সামাজিক কেন্দ্র পুনর্বণ্টন

আজকের আলোচনার বিষয় সামাজিক কেন্দ্র পুনর্বণ্টন – যা  বিনিময় এবং বণ্টন এর অর্ন্তভুক্ত,  যখন দ্রব্যাদি কোন একটা কেন্দ্রীয় জায়গায় প্রথমে জড়ো করা হয় এবং পরে আবার বণ্টন করা হয় তাকে পুনর্বণ্টন বলে । এভাবে পুনর্বণ্টন একটা “সামাজিক কেন্দ্র” ঘিরে গড়ে ওঠে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, যে সকল সমাজে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে চীফ (chief) বা বিগমেন (bigmen) থাকে সেখানে এ ধরনের বণ্টন রীতি প্রচলিত। প্রধান বা রাজা কয়েকটা পদ্ধতিতে সম্পদ জড়ো করে থাকেন। যেমন: উপহার হিসেবে, কর বা খাজনা হিসেবে, যুদ্ধক্ষেত্রের অবশিষ্ট হিসেবে ইত্যাদি।

এই সম্পদই আবার পুনর্বণ্টন করা হয়ে থাকে। পুনরায় বণ্টন করার প্রক্রিয়া নানান ভাবে হতে পারে। কখনো কখনো দ্রব্যাদি প্রত্যক্ষভাবে সমাজের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। কখনো আবার ভোজসভার আকারে এই সম্পদ পুনর্বণ্টিত হয়। সম্পদ পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধান বা রাজার কয়েকটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে। প্রথমত, সম্পদ বিতরণের এই ভূমিকায় গিয়ে সমাজে তাঁর মর্যাদা সমুন্নত রাখা। এখানে দান-ধ্যান মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রতি সমর্থন আছে এমন মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা জীবন যাপন মান নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, নিজ এলাকার বাইরে মৈত্রী স্থাপন করা। নিউ গিনির উদ্যান-কৃষিভিত্তিক সমাজে অতিথিদের শূকরের মাংস দিয়ে ভোজ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

সামাজিক কেন্দ্র পুনর্বণ্টন

 

সামাজিক কেন্দ্র পুনর্বণ্টন

 

কর সংগ্রহ এবং তারপর এর ব্যবহার পুনর্বণ্টনের একটা নমুনা। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে পেরুর ইংকা সাম্রাজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়। অনেকের মতে আধুনিক রাষ্ট্রের কর বা খাজনা সংগ্রহকেও এ ধরনের বণ্টন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে দেখা যায়। পুনর্বণ্টনের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ হচ্ছে কোয়াকিউল সমাজের পটল্যাচ প্রথা ।

পটল্যাচ: উত্তর আমেরিকার উত্তরপশ্চিম উপকূলে কোয়াকিউল ইন্ডিয়ানদের মধ্যে পটল্যাচ প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন কিছু নৃবিজ্ঞানী। এই প্রথাকে পুনর্বণ্টন ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কোয়াকিউল ছাড়া অন্যান্য জাতির মধ্যেও এই প্রথার কাছাকাছি কিছু ব্যাপার জানা গেছে। কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উদ্যাপনের ক্ষেত্রে পটল্যাচ হচ্ছে বহুল চর্চিত গণ-উৎসব। সাধারণভাবে পটল্যাচ হচ্ছে একটা ভোজসভা যেখানে খাওয়ানো ছাড়াও মেজবান (যিনি দাওয়াত দিয়ে থাকেন) অতিথিদেরকে নানান ধরনের উপহার দিয়ে থাকেন।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নৃবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের আয়োজনে দাওয়াত দিয়ে থাকেন চীফ বা প্রধানেরা। তাঁর অতিথিরা একই গ্রাম বা এলাকার অন্যান্য বাসিন্দারা এবং অন্যান্য গ্রাম বা এলাকার প্রধানেরা। সকলকেই তিনি উপহার দিয়ে থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা এও উল্লেখ করেছেন, অতিথিরা তাঁদের নিজ নিজ সামাজিক মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপহার পেতেন। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। তা হ’ল: কোয়াকিউল সমাজে টাকা-পয়সা বা ধন-সম্পত্তি মর্যাদার ভিত্তি নয়। বরং, পটল্যাচ উৎসব আয়োজন করাই হয় কোন একজনের ধন-সম্পদ কমাবার স্বার্থে। অর্থাৎ, যাতে তাঁর ধন-সম্পদ বেশি জমে না থাকে সেই উদ্দেশ্যে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে এ ধরনের আয়োজন হ’ত।

জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে কিংবা সাবালকত্ব লাভ – ইত্যাদি উপলক্ষ্যে পটল্যাচ উৎসব হ’ত। উৎসব স্থানে খাওয়ানো ছাড়াও খাবার বিলি করা হ’ত। অতিথিদের যে সকল উপহার দেয়া হ’ত তার মধ্যে রয়েছে কম্বল, কাঠের বাক্স, নৌকা, মাছের তেল, ছাতু ইত্যাদি। বিপুল পরিমাণ সম্পদ খরচ করাই এই উৎসবের মূল বৈশিষ্ট্য।

 

সামাজিক কেন্দ্র পুনর্বণ্টন

 

এখানে মেজবানের মহত্ব কিংবা ইজ্জতও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর এই আতিথেয়তার কারণে সম্মান লাভ করেন। কিন্তু মূল চেতনাটি আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে। তা হচ্ছে, কোনমতেই সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা সেই সমাজে কাম্য নয়। এই উৎসব নিয়ে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানীদের আগ্রহের কারণ বুঝতেই পারছেন। সমাজের সম্পদের বণ্টন করবার জন্য এই উৎসব বিশাল ভূমিকা রাখে ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment