Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

শিকারী সংগ্রহকারী সমাজ 

আজকের আলোচনার বিষয় শিকারী সংগ্রহকারী সমাজ  – যা  প্রাক্ পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা এর অর্ন্তভুক্ত, এই সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকার ও সংগ্রহের উপর ভরসা করা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে এটা পরিষ্কার যে, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক সময় ধরে এই ধরনের আর্থব্যবস্থা ছিল বলে নৃবিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন। তাঁদের মতে ইতিহাসের ৯৯% সময় কাল ধরে খাদ্য সংগ্রহের এই ধরনের ব্যবস্থা ছিল।

নৃবিজ্ঞানী লী এবং ডেভোর ১৯৬৮ সালে মত প্রকাশ করেছেন যে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আবিষ্কারের মধ্যে শিকার- সংগ্রহ প্রণালী পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি। কারণ, পরিবেশের বিপর্যয় কিংবা যুদ্ধবিগ্রহে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মত নানাবিধ অনিশ্চয়তা আছে কৃষিভিত্তিক এবং শিল্পভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে। এখানে একটা বিষয়ে সতর্কতার দরকার আছে।

 

শিকারী সংগ্রহকারী সমাজ

যদিও কিছু নৃবিজ্ঞানী খুবই গুরুত্বের সাথে শিকার-সংগ্রহ সমাজ নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার কোন শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের সঙ্গে প্রাচীন কালের শিকারী- সংগ্রহকারী সমাজকে গুলিয়ে না ফেলা খুবই জরুরী। নৃবিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে বর্তমান কালের কোন শিকারী-সংগ্রহকারী দল কৃষিভিত্তিক মানুষজনের সাথে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন নেই, থাকতে পারে না। একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, বর্তমান কালের শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের তথ্য দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক সমাজের কোনও প্রমাণ হাজির করা ঠিক নয়।

একটা সময়ে এই ধরনের সমাজকে কেবল শিকারী সমাজ বলা হ’ত। পরবর্তী কালে নৃবিজ্ঞানীরা | অনেকেই পরিষ্কার করে বলেছেন, যে সকল সমাজে শিকার খাদ্য যোগাড়ের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য সে | সকল সমাজে একই সাথে সংগ্রহ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মানে হ’ল: কেবলমাত্র পশু-পাখি | শিকার করে প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড় হয় না, ফলমূলও সংগ্রহ করতে হয়। বরং, কেবলমাত্র শিকারী | সমাজ বললে নারীদের শ্রমকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। কারণ, এরকম সমাজে এই নজির খুবই স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে যে, নারীরা সাধারণত ফলমূল সংগ্রহের কাজ করে থাকেন। খাদ্যের প্রধান যোগান উদ্ভিজ্জ সংগ্রহের মধ্য দিয়েই আসে।

সাম্প্রতিক কালের দুনিয়ায় শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ খুবই সীমিত হয়ে এসেছে। নৃবিজ্ঞানী মারডক গত শতকের মাঝামাঝি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের একটা সম্ভাব্য তালিকা প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায় –

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ক) আফ্রিকা: বুশমেন, কোরোকা, পিগমি, পূর্ব আফ্রিকার শিকারী সমাজ, ইথিওপীয় শিকারী সমাজ; খ) এশিয়া: সাইবেরীয় শিকারী সমাজ, , ভারতীয় শিকারী সমাজ, ভেদ্দা শিকারী সমাজ, দক্ষিণ- পূর্ব এশীয় শিকারী সমাজ, নেগরিটো; গ) ওশেনিয়া: অস্ট্রেলীয় আদিবাসী; ঘ) উত্তর আমেরিকা: এস্কিমো, উত্তর-পূর্ব এ্যালগোনকোয়ান্‌স, উত্তর-পশ্চিম আথাপাসকাস, প্লেটো ইন্ডিয়ান, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্ডিয়ান, গ্রেট বেসিন, গাল্‌ফ ইন্ডিয়ান, এ্যাপাচি, সেরি; ঙ) দক্ষিণ আমেরিকা: ওয়ারাউ, দক্ষিণ ভেনেজুয়েলার গহীন আদিবাসী, আমাজনের শিকারী সমাজ, পূর্ব ব্রাজিলের শিকারী সমাজ ইত্যাদি।

সাধারণভাবে বিবর্তনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের সঙ্গে ব্যান্ড ব্যবস্থার সমাজ মিলিয়ে দেখা হয়। কিন্তু এই হিসেবটা সব সময় অর্থবহ নয়। এই ধরনের সমাজে কি ধরনের স্বচ্ছলতা ছিল তা বোঝা যায় নৃবিজ্ঞানী মার্শাল সাহলিসের একটা মন্তব্য থেকে। তিনি এই ধরনের সমাজকে ‘সত্যিকার সমৃদ্ধ সমাজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে একটা তর্ককে খেয়াল রাখা দরকার । অনেক নৃবিজ্ঞানীই শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজকে দুর্দশাগ্রস্ত এবং প্রকৃতির বৈরিতার সম্মুখীন হিসেবে দেখিয়েছেন।

কিন্তু পৃথিবীতে কৃষিব্যবস্থার বিস্তারের পর প্রকৃতির উৎকৃষ্ট অংশ এই ব্যবস্থার অধীন হয়ে গেছে। ফলে নৃবিজ্ঞানীরা এমন একটা পরিস্থিতিতে শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজও আবিষ্কার, করেছেন যখন প্রকৃতির চমৎকার জায়গাগুলো আর তাঁদের আয়ত্তে নেই, তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। সাহলিনস বিভিন্ন রকম ঐতিহাসিক এবং জাতিতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করে যুক্তি দেন যে, এই ধরনের সমাজের সদস্যরা তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য খুবই অল্প সময় কাজ করে থাকেন। ফলে তাঁদের জীবন যাপনে অনেকটা অবসর পেয়ে যান। তিনি আরও বলেন, শিকারী- সংগ্রহকারী সমাজ প্রধানত যাযাবর ধরনের এবং এদের জীবনে খুব সামান্যই ব্যক্তিগত দখলী জিনিস আছে।

সাধারণভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাই তেমন কাজ করে না। একই সাথে সঞ্চয় বা জমিয়ে রাখারও বালাই নেই। এভাবে সাহলিনস মনে করেন এই সমাজগুলোই সত্যিকার সমৃদ্ধ সমাজ। বর্তমান কালের শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজের উপর যে সমস্ত গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা যায় আসলেই এ সকল সমাজের মানুষজন খুবই অল্প সময় কাজ করে তাঁদের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন। দৈনিক ২ থেকে ৪ ঘণ্টা তাঁরা কাজ করে থাকেন এবং বাড়তি যে খাদ্যের যোগান থাকে সেগুলো ধ্বংস করে থাকেন।

 

 

এখানে এ কথা মনে রাখারও প্রয়োজন আছে, বর্তমান কালের বহু শিকারী-সংগ্রহকারী সমাজ পরিবেশ ও প্রকৃতির নিদারুণ চাপের মধ্যে আছেন। সেটা ঘটেছে কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের চাপে। তবুও সাহলিনসের ভাবনা-ি -চিন্তা ও যুক্তির গুরুত্ব আছেই।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version