“সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব : পরিবার” পাঠটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ/বিএসএস শ্রেণীর “সমাজতত্ত্ব – ২ (সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান পরিচিতি)” এর একটি পাঠ। এখানে পরিবারকে সামাজিক সংগঠনের মৌলিক একক হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে পরিবার কীভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলে, সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণ করে এবং সমাজের স্থিতি ও ধারাবাহিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব
আজকের আলোচনার বিষয় পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব – যা পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, এই পাঠের প্রথমে যে কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল, আমরা তাতে ফিরে যাই। পরিবারের কি ইতিহাস আছে? ফ্রাইডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫; সমাজতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সের সহযোগী, তিনি নিজেও বিপ্লবী ছিলেন আর ছিলেন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক) এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয়দের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনারা ভাবেন, পরিবারের ক্ষেত্রে কোন ঐতিহাসিক বিকাশ ঘটেনি। আপনারা ধরে নেন যে, খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থে পিতৃ প্রধান পরিবারের যে রূপ অঙ্কিত, সেটা সঠিক এবং সত্য।”
এঙ্গেলসের লক্ষ্য ছিল, পরিবার যে একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান (এর অতীত এবং বর্তমান আছে, এর বদল ঘটে, এটা বদলযোগ্য), তা যুক্তিসহকারে প্রমাণ করা। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে, ইংল্যান্ডে পরিবার নিয়ে বিশাল বিতর্ক চলছিল। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল এমন ধরনের বিষয়: সমাজ গঠনে পরিবারের ভূমিকা কি? পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কি বিশ্বব্যাপী? এই বিতর্কে প্রবল ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন মেইন। ইংরেজ এই আইনজ্ঞের পুরো নাম হেনরি জেমস সামনার মেইন (১৮২২-১৮৮৮)। তিনি এনশিয়েন্ট ল’ (১৮৬১) গ্রন্থের লেখক এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তাত্ত্বিক হিসেবে বিবেচিত। মেইনের বক্তব্য ছিল, আদিযুগে মানব সমাজ বলতে বোঝাত পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সকল সমাজে উপস্থিত।
বাকোফেন এবং মর্গান, মেইনের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। মেইনের মতন য়োহানেস য়াকব বাকোফেন (১৮১৫-১৮৫৭)-ও ছিলেন আইনজীবী। সুইটজারল্যান্ডের এই অধিবাসী প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সাহিত্যের পন্ডিত ছিলেন। তিনি মিথ, রিলিজিআন এ্যান্ড মাদার-রাইট (১৮৬১)-এর রচয়িতা। প্রাচীনকালের পুরাণে আগ্রহ থেকে তিনি জ্ঞাতি ব্যবস্থার বিবর্তনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁর মতে, আদি যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল বাছ-বিচারহীন যৌন সম্ভোগ। একে তিনি মাতৃতন্ত্র (matriarchy) অথবা মাতৃ- অধিকার (mother right) হিসেবে চিহ্নিত করেন। বাকোফেন বলেন, আদি যুগের এই ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। তার স্থলে গড়ে উঠে পিতৃসূত্রীয় (patrilineal) অথবা পিতৃ-অধিকার ব্যবস্থা। পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার উদ্ভব এবং পুরুষদের নিজ সন্তানের জন্য সম্পত্তি রেখে যাওয়ার প্রবণতা ।
এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে লুইস হেনরী মর্গান (১৮১৮-১৮৮১)-এর কাজে। তিনিও ছিলেন আইনজীবী। মর্গান বহু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক: লীগ অফ দ্য ইরোকওয়া (১৮৫১), সিষ্টেমস অফ কনস্যাঙ্গুইনিটি এ্যান্ড এফফিনিটি (১৮৭১) এবং এনশিয়েন্ট সোসাইটি (১৮৭৭) । মর্গান তার কাজে, মন্টেস্ক্যু’র উদ্ভাবিত যুগ-বিভাগের শ্রেণীকরণ ব্যবহার করেন: আদিম বা বন্য যুগ (শিকারী-সংগ্রহকারী), বর্বর যুগ (কৃষি-ভিত্তিক) এবং সভ্যতা (জটিল, বিশেষায়িত সমাজ) (Charles Louis de Secondat Montesquieu, L’espirit des Lois, 1748)। মন্টেস্ক্যুর প্রথম দুটি শ্রেণীকে মর্গান তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন – নিম্ন, মধ্য, উচ্চ।
বাকোফেনের মতনই, মর্গানও মনে করেন, মানব সভ্যতার আদিযুগে ছিল নির্বিচার যৌন সম্ভোগ। তারপর, ক্রমান্বয়ে এই আদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দেখা দেয়: একরক্ত সম্পর্কের পরিবার। এটি পরিবারের প্রথম স্তর। এ পর্যায়ে, বিবাহের দলগুলি বিভিন্ন প্রজন্মে বিভাজিত হয়ে পড়ে। পরিবারের গন্ডির মধ্যে সমস্ত দাদা-দাদীরা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী, তাদের সন্তানেরা (অর্থাৎ, বাবা-মা প্রজন্ম) পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। তাদের সন্তানেরা অর্থাৎ, ফুপাত, চাচাত, মামাত, খালাত ভাই- বোন এবং নিজ ভাই-বোনেরা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। পরিবারের এই স্তরে মাতা-পিতার সাথে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়ে উঠলেও ভাই-বোন সম্পর্কের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রচলিত ছিল। পলিনেশীয় এবং হাওয়াই- এর সমাজে এই রীতির প্রচলন ছিলো বলে মর্গান দাবি করেন।
দ্বিতীয় স্তরে, পুনালুয়া পরিবার গঠিত হয়। ভাই-বোনদের যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিয়ে হয় প্রথম, দ্বিতীয় বা তারও অধিক দূরত্বের কাজিন বোনদের সাথে এমন এক দল পুরুষের যারা একইভাবে রক্ত-সম্পর্কিত। পুনালুয়া শব্দটির অর্থ হল, “ঘনিষ্ট সাথী” এবং পুরুষেরা পরস্পর পরস্পরকে এই নামে সম্বোধন করেন। স্ত্রীরাও একে অপরের পুনালুয়া।
পুনালুয়া পরিবার থেকে গোত্র সংগঠনের উৎপত্তি হয়েছে বলে মর্গান ধারণা করেছিলেন। যদিও সমগ্র পরিবারের সমস্ত সন্তান সন্তুতিদের একজন নারী নিজ সন্তান বলে সম্ভাষণ করেন, এ সত্ত্বেও নিজের পেটের ছেলে-মেয়েদের তিনি আলাদা করতে পারেন। যেহেতু এ পর্যায়ে একমাত্র মায়ের দিক দিয়ে বংশপরম্পরা নিশ্চিতভাবে জানা যায় সেকারণেই মাতৃধারা স্বীকৃত হয়। আদি মাতার বংশজাত কন্যাসন্তান এবং তাদের সন্তানসন্ততি মিলে গঠিত হয় আদি গোত্র। যখন সমস্ত ভাই-বোনদের, এমনকি মায়ের দিক দিয়ে দূর সম্পর্কের সমান্তরাল ভাই-বোনদের মধ্যে পর্যন্ত যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয় তখনই উপরুক্ত গোষ্ঠী রূপান্তরিত হয় গোত্রে।
অর্থাৎ, মায়ের দিক দিয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যাদের মধ্যে বিয়ে অনুমোদিত নয়। পুনালুয়া পরিবার থেকেই গোত্রের উদ্ভব। মর্গানের মতে, ইউরোপ, এশিয়া এবং আমেরিকায় পুনালুয়া পরিবারের প্রচলন ছিলো সুদূর অতীতে; পলিনেশিয়ায় এর প্রচলন উনবিংশ শতক পর্যন্ত ছিল।
সমষ্টি-বিবাহের সময়কালে অথবা তারও পরে কমবেশি সময়ের জন্য জোড়বাঁধা পরিবার দেখা দেয়। এটি হচ্ছে তৃতীয় স্তর। বহু পত্নীর মধ্যেও একজন পুরুষের একজন প্রধান পত্নী থাকে। এই পুরুষটি আবার তার প্রধান পত্নীর বহু পতিদের মধ্যে প্রধান। দুই পক্ষের যে কোন পক্ষ সহজেই এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে।
