Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

কেস স্টাডি : উপনিবেশকালীন বাংলায় মজুরি-নির্ভরশীল পরিবারে সদস্যদের পৃথকীকরণ 

আজকের আলোচনার বিষয় কেস স্টাডি : উপনিবেশকালীন বাংলায় মজুরি-নির্ভরশীল পরিবারে সদস্যদের পৃথকীকরণ – যা পরিবারের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত,  ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় মজুরি-ভিত্তিক অর্থনীতির (waged economy) সূত্রপাত ঘটে। মজুরি-নির্ভরশীলতা মধ্যবিত্ত গৃহস্থালীতে নতুন ধরনের সংকট ও টানাপোড়েন তৈরী করে।

ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলায়, পুরুষের ক্ষেত্র ছিল বাহির এবং গৃহের অভ্যন্তর ছিল নারীর পরিসর। বয়স এবং জ্ঞাতিত্বের নীতিমালা অনুসারে গৃহ পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন সব চাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ বিবাহিত নারী। এই দায়িত্বের মধ্যে পড়ত যৌথ ভান্ডার পরিচালনা, চাকরদের পারিশ্রমিক দেয়া, উপহার প্রদান, এবং কল্যাণমূলক দায়দায়িত্ব সম্পাদন। যদি কোন গৃহস্থালীতে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বিবাহিত নারী না থাকে, কেবলমাত্র তখনই অল্প বয়স্ক এবং অবিবাহিত নারী গৃহ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন। গৃহের অভ্যন্তরীণ পরিসরে পুরুষের শারীরিক অনুপস্থিতি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।

কেস স্টাডি : উপনিবেশকালীন বাংলায় মজুরি-নির্ভরশীল পরিবারে সদস্যদের পৃথকীকরণ

 

 

প্রাক ব্রিটিশ যুগে, গৃহস্থালীর আর্থিক সম্পদ যৌথ ভান্ডারে পুঞ্জীভূত হত। পরিবারের সদস্যরা এই ভান্ডার থেকে তাঁদের প্রয়োজন মেটাতেন। যৌথ ভান্ডারের মূলনীতি অনুসারে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আয়ের ভিত্তিতে বিভাজন করা হত না। কে আয় করে এবং কে আয় করে না, এটি বিভাজনের নীতি ছিল না।

ভূমির মালিকানা যেমন ছিল যৌথ, ঠিক একই ভাবে নগদ টাকাও ছিল যৌথ মালিকানাধীন। তবে, তার অর্থ এই নয় যে এই ভান্ডারে পরিবারের সকল সদস্যের সমান অধিকার ছিল। লিঙ্গ এবং জ্ঞাতি মর্যাদা অসম বন্টনের ভিত্তি ছিল। নারীদের ভূমিজ সম্পদে অধিকার যেমন নিকৃষ্ট ছিল, ঠিক একই ভাবে অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রেও তাদের অধিকার পুরুষদের তুলনায় ছিল নিম্নমর্যাদার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আশা করা হত হিন্দু বিধবারা হবেন স্বল্পাহারী, সকল কিছুতে স্বল্পভোগী। আয়ের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার এই অসমতাগুলো নিঃসন্দেহে কাঠামোগত ছিল । কিন্তু অসমতা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ছিল না, অসমতার বৈশিষ্ট্য “চাকরিজীবী” বনাম “বেকার”, বা “উৎপাদনশীল” বনাম “অনুৎপাদনশীল” ছিল না।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মজুরির উপর গৃহের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মধ্যবিত্ত গৃহস্থালীতে দেখা দেয় নতুন ধরনের সংকট এবং টানাপোড়েন। মজুরি নির্ভরশীলতার কারণে সম্পদ কটনে মতাদর্শিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ঔপনিবেশিক সরকারের নথিপত্র ঘাঁটলে যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়।

১৯১১ সনের শুমারিতে বলা হয়েছে, যৌথ পরিবারের ভাঙ্গনের ফলে বাড়িঘরের ভাগাভাগি হচ্ছে এবং এতে উত্তর কলকাতার পরিবেশ “অস্বাস্থ্যকর” হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হত: সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ, এবং “আয়কারী” এবং “অলস” সদস্যদের মধ্যকার টানাপোড়েন। সরকারী নথিপত্র ও সাহিত্য, উপন্যাসে টানাপোড়েনের জন্য নারীদের দোষারোপ করা হ’ত। সরকারী শুমারীর ভাষ্যমতে, জাদের মধ্যে দেখা দেয় “হিংসা” এবং হয়ত দেখা যায় যে, ভাইদের মধ্যে কোন একজনের স্ত্রী কিছুতেই চান না তার দেবর-ভাসুরদের পরিবারের পেছনে তার স্বামীর আয় ব্যয় করা হোক।

 

 

হিলারী স্ট্যান্ডিংয়ের প্রধান বক্তব্য হচ্ছে মজুরি-নির্ভরশীলতা পারিবারিক সম্পদ পুনর্বন্টনের পূর্বতন যৌথভিত্তিক অনুশীলনকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করে তুলছে। এর ফলে, বর্তমানে যৌথ পরিবার দেখা গেলেও, এর ভেতরে অন্তর্নিহিত হয়ে থাকে নির্ভরশীলতার সংকীর্ণ বা সীমিত অর্থগুলো (একজন পুরুষের আয়ের উপর তার স্ত্রী এবং সন্তানদের হক সবচাইতে বেশী)। তাঁর বিশ্লেষণ মতে, পারিবারিক সম্পর্কের এই পরিবর্তন একটি সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, এটি স্বাভাবিক কিংবা অনিবার্য নয়।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version