে পর্বতমালা তারই নিকটবর্তী কোন স্থানে হ্রস্ব-কপাল গোষ্ঠীর প্রথম জন্ম হয়েছিল। কপাল লোকের বৈশিষ্ট্য তারা মধ্যমাকার, খুলি অপেক্ষাকৃত ছোট ও চওড়া, খুলির পিছনের অংশ গোল, নাক লম্বা, মুখ গোল ও গায়ের রঙ ফরসা। মনে হয় এদের একদল এশিয়।

মাইনর বা বালুচিস্তান থেকে পশ্চিমদাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ সিন্ধু, কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ, কল্লাদ ও তামিলনাড়ু প্রদেশে পৌছায় এবং তাদের আর একদল পূর্ব-উপকূল ধরে বাঙলা ও ওড়িশায় আসে। আরও মনে হয় তারা দ্রাবিড়দের অহুসরণে এসেছিল।

দ্রাবিড় [ Drabir ]
দ্রাবিড় [ Drabir ]
আর্য-ভাষাভাষী নর্ডিকরা ছিল উত্তর এশিয়ার তৃণভূমির অধিবাসী। খ্রীস্ট পূর্ব দু’হাজার থেকে এক হাজার বছরের অন্তবর্তী কোনও এক সময় এদের এক বড় দ্বারা স্থলপথে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন এদের সঙ্গে কারা ( Kassites) ছিল। এদেরই অন্য এক শাখা ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারতের দিকে এগিয়ে আসে ও পঞ্চনদের উপত্যকায় পৌঁছে সেখানে বসতি স্থাপন করে। পঞ্জাব, কাশ্মীর ও উত্তরপ্রদেশের উচ্চতর জাতিসমূহের মধ্যে এদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।

তবে উত্তরভারতে ভূমধ্যীয় জাতির সঙ্গে এদের সংমিশ্রণ সর্বত্রই স্পষ্ট। এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা বলিষ্ট, গৌরবর্ণ ও দীর্ঘাকার, মাথা বেশী লম্বা, নাক খুব সরু ও লম্বা এবং দৈহিক ওজন বেশ ভারী। ভারতের জনসমাজের মধ্যে নর্ডিক উপাদান পূর্বদিকে বারাণসী পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। তার পূর্বদিকে আপীয় উপাদানই বৌ।

যদিও বাঙালী মিশ্র জাতি, তা হলেও উচ্চশ্রেণীর বাঙালীরা হচ্ছে আর্য-ভাষা ভাষী আলূপীয় নরগোষ্ঠীর লোক ও তারা উত্তরপ্রদেশের আর্য-ভাষাভাষী নর্ডিক নরগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক একখানি প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে (অষ্টম শতাব্দীতে রচিত ) বলা হয়েছে যে বাঙলাদেশের আর্য-ভাষা ভাষী লোকরা অসুরজাতিভুক্ত। এখন কথা হচ্ছে, এই অসুরজাতির লোকরা কারা এবং তারা কোথা থেকেই বা বাঙলাদেশে এসেছিল ?

বৈদিক ও বেদোত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে ‘অসুর’ শব্দটির খুব ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় দেব গণের বিরোধী হিসাবে। অনেকে মনে করেন যে ‘অসুর’ বলতে আর্যপূর্ব যুগের দেশজ অধিবাসীদের বোঝায়। যদি অসুররা বৈদিক আর্যগণের আগমনের পূর্বে ভারতে এসে থাকে, তাহলে তারা যে দেশজ, এই মতবাদ গ্রহণে কোনও আপত্তি নেই।

বৈদিক সাহিত্যে আমরা ‘দাস’, ‘দহা’, ‘নিষাদ’ ইত্যাদি আরও অনেক দেশজ জাতির নাম পাই। সুতরাং বৈদিক আর্যদের ভারতে আগমনের পূর্বে এদেশে যে একাধিক জাতি বাস করত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এদের অনেককেই অনার্য ভাষাভাষী বলা হয়েছে। কিন্তু সকলেই যে অনার্য ভাষাভাষী ছিল তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। বরং বৈদিক আর্যগণের ভারতে আগ মনের পূর্বে আগত আপীয় নরগোষ্ঠীর লোকরা যে আর্য-ভাষাভাষী ছিল তার সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে।

Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
যদি বৈদিক আর্য ও অসুররা উভয়েই আর্য-ভাষা ভাষী হয় তাহলে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে, ভারতে আগমনের পূর্বে উভয়ে একই সাধারণ বাসস্থানে বাস করত। এইস্থানে বাসকালে অসুর দের মধ্যে একটা বিশিষ্ট জীবনচর্যা ও ধর্ম গড়ে উঠেছিল। এই জীবনচর্যা ও ধর্ম বৈদিক আর্যগণের জীবনচর্যা ও ধর্ম থেকে বহুলাংশে পৃথক ছিল: বৈদিক আর্যগণ ভারতে আগমনের পূর্বে অনেকগুলি নূতন দেবতার আরাধনার পত্তন করেছিল। এই নূতন দেবতাগণকে তারা ‘দেইবো’ ( প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ) বা ‘দইব’ ( ইন্দো-ইরানীয় ) বা ‘দেব’ (সংস্কৃত) নামে অভিহিত করত।

