“সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব” পাঠটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ/বিএসএস শ্রেণীর “সমাজতত্ত্ব – ২ (সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান পরিচিতি)” এর একটি পাঠ। এখানে মানব সমাজে আত্মীয়তা, পরিবার, বংশ ও সামাজিক সংগঠনের ধরণ নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে কীভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে এবং সমাজের নিয়ম, দায়িত্ব ও ভূমিকা নির্ধারণে সহায়ক হয়।
সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন ও তার পাঠ পদ্ধতি
আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন ও তার পাঠ পদ্ধতি – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত। জ্ঞাতিত্ব সাংস্কৃতিক/সামাজিক নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে বহু ইউরোপীয় দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে নৃবিজ্ঞান এথনোলজি (জাতিতত্ত্ব) হিসেবে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ, ধরে নেয়া হয়েছিল নৃবিজ্ঞানীদের কাজ বা লক্ষ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর এথনোগ্রাফি রচনা।
এখনো কিছু ইউরোপীয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ এথনোলজি নামে পরিচিত। প্রথম এথনোগ্রাফি রচয়িতা বহিসেবে যিনি স্বীকৃত তিনি লুইস হেনরি মর্গান (১৮১৮-১৮৮১)। মর্গান তাঁর রচিত লীগ অফ দ্য ইরোক ওয়া (১৮৫১) গ্রন্থে আমেরিকার আদিবাসী ইরোকওয়া’দের ধর্ম, রাজনীতি ও অনুষ্ঠান পালন এসব বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে জ্ঞাতিত্ব ও বিয়ের উপর আলোকপাত করেন। – জ্ঞাতিত্ব ও বিয়ে নিয়ে তাঁর আগ্রহ পরবর্তী পর্যায়ে আরো ধারাবাহিক হয়ে ওঠে এবং বিশ বছর পর তার সিস্টেমস অফ কনস্যাঙ্গুইনিটি এ্যান্ড এফফিনিটি (১৮৭১) বইটি প্রকাশিত হয়।
স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা লাভে এই বইটি একটি মাইলফলক। উপরন্তু, নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জ্ঞাতিত্ব এবং বিবাহ হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিষয় – এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন-এর ইতিহাস আর নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস – দুটোই প্রায় দেড়শত বছর পুরোনো। সেটা নিশ্চয়ই আপনারা উপরের অনুচ্ছেদ পড়ে বুঝতে পেরেছেন। তবে, জ্ঞাতিত্ব বলতে কি বোঝায়, অর্থাৎ কি এর সংজ্ঞা, কি এর গুরুত্ব, কি এর পরিধি – এগুলো অনড়, অটল অথবা অপরিবর্তনীয় কিছু নয়।
গত দেড়শ বছর এগুলোর ক্ষেত্রে বদল ঘটেছে, এবং এই বদল চলমান। যেমন ধরুন: মর্গানের সময়কাল। তখন বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সকল বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক একইভাবে পরিবার, বিয়ে, অথবা গোত্র-ব্যবস্থার উৎপত্তি ও বিকাশকে দেখেছেন। অন্যভাবে বললে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, গবেষকদের মাঝে তর্ক-বির্তক চলতে থাকে। ভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হলে তো অবশ্যই, আবার একই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হলেও আমাদের ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে সকলে, সব বিষয়ে, সব সময়ে একমত।
এক্ষেত্রে লক্ষ্য করবেন, একই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে কিছু পূর্বানুমান (assumptions ) এবং কিছু প্রত্যয়ে (concepts) অংশীদারিত্ব। এ কারণে যেমন স্ব মিলের জায়গা তৈরী হয়, আবার কিছু বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সম্ভাবনাও থাকে । জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের এই দেড়শত বছরের যাত্রা শুরুর লগ্নের ভাবনাচিন্তা, তাত্ত্বিক তর্ক-বিতর্ক এবং হাল – আমলের মনোযোগের জায়গার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক অতি সংক্ষেপে জ্ঞাতিত্ব বিষয়ক তিনটি ইউনিটে (মোট ১৪টি পাঠ-এ) তুলে ধরা হবে।
জ্ঞাতিত্ব : জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত। “সমাজ” এবং “জ্ঞাতিত্ব” – এই দুই প্রত্যয়ের অর্থ কি, এ দুয়ের আন্তঃসম্পর্ক কি – এসব হচ্ছে এই পাঠের বিষয়। সর্বপ্রথমে, কয়েকটি বিষয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এক সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব, এগুলো হচ্ছে প্রত্যয়। অর্থাৎ, এমন ধারণা যা শুধুমাত্র বর্ণনামূলক নয়, বরং ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। উদাহরণ স্বরূপ: “পরিবার হচ্ছে একটি সামাজিক গোষ্ঠী যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের একত্রে বসবাস”। এধরনের বাক্য বর্ণনামূলক বিবরণের অংশ।
পক্ষান্তরে, “ইংল্যান্ডের শিল্পপতি শ্রেণীর গঠনকালে, বিয়ে এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক পাটাতন হয়ে ওঠে” – এই বাক্যটি বিশ্লেষণমূলক হিসেবে বিবেচিত হবে। কেন? লক্ষ্য করুন প্রথম বাক্যে কোন নির্দিষ্টতা নেই। কোন্ সমাজের কথা বলা হচ্ছে, কোন সময়কালের কথা বলা হচ্ছে, কোন্ শ্রেণী কিংবা কোন্ জাতিসত্তা, অথবা কোন্ ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, কিছুই স্পষ্ট না। অনেকে একমত হবেন যে, এটি একটি কালোত্তীর্ণ স্বর, এবং এটি (লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং ঔচিত্যবোধ ছাড়া) কিছু বুঝতে সাহায্য করে না।
দ্বিতীয় যে বাক্যটি আপনি পড়লেন, সেখানে আপনি লক্ষ্য করুন, একটি প্রধান বক্তব্য হাজির করা হচ্ছে: বিয়ে এবং শ্রেণী গঠন আন্তঃসম্পর্কিত। অর্থাৎ বিয়ে শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়, বিয়ে আকাশ থেকে পড়ে না। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিয়ের বিশেষ অর্থ দাঁড়ায়। বিয়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার শর্তসাপেক্ষ। যে শ্রেণীর (ইংরেজ শিল্পপতি শ্রেণী) কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল ক্ষমতাশালী শ্রেণী। কেবলমাত্র ইংল্যান্ডের পরিসরে নয়, সমগ্র বিশ্বে এই শ্রেণীর ক্ষমতা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়। তার মানে কি এই যে, বর্ণনা কাজের কিছু না? তা নয় মোটেই। বর্ণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বর্ণনার খাতিরে করা বর্ণনা নয়। দ্বিতীয় বাক্যের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে লিওনর ডেভিডফ এবং ক্যাথরিন হল বর্ণনার সাহায্য নিয়েছেন। মোট কথা, বর্ণনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকা জরুরী।
কথা হচ্ছিল, সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব যে প্রত্যয়, তা নিয়ে। সামাজিক বিজ্ঞানে এমন শব্দ রয়েছে যা মানুষজন প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে, যেমন: ইতিহাস, শ্রেণী, জাতীয়তাবাদ, পরিবার ইত্যাদি। এই একই শব্দগুচ্ছ আবার সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য বিশেষ অর্থ বহন করে। এগুলো সাধারণ শব্দ হিসেবে না, বরং প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সচরাচর এমনটি ঘটে না। ইলেকট্রন, প্রোটন, এটম এগুলো সাধারণত বৈজ্ঞানিক আলাপচারিতার বাইরে ব্যবহৃত হয় না (১ নং পাঠে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে)। নৃবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে, এই সাধারণভাবে ব্যবহৃত শব্দের যে বিশেষ প্রত্যয়গত ওজন আছে, সে ব্যাপারে সতর্ক হতে শেখা জরুরী।
দুই, সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব – নৃবিজ্ঞানীরা এ দুই প্রত্যয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এ দুটি প্রত্যয়ের অর্থ সকল নৃবিজ্ঞানীর কাছে এক রকম নয়। নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখেছে বিষয়গুলোকে। হয়তো বা এমনটা ঘটেছে যে, কোন একটি তাত্ত্বিক ধারা যেই বিশেষ ভাবে একটি প্রত্যয়ের অর্থ দাঁড় করিয়েছে, অন্য তাত্ত্বিক ধারা আবার সেই অর্থকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তিন, মনে রাখবেন, নৃবিজ্ঞান কোন অখন্ড জ্ঞানকান্ড নয়। অপরাপর জ্ঞানকান্ডের মতন নৃবিজ্ঞানও বেড়ে উঠেছে, শক্তিশালী হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাসূত্রে, এবং নানান ধরনের তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে।
এই পাঠের প্রথম অংশে, অতি সংক্ষেপে নৃবিজ্ঞানের (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) কিছু কেন্দ্রীয় তাত্ত্বিক ধারার সাথে আপনার পরিচয় ঘটানো হবে। ধারাগুলো হলো: ১. বিবর্তনবাদ ২. মার্ক্সবাদ ৩. ক্রিয়াবাদ ৪. কাঠামোবাদ ৫. প্রতীকবাদ এবং ৬. নারীবাদ। নৃবিজ্ঞান (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) বোঝার জন্য, ব্যবহার করার জন্য তত্ত্ব এবং প্রত্যয়ের সাথে একটি নূন্যতম পরিচয় প্রয়োজন। নিচের এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এই পাঠের দ্বিতীয় অংশে জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং জ্ঞাতিত্ব নৃবিজ্ঞানে কি গুরুত্ব বহন করে তা আলোচিত হয়েছে।
১. বিবর্তনবাদ (Evolutionism):
বিবর্তনবাদী তত্ত্ব মতে, একটি প্রজাতি অথবা একটি বিশিষ্ট জীবের জনসমষ্টি কাঠামোগতভাবে ক্রম পরিবর্তিত হয়। প্রতিবেশের সাথে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। বংশ ( heredity) এবং প্রতিবেশ (coology), কোনটার ভূমিকা কতখানি, এ নিয়ে বিবর্তনবাদে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারা রয়েছে। এসত্ত্বেও, মোটের উপর বিবর্তনবাদ ধরে নেয় যে, প্রতিবেশের সাথে জীবের অধিকতর উপযোগী হয়ে উঠা হচ্ছে বিবর্তনের সামগ্রিক ধারা। এবং বিবর্তনবাদীরা ধরে নেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিবেশের উপযোগী হয়ে উঠার সাথে সাথে প্রতিটি প্রজাতি অধিকতর জটিল, পৃথকীকৃত এবং বিচিত্র হয়ে উঠে।
জৈবিক বিবর্তনের এই ধারণা সামাজিক বিজ্ঞানে আমদানি করা হয়, ব্যবহার করা হয়। যে দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে যে, সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির (যেমন পরিবার, বিবাহ) পরিবর্তন বিবর্তনের ধারণার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব, তাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন বলা হয়। (বিবর্তনের দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে ৩ নং পাঠে। দেখুন “পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব”)। ঊনবিংশ শতক ছিলো বিবর্তনবাদী তত্ত্বের স্বর্ণযুগ। নৃবিজ্ঞানে বিবর্তনবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন মর্গান, ম্যাকলেনান, মেইন, বাকোফেন, টায়ার, ফ্রেজার এবং আরও অনেকে।
ক্রিয়াবাদীদের দৃষ্টিতে, বিবর্তনবাদ হচ্ছে কুর্সী-কেদারায় বসে বসে করা নৃবিজ্ঞান। সকল মানব সমষ্টির ক্রম পরিবর্তনের যে ধারণা ধরে বিবর্তনবাদীরা এগোন, সেটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমগ্র বিশ্বের যে ঐকিক ইতিহাস বিবর্তনবাদ দাঁড় করায়, তা বিভিন্ন অঞ্চলের, ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসের নির্দিষ্টতাকে অস্বীকার করে। এটি হচ্ছে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান সমালোচনা ।
২. ক্রিয়াবাদ (Functionalism):
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানাদি, সম্পর্ক এবং আচরণ সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় কি কার্য পালন করে ক্রিয়াবাদ তারই তত্ত্ব। এই তাত্ত্বিক কাঠামো বিংশ শতকের বৃটিশ নৃবিজ্ঞানের সবচাইতে শক্তিশালী ধারা ছিল। বলা হয়, বৃটিশ নৃবিজ্ঞানীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ফরাসী সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খাইম দ্বারা। ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব বিশেষ করে বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস – ম্যালিনোস্কির নামের সাথে যুক্ত। তিনি বিবর্তনবাদের ভাবনা চিন্তা প্রত্যাখ্যান করে এই তাত্ত্বিক কাঠামোর প্রবর্তন ঘটান।
ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে মনুষ্য প্রাণীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করার যে ভূমিকা সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদি পালন করে থাকে, সেটাই হচ্ছে ক্রিয়া। এবং “চাহিদা” পূরণের এই ক্রিয়াই হওয়া উচিত নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে চাহিদা দুই প্রকার: মৌলিক (দৈহিক এবং অনুভূতিমূলক) এবং গৌণ ।
ম্যালিনোস্কির মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র র্যাডক্লিফ-ব্রাউন ক্রিয়াবাদী চিন্তা ভাবনার নতুন নামকরণ করলেন কাঠামোগত-ত্রিয়াবাদ। অনেকের মতে, এই নামকরণ অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। র্যাডক্লিফ- ব্রাউনের দৃষ্টিতে, সমাজ কাঠামো হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানের সেই জাল যা সমাজের টিকে থাকা নিশ্চিত করে। অপর পক্ষে, ক্রিয়া বলতে তিনি বুঝিয়েছেন সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়াশীলতা।
তাঁর যুক্তি ছিল এরূপ: সমাজ হচ্ছে একটি সমগ্র যা টিকে থাকে। নির্দিষ্ট কোন সমাজে, সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞাতিত্ব, ধর্ম এগুলো নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করে। সমাজ এ কারণে টিকে থাকে। শুধুমাত্র টিকে থাকে বললে ভুল হবে। সমাজ, র্যাডক্লিফ- ব্রাউনের দৃষ্টিতে, সুসংহত এবং সুসমন্বিতভাবে বারে বারে পুর্নজন্ম লাভ করে ।
ক্রিয়াবাদের প্রধান সমালোচনা হ’ল: প্রথমত, ত্রিয়া এবং কাঠামোর যে ধারণা কাঠামোগত ক্রিয়াবাদীরা দিয়ে থাকেন সেগুলো অনৈতিহাসিক। অর্থাৎ, সমাজের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক যে রূপান্তর ঘটে থাকে তা এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বোঝা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গি অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা দ্বন্দ্ব – এই প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে চলে।
৩. কাঠামোবাদ (Structuralism):
কাঠামোবাদের সূত্রপাত ঘটে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হিসেবে। এই আন্দোলন প্রথমে দানা বাঁধে ভাষাতত্ত্বে । পরবর্তী পর্যায়ে, এই দৃষ্টিভঙ্গি নৃবিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্য সমালোচনায় ছড়িয়ে পড়ে। নৃবিজ্ঞানে এর জনক ক্লদ লেভি-স্ট্রস। তাঁর দৃষ্টিতে, মনুষ্য মন ও মনুষ্য সংস্কৃতি বোঝার মডেল হচ্ছে ভাষাতত্ত্ব।
পূর্বে ভাষাতাত্ত্বিক ফার্ডিনান্দ সস্যুঘ কিছু কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলেন। সেগুলো ছিল এরূপ প্রথমত, ভাষাকে অধ্যয়ন করতে হবে তার উৎপত্তি, তার ঐতিহাসিক বিকাশ, এভাবে নয়, বরং একটি চিহ্ন ব্যবস্থা (a system of signs) হিসেবে। দ্বিতীয়ত, শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ, কোন শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। “কুঁড়ে ঘর” আর “গোয়াল ঘর”, দুটোই আকার আকৃতির দিক দিয়ে ছোটখাট ঘরকে বোঝায়। কিন্তু একটাতে মানুষ বসবাস করে, অপরটাতে গরু-বাছুর। যদিও দুটো শব্দই ঘরকে বোঝায়, কিন্তু এদের ব্যবহার ভিন্ন, আবার সম্পর্কযুক্ত (একটাতে মানুষ থাকে, অপরটাতে পশু)।
তৃতীয়ত, ভাষা বাস্তবতাকে গঠন করে, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয়। সস্যুঘ বলছেন, মানুষের মনোজগতে যে কোন বস্তু বা ভাবনা, অর্থযুক্ত। ভাষা এই অর্থ গঠন করে, সেটিকে প্রকাশ করে। এবং এই অর্থেই, সস্যুঘের দৃষ্টিতে, ভাষার বাইরে কোন বাস্তবতা নেই। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। “মুক্তিযোদ্ধা” এবং “সন্ত্রাসবাদী” দুটি শব্দ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং তার মিত্রদের দৃষ্টিতে বর্তমানে ওসামা বিন লাদেন হচ্ছেন “সন্ত্রাসী” (বর্তমানে বলা হচ্ছে কারণ লাদেন যখন সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেন তখন তিনি একই মহলের কাছে ছিলেন “মুক্তিযোদ্ধা”)।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের মানুষের কাছে লাদেন হচ্ছেন একজন “মুক্তিযোদ্ধা”। যদি আপনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা না কি সন্ত্রাসী, এতসব বুঝি না। লাদেন হচ্ছেন একজন মানুষ”। আপনার মনে হতে পারে, “মানুষ” শব্দ ব্যবহার করে ভাষার অত প্যাচ-গোঁচ এড়ান যাবে, “মানুষ” হচ্ছে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এখানে আবার রাজনীতি-টাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার নাই। কিন্তু সস্যুঘ অনুসারী আপনাকে বলতে পারেন, হ্যাঁ, কিন্তু, তোমার কথার প্রত্যুত্তরে তোমাকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসে, যদি বলে বসে, “ও কিসের মানুষ? ও তো পশু।
১১ই সেপ্টেম্বর এতগুলো মানুষকে হত্যা করল…” অর্থাৎ, বর্গ (“মানুষ”, “পশু”) বাস্তবতাকে নির্মাণ করে। (লাদেনকে যিনি পশু ডেকেছেন, তার প্রত্যুত্তরে আপনি অবশ্য বলতে পারেন, “হ্যাঁ, কিন্তু ১১ই সেপ্টেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞ লাদেনই ঘটিয়েছিল তার প্রমাণ কই?” – এগুলো অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ)।
সস্যুঘ অনুসরণে লেভি-স্ট্রসের বক্তব্য ছিল, কাঠামোবাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মনোজগত কিভাবে কাজ করে বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেটিকে বোঝা। লেভি-স্ট্রসের পূর্বানুমান হচ্ছে: মনুষ্য প্রজাতি মাত্রই অভিজ্ঞতাকে সাজায়, সেটির শ্রেণীকরণ করে। মানুষের মনোজগতের এই কাঠামো এবং এই প্রবৃত্তি সর্বজনীন। তার কারণ হচ্ছে, এই কাজটি করে থাকে মগজ এবং সকল মানুষের মগজ একই ধরনের । মগজের উপরের স্তরের প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন, এবং সেটি সাংস্কৃতিক। অর্থাৎ, এক সংস্কৃতি হতে আরেক সংস্কৃতির প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু ভিত্তিস্বরূপ বিন্যন্ত মূলনীতি (underlying ordering principles) একই। অর্থাৎ, এটি বিশ্বব্যাপী।
কাঠামোবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে “বিপরীত জোড়”-এর (binary opposition) ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ কোন প্রত্যয়কে বোঝে নেতির মাধ্যমে। “দিন”এর অর্থ আমরা তখনই বুঝি যখন মনে মনে হলেও তুলনা করি “রাত”এর সাথে। যদি আলোর ধারণা না থাকে “আধাঁর”এর অর্থ দাঁড়ায় না যেহেতু আধাঁরের মানে হচ্ছে আলোহীনতা, একইভাবে, “মৃত্যু” মানেই “প্রাণ“হীনতা। লেভি-স্ট্রসের মতে, কিছু বিপরীত জোড় বিশ্বব্যাপী যেমন, ডান-বাম, কাঁচা- রন্ধনকৃত, সংস্কৃতি-প্রকৃতি, কেন্দ্র-প্রান্ত এবং পুরুষ-নারী।
কাঠামোবাদের সমালোচকরা বলেন, এই তত্ত্ব নিশ্চল এবং অনৈতিহাসিক। বিষয়টিকে তাঁরা এই ভাবে ব্যাখ্যা করেন: সমাজ-সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মানুষের যে ভূমিকা, কাঠামোবাদ সেটাকে গুরুত্ব দেয় না। মনে হবে, মানুষ কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। উপরন্তু, কাঠামোবাদী তত্ত্বে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ব্যবস্থার রূপান্তর ক্ষমতা (সামন্তবাদ হতে পুঁজিবাদে রূপান্তর), এর গতিময়তা, এসব বিষয় উপেক্ষিত।
৪. মার্ক্সবাদ (Marxism):
তাত্ত্বিক অর্থে মার্ক্সবাদ হচ্ছে, কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের (১৮২০-১৮৯৫) রচনাসমগ্র, এবং তার উপর ভিত্তি করে নিরন্তর রচিত হতে থাকা নানান মার্ক্সবাদীদের লেখালেখি। রাজনৈতিক অর্থে মার্ক্সবাদ হচ্ছে, সর্বহারার বৈপ্লবিক সংগ্রাম, যে সংগ্রাম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটাবে।
বর্তমান আলোচনার সুবিধার্থে মার্ক্সবাদ বলতে আমরা বুঝব: (ক) একটি দর্শন যার বিষয়বস্তু হচ্ছে বিদ্যমান মানব সমাজ, এবং ভবিষ্যতের মানব সমাজ (কি হওয়া উচিত) (খ) একটি তত্ত্ব সমগ্র যার বিষয় বস্তু হচ্ছে সমাজের স্বরূপ এবং (গ) বিশ্লেষণ করার, ও সামাজিক রূপান্তর ঘটানোর একটি পদ্ধতি। আধুনিক বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা, যথা, শিল্প-পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং সম্প্রসারণ ছিল মার্ক্সের প্রধান কাজের জায়গা। এই মনোযোগের ফলাফল হচ্ছে তাঁর রচিত তিন খন্ডের ক্যাপিটাল গ্রন্থ।
