আজকের আলোচনার বিষয় কেস স্টাডি : যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারে লিঙ্গ ও শ্রেণীর আন্তঃপ্রবিষ্টতা – যা লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক এর অর্ন্তভুক্ত, মার্কিনী সমাজে “মতাদর্শ” পরিবারের দিক-নির্দেশনা দেয়। গরীব শ্রেণীর ক্ষেত্রে এভাবে: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকবে প্রেম-ভালবাসা, স্ত্রী স্বামীর সেবা-যত্ন করবে, তার জন্য রাঁধবে বাড়বে, তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিবে, তার শার্ট ইস্ত্রি করে দিবে, ঘর-দোর গুছিয়ে রাখবে, তাদের বাচ্চা হবে ইত্যাদি। পারিবারিক সম্পর্ক দুটো জিনিস নিশ্চিত করে। এক, পুরুষ শ্রমিকের দৈনন্দিন সেবাযত্নের খরচপাতি কারখানা মালিকের বহন করতে হয় না।
ধরুন, যদি শ্রমিকের বাড়িতে বউ না থাকত এবং তার যদি হোটেলে থাকতে হ’ত, হোটেলের খাবার কিনে খেতে হত, লন্ড্রিতে কাপড় ধোয়াতে হ’ত, তাহলে নিঃসন্দেহে মিল-মালিকের আরও বেশি মজুরি দিতে হত। পুরুষ-শ্রমিকের স্ত্রী প্রেম- ভালোবাসার কারণে তার স্বামীর সেবাযত্ন করেন। গৃহিণী হিসেবে তিনি যে গৃহশ্রম (housework) দেন, তার বিনিময়ে তিনি কোন মজুরি পান না। স্বামী-শ্রমিক তার মজুরি দিয়ে যেসব পণ্য বাজার থেকে কেনেন (খাবার, পোশাক), পরিবারের সদস্য হিসেবে গৃহিণী-স্ত্রী তার অংশবিশেষ পান। অর্থাৎ, শ্রম বাজার এবং মজুরির সাথে -শ্রমিকের সম্পর্ক সরাসরি এবং প্রত্যক্ষ।
কেস স্টাডি : যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারে লিঙ্গ ও শ্রেণীর আন্তঃপ্রবিষ্টতা
পক্ষান্তরে, নারীর সম্পর্ক অপ্রত্যক্ষ। স্বামীর মধ্যস্থতায় নারী শ্রম- পুরুষ ও বাজার এবং মজুরির সাথে সম্পর্কিত। দুই, নারী তাঁর পেটে সন্তান নেন, তাকে জন্ম দেন, এবং লালন-পালন করেন। পুঁজিবাদের কঠোর বৈষম্যভিত্তিক ব্যবস্থায়, সে হয়ে ওঠে আগামী প্রজন্মের শ্রমিক। কিন্তু কারখানা-মালিক, এই প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক পেয়ে যান নিখরচায় যেহেতু নারী, মা হিসেবে, তার সন্তানের সেবা যত্ন অনিবার্যভাবে করে থাকেন। এই হচ্ছে শ্রমিক-শ্রেণীর বাস্তব অবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত মানুষজন চাকুরিজীবী। তারা বড় বড় কোম্পানীতে চাকরিরত ব্যবস্থাপক হিসেবে; অনেকে সরকারী চাকরি করেন, অনেকে পেশাজীবী। অনেক মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্যই কাজ করেন (যেমন, বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মচারী)। এই শ্রেণী বেতনের উপর নির্ভরশীল; বেতন বাদে নানান ধরনের আর্থিক সুযোগ সুবিধা তাঁরা পান (বাড়ি ভাড়া, স্বাস্থ্য বীমা, সন্তানদের শিক্ষা ভাতা, বিনোদন ভাতা)।
দেখা যায়, পদন্নোতির তাগিদে মধ্যবিত্ত গৃহস্থালী প্রায়শই স্থান পাল্টায়: গৃহস্থালীর সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক রাজ্য হতে আরেক রাজ্যে স্থানান্তরিত হন। অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক স্থানান্তরনে সাহায্য করে আত্মীয়কুলের পরিবর্তে বাজারে ক্রয়যোগ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। যেমন, বাড়ির মাল-সামান প্যাক করে দিয়ে নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার মতন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (ইদানিংকালে ঢাকায়ও)।