আর আর্য-ভাষা ভাষী অপর গোষ্ঠী তাদের আরাধ্যমগুলীকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করত। এই পরম্পরা থাকার দরুন প্রাচীন পারসিকরা ও বৈদিক আর্যগণও তাদের অনেক দেবতাকে কখনও কখনও ‘অসুর’ নামে অভিহিত করত। বস্তুত প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে অসুরগণের যেমন নিন্দাবাদ ও কটাক্ষ প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনই আবার দেব উপাসকগণের প্রধান আরাধ্য দেবতা ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাগণকে ‘অসুর’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে দেব উপাসকগণ ও অসুর-উপাসকগণ উভয়েই কোনও সময় একই সাধারণ অঞ্চলে বাস করত।

প্রাচীন অস্স্থর বা আসিরীয় রাষ্ট্রের প্রধান উপাস্থ্য দেবতার নামও অসুর ছিল। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, আসিরীয়রাও আর্য-ভাষাভাষী লোক ছিল। এদের একাধিক রাজার নাম, যথা— অস্থর-বানিপাল, অসুর নসিরপাল, শলমেনেশ্বর, প্লাম্যাম-উকিন, অসুর-উবলিত, তাদের আর্যত্ব হুচিত করে।

আর্যরা যখন দেব-উপাসক ও অসুর-উপাসক এই দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন অহর-উপাসকমণ্ডলীর প্রধান আরাধ্য হল বরুণ ও দেব-উপাসক গণের আরাধ্য হল ইন্দ্র। ক্রিস্টেনসেনের মতে যারা অপেক্ষাকৃত মার্জিত-রুচি সম্পন্ন ও চিন্তাল ছিল এবং যাদের জীবিকা ছিল মুখ্যত কৃষি ও গোপালন তারাই হয়েছিল অসুরপন্থী। আর যারা সভ্যতার মানদণ্ডে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধার দল ছিল তারা হয়েছিল দেবপন্থী।

উত্তরকালে এই অসুরপন্থীরা এশিয়া মাইনর, ইরান ও ভারতে বসতি স্থাপন করে। আর দেবপন্থীরা উত্তর পশ্চিমের গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে পঞ্চনদের উপত্যকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। দিলীপকুমার বিশ্বাস বলেছেন—বস্তুত বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীন তম অংশে ‘অসুর’ শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশংসাসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অসুরপন্থীগণ যে উন্নত সভ্যতার অধিকারী, এরূপ স্পষ্ট ইঙ্গিতও বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়।

মায়া বা ইন্দ্রজাল শক্তি বিশেষভাবে অস্থরপন্থীগণের আয়ত্ত, এই ধারণা বৈদিক যুগেও ছিল। পরবর্তী মহাকাব্য-পুরাণাদিতে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। স্থাপত্যবিদ্যাতে এদের অসাধারণ পারদর্শিতার কাহিনী সুবিদিত ও এই প্রসঙ্গে ময়াস্থর বা ময়দানবের নাম উল্লেখযোগ্য।

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি নিরূপণ করতে গিয়ে স্তার হারবার্ট রিজনী বাঙলার অধিবাসিবৃন্দকে মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিব্বয়ের সংমিশ্রণে উদ্ভূত বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বাঙালী ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, চট্টগ্রামের রাজবংশী মগ, বাকুড়া ও মেদিনীপুরের মাল এবং জলপাইগুড়ি ও রংপুরের কোচ জাতিগণকে একই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নিয়েছিলেন, এবং যেহেতু বিস্তৃত-শিৱস্কতা ও বিস্তৃতনাসিকা যথাক্রমে মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিদ্বয়ের বৈশিষ্ট্য এবং এই দুই লক্ষণ উচ্চশ্রেণীর বাঙালী ব্যতীত উপরি-উক্ত অন্যান্য জাতিসমূহের মধ্যে বিশেষ ভাবে পরিদৃষ্ট হয়, সেই হেতু তিনি অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, তাদের এই দুই নৃতাত্ত্বিক লক্ষণ মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিব্বয়ের নিকট হতে প্রাপ্ত।