সামাজিক ব্যবস্থা, মার্ক্সের মতে, নিয়মানুসারে প্রবর্তিত হয়, পরিবর্তিত হয়। মানুষ অন্য প্রজাতি হতে এই অর্থে ভিন্ন যে, কেবলমাত্র মানুষই তার আহার্য উৎপাদন করার ক্ষমতা রাখে। শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই উদ্বৃত্ত নিয়ন্ত্রণ মানব ইতিহাসের এক পর্যায়ে দ্বন্দ্বের সহৃত্রপাত ঘটায়।
সাধারণভাবে দেখা যায় যে, যে দল সম্পদের (উৎপাদনের উপায়) উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে, সেই দল হয়ে উঠে সমাজের শাসক শ্রেণী। উৎপাদনের উপায়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সমাজের অন্যান্য শ্রেণী গড়ে উঠে। উৎপাদনের উপায় কি? মার্ক্সের দৃষ্টিতে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সকল উপাদানই হচ্ছে উৎপাদনের উপায় ( means of production ) । যথা: ভূমি, কাঁচা মাল, প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি। সমাজের সকল মানুষের উৎপাদনের উপায়ের উপর ক্ষমতা একই রকম না – কেউ বা ভূমির মালিক, কেউ মালিক না, শুধুমাত্র বর্গাদার।
কেউ আবার কৃষিজমিতে মজুরি খাটেন। উৎপাদনের উপায়কে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তা হচ্ছে উৎপাদনের সম্পর্ক (ভূমি মালিক, কৃষি-মজুর: relations of production)। ভিন্নতর এই ক্ষমতা সমাজে শ্রেণী সম্পর্কের ক্ষমতা তৈরী করে। উৎপাদনের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক ফসটি সমাজের কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা পরিসরে ধরুন, কেবলমাত্র অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি হয়ে উঠে সমাজের সামগ্রিক চেহারা। সংক্ষেপে, এই হচ্ছে “ইতিহাসের বস্তুগত তত্ত্ব”। এই তত্ত্ব অনুসারে,
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়, তার কারণ এটি হচ্ছে ভিত্তি (base)। উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে রূপদান করে, যেহেতু এই ব্যবস্থাগুলো উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত, সেকারণে এগুলো হচ্ছে উপরিকাঠামো (superstructure)।
মানব ইতিহাসকে মার্ক্স কিছু ক্রমান্বয়িক পর্বে ভাগ করেন: আদি সাম্যবাদ বা উপজাতি ভিত্তিক সংগঠন, দাসত্ব, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ। জীবনের শেষ দিকে, তিনি সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজটিকে আরও পেছনের দিকে ঠেলে দেন। আদি অর্থনৈতিক সমাজের অনুসন্ধান সূত্রে তাঁর পরিচয় ঘটে নৃবিজ্ঞানের সাথে । লুইস হেনরী মর্গানের যুগ বিভাগ তত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বই লেখার কাজে হাত দেন। বই পরিকল্পনারত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে, এঙ্গেলস মার্ক্সের রেখে যাওয়া নথি পত্রের সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করেন (পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ১৮৮৪)।
ইউরোপীয় আলোকময়তার দার্শনিকদের মতন মার্ক্সও ভাবতেন, মানব সমাজ অধিকতর প্রগতির ধারায় বিকশিত হচ্ছে, পরিবর্তন ঘটছে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদে মুক্তির সম্ভাবনা অধিকতর। কিন্তু প্রগতির এই যাত্রা শান্তিপূর্ণ বা সংঘাতহীন নয়; বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর ক্ষমতার লড়াইয়ের ফসল।
মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে, ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সেই অর্থে, মার্ক্সীয় ইতিহাসের ধারণা প্রথাগত ইতিহাসের ধারণা (এক রাজবংশের বদলে আরেক রাজবংশ, কিংবা ধীরে ধীরে জাতিসত্তা অর্জন অথবা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা) থেকে ভিন্ন। শ্রেণী ইতিহাসের চাবিকাঠি হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সুবিধাদি অর্জনের লড়াই ও সংগ্রাম। সাম্প্রতিককালে, ১৯৬০’র দশক হতে, নৃবিজ্ঞানে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ই টেরে, এম গদলেয়ার, এরিক উলফ, পিটার উসলি প্রমুখদের কাজের মাধ্যমে।
৫. প্রতীকবাদ (Symbolism):
প্রতীকের অর্থ অনুসন্ধান নানাবিধ নৃবিজ্ঞানীদের আগ্রহ এবং চিন্তাভাবনাকে এক জায়গায় জড়ো করতে সক্ষম হয়। যেমন লেভি-স্ট্রস, ডেভিড শ্লাইডার, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ, ভিক্টর টার্নার, মেরি ডাগলাস ইত্যাদি। এদের মাঝে কিছু তাত্ত্বিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সমিলের একটি কেন্দ্রীয় জায়গা আছে এবং তা হচ্ছে: অর্থ এবং যোগাযোগের অনুসন্ধান। প্রতীক বলতে বোঝায় এমন কিছু যা অন্য কিছুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।
যেমন ধরুন, বাংলাদেশের পতাকা হচ্ছে এই দেশের সার্বভৌমত্বের একটি প্রতীক। অথবা, শহীদ মিনার হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। এই ধারা, ষাটের দশকের শেষভাগ হতে সত্তরের দশকে, নৃবিজ্ঞানে শক্তিশালী হয়ে উঠে। প্রতীকী নৃবিজ্ঞান সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করে অর্থ ব্যবস্থা হিসেবে। প্রতীকবাদী নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। এই অর্থ ব্যবস্থাকে নৃবিজ্ঞানী উদঘাটন করেন আচারাদি (rituals) এবং প্রতীক/চিহ্ন ব্যাখ্যাদানের সাহায্যে ।
প্রতীকী নৃবিজ্ঞান বা প্রতীকবাদ চারটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে: প্রথমত, প্রতীকবাদ সামাজিক কার্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। মনে হবে মানুষজনের কার্যকলাপ প্রতীক এবং অর্থ তৈরী দ্বারা পরিচালিত। দ্বিতীয়ত, এই তত্ত্ব সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে না।
তৃতীয় সমালোচনার জায়গা তৈরী করে দিয়েছেন নারীবাদীরা। তাদের বক্তব্য হ’ল, প্রতীকের অর্থ | সকলের জন্য এক রকম নয়। ধরুন, চাঁদ-তারা। এই দেশের কিছু মানুষের জন্য এটি ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। আবার অনেক মানুষের কাছে এটি পাকিস্তানী শাসনামল ও পাকিস্তান সরকারের বাঙ্গালিদের উপর নিপীড়নের প্রতীক। একই দেশের মানুষজনের মধ্যেকার এই বিভাজনগুলো বাস্তব। তাহলে আমরা কিভাবে ধরে নিতে পারি যে সংস্কৃতি একটি অখন্ড অর্থ ব্যবস্থা, প্রতীকের সমষ্টি, যার অর্থ সকলের জন্য একই রকম?
৬. নারীবাদ (Feminism):
নারীবাদ মার্ক্সবাদের মতনই। শুধু মাত্র তত্ত্ব নয়, সমাজে বাস্তবিক পরিবর্তন ঘটানোর আন্দোলন বা সংগ্রাম এর অবিচ্ছিন্ন দিক। নারীবাদের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা হচ্ছে: নারী নিপীড়িত, নারী নিপীড়নের অপর দিক হচ্ছে পুরুষ আধিপত্য। নারীবাদের মধ্যে ভিন্ন পজিশন থাকা সত্ত্বেও সকলে কিছু বিষয়ে একমত হবেন। যথা, নারী অধীনস্ততা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বা ঈশ্বর প্রদত্ত নয়। এটা সামাজিক এবং ঐতিহাসিক। পুরুষ আধিপত্যও তাই: নির্দিষ্ট ক্ষমতা কাঠামো দ্বারা সৃষ্ট, যার কারণে পুরুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে। নারীবাদীদের মধ্যকার কেন্দ্রীয় বিভাজন নারীর অবস্থার বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে, কিভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব, কি ধরনের পরিবর্তন কাম্য – এসব কে কেন্দ্র করে।
উদারনৈতিক নারীবাদীদের মতে, ব্যক্তি হিসেবে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁরা গুরুত্ব আরোপ করেন আইনী সংস্কারের উপর। তাঁদের বক্তব্য হল: বলা হয়ে থাকে আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। কিন্তু নারীবাদী গবেষণা সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে কিভাবে পুরুষের ক্ষমতা বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত।
উদারনৈতিক নারীবাদীরা গুরুত্ব দেন এধরনের বিষয়ের উপর: নারী ও পুরুষের মজুরির হার একই হওয়া উচিত, চাকরির একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত ইত্যাদি। সমাজতান্ত্রিক/মার্ক্সবাদী নারীবাদীদের মতে, লিঙ্গীয় বৈষম্য শ্রেণী বৈষম্যের মতনই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথাগত মার্ক্সবাদীদের ধারণা হচ্ছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবস্থা ভেঙে ফেললে নারী নিপীড়ন আর থাকবে না। তাঁদের দৃষ্টিতে, ব্যক্তি মালিকানা কেবলমাত্র শ্রেণী শাসন নয়, নারী নিপীড়নেরও কারণ। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, বিত্তহীন শ্রেণী, যাদের কিনা সম্পত্তি নাই, সেই শ্রেণীর নারী পুরুষের সম্পর্কও বৈষম্যপূর্ণ। পুরুষ আধিপত্য ও শ্রেণী আধিপত্যকে আলাদা ভাবে বুঝতে হবে, এ দুই আধিপত্য কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা নিরিখ করে দেখতে হবে।
সাম্প্রতিককালে, এই দুই ধরনের নারীবাদ তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদীদের দ্বারা। এঁরা বর্ণবাদের বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন। এঁদের বক্তব্য হচ্ছে: বিদ্যমান নারীবাদী তত্ত্বে পুরুষ আধিপত্য কেন্দ্রীয়। উদারনৈতিক নারীবাদে শ্রেণী বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যা কিনা সমাজতন্ত্রী নারীবাদীরা করেন।
কিন্তু বর্ণ বৈষম্যের প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য উভয় ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। সমাজে একাধিক কেন্দ্রীয় বিভাজন উপস্থিত: শুধুমাত্র লিঙ্গীয় এবং শ্রেণী বৈষম্য নয়, নরবর্ণ ভিত্তিক (race) বৈষম্য একইভাবে কেন্দ্রীয়। এই বৈষম্যের মুখোমুখি না হলে নারীর মধ্যকার বিভেদ এবং কি ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংহতি রচনা করা সম্ভব এগুলোর পথ খোঁজা দুরূহ হয়ে পড়বে।
উপরে নৃবিজ্ঞানের কিছু প্রধান তাত্ত্বিক ধারার সাথে – বিবর্তনবাদ, মার্ক্সবাদ, ক্রিয়াবাদ, কাঠামোবাদ, প্রতীকবাদ এবং নারীবাদ আপনার পরিচয় ঘটানো হয়েছে। গত দুই দশকে কেবল নৃবিজ্ঞান নয়, সামাজিক বিজ্ঞান এবং মানবিক বিষয়ের (সাহিত্য অধ্যয়ন, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি) তত্ত্ব জগতে তোলপাড় ঘটেছে উত্তর-কাঠামোবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ নামক তত্ত্বীয় উদ্ভাবনের কারণে। দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক দিয়ে, এই তত্ত্বগুলোর মধ্যে কিছু সামিল রয়েছে। স্থানের অভাবে এগুলোর সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটানো সম্ভব নয়। এ বাদে, একই সময়কালে সংস্কৃতি তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ উত্থাপন করেছেন প্রাচ্যবাদের ( orientalism) ধারণা।