বিয়ে ভেঙ্গে গেলে, সন্তান-সন্ততিরা আগের মত কেবল মায়ের অধিকারভুক্ত। বন্য অবস্থা ও বর্বরতার সীমারেখায় জোড়বাঁধা পরিবার দেখা দেয়। মর্গান দাবি করেন যে, যখন আমেরিকান আদিবাসীরা আবিষ্কৃত হয় তখন তাদের উত্তরণ ঘটে এবং তারা জোড়বাঁধা পরিবার গঠন শুরু করেন। বর্বরতার মধ্যবর্তী স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে উৎক্রমণ যুগে জোড়বাঁধা পরিবার থেকে চতুর্থ এবং বর্তমানে প্রচলিত একপতিপত্নী পরিবারের উৎপত্তি। ধরে নেয়া হয় এই পরিবার ব্যবস্থা সভ্যতার সূচনার অন্যতম লক্ষণ।
কি কি কারণে বিয়ে ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে? মর্গানের বক্তব্য ছিল, জীবন-ধারণের সামগ্রী লাভ করার যে কলাকৌশল, তাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আহার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনের ফলে, বিয়ে এবং পরিবার, ও রাজনৈতিক সংগঠনে অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে। এঙ্গেলস যে মর্গানের কাজে উদ্বুদ্ধ হন সেটা তাঁর লেখা পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) পড়লেই বোঝা যায়। মর্গানের তথ্যসম্ভার আর প্রধান বক্তব্য গ্রহণ করে এঙ্গেলস শ্রেণী এবং লিঙ্গীয় বৈষম্যের উৎপত্তির প্রসঙ্গটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
এঙ্গেলস বলেন, যাযাবর জীবন ছেড়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ী বসবাসের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় যখন উৎপাদনের শক্তি – প্রধানত যন্ত্রপাতি – আবিষ্কার হয়। তীর-ধনুক, কাঠের – পাত্র, বেতের ঝুড়ি, পাথরের যন্ত্রপাতি, বাড়িঘর তৈরী যাযাবর জীবনকে করে তোলে অনাবশ্যক। কুড়াল ও কোদালের মতন লৌহ যন্ত্রপাতি আবিষ্কার, বনজঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরী করে; পশু-পালন এবং চাষ-বাসের উদ্ভব ঘটে। অরণ্যে বসবাস থামিয়ে মানুষ সমতল ভুমিতে বসবাস আরম্ভ করে।
উৎপাদনের বিকাশের এই পর্যায়ে, এঙ্গেলস বলেন, “মাতৃ-অধিকার” প্রচলিত ছিল। সন্তান কোন বংশের তা নির্ধারিত হত তার মায়ের মাধ্যমে। একত্রে বসবাসের রীতি ছিলো মাতৃস্থানিক, পিতৃস্থানিক নয়। শ্রম বিকাশের এই পর্যায়ে গৃহস্থালীর সকল নারী ছিলেন একই গোত্রের, আর পুরুষেরা ছিলেন ভিন্ন-ভিন্ন গোত্রের।
উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মাতৃ-অধিকার ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটে। পশু- পালন, লৌহকর্ম, কাপড় বোনা, এবং কৃষিকাজ সম্ভব করে তোলে এমন সম্পদের সৃষ্টি যা অব্যবহৃত থেকে যায়। উদ্বৃত্ত পুরুষের কর্ম পরিসরে তৈরি হওয়াতে, এর মালিকানা হয়ে ওঠে পুরুষের। বিকশিত উৎপাদনের শক্তি এবং মাতৃ-অধিকার ভিত্তিক পারিবারিক ব্যবস্থা – এ দুয়ের মধ্যে বৈপরীত্য তৈরি হয়। – মাতৃ-অধিকার ভিত্তিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটে, এর স্থলে গড়ে উঠে পিতৃ-অধিকার ব্যবস্থা। এই নতুন ব্যবস্থায় সম্পদ প্রবাহিত হয় পিতার মাধ্যমে, মাতার মাধ্যমে নয়। এই পরিবর্তন, এঙ্গেলসের মতে, নারী অধস্তনতার সূত্রপাত ঘটায়। নারী হয়ে উঠে সন্তান উৎপাদনের একটি উপায় মাত্র।
পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্বের ভূমিকা:
আজকের আলোচনার বিষয় পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্বের ভূমিকা – যা পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত এই পাঠে আমরা একটি কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গের মুখোমুখি হব । কেন্দ্রীয় এই প্রসঙ্গটিকে ছোট-ছোট একাধিক প্রশ্নের মাধ্যমে উত্থাপন করা যায়। যেমন: পরিবার কি অপরিবর্তনীয় কিছু, নাকি রূপান্তরশীল? অর্থাৎ পরিবারের কি ইতিহাস আছে? যদি পরিবার রূপান্তরশীল হয়ে থাকে, তাহলে এই রূপান্তর -প্রক্রিয়া আমরা কিভাবে বুঝব? কোন্ তত্ত্বের সাহায্যে?
