আজকের আলোচনার বিষয় ব্যান্ড সমাজ – যা রাষ্ট্রবিহীন ব্যবস্থা এর অর্ন্তভুক্ত, নৃবিজ্ঞানী যাঁরা তথাকথিত ‘সরল সমাজে’র বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেছেন তাঁদের অনেকের মতেই ব্যান্ড সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সবচেয়ে সরল ধরনের। ধারণা করা হয়ে থাকে যে শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজেই এই ধরনের ব্যবস্থা চালু থাকে।
আর তাদের প্রধান আর্থনীতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পারস্পরিক লেনদেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির ধারণা কিংবা চর্চা এসব সমাজে নৃবিজ্ঞানীরা দেখতে পাননি। বিশেষ করে পানি, জমি এই ধরনের সম্পদের বেলায় শরীকী ব্যবহারের প্রচলন থাকে।
সম্পদ, সম্মান- আত্তি এবং ক্ষমতার ভেদাভেদে সমাজের মানুষজনের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। এই আলোচনার শুরুতেই ব্যান্ড বলতে কি বোঝানো হয়ে থাকে তা বলা যায়। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যান্ড হচ্ছে কিছু মানুষের একটা দল যাঁরা সম্পর্কে পরস্পর খুবই কাছাকাছি, একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করেন এবং রাজনৈতিকভাবে সার্বভৌম।
ব্যান্ড সমাজ
ব্যান্ড সমাজে সাধারণ মানুষজন কিংবা সম্প্রদায় একটা রাজনৈতিক একক হিসেবে কাজ করে থাকেন । এর মানে হ’ল এই ধরনের সমাজে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক একক। এর বাইরে বৃহত্তর অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
নৃবিজ্ঞানীদের বড় একটা অংশই মনে করেন যে খাদ্য সংগ্রহকারী প্রত্যেক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। কৃষি আবিষ্কৃত হবার আগে, অর্থাৎ ১০,০০০ বছর আগে প্রায় সকল সমাজেরই এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল বলে তাঁদের অভিমত।
এই দলগুলো খুব বেশি বড় মাপের নয় আর জনসংখ্যার ঘনত্ব তেমন নয়। এক একটা ব্যান্ড দলে ২০ থেকে ৫০ জনের মত সদস্যের কথা উলে-খ পাওয়া যায়। আর এক একটা অঞ্চলে ৫ থেকে ৫০ বর্গ মাইল এলাকায় একজনের বাস।
তবে যে সময়ে নৃবিজ্ঞানীরা এই সব সমাজ নিয়ে গবেষণা করছেন সেই সময়ে এইসব সমাজের মানুষজনের অনেকেই ইউরোপ থেকে বয়ে আনা রোগের শিকার হয়ে মারা পড়েছেন। ফলে এদের জনসংখ্যার হিসাব একটা গোলমেলে ব্যাপার ।
আধুনিক সমাজের নেতৃত্ব দিয়ে ব্যান্ড সমাজের নেতৃত্বকে বোঝা যাবে না। কোন ধরনের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব এই ধরনের ব্যবস্থায় নেই। নেতা বলতে যাঁরা শিকারে দক্ষ, বিচক্ষণ এবং বয়সে বড় তাঁরাই।
আপনারা ইতোমধ্যেই জানেন বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অ-ইউরোপীয় সমাজে। বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বিষয়ে জ্ঞান থাকার মধ্য দিয়ে একজন প্রবীণ অন্যদের সম্মান অর্জন করে থাকেন।
এভাবে নির্বাচিত নেতা বা প্রধান কোনমতেই কারো উপর তাঁর মতামত এবং ভাবনা-চিন্তা চাপাতে পারেন না। সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়া হ’ল: ব্যান্ডের সকল প্রবীণ মানুষজন একত্রে আলাপ- আলোচনা করেন। নেতা বড়জোর তা পরিচালনা করেন এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তৎপরতা দেখান।
অনেক সমাজেই নিজস্ব ভাষায় এই রকম নেতাকে সম্বোধন করা হয়ে থাকে ‘মুরুব্বী’ বা ‘জ্ঞানী’ বলে। সমাজে যাঁরা অন্য কোন উপায়ে সম্পদ সংগ্রহ করে সেগুলো অন্যদের মাঝে বিলি বণ্টন করেননি, তাঁদেরকে ঠিক ‘ধনী’ বলা হয় না। আর তা বলা হলেও তার সাথে নেতার বিরাট পার্থক্য আছে। নেতৃত্বকে ঠিক ক্ষমতার আধার হিসেবে বলা যায় না। বরং নেতার কাজ হচ্ছে প্রভাবিত করা।
এস্কিমোদের প্রত্যেক দলের মধ্যে এরকম প্রধান ছিলেন। সেই সব প্রধানকে অন্যরা মানতেন তাঁর দক্ষতা এবং সুবিচার করার মন মানসিকতাকে স্বীকৃতি দিয়ে। প্রধানের নানাবিধ পরামর্শ দলের সদস্যরা মেনে চলতেন। এর মানে এই নয় যে তাঁর কোন স্থায়ী ক্ষমতা ছিল কিংবা চাইলেই তিনি কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারতেন।