কিন্তু বিজলী বাঙলার যে-সকল জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের সমষ্টিগত ফলের ওপর ভিত্তি করে উপরি-উক্ত মত প্রকাশ করেছিলেন, সেই সকল জাতি যদিও বাঙলার রাষ্ট্রীয় গণ্ডীর মধ্যে বাঙালীর সঙ্গে বাস করত, তথাপি তারা সকলে বাঙালী বলতে যা বোঝায়, তা নয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, বাঙলার উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি জাতিসমূহ চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলের পার্বত্য উপজাতিগণের সঙ্গে এক নয়।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে উল্লেখ যেতে পারে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের রাজবংশী মাগণ (যাদের পরিমাপ রিজলী নিজের মত সংমিশ্রিত করেছিলেন, মোটেই বাঙলাদেশের মৌলিক অধিবাসী নয়। তারা ইন্দোচীন নামক মঙ্গোলীয় পর্যায়ের অন্তর্গত মাত্র কয়েক শত পূর্বে আরাকান দেশ থেকে চট্টগ্রাম এসে বসবাস করেছে। তাদের বিচিত্র সামাজিক সংগঠন, ও আহং, সেপোটাং, পাংড়ং, পাকাসু, থিয়াংগা, প্রভৃতি অবাঙালী থেকে সেটা প্রমাণিত এইভাবে, রংপুর জলপাইগুড়ি অঞ্চলের কোচগণ ঐতিহাসিককালে উত্তরবঙ্গবিজেতা মঙ্গোলীয় পর্যায়সস্তৃত কোচজাতির বংশধর মাত্র।

পাইয়া, লবু, অলিঙ্গ, তানডু, লোবাই প্রভৃতি এদের সম্পূর্ণ অবাঙালীর নাম। বাঁকুড়া, বীরভূম ও মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মালজাতিগণ রাজমহলের অঞ্চল বাঙলা দেশে এসে বসবাস করেছে তারা সাঁওতালপরগনার মালপাহাড়িয়া, মাল প্রভৃতি থেকে বাঙলার সীমান্তাংশবাসী এই সমস্ত অবাঙালী উপজাতিসমূহের নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলির ওপর করে সমগ্র বাঙলাদেশের জনগণের

১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় প্রথম প্রমাণ করতে প্রয়াস পান যে বাঙালী জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে রিজলীর মতবাদ সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। পরে ড কর্তৃক গৃহীত চন্দের মতবাদকে যে করে নয়, বাঙলাদেশের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির ওপর নূতন আলোকপাত করে।

Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
গুহ মহাশয় বাঙলার রাঢ়ী ব্রাহ্মণ, দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ এবং পরগনার পোদজাতির যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাণ নিয়েছিলেন, তা থেকে প্রকাশ পায় যে বাপী ব্রাহ্মণদের মাথা গোলাকার ( শিরাকার-জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৭৮.১৩), নাদিকা দীর্ঘ ও উন্নত এবং দেহ-দৈর্ঘ্যের গড় ১৬৮০ মিলিমিটার। কায়স্থদের মাথা ব্রাহ্মণদের চেয়ে কিছু বেশী গোল (শিয়াকার-জ্ঞাপক সূচক-সংথা। ৮০.৮৪), নাসিকা প্রায় সমানভাবেই উন্নত ও দীর্ঘ এবং দেহ-দৈর্ঘ্য সামান্য পরিমাণে কম (১৬৭০ মি: মি:)।

পোদদের দেহ-দৈর্ঘ্য সর্বাপেক্ষা কম ( ১৬২৮ মিঃ মিঃ), মাথা কম গোল ( শিরাকার-জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৭.১৬), মুখ ছোট ও কম উন্নত। কায়স্থ ও ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ বাদামী, কিন্তু পোদদের গায়ের রঙ গভীর বাদামী। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণের মধ্যে গরিষ্ঠসংখ্যকের চোখ ঘোর বাদামী, কিন্তু পোদদের চোখ অধিক পরিমাণে কালো। চুলের রঙ সকলেরই কালো।

আগেই বলা হয়েছে যে, বাঙালী জাতির বিস্তৃত কপাল ও প্রসারিত-নাসিকা দেখেই তারা দ্রাবিড়-মঙ্গোলীয় জাতিসম্ভূত বলে রিজলী সিদ্ধান্ত করেছিলেন। কিন্তু বিজলীর এই মতবাদের সপক্ষে কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। মঙ্গোলীয় জাতির আদিম অধিবাস ভারতবর্ষ নয়- ভারতবর্ষে তারা আগন্তুক মাত্র।

সুতরাং পূর্বভারতের জাতিসমূহের বিস্তৃত-শিরস্কতা যদি মঙ্গোলীয় জাতির সং মিশ্রণে ঘটেছে বলে ধরে নিতে হয়, তা হলে এটা নিশ্চিত যে, মঙ্গোলীয় জাতি কর্তৃক বাঙলাদেশে কোন বৃহৎ আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এরূপ কোন আক্রমণ সম্বন্ধে ইতিহাস কোন সাক্ষ্য দেয় না। অধিকন্তু বাঙালী জাতির আকৃতির মধ্যে এমন কোন নৃতাত্ত্বিক লক্ষণ বা তাদের মধ্যে প্রচলিত এমন কোন জনশ্রুতি বা কাহিনী নেই, যা দ্বারা তাদের মঙ্গোলীয় উৎপত্তি সমর্থিত হয়।

পরন্তু, নেপাল ও আসামে এরূপ অনেক জনশ্রুতি আছে, এবং এটাও আমরা জানি যে, এসকল দেশের অধিবাসিবৃন্দ মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তৰ্ভুক্ত।