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিয়ে “সমতাভিত্তিক”। র্যাপের অভিমত হচ্ছে, ‘সমতাভিত্তিক বিয়ে’ – এই শব্দগুলো পুঁজিবাদী বৈষম্য আড়াল করে। স্বামীর পেশাগত সম্মান রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এমন একজন স্ত্রীর যিনি স্বামীর উপযুক্ত সঙ্গী হতে পারবেন: শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি, স্মার্ট। আশা করা হয়, মা হিসেবে তিনি সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন, আকর মূল্যবোধ তাদের মজ্জাগত করবেন। র্যাপ বলছেন, মধ্যবিত্ত জ্ঞাতিত্বের দুইটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়: প্রথমত, সম্পদ প্রবাহিত হয় রৈখিক ভাবে (বাবা-মা হতে সন্তান, নাতি-নাতনী ইত্যাদি)। পার্শ্বিক ভাবে নয় (বৃহত্তর জ্ঞাতিকুল)। পার্শ্বিক প্রবাহ গরিব এবং শ্রমিক পরিবারের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়।
লেখাপড়া, পেশাগত প্রতিষ্ঠা এবং বিয়ের উপহার – এ ধরনের ঘটনায় বয়োজ্যেষ্ঠ প্রজন্ম (দাদা-দাদী, নানা-নানী, পিতা-মাতা) বয়োকনিষ্ঠ প্রজন্মের (নাতি-নাতনী, নিজ সন্তান) পেছনে অনেক টাকা খরচ করেন। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত পরিবার সাধারণত তাদের আবেগ অনুভূতি এবং মনোযোগ জ্ঞাতিকুলের পেছনে লগ্নি না করে বন্ধু-মহলে করে। এ ধরনের সম্পর্ক পারিবারিক সম্পদ সংরক্ষণে সাহায্য করে, বন্ধুদের মধ্যে আদান-প্রদান হয় আবেগ-অনুভূতির, সম্পদের নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব ধনী যারা, তাঁদের সম্বন্ধে গবেষকরা খুবই কম জানেন। র্যাপের মতে, এর কারণ হতে পারে, ধনীরা গবেষণার টাকা যোগান দেন, তাঁরা নিজেরা সচরাচর গবেষণার বিষয় হতে সম্মত হন না। ধনীদের একাধিক গৃহস্থালী থাকে, তাঁরা বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন গৃহে যেয়ে বসবাস করেন। ধনী পরিবার খুবই রৈখিক, এবং নিজেদের মধ্যে কে কোন্ পেশায় আছে সেটা নিয়ে তাঁরা খুব একটা মাথা ঘামায় না।
বরং, কার পারিবারিক ঐতিহ্য কি, এটা নিয়ে তাঁরা বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন। পারিবারিক গন্ডিতে অর্থ সংগৃহীত হয়, এবং প্রবাহিত হয়। তবে, র্যাপ বলেন: অর্থ এবং শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্ক সহজ-সরল নয়। এমনও হতে পারে, কোন পরিবারের অবস্থা পড়ে গেছে কিন্তু তাঁদের “খানদানি” ঐতিহ্যের কারণে তাঁরা এখনও ধনী মহলে ওঠা-বসা করেন।
উচ্চবিত্তদের জগত খুব লিঙ্গ- বিভক্ত। এই শ্রেণীর নারীরা শ্রেণী-দরজা পাহারা দেন: ঘটকালি করেন, মানানসই বিয়ের আয়োজন করেন, আদর্শ মা এবং স্ত্রীর ভূমিকা বহির্জগতে পরিবেশন করেন। রমণীয় এবং পারিবারিক আচরণ কি হওয়া উচিত তা উচ্চবিত্ত নারীরা, মিডিয়ার সাহায্যে, নিরন্তর পরিবেশন করেন। লক্ষণীয় হল, ধনী নারীদের “মা” এবং “স্ত্রী” হিসেবে পরিবেশন করা হয়। কিন্তু, আসলে মা এবং স্ত্রী হবার কারণে তাদের মিডিয়াতে বারেবারে দেখানো হয় না। তাদের পরিবেশন করা হয় কারণ তারা ধনী। এই শ্রেণীর নারীরা সমাজ সেবা করেন এবং র্যাপের বিশ্লেষণ হচ্ছে, এই ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে তারা পুঁজিবাদের কঠোরতা এবং নৃশংসতা কোমল করে তোলেন।
আরও দেখুনঃ