এস্কিমোদের মধ্যে এই নেতা বা প্রধানেরা সকলে পুরুষই ছিলেন। তবে তাঁরা নারীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন বিভিন্ন বিষয়ে (জিন এল ব্রিস ১৯৭৪)। যে কোনভাবেই চিন্তা করি না কেন, নেতৃত্বের অর্থের একটা সীমারেখা ছিল।
ব্যান্ড সমাজের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, কাউকে শাস্তি দেবার জন্য শিথিল কতগুলো নীতিমালা থাকে। যেমন একত্রে নিন্দা করা, তিরস্কার করা কিংবা এড়িয়ে চলা। খুব বড় কোন ক্ষেত্রে কাউকে হত্যা করা বা সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া ঘটতে পারে। সমাজের মানুষের মধ্যে কাউকে ঠকানোর কোন প্রবণতা লক্ষ্য করতে পারেননি নৃবিজ্ঞানীরা।
এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আফ্রিকার কালাহারি এলাকার কুং!-দের মধ্যে মাংস ভাগ না করে খাওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। নৃবিজ্ঞানী মার্শাল যখন কুং!-দের মধ্যে কাজ করছিলেন, তিনি কাউকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে যদি কেউ কাউকে না জানিয়ে পরিবারের জন্য মাংস সরিয়ে রাখতে পারেন তাহলে তো আর অন্যকে ভাগ দিতে হয় না। শুনে তাঁরা খুবই হেসেছেন। কুং!-দের কাছে এটা খুবই খারাপ একটা ব্যাপার ।
তাহলে তো মানুষ সিংহের মত হিংস্র হয়ে গেল। সমাজের অন্যরাও তখন তাকে সিংহের মত সমাজ থেকে দূরে তাড়িয়ে দেবে। তাকে শিক্ষা দেবার জন্য এক টুকরো মাংসও খেতে দেয়া হবে না। চুরি করাও কুং!-দের মধ্যে জঘন্য ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। খুব কমই এসব ঘটে।
তবু কেউ চুরির মত কোন অপরাধ করলে তার মুখের উপর কারো পায়ের ছাপ এঁকে দেয়া হয়, যাতে সকলেই চিনে যেতে পারে। চুরি কিংবা খাদ্য ভাগ করার অপরাধকে সব ব্যান্ড সমাজেই বিরাট করে দেখা হয়ে থাকে। তবে কুং! জাতি এই সকল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত।
কোন কোন ব্যান্ড সমাজের মধ্যে চুরির কিংবা ভাগ না দেবার প্রবণতা নৃবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন। যেমন: বলিভিয়ার আমাজন বেসিনের সিরিওনো জাতি। তবে এই সমস্ত ক্ষেত্রে খাদ্যের সংকট এবং দুর্ভিক্ষ একটা প্রধান কারণ বলে ধরে নেয়া হয়। ইনুইত-দের কেউ সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কোন ওঝা তাকে স্বীকারোক্তি দিতে বলে, কিংবা অপরাধ আরো গুরুতর বলে বিবেচিত হলে তাকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতে পারে।
ব্যান্ড সমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে সংঘর্ষ চালাবার জন্য কোন সামরিক বাহিনী নেই। এমনকি দল বেঁধে তেমন বড় মাপের কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাতও ঘটে থাকে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারো সাথে কারো লড়াই ঝগড়া হতে পারে। কিংবা পারিবারিকভাবে দীর্ঘকাল ফ্যাসাদ লেগে থাকতে পারে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে খুন জখমের মত ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছেন নৃবিজ্ঞানীরা।
তবে সমাজের মধ্যেই সেগুলো নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম তারা। সাধারণত নেতা বা প্রধানরা একত্রে নিয়ে বসেন উভয় পক্ষকে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মুষ্টিযুদ্ধ বা গানের লড়াইয়ের মাধ্যমে ঝগড়া মেটানোর ঘটনা দেখেছেন নৃবিজ্ঞানীরা।
তা হচ্ছে: যখন কোন লোকের সঙ্গে কারো ঝগড়া বেধেছে এবং প্রতিহিংসা কাজ করছে, তখন উভয়কে সম্মত করানো হয় যাতে তারা একত্রে গানের লড়াইয়ে বা মুষ্টিযুদ্ধে সামিল হয়।
গানের ক্ষেত্রে নিজস্ব সুরের সাথে তীক্ষ্ণ কথা জুড়ে উভয়ে উভয়ের সঙ্গে তর্ক বাধায়। যার দিকে তালি বেশি পড়ে সেই জয়ী — এই পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি হয়। এতে করে ঝগড়ার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হয় এবং শত্রুতা কমে। এরকম নজির পাওয়া গেছে ইনুইত-দের মাঝে।
আরও দেখুনঃ