ঊনবিংশ শতকের চিন্তাবিদরা এ ধরনের প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই শতক ছিল বিবর্তনবাদী তত্ত্বের স্বর্ণযুগ। আরো ছিল, স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের গড়ে ওঠার সময়কাল। পরিবার, বিয়ে – এসব – বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন এবং তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন এমন সব লেখক ও তাত্ত্বিক যাঁরা কিনা নৃবিজ্ঞানী ছিলেন না। ধরুন মর্গান, কিংবা মেইন।
দুজনই ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু, তা সত্ত্বেও নৃবিজ্ঞানীদের জন্য তাঁদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার কারণ, এই সময়কালে জ্ঞাতিত্ব নৃবিজ্ঞানীদের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরবর্তী প্রজন্মের পেশাজীবী নৃবিজ্ঞানীরা, অর্থাৎ, ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিংশ শতকের শুরুর দশকের নৃবিজ্ঞানীরা, নিজেদের চিন্তাভাবনা ও তত্ত্ব দাঁড় করান এই বিবর্তনবাদীদের কাজের প্রেক্ষিতে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা বিবর্তনবাদী চিন্তার বিরোধিতা করেন। আবার, কিছু নৃবিজ্ঞানী বিবর্তনবাদী ধারায় কাজ অব্যাহত রাখেন। বিংশ শতকের প্রবল ধারার নৃবিজ্ঞান অনেকের মতে ছিল, বিবর্তনবাদ-বিরোধী।
এই পাঠে প্রথমে বিবর্তনবাদ কি, তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখব কিভাবে জৈবিক বিবর্তনের ধারা সামাজিক বিজ্ঞানে আমদানি করা হয়, ব্যবহার করা হয়। যে দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে যে সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির (যেমন পরিবার, বিবাহ) পরিবর্তন বিবর্তনের ধারণার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব, সেটিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন বলা হয়। দ্বিতীয়ত, পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ-সম্পর্কিত তাত্ত্বিকদের কাজের সাথে আপনার পরিচয় ঘটানো হবে: বাকোফেন, মেইন, ম্যাকলেনান, মর্গান এবং এঙ্গেলস। তৃতীয়ত, বিবর্তনবাদের সমালোচনা এবং নারীবাদীদের কাছে এঙ্গেলসের গুরুত্ব আলোচিত হবে।
পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত -তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ – যা পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ তত্ত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদী চিন্তা অনুসারে সমাজের গঠন হচ্ছে প্রাণীর মতন: এর আছে অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ।
বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরল আকৃতির সমাজ হয়ে ওঠে জটিল এবং পৃথকীকৃত। বিবর্তনবাদী ভাবনাচিন্তা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভব খোঁজার প্রেরণা যোগায় কয়েক প্রজন্মের নৃবিজ্ঞানীদের। ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে পরিবারের আদি ধরন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বর্তমানে যারা স্বীকৃত (যেমন আইনজীবী বাকোফেন, মর্গান প্রমুখ) তাঁরা এতে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা পরিবারের উদ্ভবের অনুসন্ধান চালান।
এদের মধ্যে মর্গানের তত্ত্ব বহুল পরিচিত। পরবর্তী পর্যায়ে, এঙ্গেলস মর্গানের তত্ত্বের লুক্কায়িত বিষয়গুলোকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রম- বিভাজন এবং লিঙ্গীয় বৈষম্য ঐতিহাসিক ভাবে আন্তঃসম্পর্কিত – এই বক্তব্য স্পষ্ট করে তোলেন। গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা সত্ত্বেও নারীবাদীরা এঙ্গেলসের কাছে ঋণী কারণ তিনি নারী অধস্ততার সামাজিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালান ।
পরিবার ও গৃহস্থালী
আজকে আমরা আলোচনা করবো পরিবার ও গৃহস্থালী নিয়ে । ঊনবিংশ শতকের বিবর্তনবাদীদের পরিবারের উৎস খোঁজার প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। বিংশ শতকের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত একরৈখিক বংশীয় দল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বৃটিশ নৃবিজ্ঞানীগণ।
