Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

লেভি-স্ট্রস কর্তৃক অজাচার সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান

আজকের আলোচনার বিষয় লেভি-স্ট্রস কর্তৃক অজাচার সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, লেভি-স্ট্রসের দৃষ্টিতে যৌন বিধিনিষেধ এবং বিয়ের বিধিনিষেধ – এ দুয়ের পার্থক্য টানা জরুরী নয়।। তাঁর কথা হ’ল: মূল বিষয় হচ্ছে অজাচার। বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে নিষিদ্ধ করার চাইতে বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে বাঞ্ছনীয় করে তোলা হয়। অজাচার নিষেধাজ্ঞার কারণ আলোচনা করতে যেয়ে তিনি টায়লরকে অনুসরণ করেন। প্রায় ৬০ বছর পূর্বে টায়লর বহির্বিবাহ-সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছিলেন, সমাজকে সুসংহত রাখার পিছনে বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত মৈত্রীবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

টায়লরের যুক্তি ছিলো: আদিম সময়কালে পরিবারের পক্ষে নিঃসঙ্গভাবে টিকে থাকা কঠিন ছিলো। বড় ধরনের শিকার অভিযানে যেতে কিংবা শত্রু থেকে আত্মপক্ষ রক্ষা করতে হলে অন্যান্য পরিবার ও বন্ধুমহলের সাহায্য ছিলো বাঞ্ছনীয়। মিত্রসুলভ সম্পর্ক স্থাপনে বিয়ের ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। টায়লরের ভাষায়, রাস্তা ছিলো দুটো: হয় বাইরের দলগুলোর সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করা আর না হয় তাদের আক্রমনের শিকার হওয়া। লেভি-স্ট্রস একই যুক্তি ধরে এগোন। তিনি বলেন, অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয় কিন্তু এই নয় যে, নিজ বোন কিংবা মা কিংবা কন্যার সাথে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ । বরং, অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয় হচ্ছে অপরের কাছে নিজ বোন কিংবা মা কিংবা কন্যা প্রদান ।

লেভি-স্ট্রস কর্তৃক অজাচার সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান

 

 

লেভি-স্ট্রস কর্তৃক অজাচার সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান

 

তাঁর বক্তব্যের সমর্থন তিনি নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মীড-এর আরাপেশদের মাঝে করা গবেষণা কাজে খুঁজে পান। মীড যখন আরাপেশ তথ্যদাতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, বোনের সাথে জোড়বন্ধনের সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় কিনা, উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন :

কখনোই না, তাঁরা বলেন: “না আমরা আমাদের বোনদের সাথে সহবাস করি না। আমরা অন্য পুরুষদের কাছে আমাদের বোনদের প্রদান করি আর অন্য পুরুষেরা ওদের বোন আমাদের কাছে দেয়”। নৃবিজ্ঞানী প্রসঙ্গটি আবার তুললেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, যদিও এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে কিন্তু যদি কোনভাবে এটা ঘটে যায় তাহলে আপনারা এটাকে কিভাবে দেখবেন, কি ভাষায় এ নিয়ে কথা বলবেন।

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তথ্যদাতাদের কষ্ট হ’ল, এমন পরিস্থিতি ঘটার কথা যেহেতু ভাবাই যায় না। “কি, নিজের বোনকে বিয়ে করা! আচ্ছা, তোমার হয়েছেটা কি বল তো? তুমি কি ভগ্নিপতি চাও না? তুমি কি বোঝ না যে তুমি যদি অন্য কোন পুরুষের বোনকে বিয়ে কর এবং অন্য কোন পুরুষ যদি তোমার বোনকে বিয়ে করে তাহলে তুমি পাবে দুজন brother-in-law (বাঙ্গালি মুসলমান জ্ঞাতিত্ব ভাষায় “ভগ্নিপতি” এবং “সম্বন্ধি”), আর তুমি যদি নিজ বোনকে বিয়ে কর তাহলে তুমি একজনও পাবে না? [এই অবস্থায়] তুমি কার সাথে শিকারে যাবে, কার সাথে তুমি উদ্যান চাষ করবে, কার সাথে বেড়াতে যাবে?”