প্রাচ্যবাদ হচ্ছে প্রাচ্য সংক্রান্ত অধ্যয়ন। প্রাচ্যবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্যের উৎপাদিত প্রাচ্য সম্বন্ধে একটি জ্ঞানব্যবস্থা। শুধুমাত্র বিদ্যাজাগতিক লেখালেখি নয়, প্রাচ্য সম্বন্ধে “জ্ঞান” তৈরি হয়েছে নানাভাবে: ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য, উপন্যাস, সরকারী কর্মকর্তাদের বিবরণ, চিঠিপত্র ইত্যাদি। সাঈদ বলেন, প্রাচ্যবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রপঞ্চ। এটি অনড়, অটল নয়; সহজ-সরল ও নয়। প্রাচ্য সম্বন্ধে দীর্ঘ সময় ধরে যে জ্ঞান পাশ্চাত্য উৎপাদন করেছে তা নিরিখ করলে বোঝা যায় যে, এই জ্ঞানব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়। এই জ্ঞান পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যের স্মারক। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক শক্তি থেকে এই জ্ঞানব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা অযৌক্তিক।
যে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো উপরে উপস্থাপিত হয়েছে, তাদের মধ্যকার ফারাক অনেক। কি ধরনের? যেমন ধরুন, কিছু নৃবিজ্ঞানী উপরে আলোচিত তত্ত্বগুলোকে দুইভাগে ভাগ করবেন: (ক) মার্ক্সবাদী (এতে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন তাঁরা) এবং (খ) অ-মার্ক্সবাদী তত্ত্ব। খোদ মার্ক্সের ভাষায় বললে, এই ফারাকের কেন্দ্রীয় দিক হচ্ছে, অন্য সকল দর্শন জগতকে বুঝতে চায়, পক্ষান্তরে, মার্ক্সবাদ জগতকে পরিবর্তন করতে চায় (তবে, মনে রাখবেন, মার্ক্স নিজে কখনও “মার্ক্সবাদ” শব্দটি উচ্চারণ করেননি)।
মার্ক্সবাদী তত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সংঘাতের উপর। তার বিপরীতধর্মী তত্ত্ব, উদাহরণস্বরূপ ক্রিয়াবাদী তত্ত্বে, গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ভারসাম্যের উপর, সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর। মার্ক্সবাদে শোষণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া, বিপ- ব এবং মানব মুক্তির পক্ষে লড়াই করা গুরুত্বপূর্ণ।
এই বিষয়গুলো মার্ক্সবাদের কেন্দ্রে, এই বিষয়গুলো মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ঐতিহাসিক। পক্ষান্তরে, আপনারা উপরের আলোচনায় দেখেছেন যে, সমালোচকদের মতে, অ-মার্ক্সবাদী তত্ত্বের একটি প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সেগুলো মূলত অনৈতিহাসিক। তবে, এক্ষেত্রে উল্লেখ করা জরুরী যে, বর্তমানের বহু মার্ক্সীয় নৃবিজ্ঞানীদের মতে, লুইস হেনরী মর্গানের বিবর্তনবাদী পরিকাঠামো গ্রহণ করার কারণে খোদ মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাঁদের উদ্ভাবিত ঐতিহাসিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকে সরে যান। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সমাজের ক্রম বিকাশের পর্ব, স্টালিনীয় যুগে’ একটি যান্ত্রিক ফর্মুলায় পর্যবসিত হয়। পৃথিবীর বিবিধ ইতিহাস কিছূ অনড় পর্বে বন্দীকৃত হয়ে পড়ে।
জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্ব : জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব অধ্যায়ের সারাংশ- যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, এই পাঠে কেন্দ্রীয় কিছু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে – বিবর্তনবাদ, মার্ক্সবাদ, ক্রিয়াবাদ, কাঠামোবাদ এবং – নারীবাদ — আপনার পরিচয় ঘটানো হয়েছে।
নৃবিজ্ঞান (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) বোঝার জন্য, ব্যবহার করার জন্য সংক্ষিপ্ত রূপে হলেও, এই তাত্ত্বিক এবং প্রত্যয়গত পরিচয় জরুরী। সাম্প্রতিককালে এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবাদের ধারণা সামাজিক এবং মানবিক শাখার বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বর্তমানের অনেক চিন্তাবিদের উপলব্ধি হচ্ছে যে, এ পর্যন্ত যে প্রত্যয় বা তত্ত্ব উদ্ভাবিত হয়েছে, সেগুলো সর্বজনীন ঘটনাবলী ব্যাখ্যাদানের দাবি করে।
কিন্তু ভালভাবে নিরিখ করলে দেখা যায় যে, এই তত্ত্ব এবং প্রত্যয়গুলোর ব্যাখ্যাদানের ক্ষমতা সীমিত। এগুলো বিশ্বের বৈচিত্র্য এবং বিবিধতাকে বুঝতে বা অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে না। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো পাশ্চাত্য সমাজের প্রচলন ও অনুশীলনকে মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করায়। এ সকল কারণে বর্তমানে অনেকে ঝুঁকে পড়েছেন প্রত্যয় বা তত্ত্ব বা জ্ঞানের ইতিহাস এবং এর পক্ষপাতিত্ব অনুসন্ধানে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের গুরুত্ব ঠিক একইভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে।
জ্ঞাতিত্ব
জ্ঞাতিত্ব রক্ত-সর্ম্পকের সামাজিক সত্তা। এটা প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মাধ্যমে। বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কও জ্ঞাতিত্বের আওতায় পড়ে। কোন ব্যক্তির কার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীয়বর্গের মধ্যে সক্রিয় সদস্য হওয়ার জন্য একজনকে অবশ্যই জ্ঞাতিত্বের অবস্থানের অধিকার ও দায়িত্ব এবং জ্ঞাতিবর্গের সদস্যদের মধ্যে প্রথাগত আচরণ সম্পর্কে জানতে হয়। জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার ও অন্যান্য সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত দলের মাধ্যমেই লোকজন সাধারণত তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কার্যাদি পরিচালনা করে থাকে।
আত্মীয় সম্পর্কীয় দলসমূহের মধ্যে দ্বি-মুখী ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি দিলে বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সংগঠন এবং এতে বিদ্যমান সহযোগিতা ও সংঘাত অনুধাবন করা সহজ হয়। প্রতিটি পরিবারে একদল ব্যক্তিত্ব থাকে যারা সার্বক্ষণিকভাবে সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি বিনিময় করে থাকে এবং নিজেদের লক্ষ্য ও চাহিদা পূরণের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করে থাকে। জ্ঞাতিত্ব, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ব্যাপ্তি এবং সাধারণ জীবনযাপনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক একক রয়েছে। একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আত্মীয়দের অধিকার, দায়িত্ব ও আচরণ জ্ঞাতিত্ব পদ্ধতিরই অংশ।
অন্য অনেক সমাজের মতো বাংলাদেশে আত্মীয়পদ বলতে বোঝায়:
১. | প্রজন্ম পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার (পিতা, পুত্র, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি প্রভৃতি)। প্রতিটি আত্মীয়পদ দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মীয়ের প্রজন্মকে নির্দেশ করে থাকে। |
২. | একই প্রজন্মের মধ্যে বয়সের তারতম্য বিচার (বড় এবং ছোট ভাই-বোন, পিতার বড় ও ছোট ভাই প্রভৃতি)। |
৩. | এক বংশভুক্ত (lineal) এবং সহগামী (collateral) আত্মীয়ের পার্থক্য বিচার। একবংশ সূত্রীয় রীতি বলতে একটি রেখার মাধ্যমে চিহ্নিত সংগঠিত আত্মীয়দের বোঝায়। এ পদ্ধতিতে, শুধু পুরুষ দ্বারা পরিচিতি দেওয়া হলে তাকে পিতৃবংশ পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উভয় লিঙ্গের সন্তানরা তাদের পিতার বংশের অন্তর্ভুক্ত। ওই পুরুষের সন্তান ও সন্তানের সন্তান এবং তাঁর সন্তান একই বংশের অন্তর্ভুক্ত। জ্ঞাতিসম্পর্ক আত্মীয়বন্ধনের মাধ্যমে নির্ণীত হয়। বাংলাদেশে আত্মীয়তা প্রধানত পুরুষের মাধ্যমে বংশধারা বন্ধনকে স্বীকার করে। |
৪. | আত্মীয়দের মধ্যে লিঙ্গের প্রভেদ (ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাতিজি ইত্যাদি)। |
৫. | সম্বোধনকারীর লিঙ্গ বিচার, (পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক পদ্ধতির শব্দাবলি রয়েছে)। |
৬. | যে ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তাদের লিঙ্গ তারতম্য (পিতার ভাই, মাতার ভাই, পিতার বোন ইত্যাদি)। একে বলা হয় বিপরীত লিঙ্গবন্ধন (cross sex tie)। |
৭. | জন্মসূত্রে এবং বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়ের মধ্যে পার্থক্য (বোন বা মা বনাম স্বামীর মা) অর্থাৎ রক্তের সম্বন্ধযুক্ত বনাম বৈবাহিক সম্বন্ধযুক্ত বন্ধন। |
৮. | ডাকবলা সম্পর্ক (সম্বোধনের মাধ্যমে সম্পর্ক) বা কল্পিত আত্মীয়বন্ধন এবং এর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কযুক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনের সংযুক্ততা। |
জ্ঞাতিত্বের সামাজিক কাঠামো সৃষ্টি ও সংরক্ষণে ঘর-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঘর বলতে আক্ষরিক অর্থেই একটি আবাসিক একক বোঝায় যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের যেকোনো ধরনের সকল সদস্য অবস্থান করে। প্রতিটি একক ঘরকে বলা হয় চুলা বা খানা যার অর্থ হচ্ছে ‘একই সঙ্গে আহার গ্রহণকারী একক’। ঘরের সদস্যপদ প্রধানত পিতৃবাসের ওপর ভিত্তি করে নিরূপিত হয়। এটি উৎপাদন ও খরচের প্রাথমিক একক। ঘর হচ্ছে একটি আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্র। রক্তের সম্পর্কের সদস্য, তাদের বিবাহিত সঙ্গী এবং এক থেকে তিন প্রজন্মের ব্যক্তি সমন্বয়ে ঘর গঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া, কখনও কখনও অন্যান্য আত্মীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
একটি বাড়িকে ঘিরে জ্ঞাতিত্ব গড়ে ওঠে। বাড়ি বলতে সাধারণভাবে একই আঙ্গিনায় একগুচ্ছ ঘরকে বোঝায়। বাড়ির অভ্যন্তরে, ঘরের প্রধানগণ হয় রক্তীয় অথবা বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা যুক্ত। কিছু কিছু ঘরের প্রধানগণ উল্লিখিত দুই সম্পর্কের কোনোটার দ্বারাই সম্পর্কযুক্ত নয়। অবশ্য এরকম ঘটনা খুবই বিরল। প্রতিটি পরিবারের একজন কার্যকরী প্রধান থাকে। কিন্তু সাধারণত বাড়ির কোনো স্বীকৃত প্রধান থাকে না। বাড়ির সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করে থাকে, বিশেষ করে কোনো সংকটময় মুহূর্ত উপস্থিত হলে এমনটি দেখা যায়। বাড়ির বয়োবৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলাকে বিশেষ সম্মান দেখানো হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। বাড়ির অভ্যন্তরে প্রতিটি ঘরের সদস্যদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকলেও বাড়ি মূলত একটি সামাজিক বন্ধনযুক্ত একক। একটি বাড়ি সাধারণত তাঁর সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ জীবিত অথবা মৃত সদস্যের মর্যাদার উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে।