এই সময়ে নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রধান বিতর্ক ছিল বংশীয় দলের রাজনৈতিক-আইনী বা বিচারশাস্ত্রীয় দিকগুলো নিয়ে। এ কারণে পরিবার বা গৃহস্থালী নৃবিজ্ঞানীদের কাজে, তাঁদের চিন্তা-ভাবনায় তেমন গুরুত্ব পায়নি। এসব বিষয়ের প্রতি নৃবিজ্ঞানীরা মনোযোগী হয়ে ওঠেন ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে। “পরিবার” এবং “গৃহস্থালী” এ দুটো এক নয়, এটাই ছিল প্রথম ভাবনার জায়গা।
পরিবার সংজ্ঞায়নে নৃবিজ্ঞানীরা জোর দেন বিয়ে, স্বামী-স্ত্রীর একত্রে বসবাস, এবং সন্তান লালন-পালনের উপর । গৃহস্থালী সংজ্ঞায়িত হয় “আবাসস্থলের একক” হিসেবে। আপনি পূর্বেই জেনেছেন শুরু থেকে নৃবিজ্ঞান ছিল পাশ্চাত্য সমাজের একটি জ্ঞানকান্ড, যেই জ্ঞানকান্ডের বিষয়বস্তু ছিল অপাশ্চাত্যের মানুষজন: তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তাদের আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস। আপনারা এও জেনেছেন: পাশ্চাত্য সমাজের মানুষজন যখন ভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির মানুষজনের মুখোমুখি হন, তারা বহুলাংশেই সেই সমাজগুলোকে তাঁদের নিজেদের সমাজের মাপকাঠি অনুসারে বিচার-বিশ্লেষণ করেন।
বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে নানান ধরনের ধারণাগত বিভ্রান্তি তৈরী হয়। পরিবার এবং গৃহস্থালী সংজ্ঞায়নে কি ধরনের তাত্ত্বিক সমস্যা সৃষ্ট হয় সেটা এই পাঠের প্রথম অংশে আলোচিত হবে। বর্তমান সময়ে নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ড এসব বিষয়ের মুখোমুখি হওয়া জরুরী মনে করছে।
পরিবার ও গৃহস্থালী অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় পরিবার ও গৃহস্থালী অধ্যায়ের সারাংশ -তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ – যা পরিবার ও গৃহস্থালী এর অর্ন্তভুক্ত, পরিবার এবং গৃহস্থালী নৃবিজ্ঞানীদের মনোযোগ পেয়েছে বহু পরে, বিংশ শতকের শেষ অর্ধে। পরিবার এবং গৃহস্থালী নিয়ে যেসব তত্ত্ব তৈরির কাজ, এবং মাঠগবেষণা ভিত্তিক কাজ শুরু হয় তা পরবর্তী কালে জাত্যাভিমানাত্মক হওয়ার কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন পরিবারের কিছু আকর বৈশিষ্ট্য আছে, পরিবার কিছু আকর ভূমিকা পালন করে, যা বিশ্বের যাবতীয় ভিন্নতাকে (বিশ্বের এক অঞ্চল হতে আরেক অঞ্চলের সামাজিক এবং কৃষ্টিগত ভিন্নতা) ছাপিয়ে যায়। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, যে বিশ্বজনীন সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়েছিল সেগুলো ছিল পার্শ্বিক; এই সংজ্ঞাগুলোর ভিত্তি ছিল পাশ্চাত্য সমাজের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, সেখানকার ঘটনা।
পাশ্চাত্য সমাজে যা স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তার ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা তৈরী করেন পরিবার এবং গৃহস্থালীর বিশ্বজনীন সংজ্ঞা। হাল আমলের কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন যে, এ ধরনের নৃবৈজ্ঞানিক কাজ পাশ্চাত্য সমাজকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক মানদন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।
কেস স্টাডি : পরিবার ও গৃহস্থালী সংক্রান্ত জাপানী সাংস্কৃতিক প্রত্যয়:
আজকের আলোচনার বিষয় কেস স্টাডি : পরিবার ও গৃহস্থালী সংক্রান্ত জাপানী সাংস্কৃতিক প্রত্যয় – তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ – যা পরিবার ও গৃহস্থালী এর অর্ন্তভুক্ত, মজার ব্যাপার হল, জাপানে পরিবার এবং গৃহস্থালী একেবারে ভিন্ন। শুধু তাই নয়, জাপানে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রত্যয় আছে যা কিনা মানুষজনকে নানান দলে অন্তর্ভুক্ত করে।
জাপানি জ্ঞাতি দল, বা বসবাসকারী এককের ধারণা পাশ্চাত্য সমাজের পরিবার এবং গৃহস্থালীর ধারণা বা অনুশীলন হতে একেবারে ভিন্ন। “শতাই” (shotai) হচ্ছে তারা যারা একসাথে জীবনযাপনের খরচপাতি করে থাকে। এমনও হতে পারে, তাদের মধ্যে কোন জ্ঞাতি সম্পর্ক নেই। “কাজোকু” (kazoku) হচ্ছে এমন একটি দল যাদের মধ্যে ঐক্য আছে।
তারা একত্রে বসবাস নাও করতে পারে। যেমন ধরুন প্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র যে বাবা-মা’র সাথে থাকে না কিন্তু সে কাজোকুর অন্তর্ভুক্ত। “ইয়ে” (ie) বলতে বোঝায় বাড়ি (দালান-কোঠা অর্থে) এবং এর একাধিক মৃত, এবং বর্তমান, প্রজন্ম। প্রতি প্রজন্মে থাকবে শুধুমাত্র একটি বিবাহিত দম্পতি। “দোজকু” (dozoku) হচ্ছে আরো বড়সড় জ্ঞাতি দল। এর অন্তর্ভূক্ত ইয়ে এবং ইয়ে’র দুই একটি শাখা (ধরুন আরেকজন পুত্র ও তার পরিবার) কিন্তু সকল শাখা-প্রশাখা না। “শিন্সকেই” (shinskei) তে অন্তর্ভূক্ত ইয়ে এবং বিবাহিত কন্যাসকল।