বাঙালী জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে হরিবংশে (১১ অধ্যায়) যে কাহিনী আছে, সেই কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে পুরু ( যযাতিপুত্র ) বংশে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। উক্ত রাজার পাঁচ পুত্র ছিল, তাদের নাম যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুদ্ধ, ও পুণ্ড্র।

মহাভারতের আদিপর্বেও অসুর-রাজ বলির এই পাঁচ পুত্রের উল্লেখ আছে। বলিরাজের এই পাঁচ সন্তান যে পাঁচটি রাজ্য শাসন করতেন, তাঁদের নাম থেকেই সেই পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল। বলিরাজার এই পাঁচটি পুত্র ‘বালেয় ক্ষত্রিয়’ নামে অভিহিত হয়েছেন, ও তাঁরাই চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। মংস্য (812912৮) ও বায়ু পুরাণেও (১/২৭ ) বলিরাজার এই পঞ্চপুত্রের উল্লেখ আছে।

এখন কথা হচ্ছে এই যে, এইসকল শাস্ত্রীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রিজলী কেন বাঙালী জাতিকে মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত, এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছিলেন? আগেই বলা হয়েছে তার প্রধান কারণ বাঙালী জাতির বিস্তৃত শিঙ্কতা। কিন্তু এটা একমাত্র মঙ্গোলীয় জাতির বৈশিষ্ট্য নয়।

Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
বস্তুত বিস্তৃত শিরদ্ধতা ব্যতীত মঙ্গোলীয় জাতির নিজস্ব কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে, যা মঙ্গোলীয় জাতি ছাড়া অন্য জাতিসমূহের মধ্যে কখনও দেখা যায় না। যেমন, তাদের ঋজু সরল চুল, চোখের খাজ ( epicanthic fold ), গণ্ডাস্থির প্রাধান, পীতাভ গায়ের রং ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এই সমস্ত মঙ্গোলীয় লক্ষণ বাঙালী দের মধ্যে নেই। উপরন্তু, দীর্ঘশিরস্ক মঙ্গোলীয় জাতিও যথেষ্ট পরিমাণে ভারতের পূর্ব সীমান্ত প্রদেশে দেখতে পাওয়া যায়।

এটা সত্য যে বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসিবৃন্দ মঙ্গোলীয় জাতিসস্তৃত। কিন্তু এ সম্পর্কে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যদিও বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের ভুটিয়া, ল্যাপচা প্রভৃতি জাতিসমূহ বিস্তৃত-শিরস্ক, তথাপি উত্তরবঙ্গের বাঙালীদের মধ্যে দীর্ঘশিরস্কতারই প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক তদ্রূপ, যদিও পূর্ব সীমান্তের মঙ্গোলীয় জাতিসমূহ দীর্ঘশিরস্ক, কিন্তু পূর্ব বাঙলার বাঙালীরা বিস্তৃত-শিরস্ক।

কগিন ব্রাউন ও এস. ডব্লিউ. কেম্প পূর্ব সীমান্তের আরবজাতির যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন, তা থেকে দেখা যায় যে তাদের মধ্যে শতকরা গড়ে ৩২ জন দীর্ঘশিরস্ক ও মাত্র ৬ জন বিস্তৃত-শিরস্ক। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে পরস্পর সান্নিধ্য হেতু বাঙলার অধিবাসিবৃন্দের সঙ্গে যদি সীমান্ত প্রদেশস্থ মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের সংমিশ্রণ ঘটে থাকত, তা হলে উত্তরবিভাগে এট। বাঙালীর বিস্তৃত-শিৱদ্ধতায় ও পূর্ববিভাগে দীর্ঘ-শিরদ্ধতায় প্রতিফলিত হত। কিন্তু আমরা দেখেছি যে প্রকৃত নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি এর বিপরীত সাক্ষ্য বহন করে।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের বিস্তৃত শিৱদ্ধ জাতি সমূহ একই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্গত এবং তারা উত্তরভারতের দীর্ঘণিবন্ধ নৃতাত্ত্বিক পর্যায় থেকে পৃথক। পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের এবং উত্তরপ্রদেশের জাতিসমূহের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাণ নীচে দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে এটা স্পষ্টই প্রকাশ পায়—

 

পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের এবং উত্তরপ্রদেশের জাতিসমূহের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাণ
পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের এবং উত্তরপ্রদেশের জাতিসমূহের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাণ।

জাতি —————— শির সুচক ——- নাসিকা সূচক ——- দেহধৈর্ঘ্য

নগর ব্রাহ্মণ ———– ৭৯’৭ ———— ৭৩’১ —————- ১৬৪৩

গুজরাটী বেনিয়া —— ৭৯’৩ ———– ৭৫’৭ —————- ১৬১২

প্রভুকায়স্থ ————- ৭৮’৮ ———– ৭৫’৮ —————- ১৬২৭

বাঙালী ব্রাহ্মণ ——— ৭৮’৪ ———– ৭৩.৮ —————- ১৬৭৬

বাঙালী কায়স্থ ——— ৭৩’১ ———– ৭৩.৭ —————– ১৬৩৬

উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ – ৭২’৬ ———– ৭৪’৬ —————- ১৬৫৯