সাধারণত গোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞাতিত্বের সন্ধান মেলে। গোষ্ঠীর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে বিয়ে হয়ে সংসারে আসা স্ত্রীগণ ও বিয়ে হয়ে অন্য সংসারে যাওয়া কন্যাগণ ব্যতীত একগুচ্ছ ঘর বা পরিবার যারা সকলেই সগোত্রীয়। প্রপিতামহের সকল পুরুষ বংশধর এর অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ বংশ একটি অধিকারবোধ জাগ্রত করে যা গোষ্ঠীর সদস্যদের একই বন্ধনে আবদ্ধ করে। সদস্যরা একজন মৃত বা পূর্বপুরুষের মধ্যে তাদের সাধারণ উৎস খুঁজে থাকে।
কোনো গোষ্ঠীর কোনো অবস্থাসম্পন্ন সদস্যের একই গ্রামের বা কখনও কখনও পাশ্ববর্তী গ্রামে নতুন আবাসিক প্লটে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস অস্বাভাবিক নয়। ফলে, একই গোষ্ঠীর সদস্যরা একই বাড়ির আঙ্গিনায় বসবাস করতেও পারে, নাও পারে। গোষ্ঠীর সদস্যগণ যারা একক সাধারণ পুরুষের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষের সন্ধান করে তারা একত্রে বাস করুক বা না করুক, তারা একই কুলের বা বংশের অন্তর্ভুক্ত। তবে হিন্দুদের মধ্যে কুল সম্পর্কে সচেতনতা মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে গোষ্ঠীসচেতনতা অনেক বেশি শক্তিশালী। যদিও কুল ও গোষ্ঠী উভয়ই সমার্থক শব্দ, মুসলমানগণ তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এবং মৃত ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় গরিব দুস্থদের আহার করিয়ে থাকে।
পক্ষান্তরে, হিন্দুরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও সন্তুষ্টির জন্য খাবার পরিবেশন ও পূজা করে থাকে। বিয়ের পর একজন মুসলমান মহিলা তাঁর স্বামীর গোষ্ঠীর সদস্যপদ লাভ করে, তবে একইসঙ্গে তাঁর পিতৃগোষ্ঠীর সদস্যপদও বহাল থাকে। একজন মুসলমান মহিলা বিয়ের মাধ্যমে অনেকটা দ্বৈত গোষ্ঠী সদস্যপদ অর্জন করে। সে ও তাঁর সন্তানরা বাপের বাড়ি বেড়ানোর সময় আত্মীয়-গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে উপহার গ্রহণ করলেও, পিতৃগোষ্ঠীতে তাঁর উত্তরাধিকার ও সেখানে আশ্রয়ের অধিকার বহাল থাকে। বিয়ের পর একজন হিন্দু মহিলার তাঁর পিতার পরিবারে আর কোনো সদস্যপদ থাকে না। স্বামীর গৃহে আসার পর সে স্বামীর গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে যায়।
বাংলাদেশে জ্ঞাতিত্ব বলতে সাধারণত আত্মীয়-স্বজনকে বোঝানো হয়। এ জটিল শব্দটির সংজ্ঞা দিতে গেলে আত্মীয় ও স্বজন শব্দ দুটিকে আলাদাভাবে এবং একটি জটিল বিন্যাসে বিবেচনা করতে হবে। একটি গোষ্ঠীতে সকল সদস্যের সাধারণ পূর্বপুরুষ থাকে। বংশ তালিকায় এটা দৃষ্টিগোচর হয়। মোটকথা এসব লোকদের বলা হয় ‘নিজের লোক’ (স্বজন)। আত্মীয় হওয়ার জন্য এ ধরনের সাধারণ পূর্বপুরুষের প্রয়োজনীয়তা নেই। আত্মীয় শব্দটি এসেছে আত্মবাচক শব্দ ‘আত্মা’ থেকে। আত্মীয় সদস্যপদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে, আবার এ সদস্যপদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তৃত হতে পারে। বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ নিজেদের আত্মীয় সদস্যরূপে দাবি করে থাকে। মায়ের রক্তের সম্পর্কিত লোকজন (যেমন মায়ের ভাই) এবং পুরুষের রক্তের সম্পর্কিত বিবাহিত মহিলাদেরকেও আত্মীয়-স্বজনরূপে গণ্য করা হয়।
পিতৃগোষ্ঠীর মাধ্যমে রক্ত সম্পর্কিত বাড়ির সকল সদস্যদের মধ্যে গভীর নৈকট্যবোধ থাকে; তারা মনে করে যে, তাদের পরস্পরের সম্পর্ক বাড়িতে বধূ হিসেবে আনা গৃহিণীদের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি গাঢ় ও নির্ভরশীল। এ কারণে, নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে যখন কোনো মহিলার বিবাহ হয়, তখন সে তাঁর পিতৃপরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ভাইরাও তাদের বোনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে এবং সুযোগ-সুবিধামতো উপঢৌকন দিয়ে ও বাড়িতে দাওয়াতের মাধ্যমে ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে।
যখন কোনো ভাই বিবাহিত বোনের বাড়ি বেড়াতে যায় তখন বোন তাঁর বিশেষ যত্ন নেয় এবং উত্তম আহারাদি পরিবেশন করে। গ্রামের সকল মহিলাই বিয়ের পরে স্বামীর পিতার গৃহে গমন করে এবং সারাজীবন সেখানে কাটায়। কিন্তু একজন মহিলার সবসময়ই তাঁর বাপের বাড়ির জন্য বিশেষ অনুভূতি থাকে। বাপের বাড়ি বেড়ানোর জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যখনই সম্ভব হয় একজন পিতা তাঁর বিবাহিত কন্যাকে ‘নাইওর’ আনার ব্যবস্থা করেন। এ সময় যদি জামাই সঙ্গে আসে তখন অবশ্যই বিশেষ খাবার প্রস্ত্তত করা হয়। ফলে, এ ধরনের আমন্ত্রণ ঘরের ছেলেমেয়েরা খুবই উপভোগ করে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে শিশুরা তাদের পিতামাতা ও ভাইবোন দ্বারা লালিত-পালিত হয়ে থাকে। সাধারণ পরিস্থিতিতে, ঘরের বন্ধন খুবই ঘনিষ্ঠ। একজন পুরুষের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাঁর নিজের ঘর বা পরিবার দেখাশোনা করা। এরপর সে গোষ্ঠী বা স্বজনের দিকে নজর দিতে পারে। এ ধরনের কর্তব্য প্রথমে নিকট আত্মীয় ও আত্মীয়-স্বজন, এরপর সমাজ এবং পাড়া-পড়শির মধ্যে বিস্তৃত হতে পারে। আত্মীয় ও আত্মীয়-স্বজনের বিস্তারলাভ ঘটে থাকে সমাজ বরাবর এলোপাতাড়িভাবে। কারণ এ ধরনের সম্পর্ক সাধারণত তৈরি হয় বিয়ের মাধ্যমে। কখনও কখনও গোষ্ঠী বিস্তার ঘরের সীমানা এবং প্রায়শই গ্রাম ছাড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশে ঘরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক একক হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে সকলে একসঙ্গে কাজ করে, ফসল ফলায়, গবাদিপশু দেখাশোনা করে এবং সর্বোপরি, তারা যে সমস্ত জিনিসপত্র ভোগ করে তাঁর বেশির ভাগই নিজেরা উৎপাদন করে। একটি গৃহ নানা ধরনের বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা আবদ্ধ। এর কিছুটা হয়ে থাকে বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন, যেমন গোষ্ঠী, আত্মীয়, স্বজন দ্বারা। তারা বৈবাহিক সম্পর্ক বাছাই, মোহরানা ও কনের পণ নির্ধারণ, দত্তক গ্রহণ ইত্যাদি গৃহস্থালি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ন্ত্রণ অধিকার আসে রক্তীয়, বৈবাহিক বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এ ধরনের বিষয়ে গোষ্ঠী সদস্যদের প্রভাব আত্মীয়-স্বজনভুক্ত সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি। এ তিন দলের ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে সাধারণত গৃহে পুরুষের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব মহিলার চেয়ে বেশি। অবশ্য কনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যের ওপর বয়স্ক মহিলাদের প্রভাব থাকতে পারে। বিয়ের পূর্বপর্যন্ত একজন মহিলাকে তার পিতামাতার কর্তৃত্বে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আবার বিয়ের পর স্বামীর, বিশেষ করে কয়েকজন ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত শাশুড়ির কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে। বিধব্য অবস্থায় সে সাধারণত তার অবিবাহিত উপযুক্ত পুত্রের তত্ত্বাবধানে থাকতে পছন্দ করে। যথাসময়ে পুত্র যদি বিয়ে করে, সে তার সঙ্গেই বসবাস করতে থাকে। তবে সকল পুত্রই আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। পুরুষ কর্তৃক সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ এবং শিশু যত্নের শ্রম থেকে মুক্ত থাকার ফলে পুরুষ বিশেষত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় যেমন, মাঠের কাজ করা, মাছ ধরা, বাজারে বেচা-কেনা এবং সমাজের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করতে পারে।
জ্ঞাতিত্বের বন্ধন লোকজনের মধ্যে আনুগত্যের সৃষ্টি করে। একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলা ও খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গৃহের সদস্যদের একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক সহজ করে তোলে। তারা একে অন্যকে ভালভাবে বুঝতে পারে। তারা অনুভব করে যে প্রয়োজনের সময় তারা একে অন্যের প্রতি আস্থার সাথে নির্ভর করতে পারে।
প্রতিটি মুসলমান ও হিন্দু গৃহ এক একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি হিন্দু পরিবার আবার একটি বর্ণভুক্ত। মুসলমানদের বেলায় এটি প্রযোজ্য নয়। একজন বাঙালি চাষি তার গ্রামের সঙ্গে এবং অন্যরাও তার পরিবার, গোষ্ঠী ও দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্প্রসারিত আত্মীয়ের সঙ্গে কিছু কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। এদের সকলেই তার গ্রামের বাসিন্দা হতেও পারে, নাও পারে। মুসলমান হলে তার মসজিদের সঙ্গে কিছু কিছু কর্মকান্ড সংশ্লিষ্ট থাকে। গ্রামের সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বর্ণ, সমাজ ও জ্ঞাতিত্ব। এগুলি গ্রামকে বিভিন্ন সামাজিক দলে বিভক্ত করে। মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আত্মীয় সদস্যদের বিশেষ অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে বিভিন্ন আত্মীয়দলের সদস্যরা বিদ্যমান সামাজিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করে।
মুসলমানরা প্রায়শ নবজাতকের নামকরণ উৎসবে আকিকা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আকিকা পালনে ছেলেশিশুর জন্য দুইটি ও মেয়েশিশুর জন্য একটি ছাগল কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানি পশুর মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এর এক ভাগ নবজন্ম শিশুর পরিবার, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং তৃতীয় ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। জিয়াফত বা মেজবানি অর্থাৎ কোনো উৎসব উপলক্ষে রক্ত ও বিবাহসূত্রে সকল ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
