আজকের আলোচনার বিষয় ৯৮ এর ভূমিহীন আন্দোলন – যা বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন এর অর্ন্তভুক্ত, আগের আন্দোলনটা যেমন প্রধানত বর্গাচাষীদের দ্বারা পরিচালিত একটা আন্দোলন ছিল, এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা। এটা সাতক্ষীরা অঞ্চলে সংঘটিত আন্দোলন। গত এক দেড় দশকে উপকূলীয় দক্ষিণ অঞ্চলে চিংড়ি চাষ করবার প্রবণতা বাড়ে।
৯৮ এর ভূমিহীন আন্দোলন
এই চাষ করে ধনী ব্যবসায়ীরা আরো মুনাফা পেতে পারে। কারণ বিদেশে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা আছে। চিংড়ি চাষের জন্য সাধারণত নিচু জমি বেছে নিতে হয় যেখানে ধান জন্মে। অনেক এলাকাতে বেশ কিছু জমি চিংড়ি ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত মনে করেছে যেগুলো আবার খাস জমি হিসেবে ভূমিহীনদের দেয়া হয়েছিল।
এ সকল জমি দখল করবার জন্য নানা রকম জোর জবরদস্তি, আইনী ফন্দি বের করেছিল চিংড়ি ব্যবসায়ীগণ। সাতক্ষীরাতে এভাবে প্রচুর জমি দখল করতে গেছে ব্যবসায়ীরা। যে সকল ভূমিহীনরা সেই জমি ব্যবহার করছিলেন তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এখানেও সম্মুখ সারিতে নারীরা ছিলেন। এই আন্দোলন দমন করবার জন্যও পুলিশ ও ভাড়াটিয়া অস্ত্রধারীদের ব্যবহার করা হয়।
পত্র-পত্রিকায় জাহেদা নামের একজন নারীর মৃত্যুর খবর আসে। তিনি মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। ব্যাপক নির্যাতনের খবর তেমন ভাবে জানতে পারেননি মানুষজন। বেশ কয়েকজন শিশুকেও হত্যা করা হয় তখন। কৃষকদের আন্দোলন একটা চলমান বিষয়। কেবল গুটিকতক আন্দোলনের খবর আমরা জানতে পাই । কিন্তু নিরন্তর নিপীড়িত দশা থেকে মুক্তির জন্য কৃষকেরা নিত্যদিন লড়াই করে চলেছেন মালিক এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে |
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ২১ বছরেও কার্যকর হয়নি:
১ নভেম্বর ২০১৯, এর জনকন্ঠ লিখেছে:
সাতক্ষীরায় খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দীর্ঘ একুশ বছরেও সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। অবমুক্ত হওয়া ১১৯১.৭৯ একর জমি বিতরণ করা হয়েছে ভূমিহীনদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সাতক্ষীরার ১৩শ’ ৬৪ ভূমিহীন পরিবারকে দেয়া হয়েছে খাসজমির স্থায়ী দলিল। দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার নোড়র চারকুনি আবাদ বিশেষ চিংড়ি চাষযোগ্য জলমহালের ৪৩৯ দশমিক ০৬ একর খাসজমি এখনও জলমহাল থেকে অবমুক্ত করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তরিত করা হয়নি। এখানে বসবাসরত ৫শ’ ৩ ভূমিহীন পরিবার এই জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে।
ওই ভূমিহীনদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদনের পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার ভূমিকে দখলদার ভূমিহীনদের অবস্থান চিহ্নিত করে রঙ্গিন নক্সা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামালের পাঠানো রিপোর্টে নোড়ার চারকুনি আবাদের ৪৩৯ দশমিক ০৬ একর বিশেষ চাষযোগ্য ঘের জলমহালের তালিকা থেকে অবমুক্তির প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জে হাজার হাজার বিঘা সরকারী খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বিতরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন ’৯৮ সালে। দীর্ঘ ২১ বছরেও প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ সম্পূর্ণভাবে কার্যকর না হওয়ায় সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় বসবাসরত ভূমিহীনদের মাঝে রয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও খাসজমি ‘অবমুক্ত’ করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তর করা না করায় সমস্যা রয়ে গেছে।
পিও/৭২-এর বলে সরকার সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলার ঢেপুখালিপূর্ব, ঢেপুখালি পশ্চিম, কাঠমহল, কামিনীবসু, কালাবাড়িয়া-১, কালাবড়িয়া-২, নোড়ার চারকুনি, ঝায়ামারী, ভাঙ্গানমারী ও বাবুরাবাদ এলাকায় ৩ হাজার, ১শ’ ৭৮ একর জমি অধিগ্রহণ করে খাস ঘোষণা করে। ১৯৮২ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ পৃথক দুটি রায়ে এই জমি ‘কৃষি খাসজমি’ হিসেবে সরকারের ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত করে তা ভূমিহীনদের মাঝে সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার আদেশ দেয়া হয়।
খাস জমির অধিকার নিয়ে ’৯৮ সালে সাতক্ষীরার দেবহাটা কালীগঞ্জে গড়ে ওঠে ভূমিহীনদের আন্দোলন। সে সময় প্রশাসন ও ভূমিদস্যুদের নির্যাতনে ও পুলিশের গুলিতে ভূমিহীন জায়েদা নিহত হওয়ার পর উত্তাল হয়ে ওঠে সাতক্ষীরা। খাসজমি পাওয়ার এই অধিকারের প্রতি দেশজুড়ে সমর্থন মেলে। ভূমিহীনদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সে সময়ে বিরোধীদলসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানরা সাতক্ষীরায় এসে জনসভা করে ভূমিহীনদের আন্দেলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। উত্তাল সাতক্ষীরাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালীগঞ্জে এসে জনসভায় খাসজমিতে বসবাসরত সকল ভূমিহীনের জমি প্রদানের ঘোষণা দেন। এ ছাড়া চিংড়ি ঘের হিসেবে ব্যবহৃত খাসজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে কৃষি খাসজমিতে রূপান্তরিত করে স্থানীয় ভূমিহীনদের মাঝে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের ঘোষণা দেন।
’৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কালীগঞ্জে ৭শ’ ৩১ একর জমি, দেবহাটায় ৪শ’ ২৬ একর জমি এবং দেবহাটা কালীগঞ্জের নোড়ার চারকুনি এলাকায় ৪শ’ ৯২ একর জমি অবমুক্ত করা হয়। এদিকে নোড়ার চারকুনিতে বসবাসরত ৫শ’ তিনজন ভূমিহীন পরিবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় দিন গুনছে গত ২১ বছর ধরে। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই জনপদে বসবাসরত ভূমিহীনদের দখলে থাকা ৪শ’ ৩৯ দশমিক ০৬ একর জমি বিশেষ জলমহাল থেকে অবমুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাতক্ষীরার দেবহাটা-কালীগঞ্জের জনপদে বসবাসরত ভূমিহীনদের দাবি, অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকর করতে অবশিষ্ট ৪শ’ ৩৯ দশমিক ০৬ একর খাসজমি শ্রেণী পরিবর্তন করে অবমুক্ত করে ভূমিহীনদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হোক।
আরও দেখুনঃ