বংশধারা তাত্ত্বিকদের থেকে লেভি-স্ট্রসের তত্ত্ব খুবই ভিন্ন। তাঁদের দৃষ্টিতে, “আদিম” সমাজের সামাজিক সংগঠনের মূলে রয়েছে বংশভিত্তিক সংগঠন। বংশভিত্তিক সংগঠনের কারণেই এই সমাজগুলো স্থিতিশীল। সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং হাল-আমলের অনেক নৃবিজ্ঞানীর মতে, ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীরা বারে বারে অ-ইউরোপীয় সমাজের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি অনুসন্ধান করাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখেন। বংশধারা তাত্ত্বিকদের থেকে লেভি-স্ট্রসের ভিন্নতা এখানেই যে তাঁর মতে, আদিম সমাজ বংশ-ভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে টিকে থাকে না, বরং একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে টিকে থাকে।

এই বিশেষ সম্পর্ক বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর নাম লেভি-স্ট্রস রাখেন “মৈত্রী বন্ধন” । লেভি-স্ট্রসের দৃষ্টিতে, যে সমাজগুলো আদিম, সেগুলোর আছে একটি “মৌলিক কাঠামো”। আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের মাঝে এই মৌলিক কাঠামো পাওয়া যায়, আরো পাওয়া যায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে, দক্ষিণ ভারতে, এবং দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের মাঝে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এইসব অঞ্চলে বিভিন্ন সমাজে যে মৌলিক কাঠামো লক্ষ্য করা যায় তা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ইনুইত (এস্কিমো)-দের “জটিল কাঠামো”র বিপরীত। যে সকল সমাজে জটিল কাঠামো বিদ্যমান সেখানকার বিবাহ-রীতি, লেভি-স্ট্রসের ভাষায়, “নেতিবাচক”। তিনি নেতিবাচক বলেছেন এই কারণে, যেহেতু এই নিয়ম বলে দিচ্ছে কাকে বিয়ে করা যাবে না । উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে একই রক্তের ভাই বা বোনকে বিয়ে করা যাবে না, অথবা বাবা-মাকে বিয়ে করা যাবে না। পক্ষান্তরে, লেভি-স্ট্রসের দৃষ্টিতে, মৌলিক কাঠামো-ভিত্তিক সমাজের বিবাহ-রীতি “ইতিবাচক” কারণ কাকে বিয়ে করা উচিত, সেটা বিধিবদ্ধ করা হচ্ছে।

লেভি-স্ট্রসের বই মূলত মৌলিক কাঠামো নিয়ে: তাঁর দৃষ্টিতে বিবাহ-রীতি সমাজকে সুসংহত করে তোলে। তাঁর যুক্তিকে তিনি এভাবে দাঁড় করাচ্ছেন: মৌলিক কাঠামো দুই ধরনের। প্রথম ধরনের মৌলিক কাঠামোতে দুটি দল থাকে, ধরুন “ক” এবং “খ”। এ ধরনের সমাজের ইতিবাচক বিবাহ-রীতি মোতাবেক “ক” দলের মানুষজনের বিয়ে করা উচিত “খ” দলের মানুষজনকে, আর “খ” দলের মানুষজনের বিয়ে করা উচিত “ক” দলের লোকজনকে। লেভি-স্ট্রস এ ধরনের ব্যবস্থার নামকরণ করেছেন “প্রত্যক্ষ বিনিময়”। তাঁর যুক্তি হ’ল, তিনি যাদের মাঝে গবেষণা কাজ করেছেন, সে সমাজের মানুষেরা বিষয়টাকে দেখেন একদল হতে আরেক দলে নারীর বিনিময় হিসেবে।

দ্বিতীয় ধরনের মৌলিক কাঠামোর ক্ষেত্রে ঘটে থাকে “অপ্রত্যক্ষ বিনিময়”। এই সমাজের রীতি ভিন্ন কারণ এখানে দলের সংখ্যা দুয়ের অধিক। বেশী সংখ্যক দল হলে সামাজিক সংহতি ভিন্নভাবে ঘটে থাকে ভিন্ন ধরনের বিবাহ- রীতির মাধ্যমে। এখানে “ক” দলের মানুষজনের “খ” দলের মানুষজনকে বিয়ে করার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু “খ” দলের মানুষজন “ক” দলের লোকজনকে বিয়ে না করে বরং “গ” দলের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। আবার দেখা যায়, “গ” দলের মানুষজন বিয়ে করছেন “ক” দলে। অপ্রত্যক্ষ বিনিময় ব্যবস্থায় বিয়ে ঘটে চক্রাকারভাবে, , এই চক্রের কোন পর্যায়ে ইতি টানা হয় না (যেমন কিনা প্রত্যক্ষ বিয়ে ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঘটে)।