হিন্দু ধর্মীয় পঞ্জিকায় পালনের জন্য বিভিন্ন দিবস রয়েছে। তাদের সবচেয়ে প্রত্যাশিত উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রথযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা। এ সময় মহিলারা পরিবারের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে স্থানীয় মন্দিরে দেবতা জগন্নাথের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও অর্থ নিবেদন করে থাকে। বাড়ির মহিলা ও শিশুরা ধর্মীয় চেতনার উৎকর্ষ ঘটানো ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে একত্রে গ্রামের বাইরে যাবার যে সকল সুযোগ পায় এ মেলা তার অন্যতম। মেলায় এক বাড়ির সদস্যরা অন্য বাড়ির, বিশেষ করে বৈবাহিকসূত্রে সম্পর্কিত আত্মীয় সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়। বাড়ির বা গৃহের বাইরে আরও কয়েকটি বড় ধরনের ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এ ধরনের উৎসব একটি গ্রামের একই বর্ণের প্রায় সকলের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে আয়োজন করা হয়। বেশির ভাগ গ্রামেই বর্ণভিত্তিক দল বৈবাহিক জোটের মাধ্যমে একটি আত্মীয়দলে রূপান্তরিত হয়। এভাবে দুর্গা পূজা, কালী পূজা, গঙ্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, শীতলা পূজা এবং মনসা পূজার মতো বড় বড় ধর্মীয় উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে বর্ধিত আত্মীয়দল একটি সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। বাংলাদেশের হিন্দুসমাজের সবচেয়ে বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার সময় পূর্বপূরুষের স্মৃতির উদ্দেশে প্রার্থনা করা হয়। প্রতিটি পরিবার তার মৃত পূর্বপুরুষের জন্য বলিদান করে থাকে। ব্রাহ্মণকে কিছু দান করলে তা পূর্বপুরুষগণ পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। সুতরাং মৃত আত্মীয়স্বজন যে সমস্ত উপাদান পছন্দ করত সেগুলিই পুরোহিতকে দান করা হয়।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহের সময় রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি প্রচলিত আছে। পুত্র বা কন্যার বিয়ের সময় পিতা তার নিজের বংশের লোকজনদের ছাড়াও শ্বশুর, মামা, মামাশ্বশুর, জামাই ও সন্তানদের শ্বশুরকুলের লোকজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শুধু বংশের একজন প্রতিনিধি বিবাহ কর্মকান্ডে অংশ নেয়। হিন্দুদের মধ্যে বিধবাগণ বিবাহ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে না, তবে বিবাহ অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিতে তাদের কোনো বাধা নেই।
হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ে বর ও কনের পিতাদেরকে পুরোহিতের সামনে স্মৃতি থেকে পূর্বপুরুষের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারণ করতে হয়। তাদের অবর্তমানে ভাই কিংবা পুত্রগণও এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারে। বর ও কনের নিজ নিজ বাড়িতে আলাদাভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। কোনো বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর যদি রক্তসম্পর্কীয় কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে তাহলে সেই বিয়ে কয়েক দিনের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি অনুষ্ঠান নির্ধারিত কিছু আত্মীয়-স্বজনকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠীর সময় সকল জামাইকে অবশ্যই আমন্ত্রণ জানাতে হয়। সাধারণত মেয়ের স্বামীকে এ ধরনের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে ধনাঢ্য পরিবারগুলি ভাইয়ের মেয়ের স্বামীকেও নিমন্ত্রণ করে থাকে। এ সময় জামাই ও শাশুড়ি পরস্পরকে নতুন কাপড় উপহার দিয়ে থাকে। শাশুড়ি জামাইয়ের দীর্ঘায়ু প্রত্যাশায় আশীর্বাদ করে। এ ধরনের আরেকটি উপলক্ষ আছে যার নাম শীতল-ষষ্ঠী। এ সময় মা তার ছেলের দীর্ঘায়ু কামনায় আশীর্বাদ করে থাকে। অন্য আরেকটি অনুষ্ঠান ভ্রাতৃ বা রাখিবন্ধন-এর মাধ্যমে ভাই এবং বোন পরস্পরের দীর্ঘজীবন কামনা করে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে।
হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আচার-অনুষ্ঠানে আত্মীয়দের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মৃতের পুত্র, পিতৃপক্ষের রক্ত সম্পর্কীয় ব্যক্তি বা অন্য আত্মীয় মৃতদের শ্মশানে নিয়ে যাবে। যারা মৃতের মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দিতে পারবে তারা হচ্ছে পুরুষের ক্ষেত্রে জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র, অথবা স্ত্রী, অথবা কন্যা, অথবা ছোট ভাই, অথবা পিতা, বা চাচা বা দাদা, বা মামা, বা নানা এবং অন্যান্যরা। নারীর ক্ষেত্রে পুত্র বা কন্যা বা সতীনের ছেলে বা স্বামী বা পুত্রবধূ বা ভাই এবং অন্যান্যরা।
মৃত্যুর পর অশুচিকাল পালন করতে হয়। এটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, যেমন মৃতব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আত্মীয়তার ধরন, তাদের পেশা, বর্ণ ইত্যাদি ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। অশুচিকাল শেষে সব ধরনের বিধিনিষেধ উঠে যায় এবং পুত্ররা মাথা ন্যাড়া করে পুরোহিতের সহায়তায় একটি অনুষ্ঠান পালন করে যার নাম শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের দিন পুত্ররা রক্তসম্পর্কীয় সকল আত্মীয়কে মৃতের আত্মার শান্তির জন্য তাদের সঙ্গে স্নান ও আহারের নিমন্ত্রণ করে।
মুসলমান ও হিন্দু উভয়েই বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য ভোজের আয়োজন করে থাকে। মৃত্যু পরবর্তী ‘ভোজ’ আয়োজনের জন্য প্রয়োজন হলে মৃতব্যক্তির সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করা হয়। মুসলমান বা হিন্দু উভয়ের মধ্যেই এ প্রথা চালু রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সমন্বয়ে বেশির ভাগ ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই ভোজন ও উপহার প্রদানের ব্যবস্থা থাকে। প্রত্যেক পরিবার প্রতিটি ধর্মীয় উপলক্ষ যথাযথভাবে পালনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদ বা পূজার ছুটির সময় গ্রামের বাইরে বা দূরদেশে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যরা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আনন্দোৎসবে যোগদানের জন্য সচেষ্ট থাকে। এভাবে তারা নিয়মমাফিক জীবনযাত্রার বাইরে এসে আনন্দ উপভোগ ও আত্মীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আচরণ প্রকাশের সুযোগ পায়।
বাঙালি আত্মীয়তা একটি ব্যাপক বর্ণনার বিষয়। শব্দটির অর্থ বহুমুখী এবং এর পরিসর অনাত্মীয় সামাজিক সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণে অনেক দূরের সম্পর্কের লোকদেরও আত্মীয়রূপে শ্রেণিকরণের একটি অবিরাম প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশের সমাজে প্রায় দু’শরও বেশি আত্মীয় সম্পর্কের পদশব্দ রয়েছে। সামান্য পার্থক্যবিশিষ্ট এসব সম্পর্কের বিশ্লেষণ অত্যন্ত কঠিন। তবে তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের রীতি বা শ্রেণিবিভাগ অনুসরণ তেমন কঠিন নয়।
জ্ঞাতিত্ব পদাবলী
নৃবিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানের গোড়াপত্তনের সময়কালের নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল “অনুন্নত” মানুষজনের সামাজিক আচরণ বুঝতে হলে জ্ঞাতিভিত্তিক সম্পর্ক বুঝতে হবে। তাঁদের মতে, প্রতিটি সমাজে জ্ঞাতিকুলকে বিশেষভাবে ভাগ বা শ্রেণীকরণ করা হয়; জ্ঞাতিপদ এই শ্রেণীকরণ ব্যবস্থা বুঝতে সাহায্য করে। এক বা একাধিক শব্দের সাহায্যে জ্ঞাতিপদ গঠিত, এই জ্ঞাতিপদ জ্ঞাতি অবস্থান বা মর্যাদার প্রতীক। একটি সমাজের সকল জ্ঞাতিপদ মিলে তৈরী হয় সেই সমাজের জ্ঞাতিভিত্তিক পদাবলী ব্যবস্থা ।
প্রাথমিককালের নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল: ঐতিহ্যবাহী সমাজে, মানুষজনের সামাজিক মর্যাদা পাশ্চাত্য মানুষজনের মত অর্জিত না, বরং জন্ম-সূত্রে আরোপিত। অপাশ্চাত্য সমাজের সামাজিক সংগঠনের মূলে রয়েছে জ্ঞাতিসম্পর্ক – এটা তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, জ্ঞাতিত্ব নির্ধারণ করে দিচ্ছে একজনের সামাজিক মর্যাদা, তার আত্মমর্যাদা বোধ, নির্ধারণ করে দিচ্ছে একজনের প্রতি অপরের কাঙ্ক্ষিত আচরণ, এবং অপরের প্রতি সেই মানুষটির আচরণবিধি। তাঁদের দৃষ্টিতে, পৃথিবীর “আদিম”, “বর্বর” (হাল-আমলের ভাষায়, “অনুন্নত”) সমাজে কি কি ভিত্তিতে জ্ঞাতি শ্রেণীকরণ করা হয়ে থাকে, সেটা অনুসন্ধান করা একান্ত জরুরী। তাঁরা বুঝতে চাইছিলেন জ্ঞাতি শ্রেণীকরণের মূলনীতি।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের এই প্রবল ধারার বিরুদ্ধে সমালোচনা তৈরী হয় ১৯৬০-এর দশক হতে। প্রধান সমালোচক ছিলেন এডমান্ড লীচ, ডেভিড স্লাইডার এবং রবিন ফক্স। লীচ বলেন, জ্ঞাতি-ভিত্তিক সম্পর্ককে নানাভাবে, বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা সম্ভব। কিন্তু এই শ্রেণী-বিভাজনের আদৌ কোন “সামাজিক গুরুত্ব” আছে কিনা তা অস্পষ্ট। নৃবিজ্ঞানীদের এই ধরনের ক্রিয়াকলাপ (জ্ঞাতি পদের শ্রেণীকরণ, জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে দুটি বিরুদ্ধ জ্ঞাতিব্যবস্থা চিহ্নিত করা, যেমন ধরুন, মাতৃসূত্রীয় এবং পিতৃসূত্রীয় সমাজ) সামাজিক কাঠামো বুঝতে সাহায্য করে না। এ ধরনের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নকে লীচ তুলনা করেন “প্রজাপতি” সংগ্রহের সাথে।
লীচের বক্তব্য ছিল, বিভিন্ন ধরনের প্রজাপতি সংগ্রহ করে সেগুলোকে নানাভাবে শ্রেণীকরণ করা সম্ভব (রং, আকার ইত্যাদি) কিন্তু এটি আমাদের প্রজাপতির গঠন বুঝতে বিন্দুমাত্র সহায়তা করে না। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নকারীরা বিষয়টিকে বিশ্লেষণের একটি পৃথক ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, এবং তাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয় না যে এই ক্ষেত্র অপরাপর ক্ষেত্র, যেমন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম – এগুলোর সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত।
