Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

বর্তমান বিশ্বে মর্যাদার ভেদাভেদ

বর্তমান বিশ্বে মর্যাদার ভেদাভেদ

বর্তমান বিশ্বে মর্যাদার ভেদাভেদ

আজকের আলোচনার বিষয় বর্তমান বিশ্বে মর্যাদার ভেদাভেদ – যা  পদমর্যাদা ভেদাভেদ এর অর্ন্তভুক্ত, সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটা জনপ্রিয় ধারণা আছে। সেটা হ’ল: সম্পদের ভিত্তিতে সমাজে যে | ভেদাভেদ তা দিয়েই শিল্পভিত্তিক সমাজের বৈষম্য বোঝা যাবে। কিন্তু শিল্পভিত্তিক সমাজের সকল বৈষম্য | সম্পদ দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। সামাজিক মর্যাদার অত্যন্ত শক্তিশালী চর্চা শিল্পভিত্তিক সমাজে রয়েছে। | গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় আধুনিক সমাজেই বরং মর্যাদার মাধ্যমে ভেদাভেদ অত্যন্ত তীব্র। আগের পাঠগুলোতে আপনারা নারী-পুরুষের বৈষম্য এবং বয়সের ভিত্তিতে ভেদাভেদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এখানে সেই প্রসঙ্গ মনে রেখে আলোচনা করা সুবিধাজনক হবে।

প্রথমেই আমরা চাকুরির ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে পারি। পৃথিবীতে এখন সবচাইতে বেশি ব্যয় করা হয় সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য। আর সামরিক বাহিনী হচ্ছে সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত একটা ব্যবস্থা। এখানে প্রত্যেকটা পদের সাথে অন্য পদের প্রভেদ স্পষ্ট করে দেখানো আছে। সাধারণ সৈনিকরা সকল সময় অফিসারের হুকুম পালন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্য থাকে না। এমনকি নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে যদি সেটা অফিসারের আদেশ হয়। অফিসারদের মধ্যেও আবার পদমর্যাদার ভেদাভেদ আছে। সকল বয়োকনিষ্ঠ অফিসার তাঁর উর্দ্ধতন কর্মকর্তার আজ্ঞাবাহী থাকেন।

বর্তমান বিশ্বে মর্যাদার ভেদাভেদ

 

 

এভাবে কোন দেশের সমগ্র সামরিক বাহিনী একটা পিরামিডের আকার ধারণ করে। এর সর্বোচ্চ স্থানে থাকেন যিনি ঐ দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান । যদি দুই দেশের সামরিক বাহিনী একত্রে কোন অভিযানে অংশ নেয় তাহলে দুর্বল শক্তির দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা একই মর্যাদায় থাকলেও সবল দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অধীনস্ত হয়ে পড়েন। সামরিক বাহিনীর মধ্যকার মর্যাদার প্রসঙ্গ খুব বিশেষ কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু আধুনিক সমাজের যে কোন চাকুরিতেই এই পদসোপানিক ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। তা সে ব্যাঙ্ক হোক, বীমা হোক আর, শিক্ষায়তনের কোন কাজ হোক।

সকল ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কিছু আচরণ বিধি লিখিতভাবে বা অলিখিতভাবে থাকে। এগুলিকে সাধারণ ভাষায় আদব-কায়দা হিসেবে বলা হয়। এই আলোচনা হচ্ছে একই ধরনের আর্থিক সম্পদের মানুষজনের কথা বিবেচনা করে। চাকুরি যদি শ্রমিকের হয় তাহলে মর্যাদার অবস্থান অনেক নিচে।

বাংলাদেশের মতন একটি প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশে আসা যাক। আমাদের সমাজে একটা ধারণা চালু আছে যেটা গভীরভাবে মর্যাদা কেন্দ্রিক। সেটা হচ্ছে ‘খান্দান’। এটা দিয়ে সাধারণভাবে বংশ মর্যাদা বোঝানো হয়ে থাকে। সামাজিক মেলামেশা এবং সম্পর্ক তৈরিতে খান্দানের ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী। কাউকে হেনস্তা করবার জন্য বলা হয়ে থাকে ‘দেখতে হবে না কোন্ বংশ থেকে এসেছে!’ বংশ মর্যাদা মাপার কতগুলো প্রচলন আছে।

একটা হচ্ছে কাদের পরিবার বা বংশ কত আগের ‘জমিদার’ কিংবা সম্পদশালী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে পিতৃবংশের কথা ভাবা হয়ে থাকে। তবে মাতৃবংশের যদি সম্পদশালী অতীত থাকে সেটাও হিসেব করা হয়ে থাকে মাঝে মধ্যে। যদিও ব্রিটিশ কালে জমিদার বলতে ব্রিটিশদের অনুগত কিছু মানুষজনই ছিল তবু এটা তেমন আলোচনায় আসে না। খান্দান বা বংশ মর্যাদা মাপামাপির ক্ষেত্রে গত তিন চার দশকে আরও কিছু উপকরণ চালু হয়েছে। যেমন: চাকুরি কিংবা শিক্ষা। কোন্ পরিবার কত আগে থেকে ‘সম্মানজনক’ চাকুরি করছেন তার ভিত্তিতে সেই পরিবারের বংশ মর্যাদা ধরে নেয়া হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে চাকুরির মর্যাদা সরকারী চাকুরির দিকে বেশি ছিল।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

পরবর্তীতে উচ্চ বেতনের বেসরকারী চাকুরি আরও মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার প্রসঙ্গটাও গুরুত্বপূর্ণ এবং তা চাকুরির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ ধরনের মর্যাদার বোধ এতটাই শক্তিশালী যে বিয়ে সাদী বা অন্যান্য কোন উৎসবে এগুলো হিসেব করে মেহমান ডাকা হয়। তাছাড়া বিয়ে করার জন্য জোড়া বাছাইয়ের সময় পরিবারের লোকজন কম বংশ মর্যাদার কাউকে বিবেচনা করেন না। এখানে যে প্রবণতার কথা আলোচনা করা হচ্ছে তা অবশ্যই মূলত স্বচ্ছল শ্রেণীর মানুষজনের ক্ষেত্রে সত্যি। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার যে শ্রেণীর সাথে বংশ মর্যাদা সম্পর্কিতভাবে কাজ করে। যেমন: কোন বিয়েতে পাত্র বা পাত্রীর বংশ খুব পছন্দ হ’ল না অপর পক্ষের।

সেখানে পাত্র/পাত্রীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা মজবুত হলে সেটার জোরে সম্পর্ক হতে পারে। এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসঙ্গের গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানিং কালে আর একটি মাত্রা লক্ষ্য করা যায়। তা হচ্ছে বিদেশ ভ্রমণ। অবশ্য এই প্রবণতাটি ভিন্ন ভাবে ব্রিটিশ কালেও ছিল। এর সঙ্গে আরেকটি মাত্রা হচ্ছে ইংরেজী জানা। মর্যাদার ধারণার সঙ্গে মর্যাদা রাখতে পারাও খুব গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। মর্যাদা রাখার প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিক ভোগ করা। অর্থাৎ আধুনিক কালের নগর সমাজে যত বেশি পরিমাণে ভোগ্যপণ্য খরিদ করা হয় ততই বেশি মর্যাদাবান থাকবার একটা ব্যবস্থা আছে। এটাকে কথ্য ভাষায় এই শ্রেণীর লোকজন বলে থাকেন ‘স্টেটাস রাখা ।

বর্তমান কালে মর্যাদার ব্যাপার কতগুলো সূক্ষ্ম উদাহরণেও দেখা যেতে পারে। বড় শহরের প্রায় সব মধ্যবিত্ত গেরস্থালিতে কাজকর্মের জন্য গৃহশ্রমিক আছেন। চলতি ভাষায় এঁদেরকে ‘বুয়া’ বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত নারী। এই গৃহশ্রমিকেরা সকলেই অতি দরিদ্র শ্রেণীর সদস্য এবং মাস ভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করে থাকেন। মানে দিনের শ্রম ঘণ্টা মেপে এঁদের কাজ বা মজুরি হয় না। যেহেতু গৃহশ্রমিকেরা সকলে স্বচ্ছল ঐ মধ্যবিত্তের গৃহেই থাকেন, তাই একই স্থান ব্যবহার করতে হয়। কোন্ ঘরে তিনি থাকবেন তার একটা ব্যবস্থা থাকে, বলাই বাহুল্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটা যথাসম্ভব নিচু মানের।

কিন্তু পাশাপাশি কোন্ ঘরে তিনি কাজের জন্য আসবেন এবং অন্য সময়ে আসতে পারবেন না সেটারও পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এটা কেবল ঘর বা জায়গা ব্যবহারের বেলাতেই নয়, টেলিভিশন দেখা, মেহমানদের সাথে কথা বলা বা হাসা, গান গাওয়া বা অন্যান্য অনেক কিছুর ব্যাপারই নিষেধাজ্ঞা থাকে। এখানে এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারগুলো কেবল আর্থিক বা সম্পদের প্রসঙ্গ দিয়ে বোঝা যাবে না। কারণ সেই পার্থক্য তো তাঁকে মজুরি দেয়ার সময়েই ঢুকে গেছে। এখানে ভেদাভেদটা আসলে মর্যাদার। গৃহমালিক পক্ষের মানুষজন গৃহশ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে সব সময় তাঁকে সতর্ক রাখতে চান বলেই এই নিষেধাজ্ঞা।

আর একটা ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে গায়ের রং। প্রচলিতভাবে আমাদের সমাজে অনায়াসেই লক্ষ্য করা যায় গায়ের রঙের ভেদে মানুষের মর্যাদার ভেদাভেদ হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে যাঁদের গায়ের রঙ হলদেটে তাঁদেরকে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়। এটা আমাদের একটা স্থানীয় বিষয় মনে হলেও আসলে এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আছে।

 

 

সারা পৃথিবীতে শ্বেতাঙ্গ মানুষজনের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজন নিপীড়িত হয়েছে। এই ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রেই কাগজে কলমে এই বৈষম্য আর নেই। আইনগত ভাবে সকলে সমান। কিন্তু বাস্তবে এখনও দেখা যায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব বহু শ্বেতাঙ্গ সমাজে আছে। এই বিদ্বেষ অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। যে সব সমাজের মানুষ আফ্রিকার মত কৃষ্ণবর্ণের নয় সেখানে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিই শ্বেতাঙ্গ ধ্যান- ধারণা দিয়ে গঠিত। যেমন আমাদের সমাজ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version