উত্তরপ্রদেশের কায়স্থ – ৭৪’৯ ———– ৭৪’৮ —————– ১৬৪৮

বিহারী ব্রাহ্মণ ———-৭৪’৯ ———– ৭৩’২ —————– ১৬৬১

পশ্চিম ও প্রাচ্য-ভারতের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত সাদৃশ্য থাকা হেতু এরূপ সিদ্ধান্ত করা ব্যতীত উপায় নেই যে, অতি প্রাচীনকালে কোন বিস্তৃত-শিরস্ক জাতির লোকরা বহু সংখ্যায় গুজরাট প্রভৃতি প্রদেশের ন্যায় বাঙলাদেশেও এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, এরা কারা? এর জবাব দেওয়া খুবই সহজ।

এই বিস্তৃত-শিরস্ক জাতির আদিম অধিবাস সম্বন্ধে রমাপ্রসাদ চন্দ প্রথম সুধী জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পঞ্চনদের পশ্চিমে বালুচিস্তান ও আফগানিস্তানের বালুচ ও পাঠান জাতীয় লোকগণ আর্যভাষাভাষী এবং নাতিদীর্ঘশিরস্ক ( mesaticephalic ) ; এদের মধ্যে দীর্ঘশিরস্কতা যথাক্রমে ইরানীয় ও তুরানীয় জাতিসমূহ হতে প্রাপ্ত, এই সিদ্ধান্ত করে স্নার হারবার্ট বিজলী এদের ‘তুর্ক ইরানী’ পর্যায়ভুক্ত করেছিলেন।

কিন্তু মধ্য-এশিয়ার পামির ও চনিক তুর্কী স্থানের জাতিসমূহের সম্পর্কে উজফালভী (Ujfalvy ) ও দ্যার অরেল স্টাইন (Sir Aurel Stein) যে নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেছিলেন তার ফলে আমরা জানতে পারি যে, বালুচ ও পাঠান, গুজরাটী, মারাঠী, কূর্গ এবং বাঙালী ও ওড়িশার জাতিসমূহের বিস্তৃত-শিরষ্কতার জন্য আমাদের তুর্ক, শক, মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতিসমূহকে টেনে আনবার কোন প্রয়োজন নেই। আগেই বলা হয়েছে যে তুর্ক, শক ও মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের নিজেদের যেসকল নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আছে, তা এসকল জাতিগণের মধ্যে মোটেই নেই। পরস্তু, পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের জাতিসমূহের সঙ্গে এদের নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলি সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।

Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]

পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে টি. এ. জয়েদ (T. A. Joyce) যে সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রকাশ করেছেন তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাকলামাকান মরুদেশের চতুষ্পার্শ্বস্থ দেশসমূহের জাতিগণের মধ্যে একটা মোটামুটি নৃতাত্ত্বিক ঐক্য আছে।

এই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়টি আমরা বিশুদ্ধ অবস্থায় লক্ষা করি ওয়াখিগণের ( Wakhis) মধ্যে। এই অঞ্চলের অধিবাসিবৃন্দের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করা হয়েছে তার জটিলতার মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করবার মত বস্তু এই যে পামির ও তাকলামাকান মরুদেশের আদিম অধিবাসীরা আলপাইন ( Alpine) পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত, কেবলমাত্র পশ্চিমে ইন্দো-আফগান পর্যায়ের সঙ্গে এদের কিছু সংমিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত যে এই সকল অঞ্চলের সাধারণ আধবাসিবৃন্দের ওপর মঙ্গোলীয় জাতির প্রভাব নেই বললেই হয়।

এই অঞ্চলের পর্যায়গুলির নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলি এরূপ —

প্রথম পর্যায় :

বিস্তৃত-শিরস্ক, গোলাপী আভাবিশিষ্ট গৌরবর্ণ ত্বক্, দেহ-দৈর্ঘ্য গড়ের ওপর, পাতলা উন্নত দীর্ঘনাসিকা— তা সরল থেকে কুব্জ, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখ, বাদামী রঙের চুগ—সাধারণত খুব ঘোর এবং তা প্রচুর ও ঢেউখেলানো ; চোখ প্রধানত মধ্যম শ্রেণীর। এরা লা পুঞ্জের ( La Pouge) ‘আলপাইন’ পর্যায়ভুক্ত।

দ্বিতীয় পর্যায়:

বিস্তৃ-শিরস্ক, গায়ের রঙ ফর্সা, কিন্তু সামান্য বাদামী আভাবিশিষ্ট ; দেহ-দৈর্ঘ্য গড়ের ঊর্ধ্বে ; নাক সরল, কিন্তু প্রথম পর্যায় অপেক্ষা বিস্তৃত; গণ্ডান্তি চওড়া; চুপ প্রথম পর্যায় অপেক্ষা সরল — তা ঘোর বর্ণ ও অপ্রচুর, চোখ কাল। এরা ‘তুর্কী’ পর্যায়ভুক্ত।

তৃতীয় পর্যায় :

নাতিদীর্ঘ-শিবন্ধ, দীর্ঘ দেহ, পাতলা উন্নত কুব্জ নাসিকা, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখ, কাল ঢেউখেলানো চুল এবং কালো চোখ। এরা ‘ইন্দো আফগান’ পর্যায়ভুক্ত।

পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি থেকে এটা স্পষ্টই প্রমাণ হচ্ছে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে পামির ও তাকলামাকান মরু অঞ্চলে বিস্তৃত শিৱষ এক জাতি বাস করত। এরা পাশ্চাত্ত্য ইউরোপে প্রচলিত ইটালো সৈলটিক ভাষার অনুরূপ এক আর্যভাষাভাষী ছিল এবং পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসিবৃন্দ ওই একই বিস্তৃত-শিরস্ক পর্যায়-সস্তৃত বলে এদের নামকরণ করা হয়েছে ‘আলপাইন’ পর্যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে এবং বালুচিস্তানে এই পর্যায় বৈদিক আর্য ও দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়ে, তথায় নাতিদীর্ঘ শিরস্ক ‘ইন্দো-আফগান’ পর্যায়ের সৃষ্টি করেছে।

এই একই পর্যায় ভারতের অন্যত্রও আদিম অধিবাসিগণ (Proto-Australoid), বৈদিক আর্য এবং দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়ে নাতিদীর্ঘ পর্যায়ের সৃষ্টি করেছে। অনেকে মনে করেন যে ‘আলপাইন’ পর্যায়ভুক্ত বিস্তৃত-শিরস্ক জাতিসমূহ বৈদিক আর্যদের অব্যবহিত পরে ভারতবর্ষে এসে আর্যাবর্তের দেশসমূহ বৈদিক আর্যগণ কর্তৃক অধিকৃত দেখে পশ্চিম উপকূল ধরে নেমে এসে মধ্যভারতের মালভূমির ভিতর দিয়ে গঙ্গানদীর নিম্ন উপত্যকায় গিয়ে বসবাস করে।

Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
Ancient Bengal Map [ প্রাচীন বাংলার ম্যাপ ]
তাদেরই অপর এক শাখা কাথিয়াবাড়, গুজরাট ও পশ্চিম ভারতে বসবাস শুরু করে। কিন্তু অপর পক্ষে, এরূপ সিদ্ধান্ত করবার সপক্ষেও যথেষ্ট কারণ আছে যে আলপাইন পর্যায় ভুক্ত একদল এশিয়া মাইনর বা বালুচিস্তান থেকে পশ্চিম সাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ সিন্ধু, কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কুর্গ, কন্নাদ ও তামিলনাড়ু প্রদেশে পৌঁছায় এবং তাদের আর একদল পূর্ব-উপকূল ধরে বাঙলা ও ওড়িশায় আসে। আরও মনে হয়, তারা দ্রাবিড়দের অনুসরণে সমুদ্র পথে আর্যদের পূর্বে ভারতে এসে পৌঁছেছিল।

বাঙালী যে মঙ্গোলীয় জাতিসস্তৃত নয়, তার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা দিয়েছি। দ্রাবিড় জাতির সঙ্গেও তাদের খুব বেশী রক্ত-সম্বদ্ধ নেই। রিজলীর সময়ে দ্রাবিড় জাতিগণকেই ভারতের আদিম অধিবাসী বলে মনে করা হত। এবং সেজন্যই তিনি বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক গঠনে দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ আছে, এরূপ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়েছে যে আর্যভাষীগণের ন্যায় দ্রাবিড় জাতিগণও ভারতে আগন্তুক মাত্র। তাদের পূর্বে ভারতে প্রাকৃ দ্রাবিড় (Pre-Dravidians) বা আদি-অস্ত্রা (Proto-Australoid) জাতিসমূহ বাস করত এবং তারাই ভারতের আদিম অধিবাসী।

এদেরই আমি এই বইয়ে ‘অস্ট্রিক’ ভাষাভাষী জাতি বলে অভিহিত করেছি। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এদের ‘কোল’ জাতি বলে অভিহিত করেছেন। তাদের বংশধর গণকেই আজ আমরা ভারতের বনে, জঙ্গলে ও পার্বত্য অঞ্চলসমূহে দেখতে পাই। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, নিম্ন সম্প্রদায়ের চালীর মধ্যে বেশকিছু পরিমাণ প্রাক্-দ্রাবিড় রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

