বিবাহ কেবলমাত্র দুটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়; বহু সমাজে এটি বৃহত্তর আত্মীয়তার নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সামাজিক কাঠামোর সাথে গভীরভাবে যুক্ত। এর মধ্যে স্বামীর ভাই বিবাহ (Levirate Marriage) এবং শ্যালিকা বিবাহ (Sororate Marriage) দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথাগত বিবাহরীতি, যা বিশ্বের বহু সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান।
স্বামীর ভাই ও শ্যালিকা বিবাহ
স্বামীর ভাই বিবাহ (Levirate)
স্বামীর ভাই বিবাহে, স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর ভাইয়ের সাথে বিবাহ দেওয়া হয়।
- উদ্দেশ্য: সাধারণত এই রীতি চালু থাকে মৃত স্বামীর পরিবার বা গোত্রের মধ্যে সম্পত্তি, উত্তরাধিকার এবং সন্তানদের অভিভাবকত্ব বজায় রাখার জন্য।
- দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট: আমাদের গ্রামীণ অঞ্চলে বিশেষত দেবরের সাথে বিধবার বিবাহের প্রথা এখনও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যদিও আইনগত ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণে এটি ক্রমশ কমে আসছে।
- আফ্রিকার উদাহরণ: নুয়ের (Nuer) সমাজে মৃত স্বামীর আপন ভাই বিধবাকে বিবাহ করতে পারেন। যদি মৃত স্বামীর ঔরসজাত কোনো সন্তান না থাকে, তবে এই পুনর্বিবাহ থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানদের আইনত মৃত স্বামীর সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
নৃবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
কিছু নৃবিজ্ঞানীর মতে, এই প্রথা পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর অংশ, যেখানে বিবাহের পর স্ত্রী শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি বা গোত্রের স্থায়ী সদস্য হয়ে যান। তবে, এই ব্যাখ্যা সর্বজনগ্রাহ্য নয়—
- অনেক পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই রীতি অনুপস্থিত।
- আবার এমন কিছু মাতৃতান্ত্রিক বা সমতাভিত্তিক সমাজেও এই রীতি দেখা যায়, যেখানে একে পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে সরাসরি যুক্ত করা যায় না।
শ্যালিকা বিবাহ (Sororate)
শ্যালিকা বিবাহে, স্ত্রী মারা গেলে তার স্বামী নিজের শ্যালিকাকে (স্ত্রীর বোন) বিবাহ করেন, অথবা সেই অধিকার রাখেন।
- উদ্দেশ্য: স্ত্রী মারা গেলে সন্তানদের মাতৃপরিচর্যা একই পরিবারের ভেতরে বজায় রাখা, এবং দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা।
- বৈচিত্র্য: কিছু সমাজে স্ত্রী জীবিত থাকলেও শ্যালিকা বিবাহ হতে পারে, বিশেষত স্ত্রী যদি নিঃসন্তান হন বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হন।
- সন্তান স্বীকৃতি: বহু সংস্কৃতিতে শ্যালিকার গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানদের প্রথম স্ত্রীর সন্তান হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক তাৎপর্য
স্বামীর ভাই বিবাহ ও শ্যালিকা বিবাহ উভয়ই প্রমাণ করে যে বহু অ-পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহ কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং দুটি আত্মীয়গোষ্ঠী, জ্ঞাতিকুল বা গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি।
- অ-পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি: এখানে বিবাহের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক জোট ও সম্পদ সংরক্ষণ, যা গোত্রের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
- পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি: বিবাহকে মূলত দুজন ব্যক্তির আবেগিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিসেবে দেখা হয়।
বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট ও তুলনা
- ইহুদি আইন: প্রাচীন হিব্রু সমাজে Levirate বিবাহ ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল (তওরাতে এর উল্লেখ আছে)।
- নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতি: বহু উপজাতি Sororate বিবাহ পালন করত, যাতে দুই গোত্রের মধ্যে মৈত্রী বজায় থাকে।
- মঙ্গোল ও তুর্কি সমাজ: যাযাবর জীবনে সম্পত্তি ও পশুপালন সংরক্ষণের জন্য লিভিরেট প্রচলিত ছিল।
- আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চল: কেনিয়া ও তানজানিয়ার কিছু উপজাতিতে আজও উভয় প্রথা সীমিত আকারে প্রচলিত।
এই দুই প্রথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বিবাহের রীতি ও অর্থ সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। যেখানে আধুনিক নগরায়িত সমাজে বিবাহ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়, সেখানে ঐতিহ্যবাহী সমাজে এটি ছিল পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্পর্ক রক্ষা, উত্তরাধিকার সুরক্ষা এবং গোষ্ঠীগত ঐক্য বজায় রাখা।