এখন প্রশ্ন হল: জাপানি জ্ঞাতি ব্যবস্থায় কোনটাই বা “পরিবার” আর কোনটাই বা “গৃহস্থালী”? পরিবার এবং গৃহস্থালী থাকতে বাধ্য, সকল সমাজে এগুলো আছে, এভাবে না এগিয়ে হাল আমলের কিছু নৃবিজ্ঞানীর মনে হবে, জাপানি সাংস্কৃতিক প্রত্যয়ের সাহায্যে জাপানি সামাজিক সংগঠন বুঝতে চেষ্টা করাটা আরো অর্থবহ। বিষয়টি নিয়ে আপনাকে ভাবতে অনুরোধ করছি।
পরিবারের ধরন
আজকে আমরা আলোচনা করবো পরিবারের ধরন নিয়ে । “পরিবারের ধরন” – পাঠের বিষয় হিসেবে এটিকে খুব স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। তার কারণ, আমরা ছোটবেলা থেকে পাঠ্য পুস্তকে প্রায় যে কোন জিনিসের বিভিন্ন “ধরন” কি তাই শিখে থাকি: প্রাণীর ধরন, সরকার ব্যবস্থার ধরন, অর্থনীতির ধরন ইত্যাদি।
যে কোন কিছুকে – তা হোক – প্রাণী কিংবা বস্তু মূলনীতির ভিত্তিতে শ্রেণীকরণ করা হচ্ছে জ্ঞান আহরণের একটি বিশেষ পদ্ধতি। – সাম্প্রতিককালের সমালোচকদের অভিমত হলো, এটি পাশ্চাত্যীয় জ্ঞান তত্ত্বের মূলনীতি। সে প্রসঙ্গ থাক। এই ধারা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে প্রভাবশালী ছিল, প্রায় একশ বছর। এই ধারায় পরিবারকে কিভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে তার সাথে আপনার পরিচয় ঘটানো হবে এই পাঠে।
পরিবারকে শ্রেণীকরণের মূলনীতি একটি ছিল না। কোন্ কোন্ জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিবার গঠিত এই মূলনীতি এক ধরনের শ্রেণীকরণের জন্ম দিয়েছে: বর্ধিত, একক, যুক্ত। আবাসস্থান এবং বংশসূত্রিতা, এবং এর নানান ধরনের বিন্যাস বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীকরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। আবাসস্থান এবং বংশসূত্রিতার ভিত্তিতে সৃষ্ট শ্রেণীকরণ এই পাঠে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হবে না।
কেবলমাত্র বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানীর তৈরি করা সংজ্ঞাগুলো তুলে ধরা হবে। এই ধারার কাজের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে এটি অনৈতিহাসিক। এই ধারার কাজ কেবলমাত্র কিছু বর্গ তৈরি করে যা থেকে মনে হয় পৃথিবীতে বিশেষ ধরনের পরিবার রয়েছে এবং এগুলি চিরন্তন।
বর্গের ভিত্তিতে তৈরি করা শ্রেণীকরণ পরিবর্তনকে এবং বিবিধতাকে বুঝতে সাহায্য করে না। সমালোচকদের মতে, এ ধারার নৃবিজ্ঞানীরা বিবিধতার সম্মুখীন হয়ে আরেকটি শ্রেণীকরণের জন্ম দিয়েছেন মাত্র; প্রধান সমস্যা, যথা – বর্গ, সামাজিক জীবন এবং বিবিধতা কিংবা কি প্রক্রিয়ায় এর পরিবর্তন ঘটে, এ প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে গেছেন। এই পাঠের দ্বিতীয় অংশে ভিন্ন ধারার কাজ উপস্থাপিত হবে। একটি কেস স্টাডি রয়েছে, যেখানে, আলোকপাত করা হবে কিভাবে মজুরি-নির্ভরতা উপনিবেশকালীন বাংলায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পৃথকীকরণের সূত্রপাত ঘটায়।
পরিবারের ধরন অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় পরিবারের ধরন অধ্যায়ের সারাংশ – যা পরিবারের ধরন এর অর্ন্তভুক্ত, প্রায় একশত বছর ধরে, জ্ঞানগত কাজ হিসেবে নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে পরিবারের শ্রেণীকরণ খুবই জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন মূলনীতির ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা নানান ধরনের শ্রেণী এবং বর্গ তৈরী করেছিলেন। নতুন নতুন মাঠ গবেষণা নতুন নতুন শ্রেণীকরণের জন্ম দিয়েছিল।
১৯৫০-১৯৬০এর দশকে পরিবার বিশ্লেষণের প্রত্যয় এবং তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনায় মৌলিক বদল ঘটে। শ্রেণীকরণের ধারা তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, বর্গকরণ সামাজিক জীবনের বিবিধতাকে বুঝতে সাহায্য করে না। এ ধরনের জ্ঞানচর্চা পারিবারিক সম্পর্কের বদলকেও বুঝতে সাহায্য করে না।