এই জোরালো সমালোচনার পর থেকে, এবং বিশেষ করে ডেভিড শ্রাইভারের মার্কিনী জ্ঞাতিত্ব নিয়ে গবেষণা কাজটি প্রকাশিত হবার পর থেকে, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে বড়সড় রদবদল ঘটে। এই রদবদলকে বর্ণনা করা হয়েছে, “ভগ্নাংশ থেকে সামগ্রিক”এর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ হিসেবে। জ্ঞাতিত্বকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা হ’ল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরের অংশ হিসেবে (an aspect of more inclusive social and cultural domains”)| জ্ঞাতিত্বের এই পুনর্সংজ্ঞায়ন জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নকে পুনর্গঠিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
এই পাঠটি প্রজাপতি সংগ্রহ ঢং-এর জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের নমুনা। এতে আছে দুটি প্রধান অংশ। প্রথমত, জ্ঞাতি শ্রেণীকরণের মূলনীতির আলোচনা, এবং দ্বিতীয়ত, জ্ঞাতি পদাবলী ব্যবস্থার শ্রেণীকরণ। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের এই ঢং-এর সাথে আপনার পরিচিত ঘটানো এবং এর “সম্ভাব্য অর্থহীনতা”র সমালোচনাটি আপনার কাছে স্পষ্ট করা।
এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা না হলে সাম্প্রতিক জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ধারা বোঝা সম্ভব হবে না। তবে, এটা যোগ করা জরুরী যে, প্রজাপতি সংগ্রহ ঢং- এর আরো নমুনা সামনের পাঠগুলোতে পাবেন। এই ধারা এত দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত ছিল এবং এতই শক্তিশালী ছিল (এবং কিছু-কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং নৃবৈজ্ঞানিক মহলে, এখনও আছে) যে এটাকে বাদ দেয়া জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ইতিহাসকে অস্বীকার করার সামিল। উপরন্তু, এই ইতিহাস জানা জরুরী কারণ এই প্রেক্ষিত থেকেই সৃষ্ট হয়েছে নতুন ধারার কাজ ।
জ্ঞাতিত্ব পদাবলী অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্ব পদাবলী অধ্যায়ের সারাংশ – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, এই পাঠে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ‘প্রজাপতি সংগ্রহ’ পর্ব তুলে ধরা হয়েছে।
জ্ঞাতিত্ব পদাবলী অধ্যায়ের সারাংশ
তবে এই পর্বকে পিছনে ফেলে- আসা-পর্ব হিসেবে দেখলে, ভুল করা হবে। বহু বিশ্ববিদ্যালয় মহলে, বহু প্রকাশনায় এই ধারা অবিকৃত রূপে এখন পর্যন্ত চর্চিত হচ্ছে। এই ধারা সমালোচিত হওয়ার পিছনে প্রধান কারণ ছিল এটি জ্ঞাতিত্বকে দাঁড় করায় স্বতন্ত্র, এবং সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ক্ষেত্র হিসেবে। আগামী পাঠগুলোতে দেখবেন যে, নতুন এবং পুনর্গঠিত জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: জ্ঞাতিত্বের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্তপ্রবিষ্টতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা, সেটার অনুসন্ধান করা।
বংশধারা তত্ত্ব
আজকের আলোচনার বিষয় বংশধারা তত্ত্ব – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, নৃবিজ্ঞানের জন্মলগ্ন হতে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন ছিল নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। আপনারা ৩ নং পাঠে দেখেছেন কিভাবে মর্গান-অনুসরণে প্রাথমিক পর্যায়ের নৃবিজ্ঞান গুরুত্ব দিয়েছিল জ্ঞাতিত্ব পদাবলীর উপর।
মর্গানের প্রভাবের কারণে গত শতকের প্রথম দশকগুলোতে জ্ঞাতি অধ্যয়ন বলতে বোঝাত বিভিন্ন সমাজের জ্ঞাতি পদাবলীর তুলনামূলক আলোচনা। ম্যালিনোস্কি এবং কাঠামোগত ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীরা, এধরনের “জ্ঞাতি এলজেব্রা” থেকে সরে দাঁড়ালেন। একে জ্ঞাতি এলজেব্রা বলা হয়েছিল কারণ যুক্তিবিদ্যা বা logic-এর মতনই এগোচ্ছিল জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন – আনুষ্ঠানিক নিয়মনীতি, নানারকমের অর্থহীন শ্রেণীকরণ তৈরি ইত্যাদি।
ম্যালিনোস্কি এবং কাঠামোগত ক্রিয়াবাদীরা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নকে ঢেলে সাজালেন। তাঁরা গুরুত্ব আরোপ করলেন জ্ঞাতিত্বের সামাজিক প্রেক্ষিতের উপর। কোন্ সমাজে কোন্ জ্ঞাতি সম্পর্ক কোন্ ধরনের ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে – এই ছিল তাঁদের মনোযোগের জায়গা। জ্ঞাতিত্ব নিয়ে গবেষণা এবং তাত্ত্বিক লেখালেখির মাধ্যমে কাঠামোগত ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী হয়ে উঠল। এদের প্রধান অবদান বংশধারা বা গোষ্ঠী তত্ত্ব।
বংশধারা তত্ত্ব ১৯৪০ হতে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত বৃটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানে প্রভাব বিস্তার করে। একই সময়কালে এই তত্ত্ব মার্কিনী সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে প্রভাবশালী ছিল। এই তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ভাবনা এক দিকে ছিল ভূখন্ড এবং জ্ঞাতিত্বের সম্পর্ক নির্ণয়, অপর দিকে, পরিবার এবং অধিকতর বৃহত্তর সামাজিক একক যেমন ক্ল্যান, জেন এবং সিব – এদের আন্তঃসম্পর্ক উদ্ঘাটন।
বংশধারা তত্ত্ব বিবর্তনবাদ হতে জন্মলাভ করে। পরবর্তী পর্যায়ে, যখন মাঠকর্ম-ভিত্তিক গবেষণা এবং ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব শক্তিশালী হয়ে উঠে, তখন এই ভাবনা শক্ত-পোক্তভাবে নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে দানা বাঁধে যে সামাজিক সংগঠনের প্রধান একক হচ্ছে গোষ্ঠী। এবং আস্তে-আস্তে বিবর্তনবাদী ধারণা – যেমন গোষ্ঠী মনুষ্য প্রজাতির বিবর্তনের কোন পর্যায়ে উদ্ভাবিত হ’ল – গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে, সামাজিক সংগঠন হিসেবে গোষ্ঠী কিভাবে সামাজিক ভারসাম্য নিশ্চিত করে – এই ধরনের প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী র্যাডক্লিফ-ব্রাউন এবং আরো পরে মেয়ার ফোর্টস, ইভানস্-প্রিচার্ড প্রধানত আফ্রিকায় কাজ করেন এবং সেখানকার সমাজে করা গবেষণার সাহায্যে গোষ্ঠী তত্ত্ব তৈরী করেন। এই তত্ত্ব এতই শক্তিশালী ছিল যে এক সময় নৃবিজ্ঞানীদের মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সকল সমাজেই গোষ্ঠী কিংবা বংশ আছে, থাকতে বাধ্য। ফরাসী নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেডী-স্ট্রস’এর মৈত্রীবন্ধনতত্ত্ব পরে বংশধারা তত্ত্বকে ম্লান করে দেয়।
বংশধারা তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় বংশধারা তত্ত্ব অধ্যায়ের সারাংশ – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, বিংশ শতকের প্রথম দিকে চর্চিত “জ্ঞাতি এলজে” (যার নমুনা পেলেন এই ইউনিটের ৩ নম্বর পাঠে) থেকে নৃবিজ্ঞানীরা সরে এসেছেন।
সরে এসে তাঁরা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নকে কিভাবে ক্রিয়াবাদী পরিকাঠামোর সাহায্যে ঢেলে সাজালেন, এবং তার ফলে কি ধরনের তত্ত্ব দাঁড় করালেন – সেটাই ছিল এ পাঠের বিষয়বস্তু। নৃবিজ্ঞানে তাত্ত্বিক মোড় ঘোরানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হচ্ছে বংশধারা তত্ত্ব। বংশধারা তত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সামাজিক প্রেক্ষিতের উপর: জ্ঞাতিত্ব কোন্ সমাজে কি ধরনের কার্য সম্পাদন করে থাকে।
মনোযাগ দিয়ে ইরোকওয়া কেইস স্টাডি পড়লে বোঝা যায় ইরোকওয়া মিত্র সংঘের ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের জ্ঞাতিভিত্তিক সংগঠন: গৃহস্থালী/পরিব্যপ্ত পরিবার, বংশ, গোষ্ঠী, (উপ) জাতি, মিত্রসংঘ। প্রতিটি পর্যায়ের জ্ঞাতিভিত্তিক সংগঠনগুলো কেবলমাত্র সামাজিক ভূমিকা পালন করে না, এগুলো একইসাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকাও পালন করে থাকে। বংশধারা তাত্ত্বিকদের লেখালেখি পড়ে মনে হতে পারে যে পৃথিবীর সকল সমাজে, বংশীয় দল বিদ্যমান। বাস্তবে যে তা নয়, সেটি আগামী পাঠের বিষয়বস্তু। তাতে আলোচনা করা হবে মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব, যার আবির্ভাব বংশ ধারা তত্ত্বকে নান করে দেয় ।
আরও পড়ুন:
বংশধারা:
প্রজনন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরে সঞ্চালিত হওয়ার মাধ্যমে জীব তার নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে, একে বংশগতি (Heredity) বলে। বিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, কার্যপদ্ধতি ও তার বংশানুক্রমিক সঞ্চালন পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয় তাই জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স (Genetics)। আর জিন হলো বংশগতির মৌলিক একক যা বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে বংশধারা ধরে রাখে। অপরদিকে প্রকৃতিতে যে মন্থর ও ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অতীতে উদ্ভূত কোনো সরল জীব হতে জটিল ও উন্নত জীবের আবির্ভাব ঘটে তাকে বিবর্তন (Evolution) বলে। এখানে জিনতত্ত্ব ও বিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মেন্ডেলিজম ও মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelism and Mendelian Inheritance):
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি বংশগতির নীতিসমূহ উদ্ভাবনে সমর্থ হন। মেন্ডেল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই ২ তারিখ তৎকালীন অস্ট্রোহাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সাইলেসিয়া (Silesia) অঞ্চলের হাইজেনডর্ফ (Heinzendorf) বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অংশ) গ্রামের এক গরিব কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মান ও চেক শ্রি বংশোদ্ভুত পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
অতঃপর মেন্ডেল প্রধানত আর্থিক কারণে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার মোরাভিয়া অঞ্চলে ব্রন (Brun, বর্তমানে ব্রুনো: Brno; চেক প্রজাতন্ত্র) নামক স্থানের অগাস্টিনিয়ান মঠে শিক্ষানবীশ হিসেব যোগদান করেন। চার বৎসর পর তিনি যাজক হন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে স্নেম প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতঃপর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৮৫৩ পর্যন্ত পড়াশোনা করে ব্রুনে ফিরে আসেন। ব্রুনে মডার্ন স্কুলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১২ বৎসর একজন সার্থক শিক্ষক হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ সাত বৎসর গবেষণা করেন।
জোহান গ্রেগর মেন্ডেল স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় মঠের বাগানে অবসর সময়ে মটরশুঁটি উদ্ভিদ নিয়ে ১৮৫৭ থেকে গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, মটরশুঁটির বৈজ্ঞানিক নাম— Pisum sativum (পিসাম স্যাভিটাম)। সঙ্করায়ণ (Hybridization) পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি উদ্ভিদকে নির্বাচন করেন। মটরশুঁটি উদ্ভিদ উভলিঙ্গী, স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন হয়। পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সজ্জিত যে, পরনিষেকের (Cross fertilization) কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে বিভিন্ন জাতের (Variety) মটরশুঁটি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ অবস্থায় আছে। অত্যন্ত অল্প সময়ে এর জীবনচক্র সম্পন্ন হয় এবং স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে অধিক সংখ্যক অপত্য বংশ উৎপন্ন হয়। অপত্য বংশে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট প্রকাশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।
মেন্ডেল বিভিন্ন উৎস হতে ৩৪ ধরনের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করে আশ্রমের বাগানে প্রায় এক বৎসর প্রত্যেক ধরনের বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পরীক্ষায় ব্যবহৃত সাতটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, ফুলের রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) একজোড়া করে বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ১৪টি খাঁটি উদ্ভিদ নির্বাচন করেন। প্রতি জোড়া বৈশিষ্ট্য পরস্পর বিপরীতধর্মী।
মটরশুঁটি উদ্ভিদের নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যের প্রতিটি একটি মাত্র জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বৈশিষ্ট্য নির্বাচনের বিষয়ে মেন্ডেল অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলেন। কারণ জটিল বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করলে মেন্ডেল বংশগতির অন্তর্নিহিত নীতিগুলো হয়তোবা আবিষ্কার করতে পারতেন না।
জোহান গ্রেগর মেন্ডেল একটি যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সঙ্করায়ন পরীক্ষা পরিচালনা করেন। অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরীক্ষণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তিনি যে পরাগরেণু স্থানান্তর করেছেন তার দ্বারাই পরাগায়ন হয়েছে তা নিশ্চিত করেন। সঙ্করায়নকালে মেন্ডেল অপত্য অংশে একসাথে মাত্র একটি চরিত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং সম্পূর্ণ উপাত্ত (data) সংরক্ষণ করেন। অতঃপর পরিসংখ্যান (statistics) এর প্রয়োগ দ্বারা এ উপাত্ত থেকেই লব্ধ ফলাফলের যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণপূর্বক এবং একটানা প্রায় এক দশকের নিরলস পরিশ্রম দ্বারা বংশগতির নিয়ম সম্পর্কে পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) উপস্থাপন করেন।
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সঙ্করায়ন ও বংশগতি সম্বন্ধে তাঁর গবেষণার বিবরণ ও ফলাফল ব্রুন ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির পরপর দুটি বৈজ্ঞানিক সভায় উপস্থাপন করেন। সোসাইটির বার্ষিক মুখপত্রেও গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় তৎকালীন বিশ্বে কেউই ধর্মযাজক মেন্ডেল এর গবেষণা ফলাফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেননি। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেন্ডেল মঠাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ৬ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবদ্দশায় তাঁর গবেষণা কর্মের জন্য তিনি কোনো স্বীকৃতি লাভ করেননি।
মেন্ডেলের গবেষণাপত্র প্রকাশের ৩৫ বৎসর পর বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই হল্যান্ডের ডি ভ্রিস (de Vries), জার্মানির কার্ল করেন্স (Karl Correns) ও অস্ট্রিয়ার শেরমাক (Tschermak) পৃথক পৃথকভাবে গবেষণা করে মেন্ডেল এর ফলাফলকে সমর্থন করেন। বর্তমানে বিশ্বে মেন্ডেল এর আবিষ্কার অর্থাৎ পার্টিকুলেট থিওরি (Particulate Theory) একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পার্টিকুলেট থিওরিতে বর্ণিত সুত্রগুলো জেনেটিক্সে মেন্ডেলের সূত্র (Mendel’s Law) নামে অভিহিত। মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী জীবের বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশগতিতে সঞ্চারণের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তাকেই মেন্ডেলতত্ত্ব Mendelism) বলে। মেন্ডেলতত্ত্ব আধুনিক জেনেটিক্স এর প্রধান ভিত্তি। এ কারণেই মেন্ডেলকে জেনেটিক্স এর জনক বলা হয়ে থাকে।
পার্টিকুলেট থিওরী (Particulate Theory) বা মেন্ডেলতত্ত্ব (Mendelism) অনুযায়ী জীবে বংশগতির একক বিদ্যমান থাকে বা মিশ্রিত হয়না, শুধুমাত্র সুপ্ত থাকে। মেন্ডেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মটরশুঁটি উদ্ভিদে প্রতিটি চরিত্রের (trait) জন্য (কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি) এক জোড়া ফ্যাক্টর থাকে, যার একটি আসে পিতা থেকে এবং অপর একটি আসে মাতা থেকে। গ্যামিটে শুধু একটি একক উপস্থিত থাকে এবং পরবর্তী জনুতে সঞ্চারিত হয়। মেন্ডেল বর্ণিত পার্টিকল বা ফ্যাক্টর অবশ্যই জিন। আর একটি মাত্র জিন দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্য মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্য (Mendelian trait) বলে এবং মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্যর সঞ্চায়ণকে মেন্ডেলিয়ান বংশগতি (Mendelian inheritance) বলা হয়।
মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব
আজকের আলোচনার বিষয় মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানী লেভি-স্ট্রসের নামের সাথে মৈত্রী-বন্ধন তত্ত্ব সবচাইতে বেশি যুক্ত। লেভি-স্ট্রস তাঁর তত্ত্বে, বংশধারার পরিবর্তে মৈত্রীবন্ধনের কাঠামোগত এবং সাংগঠনিক দিকের উপর জোর দিয়েছেন ।
দ্য এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারস অফ কিনশিপ (১৯৬৯) বইয়ে তিনি মৈত্রী-বন্ধন তত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন। বংশধারা তাত্ত্বিকেরা প্রধানত একটি বিষয় নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন: কি উপায়ে প্রাক-রাষ্ট্রীয় সমাজ টিকে থাকে এবং কিভাবে নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থা ঠেকানো হয়। এই তত্ত্ব-অনুসারে, বংশধারা দল আদিম মানুষজনের মাঝে স্থিতিশীলতা তৈরি করে।
এই তত্ত্ব প্রথম দাঁড় করান বৃটেনের নৃবিজ্ঞানী যাঁরা কাজ করেছেন আফ্রিকার কিছু, যাকে বলা হয়, অ-রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রবিহীন সমাজ নিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে এই তত্ত্ব বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় আমদানি করা হয়। উল্লেখ করা জরুরী, নতুন স্থানে এই তত্ত্ব খুব বেশি ভালো কাজ করেনি।
সাম্প্রতিক কালের নৃবিজ্ঞানীদের মতে, স্থিতিশীলতার বিষয়টি বিভিন্নভাবে বারে- বারে ঔপনিবেশিক সময়কালে নৃবিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই প্রসঙ্গটি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বংশধারা তত্ত্ব যখন জ্ঞাতি তত্ত্বের শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত সে সময়ে লেভি-স্ট্রসের মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব (alliance theory) প্রকাশ পায় ।
মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব সারাংশ:
আজকের আলোচনার বিষয় মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব সারাংশ – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, “জ্ঞাতি বীজগণিত”-এর স্থলে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে, বংশধারা তত্ত্ব জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে কেন্দ্রীয় জায়গা দখল করে নেয়। বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত এই তত্ত্ব ছিল অপরিবর্তিত। লেভি-স্ট্রসের মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব বংশধারা তত্ত্বের গুরুত্বকে লাঘব করে দেয়।
বংশধারা তত্ত্বের কারণে বংশ, গোষ্ঠী এবং জৈবিক সূত্রিতার বিষয়গুলি জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের কেন্দ্রে ছিল। লেভি-স্টসের তাত্ত্বিক উদ্ভাবনের কারণে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের কেন্দ্রে চলে আসে মৈত্রী স্থাপনের বিষয়টি। বংশধারা তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে তিনি বলেন, আদিম সমাজ বংশভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় না।
বরং, এ সমাজগুলো সংরক্ষিত হয় বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে। অজাচার, বিবাহের নিষেধাজ্ঞা, যৌন নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে যে ধ্যান-ধারণা নৃবৈজ্ঞানিক মহলে প্রচলিত, লেভি-স্ট্রস সেগুলোকে প্রত্যাখান করেন । লেভি-স্টুসের পূর্বে নৃবিজ্ঞানীরা এগুলোকে নেতিবাচক রীতিনীতি (“নিষেধাজ্ঞা”) হিসেবে দেখতেন।
দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি লেভি-সি উল্টে দেন। তাঁর চিন্তা যে বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক গুরুত্ব আরোপ করে তা হ’ল: বিয়ের সম্পর্ক (এবং সামাজিক সম্পর্ক) বুঝতে হলে কোন্ কোন্ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ – এভাবে না দেখে সামাজিক রীতি-নীতিগুলো কি হাসিল করতে চাচ্ছে – সেভাবে দেখা আরো কাজের। বিয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণে তিনি গোত্রের আনুষ্ঠানিক নিয়মাবলীর চাইতে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন বিনিময় এবং পারস্পরিকতার উপর।