লেভি-স্ট্রস তাঁর মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব দাঁড় করান ক্রস-কাজিন বিবাহ ব্যবস্থা (ফুপাত-মামাত ভাই ও বোন) যে সকল সমাজে প্রচলিত তার প্রেক্ষিতে। তাঁর মতে, এই বিবাহ ব্যবস্থা নারী বিনিময় ব্যবস্থার অংশ। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দলগুলো নারী বিনিময়ের মাধ্যমে স্থায়ী মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। দুই পরিবার বা দলের মধ্যে নারী বিনিময় আন্তঃনির্ভরশীলতা নিশ্চিত করে তোলে। যদি নারী বিনিময় না ঘটে, যদি নিজ দল হতে বিবাহ সঙ্গী বাছাই করা হ’ত তাহলে এই মৈত্রী তৈরি হত না, সংহতি তৈরী হ’ত না। বহির্বিবাহ রীতি পারিবারিক বিনিময় নিশ্চিত করে এবং এর মাধ্যমে বৃহত্তর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি সম্ভব করে। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মস অনুসারে, লেভি-স্ট্রস মনে করতেন উপহার বিনিময় হচ্ছে পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রতীকী রূপ। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে: পরিবার এবং দল অন্য কিছু

বিনিময় না করে কেন নারীদের বিনিময় করবেন? তাঁর উত্তর ছিল এরকম: যদি দুই দলের মধ্যে নারী বিনির্মিত না হয়ে কোন বস্তু’র বিনিময় ঘটত তাহলে একবার বস্তু হস্তান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর সেই সম্পর্ক থাকত না যা কিনা নারী বিনির্মিত হওয়ার কারণে সম্ভব। বস্তু বিনিময় প্রথার পূর্বে নারী বিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল – এই ছিল লেভি-স্ট্রসের অভিমত।

ইতিবাচক বিবাহ-নীতির গুরুত্ব এর আগেও দৃষ্টি কেড়েছিল নৃবিজ্ঞানীদের। দলকে সম্পর্কযুক্ত করার ক্ষেত্রে বিয়ের গুরুত্ব ধরা পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে করা বৃটিশ এবং ওলন্দাজ নৃবিজ্ঞানীদের কাজে। তবে নিশ্চিতভাবেই লেভি-স্ট্রসের তত্ত্বের ছিল বিস্তৃতি। প্রকাশনার পর থেকে এই বইটি যেমন সমাদর পেয়েছে, আবার সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে।

প্রথমত, বিবর্তনবাদী বক্তব্যের কারণে এই বইটি সমালোচিত হয়েছে।  দ্বিতীয়ত, পীচ মায়ানমার (পূর্বে বার্মা নামে পরিচিত)-এ সম্পন্ন করা কাজের ভিত্তিতে বলেন, বিবাহ-নীতি বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করা সঙ্গত নয়। সবসময় এ নীতিগুলোকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির প্রেক্ষিতে বিচার করা উচিত।

 

 

তৃতীয়ত, বিবাহ নীতি এবং সংযুক্তকরণের যে আবশ্যিক সম্পর্ক লেভি-স্ট্রস দেখেছেন, তাকে প্রশ্ন সাপেক্ষ করে তোলেন লুই ডুমো ডুমো বলেন, যদিও দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে লেভি-স্ট্রস যাকে বলবেন “মৌলিক কাঠামো”, তা আছে, কিন্তু এই নীতির সামাজিক অর্থ সকল স্থানের জন্য একরকম নয়। যেমন ধরুন, দক্ষিণ ভারতে যদিও বা বিবাহ-বন্ধন স্থাপনের মধ্য দিয়ে মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু একই কথা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজের ক্ষেত্রে বলা যায় না।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version