এই সমালোচনার প্রেক্ষিতে নতুন কিছু তাত্ত্বিক ধারা তৈরী হয়। এগুলির মধ্যে ভিন্নতা সত্ত্বেও, সমিলের দুটি বড় জায়গা ছিল। নতুন তাত্ত্বিকদের বক্তব্য হচ্ছে: প্রথমত, বিভিন্ন সামাজিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক প্রক্রিয়া পরিবারকে গঠন করে। এগুলি স্থান-কাল নির্দিষ্ট। দ্বিতীয়ত, পরিবার সমাজের অপরাপর সামাজিক, ঐতিহাসিক সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্ন নয়।
কিছু নৃবিজ্ঞানী এটিকে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার উপর গুরুত্ব দেন। তারা বলেন, পরিবারকে একটি স্বতন্ত্র পরিসর হিসেবে বিবেচনা না করে, আমাদের দেখা উচিত পরিবার কিভাবে অপরাপর সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে, আবার কিভাবে এটি অপরাপর প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়। নৃবিজ্ঞানী হিলারী স্ট্যান্ডিংয়ের কাজ ইতিহাস- নির্দিষ্ট নৃবিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে।
লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক
আজকে আমারা আলোচনা করবো লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক নিয়ে । নৃবিজ্ঞানের ধ্রুপদী বিবর্তনবাদী যুগে, বিশেষ করে মর্গান এবং এঙ্গেলসের কাজে, শ্রেণী এবং লিঙ্গ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। এ দুয়ের মধ্যকার সম্পর্ক গুরুত্ব পেয়েছিল। এঙ্গেলস যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন যে, শ্রেণী বিভাজিত সমাজের উদ্ভবের সাথে পরিবার এবং বিয়ে ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়।
ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবস্থায় পুরুষ হয়ে উঠে ক্ষমতাশালী এবং নারী হয়ে উঠে অধস্তন। এই ইউনিটের এক নম্বর পাঠে এসব আপনারা জেনেছেন। পরবর্তী সময়ে, নৃবিজ্ঞান যখন একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং বেড়ে উঠে, শ্রেণীর প্রসঙ্গটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এ সময়ে পরিবারের প্রসঙ্গটি বিভিন্ন ভাবে উত্থাপিত হয়।
এই পাঠের প্রথম অংশে আলোচিত হবে, বিংশ শতকের প্রথমার্ধে নৃবিজ্ঞানীরা কিভাবে পরিবারের নির্যাস বা মৌলিকত্ব অনুসন্ধানের চেষ্টা চালান। নৃবিজ্ঞানের এই অনুসন্ধানে, নারী-পুরুষ সম্পর্ক উদ্ঘাটনে, প্রাধান্য পেয়েছিল “পিতৃত্ব” এবং “মাতৃত্ব”-এর ধারণা। ব্রনিসলো ম্যালিনোস্কি এবং মেয়ার ফোর্টসের মতন নৃবিজ্ঞানী এ ধরনের জিজ্ঞাসা দাঁড় করান: পিতা বা মাতা হওয়ার মৌলিক অর্থ কি? অর্থাৎ, তাঁদের জিজ্ঞাসা ছিল পিতা বা মাতা হওয়ার এমন কোন নিগূঢ় অর্থ আছে কিনা যা স্থান-কালের নির্দিষ্টতা মানে না, এক সংস্কৃতি হতে আরেক সংস্কৃতিতে, বা এক সময়কাল হতে আরেক সময়কালে ভিন্ন হয় না।
স্থান-কাল বিহীন আলোচনা করার প্রবণতাকে বলা হয় নির্যাসকরণ (essentializing)। এই প্রবণতা সর্বজনীন তত্ত্ব দাঁড় করানোর সাথে যুক্ত। সহজ ভাষায় বললে, সর্বজনীন তত্ত্বের মানে হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব যা কিনা “অল-সাইজ” জামার মতন। এমন একটি জামা যা সকল সাইজের মানুষের গায়ে লাগে। এই প্রবণতা শুধু মাত্র ম্যালিনোস্কি বা মেয়ার ফোর্টস না, বহু নৃবিজ্ঞানী, সামাজিক বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদের কাজে লক্ষণীয়।
মার্কিনী সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স এর পরিবার সম্পর্কিত তত্ত্ব ধ্রুপদী আধুনিকায়ন পজিশনকে ব্যক্ত করে। তাঁর মতে, শিল্পভিত্তিক সমাজে জ্ঞাতিত্ব হয়ে উঠে সীমিত, সংকীর্ণ। এই তত্ত্ব বিংশ শতকের মাঝামাঝি খুব প্রভাবশালী ছিল। এই তত্ত্ব কেবলমাত্র সমাজবিজ্ঞানীদের নয়, নৃবিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে। তাঁর প্রধান বক্তব্যের নতুন নতুন সংস্করণ তাঁর মৃত্যুর পরে, এমন কি আজ অব্দি, সময়ে সময়ে পয়দা হতে থাকে।
এই পাঠের দ্বিতীয় অংশে পারসন্সের পরিবার সম্পর্কিত ভাবনা চিন্তা তুলে ধরা হবে। তৃতীয় অংশে আলোচনা করা হবে মার্কিনী নৃবিজ্ঞানী রায়না র্যাপের পরিবার সম্পর্কিত তাত্ত্বিক উপলব্ধি। র্যাপ বলেছেন শ্রেণী ও লিঙ্গীয় সম্পর্কের আন্তঃপ্রবিষ্টতার কথা। এই আন্তঃপ্রবিষ্টতা গঠন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবার এবং পারিবারিক সম্পর্ক। মার্কিন সমাজে পারিবারিক সম্পর্কের একটি কেস স্টাডি রয়েছে এই পাঠের শেষে ।
লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক অধ্যায়ের সারাংশ :
আজকের আলোচনার বিষয় লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক অধ্যায়ের সারাংশ – যা লিঙ্গীয় ও শ্ৰেণী সম্পৰ্ক এর অর্ন্তভুক্ত, নৃবিজ্ঞানে, পরিবার প্রসঙ্গটি প্রধানত দুইভাবে দেখা হয়েছে। ব্রনিসলো ম্যালিনোস্কির মতন নৃবিজ্ঞানী পরিবারের আকর বৈশিষ্ট্যকে খুঁজেছেন যাতে প্রমাণ করা যায় যে পরিবার হচ্ছে বিশ্বজনীন।
এই দৃষ্টিকে বলা যায় নির্যাসকারী, যেহেতু এটি পরিবারের নির্যাস খোঁজে, যে নির্যাস পরিবারকে দান করবে সর্বজনীনতা। সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স পরিবারকে বিচার করেছেন আধুনিকতাবাদী দৃষ্টি থেকে। আধুনিক, শিল্পোন্নত সমাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান-নির্ভর; অনুন্নত, পিছিয়ে-পড়া সমাজ হচ্ছে জ্ঞাতি-নির্ভর।
জ্ঞাতি ভিত্তিক সংগঠন দ্বারা সম্পাদিত কার্যাবলী, সমাজের উন্নতির সাথে সাথে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। আধুনিক সমাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী দপ্তর, সামরিক বাহিনীর মত প্রতিষ্ঠান জ্ঞাতিকুলের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে। শ্রেণীর প্রসঙ্গটি নৃবিজ্ঞানে উপেক্ষিত হয়েছে বহু বছর ধরে। বর্তমানে এটি, পুঁজিবাদের বিস্তারের কারণে, এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের ভাঙ্গনের কারণে, নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন ।
বর্ণবাদের সম্পর্ক
আজকে আমরা আলোচনা করবো বর্ণবাদের সম্পর্ক নিয়ে । নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে এটিও একটি: নৃবিজ্ঞান হচ্ছে “নরবর্ণ এবং সংস্কৃতির বিজ্ঞান” ( anthropology is the science of race and culture)। ইদানিং কালে অবশ্য এই সংজ্ঞা খুব একটা দেখা যায় না।
নরবর্ণের (race) ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষজনের বর্গীকরণ আরম্ভ করেন ইউরোপীয়রা। এর সূত্রপাত ঘটে চৌদ্দ শতকে, যখন থেকে ইউরোপীয় শক্তির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ শুরু। এই পাঠের প্রথম অংশে রয়েছে এর আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে, বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ কি, এবং নৃবিজ্ঞানী বোয়াস কি যুক্তিতে এর বিরোধিতা করেন, তা আলোচিত হবে।
ড্যানিয়েল ময়নিহান-এর কাজ হচ্ছে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে পরিবার নিয়ে লেখালেখির একটি নমুনা। এটির আলোচনা আছে এই পাঠের তৃতীয় অংশে, এবং এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা কেন গরিব, এ বিষয়ে ময়নিহানের বর্ণবাদী যুক্তি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এই অংশে আরো রয়েছে ক্যারল স্ট্যাক-এর কাজ হতে মার্কিনী কৃষ্ণাঙ্গদের পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে কেস স্টাডি। স্ট্যাকের কাজ ময়নিহানের যুক্তি খণ্ডনের একটি শক্তিশালী, বাস্তবসম্মত উত্তর হিসেবে বিবেচিত।
বর্ণবাদের সম্পর্ক অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় বর্ণবাদের সম্পর্ক অধ্যায়ের সারাংশ – যা বর্ণবাদের সম্পর্ক এর অর্ন্তভুক্ত, নরবর্ণের ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষজনের বর্গীকরণ ইউরোপীয়রা আরম্ভ করেন। বর্গীকরণের সূত্রপাত এবং ইউরোপীয় শক্তির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের সূত্রপাত একই সময়ে ঘটে।
এই কারণে, নরবণীয় বর্গীকরণকে বৈজ্ঞানিক করে তোলার সকল প্রচেষ্টা (যেমন ধরুন আই কিউ পরীক্ষা), এবং সমাজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সকল প্রচেষ্টা, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্যাচারিতকে দোষারোপ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক বিজ্ঞান চর্চায়, বিশেষ করে ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকগুলোতে, যখন বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী হয়, তখন একাধিক বিদ্যাজাগতিক কাজে কৃষ্ণাঙ্গদের দোষারোপ করা হয়।
বলা হয়, তারা নিজেরাই তাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী । বর্তমানের নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায়, নতুন নতুন ধরনের স্তরায়িত বর্গীকরণ করা হচ্ছে: যেমন “জঙ্গী আরব” বনাম “সভ্য শেতাঙ্গ”। নৃবিজ্ঞানের একটি ধারার বিবেচনায় এটা নরবর্ণ-ভিত্তিক বর্গীকরণের সাম্প্রতিকতম রূপ ।