আজকের আলোচনার বিষয় মিথের কাঠামোগত বিশ্লেষণ – যা ধর্ম : মিথ ও আচার এর অর্ন্তভুক্ত, ফরাসী নৃবিজ্ঞানী লেভি-স্ট্রস প্রণীত একটি তাত্ত্বিক রূপরেখা, যা কাঠামোবাদ (structuralism) নামে পরিচিত, বিভিন্ন সমাজের মিথসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণে যথেষ্ট অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে।
মিথের কাঠামোগত বিশ্লেষণ
কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করা হয়, মানুষের মনের কতগুলি বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোর মূলে রয়েছে মানব মস্তিষ্কের কিছু সাধারণ কাঠামোগত বিষয়। এসবের ফলে দেখা যায় যে, স্থান কালের পার্থক্য সত্ত্বেও একটা মৌলিক স্তরে সকল মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া একই ধরনের। এরকম একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সকল মানব সমাজই তাদের চারপাশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক জগতকে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করে।
এধরনের বর্গীকরণের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্বৈত বৈপরীত্য (binary opposition / contrast) বা বিপরীত জোড় পদের ব্যবহার–ভাল বনাম মন্দ, জীবন বনাম মৃত্যু, পুরুষ বনাম নারী, প্রাপ্তবয়স্ক বনাম শিশু, উঁচু বনাম নীচু ইত্যাদি। বিভিন্ন মিথ, রূপকথা প্রভৃতির মূলে রয়েছে এ ধরনের কিছু সাধারণ বিপরীত জোড় পদ, যেগুলোর বিভিন্ন ধরনের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আপাতঃদৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন অনেক কাহিনী।

কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানীরা তাদের বিশ্লেষণে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কিভাবে বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত মিথ ও অন্যান্য কাহিনীর মূলে রয়েছে অভিন্ন কিছু মৌলিক উপাদান, কিভাবে এই মৌলিক উপাদানগুলির বিবিধ রূপান্তর ও নব নব বিন্যাস দিয়ে গড়ে ওঠে আলাদা আলাদা কাহিনী।
বৈপরীত্যের ভিত্তিতে মানুষ জীবন ও জগতকে অনুধাবন করলেও বাস্তবে এবং কল্পনায় এমন অনেক সত্তা, বস্তু বা বিষয় রয়েছে যেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বৈপরীত্যের যুগপৎ সমাহার দেখা যায়। বিভিন্ন মিথ এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এই ধরনের তৃতীয় বর্গ একটি কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে। যেমন, পৌরাণিক কাহিনীসমূহে অর্ধ-মানব অর্ধ-দেবতা, অর্ধ-মানব অর্ধ-পশু, অর্ধ-নর অর্ধ-নারী ইত্যাদি চরিত্রের ব্যাপক সাক্ষাত মেলে।
সামাজিকভাবেও এই ধরনের ‘মিশ্র’ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অনেক কিছুকে ঘিরে আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান লক্ষ্য করি। যেমন, হিজড়ারা ঠিক পুরুষও না নারীও না, বরং তৃতীয় একটি লিঙ্গীয় বর্গের মানুষ। সামাজিকভাবে তারা প্রান্তিক হলেও তাদের কিছু বিশেষ ‘ক্ষমতা” আছে বিশ্বাস করা হয়। এভাবে কাঠামোবাদীরা তাদের বিশ্লেষণ শুধুমাত্র মিথ, রূপকথা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সীমিত রাখেন নি, বরং সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যান্য আরো বহু বিষয় বিশ্লেষণে তারা একই ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন।
আরও দেখুনঃ