আজকের আলোচনার বিষয় সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ ধারণার মূল্যায়ন – সর্বপ্রাণবাদ- মহাপ্রাণবাদ ও মানা এর অর্ন্তভুক্ত, টায়লর ও ম্যারেট উভয়েই বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসসমূহ পর্যালোচনা করে কিছু সাধারণীকরণের নির্ভর। কিভাবে সুদূর ভিত্তিতে যথাক্রমে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ ও ‘মহাপ্রাণবাদ’কে ধর্মীয় বিশ্বাসের আদি ভিত্তি হিসাবে সনাক্ত করেছেন। তাদের উভয়ের ব্যাখ্যা অনেকটা অনুমান ঠিক অতীতে মানুষের মনে ‘মানা” জাতীয় শক্তি বা আত্মা, ভূত-প্রেত ইত্যাদি সত্ত্বা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মাল, তা নিশ্চিত করে বলা প্রায় অসম্ভব।
সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ ধারণার মূল্যায়ন
অবশ্য উপরের আলোচনাতেই আমরা দেখেছি যে, ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা ‘মহাপ্রাণবাদ’ প্রত্যয় শুধুমাত্র তথাকথিত আদিম সমাজ সমূহের ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং এগুলি সমকালীন প্রেক্ষিতেও প্রযোজ্য। সে হিসাবে এ ধরনের প্রত্যয়ের বিশ্লেষণী মূল্য রয়েছে। তবে টায়লর ও ম্যারেট উভয়ের বিশ্লেষণে যে বিষয়টা তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয় নি, তা হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সমাজ কাঠামোর সম্পর্ক।
কোন বিশ্বাসকে আমরা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা ‘মহাপ্রাণবাদ’ ধারণার আলোকে কিছুটা বুঝতে সক্ষম হতে পারি, কিন্তু সেটাকে বিশদভাবে জানতে-বুঝতে গেলে সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও অন্যান্য প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া জরুরী। ।। যেমন, ‘মানা” সংক্রান্ত বিশ্বাস মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়া, উভয় অঞ্চলে সাধারণভাবে দেখা যায়, তবে অঞ্চলেভেদে এই বিশ্বাসের সুনির্দিষ্ট রূপের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে।

সাধারণভাবে মেলানেশীয়দের তুলনায় পলিনেশীয় সমাজ ব্যবস্থা অধিকতর স্তরায়িত ছিল। মেলানেশীয় সমাজে একজন ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজে মর্যাদার আসন লাভ করতে পারত, এবং সেখানে এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, যে কেউ চেষ্টা করে বা ভাগ্যক্রমে ‘মানা’ শক্তির অধিকারী হতে পারে।
অন্যদিকে পলিনেশীয় সমাজে, যেখানে গোষ্ঠীপ্রধানের পদ ছিল, যা বংশানুক্রমে নির্ধারিত হত, ‘মানা” সবার জন্য সমানভাবে লভ্য ছিল না। একজন গোষ্ঠীপ্রধান সমাজের অন্যদের তুলনায় সব সময়ই অধিক ‘মানা’র অধিকারী বলে বিবেচিত হত, এবং তার এই বিশেষত্বের কারণে সাধারণ মানুষদের তার সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে হত (কারণ ‘মানা’ এমন একটা শক্তি বলে বিবেচিত হত, বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়া যেটির সংস্পর্শ বিপদ ডেকে আনতে পারে)।
কাজেই দেখা যায়, ‘সর্বপ্রাণবাদ’, ‘মহাপ্রাণবাদ’, ‘মানা’ প্রভৃতি ধারণার সাধারণ বিশ্লেষণী মূল্য থাকলেও এগুলি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপটের নির্দিষ্টতার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। অন্যভাবে বলা যায়, কোন নির্দিষ্ট সমাজের বিশেষ কোন বিশ্বাসকে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বা অনুরূপ কোন নামে অভিহিত করা গেলেই সেটাকে আমাদের বোঝা হয়ে যায় না, বরং তা হবে আমাদের অনুধাবনের প্রয়াসের একটা প্রাথমিক ধাপ মাত্র।
১. সার্বিক তুলনামূলক মূল্যায়ন টেবিল: সর্বপ্রাণবাদ বনাম মহাপ্রাণবাদ
মূল্যায়নের দিক | সর্বপ্রাণবাদ (Animism) | মহাপ্রাণবাদ (Vitalism) |
---|---|---|
মূল ধারণা | প্রকৃতির সকল কিছুর মধ্যে আত্মা বা প্রাণের উপস্থিতি | জীবনের মূল উৎস একটি অতিরিক্ত, জৈব-অতিরিক্ত প্রাণশক্তি |
দার্শনিক ভিত্তি | আধ্যাত্মিক ও আদিম দার্শনিকতা | জৈবতত্ত্বের প্রাচীন ব্যাখ্যা; আরিস্তটল, বার্গসঁ প্রমুখের মতবাদ |
ধর্মীয় প্রভাব | বহুপ্রাণবাদ, লোকধর্ম, প্রকৃতি উপাসনার মূল ভিত্তি | ধর্মীয় নয়, বরং দার্শনিক ও প্রাক-বিজ্ঞানচর্চায় ব্যবহৃত |
বৈজ্ঞানিক অবস্থান | বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ, পরীক্ষাযোগ্য নয় | আধুনিক বিজ্ঞানে পরিত্যক্ত, জৈব-রসায়ন দিয়ে প্রতিস্থাপিত |
সাংস্কৃতিক ব্যবহার | লোকাচার, শিকড়ের বিশ্বাস, উৎসব, রীতিনীতি | ইউরোপীয় বিজ্ঞান-ইতিহাসে সীমাবদ্ধ |
আজকের প্রাসঙ্গিকতা | পরিবেশবাদ, ইকোস্পিরিচুয়ালিজমে পুনঃব্যবহার | ইতিহাসের পাঠে গুরুত্বপূর্ণ, আধুনিক বিজ্ঞানে উপযোগিতা নেই |
২. দার্শনিক মূল্যায়ন টেবিল
দার্শনিক প্রশ্ন | সর্বপ্রাণবাদ | মহাপ্রাণবাদ |
---|---|---|
বাস্তবতা কী দিয়ে গঠিত? | আত্মা বা চেতনা-সম্পন্ন বস্তু | পদার্থের বাইরে একটি ‘প্রাণশক্তি’ দ্বারা |
মানুষের স্থান | প্রকৃতির অংশ, আত্মাসমৃদ্ধ প্রাণী | প্রাণশক্তির বাহক হিসেবে মানুষ একটি বিশেষ অস্তিত্ব |
স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের ধারণা | আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করাই মূল | প্রাণশক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারা বোঝা সম্ভব নয় |
চেতনার উৎস | প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই চেতনার উপস্থিতি | জৈব জীবের মধ্যে এক অতিপ্রাকৃত প্রাণতত্ত্ব |
৩. আধুনিক দর্শনে প্রাসঙ্গিকতা
মূল্যায়ন দিক | সর্বপ্রাণবাদ | মহাপ্রাণবাদ |
---|---|---|
পরিবেশবাদে ভূমিকা | প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি জোগায় | পরিবেশবাদে সরাসরি প্রভাব নেই |
বিকল্প আধুনিকতা চিন্তায় | আদিবাসী দর্শনে, ইকোফেমিনিজমে স্থান পেয়েছে | কেবল ইতিহাসগত দৃষ্টিকোণে আলোচিত হয় |
নিউ-এজ ও স্পিরিচুয়াল চিন্তায় | ব্যাপকভাবে গৃহীত | সীমিত আলোচনায় থাকে |
শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চায় | লোকজ সংস্কৃতি, নাটক, সাহিত্যে ব্যবহারযোগ্য | শিক্ষার ইতিহাসে স্থান পেয়েছে |
আরও দেখুনঃ