তবে উচ্চশ্রেণীর বাঙালী যে আলপাইন পর্যায়ভুক্ত, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। জগতের সমস্ত নৃতত্ত্ববিদ এটা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নিয়েছেন। একথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে আজ কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর বাঙালীর মধ্যে যেসকল পদবী প্রচলিত আছে (যেমন ঘোষ, বসু, মিত্র, দত্ত, দেব, কর, গুপ্ত, নাগ, পাল, সেন, চন্দ্র, প্রভৃতি) এক সময় ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। ড. দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার দেখিয়েছেন যে, পশ্চিম ভারতে ওই একই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্গত নগর ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও ঠিক অনুরূপ পদবীর প্রচলন আছে।

বোধ হয় এক সময়ে এগুলি আলপাইন পর্যায়ের উপশ্রেণীর (tribes ) নামবিশেষ ছিল, এবং পরে বর্ণসৃষ্টির সময়ে সেগুলি জাতিবাচক পদবী হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। সে যাই হোক, বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্পর্কিত এই আলোচনার ফলে এটা পরিষ্কার প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাঙালী বিজলীর তথা কথিত মঙ্গোলীয়-দ্রাবিড়-গোষ্ঠী-সস্তৃত নয় ।

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় - অতুল সুর
বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – অতুল সুর

এযাবৎ আমরা ‘নৃতাত্ত্বিক পর্যায়’-এর কথা বলছিলাম। কিন্তু ‘নৃতাত্ত্বিক পর্যায়’ বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি, তার একটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। ‘নৃতাত্বিক পর্যায় বলতে আমরা এমন এক জনসমষ্টিকে বুঝি যাদের সকলের মধ্যেই জীন (genes) ও ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ভিত্তিক কতকগুলি বিশিষ্ট অবয়বগত সাদা আছে। অবয়বগত কোন্ কোন্ সাদৃশ্য থাকলে, আমরা কোন এক বিশেষ শ্রেণীর জনসমষ্টিকে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত করব, সে সম্বন্ধে সুধীজনের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে যে সকল লক্ষণ সুধীজন একবাক্যে স্বীকার করে। নিয়েছেন, সেগুলি হচ্ছে – ১. মাথার চুলের বৈশিষ্ট্য ও রঙ, ২. গায়ের রঙ, ৩. চোখের রঙ ও বৈশিষ্টা, ৪. দেহের দীর্ঘতা, ৫. মাথার আকার, ৬. মুখের গঠন, ৭. নাকের আকার, ৮. শোণিত বর্গ বা blood groups.

নৃতাত্ত্বিক পর্যায়
নৃতাত্ত্বিক পর্যায়

এই লক্ষণগুলির মধ্যে মাথার চুলের বৈশিষ্ট্য প্রধানতম। চুলের বিশিষ্টতার দিক দিয়ে মানুষের চুলগুলিকে সাধারণত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রথম, ঋজু বা সোজা চুল ( straight hair)। এটা মঙ্গোলিয়ান জাতিসমূহের লক্ষণ। দ্বিতীয়, কুঞ্চিত বা কোঁকড়া চুল ( woolly hair)। এটা নিগ্রোজাতির লক্ষণ। তৃতীয়, তরঙ্গায়িত বা ঢেউখেলানো চুল ( smooth, wavy or curly hair)। এটা জগতের অবশিষ্ট জাতিসমূহের লক্ষণ।

অনেকসময় অনেক পুরুষের ( generations ) রক্তের সংমিশ্রণে চুলের এই বাহুবৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু স্বণ্ডিত চুলকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করলে, তার মৌলিক নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত বৈশিষ্ট্য পুনরায় প্রকাশ হয়ে পড়ে। খণ্ডিত চুলকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কিভাবে পরীক্ষা করা হয়, এবং তার কি কি লক্ষণ পেলে তাকে কোন বিশেষ নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত করা হয়, সে সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা এ স্থলে সম্ভবপর নয়। তবে যারা উৎসাহী তাঁরা এ সম্বন্ধে গাঁ-মার্ত্তার (St. Martin ) বই পড়ে নিতে পারেন।

চুলের এবং চোখের রঙ অপেক্ষা নৃতত্ত্ববিদ্‌গণ গায়ের রঙের উপর বেশী জোর দিয়ে থাকেন। যদিও এটা দেখা গিয়েছে যে কালো রঙের সঙ্গে কালো চুলের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু কালো চুলের সঙ্গে কালো চোখের এরূপ কোন পারস্পরিক সাহচর্য সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণত গায়ের রঙ অনুযায়ী মানুষকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় ফর্সা সাদা রঙ, ময়লা বা কালো রঙ ও পীত রঙ। অবস্থা এই তিন শ্রেণীর আবার বহু উপবিভাগ আছে। দেহের দীর্ঘতা অনুযায়ী মানুষকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যথা:

দেহের দীর্ঘতা অনুযায়ী মানুষকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় - ১. বামন ( pygmy ) - উচ্চতা ১৪৮০ মিলিমিটারের কম। ২. খর্বাকৃতি বা বেঁটে (short) – উচ্চতা ১৪৮০ মিলিমিটার থেকে ১৫৮১ মিলিমিটার। ৩. ম্যধমাকৃতি বা মাঝারি (medium) – উচ্চতা ১৫৮২ মিলিমিটার থেকে ১৬৭৬ মিলিমিটার। ৪. দীর্ঘ (tall ) — ১৬৭৭ মিলিমিটার হতে ১৭২০ মিলিমিটার। অতিদীর্ঘ ( very tall ) – ১৭২১ মিলিমিটারের উপর।
দেহের দীর্ঘতা অনুযায়ী মানুষকে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়

নৃতাত্ত্বিক আলোচনার জন্য মানুষের মাথার আকার এক সূচক-সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই স্বচক-সংখ্যাকে cephalic index বা শির-শূচকসংখ্যা বলা হয়। মাথার দীর্ঘতার (সম্মুখভাগ nasion হতে পশ্চাদভাগ occiput পর্যস্ত ) তুলনায় মাথার চওড়ার দিকের মাপের শততমাংশিক অনুপাতকেই cephalic index বলা হয়। এই অনুপাত অনুযায়ী মানুষের মাথাকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা

১. লম্বা মাথা বা দীর্ঘশিরস্ক (dolicho-cephalic ) — অনুপাত ৫ শতাংশের কম।

২. মাঝারি মাথা বা নাতিদীর্ঘশিরস্ক (mesaticephalic) — অনুপাত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের কম।

৩. গোল মাথা বা বিস্তৃতশিরস্ক (brachy-cephalic) অনুপাত ৮০ শতাংশ বা ততোধিক।

নাকের আকারের পরিমাপও ঠিক মাথার আকারের পরিমাপ-প্রথার অনু রূপ। নাকের দীর্ঘতার (নাকের মাথা থেকে তলা পর্যন্ত) তুলনায় নাকের চওড়ার (তলদেশ) দিকের মাপের শততমাংশিক অনুপাতকে nasal index বা নাসিকা-সূচক সংখ্যা বলা হয়। এই অনুপাত অনুযায়ী মানুষের নাককে তিন শ্রেণীতে পর্যায়ভুক্ত করা হয়। যথা =

১. লম্বা সরু নাক (leptorrhine ) – অনুপাত ৫৫ শতাংশ হতে শতাংশ।

২. মাঝারি নাক (mesorrhine ) – অনুপাত ৭৮ শতাংশ হতে ৮৫ শতাংশ।

৩. চওড়া নাক (platyrrhine) – অনুপাত ৮৬ শতাংশ হতে ১০০ শতাংশ।

নৃতাত্ত্বিক পর্যায় নির্ণয়ের জন্য রক্তের চারিত্রিক গুণও পরীক্ষা করা হয়। দানা বাধা (agglutination ) গুণের দিক থেকে রক্তকে ‘O’, ‘A’, ‘B’, ‘A B’, ‘M’, ‘N’, Rh positive ও negative, ও জীবাণু-প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদনের দিক থেকে ‘A’-বর্গের রক্তকে A ও A শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যখন দুই নরগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের চারিত্রিক মিল থাকে, তখন তাদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব আছে বলে সিদ্ধান্ত করা হয়।

১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দে ডি. এন. মজুমদার যে সমীক্ষা করেছিলেন, তা থেকে জানা গিয়েছিল যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও নমশূদ্রদের মধ্যে ‘O’-বর্গের রক্তই প্রধান। কায়স্থদের মধ্যে ‘B’-বর্গের রক্ত প্রধান। বণিকদের মধ্যে ‘O’ ও ‘B’ এই উভয়বর্গের রক্ত সমানভাবে ব্যাপ্ত। শঙ্খবণিক ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘A’-বর্গের রক্ত প্রধান। এবং মুসলমানদের মধ্যে ‘O’, ‘A’, ও ‘B’ এই তিন বর্গের রক্তই সমানভাবে বিদ্যমান। পরে ডি. কে. সেন এ সম্বন্ধে যে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, তা থেকেও জানা গিয়েছিল যে ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘O’-বর্গের রক্তই প্রধান। কায়স্থ ও বৈদ্যদের মধ্যেও তাই। কিন্তু অন্যান্যদের মধ্যে ‘B’-বর্গের রক্তই প্রধান।

বর্তমানে, আঙ্গুলের রেখাবিন্যাসের মিল দ্বারাও নৃতাত্ত্বিক সম্পর্কের নৈকট্য নির্দেশ করা হচ্ছে।

তবে, একথা এখানে বলা আবশ্যক যে নৃতত্ত্ববিদগণ নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত করবার জন্য অবয়বের কোন এক বিশেষ লক্ষণের উপর নির্ভর করেন না। উপরি-উক্ত সমস্ত অবয়ব-লক্ষণের সমষ্টিগত ফলের উপর নির্ভর করেই তারা নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত করবার জন্য কোন এক বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য তাঁরা একই জাতির অন্তর্ভুক্ত বহুসংখ্যক লোকের পরিমাপ গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment