নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী

আজ আলাপ হবে নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী বা সারাংশ-নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে। এই পাঠটি “নৃবিজ্ঞান পরিচিতি” বিষয়ের একটি পাঠ।  বিগত আর্টিকেলে আমরা নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করেছি।

নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

 

নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী:

বিভিন্ন নামে অভিহিত নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ধারার মধ্যে সাধারণভাবে কিছু অভিন্ন যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। এগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ধারণার ব্যবহার, সংগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, মাঠকর্ম ওতুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এসব মিল নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়ি্ক ক্ষেত্রগুলোকে একত্রে একটি সমন্বিত ও স্বাতন্ত্যমন্ডিত জ্ঞানকান্ড হিসাবে পরিচিতি দিয়েছে। এছাড়া অনেক জায়গায়, বিশেষ করে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, নৃবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নৃবিজ্ঞানের একাধিক শাখার উপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।

ফলে এখনো অনেক নৃবিজ্ঞানীই তাদের গবেষণা ও লেখালেখিতে এক ধরনের সমন্থিত ‘নৃবৈজ্ঞানিক” দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণের চেষ্টা করেন। নীচে একটি সমন্বিত জ্ঞানকান্ড হিসাবে নৃবিজ্ঞানের উল্লিখিত প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হল।

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

সংস্কৃতির ধারণার তাৎপর্য :

নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতেই “সংস্কৃতি’ একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হিসাবে ব্যবহৃতহয়। শুধু সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে নয়, দৈহিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান ও ভাষাতাত্তিক নৃবিজ্ঞানেও সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয়।

প্রচলিত অর্থে সংস্কৃতি বলতে যা বোঝাত–নৃত্য, সগীত ইত্যাদি–নৃবিজ্ঞানীরা তার থেকে ভিন্ন ও ব্যাপকতর অর্থে শব্দটি ব্যবহার শুরু করেছিলেন বেশ আগে। উনবিংশ শতান্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টায়লর সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে: সংস্কৃতি হচ্ছে সেই জটিল সমগ্র, যার আওতায় পড়ে জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নৈতিকতা, আইন, প্রথা এবং অন্য যে কোন কর্মদক্ষতা ও অভ্যাস যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জন করে”। টায়লর পরে অন্য নৃবিজ্ঞানীরা মিলে সংস্কৃতির শতাধিক সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তাদের কাছে এই ধারণা কতটা গুরুত্তপূর্ণ।

নৃবিজ্ঞানে সংস্কৃতির ধারণার দুই ধরনের তাৎপর্য রয়েছে। একদিকে একটি প্রজাতি হিসাবে জীবজগতে মানুষের অনন্যতা বোঝানোর জন্য সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয়: নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রাণীজগতে একমাত্র মানুষেরই রয়েছে সংস্কৃতি ধারণ করার ক্ষমতা, এবং এই সাধারণ অর্থে মানুষ মাত্রই সংস্কৃতিসম্পন্ন (এই সাধারণ অর্থে ইংরেজীতে সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয় একবচনে, যা অনেক সময় বড় হাতের C দিয়ে লেখা হয়: Culture) ।

অন্যদিকে বিভিন্ন মানব সমাজের ভিন্নতার সূচক হিসাবেও সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয়: প্রতিটা সমাজেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু রীতি-নীতি, আচার-প্রথা ইত্যাদি, অর্থাৎ সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট নিজস্ব রূপ। কাজেই সমাজ ভেদে সংস্কৃতিরও ভিন্নতা দেখা যায় (এই অর্থে ইংরেজীতে সংস্কৃতির ধারণা ব্যবহার করা হয় বহুবচনে, যা লেখা হয় ছোট হাতের c দিয়ে: cultures) |

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

সমগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গী:

নৃবিজ্ঞানের কোন একটি বিশেষায়িত ধারায় মানব জীবনের নির্দিষ্ট কোন দিক অধ্যয়নের উপর নজর দেওয়া হলেও সাধারণত তা বিচ্ছিন্নভাবে করা হয় না, বরং মানব জীবনের একটা দিক কিভাবে অন্যান্য দিকগুলোর  সাথে সম্পর্কিত, তাও দেখার চেষ্টা করা হয়। কাজেই বলা হয় যে, নৃবিজ্ঞানীরা সমগ্রবাদী বা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গী (holistic perspective) অনুসরণের চেষ্টা করেন, অর্থাৎ তারা মানুষ ও তার সংস্কৃতি বা সমাজের কোন অংশকে খন্ডিতভাবে না দেখে সমগ্রের আলোকে সেটাকে অনুধাবনের চেষ্টা করেন।

মাঠকর্ম:

এতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন শাখার নৃবিজ্ঞানেই মাঠকর্ম অর্থাৎ প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপার্ত সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন, দৈহিক নৃবিজ্ঞানীরা মানব জীবাশ্খের সন্ধানে বা প্রাণীজগতে মানুষের নিকটতম প্রজাতিদের সামাজিক আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য মাঠকর্ম সম্পাদন করেন। প্রত্নতাত্তিক নৃবিজ্ঞানীরা খননকার্ষের মাধ্যমে অতীতের কোন জনপদের সন্ধান পেলে সেখান থেকে বিস্তারিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এক একটা সমাজের বিস্তারিত বিবরণ তৈরী করেন।

এভাবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিটা শাখাতেই ক্ষুদ্র পরিসরে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হয়।

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী:

নৃবিজ্ঞানের সকল শাখাতেই বিভিন্ন কালের ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত উপাত্তসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন করা হয়। বিভিন্ন কালের ও বিভিন্ন স্থানের মানুষদের জৈবিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেন কি কি বৈশিষ্ট্য সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এবং কি কি বৈশিষ্ট্য শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডের মধ্যে একমাত্র নৃবিজ্ঞানেই দেখা যায় স্থান ও কালের দিক থেকে মানব বৈচিত্রের সমগ্র পরিধিকে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ কোন আলোচ্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করার প্রচেষ্টা।

উপরের আলোচনায় নৃবিজ্ঞানের সনাতনী বৈশিষ্ট্যসমূহের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানে একথাও যোগ করা দরকার যে, নৃবিজ্ঞানকে মানব বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান বলার রেওয়াজ থাকলেও বাস্তবে অবশ্য প্রায় কোন নৃবিজ্ঞানীকেই বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এর সকল শাখায় সমান জ্ঞান বা আগ্রহ নিয়ে বিচরণ করেন। অতীতে যখন নৃবিজ্ঞানীদের নজর কেন্দ্রীভূত ছিল

তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠীসমূহের প্রতি, তখন হয়ত একই নৃবিজ্ঞানী নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে একাধারে তাদের প্রাক-ইতিহাস থেকে শুরু করে ভাষা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি অধ্যয়ন করতেন।

তবে এ ধরনের উদাহরণ বর্তমানে বিরল। অতীতে আদিম বলে বিবেচিত বিভিন্ন সমাজ অধ্যয়নের ব্যাপারে আগ্রহের ব্যাপকতা নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে যতটা সমন্বিত রাখতে সহায়তা করেছিল, বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। কাজেই সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কিছুটা দূরতু বিরাজ করছে, যে কারণে ‘নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী বলে অভিন্ন কোন কিছু আছে, এ ব্যাপারে সকল নৃবৈজ্ঞানি হয়ত সহজে একমত হবেন না।

সারাংশ:

নৃবিজ্ঞান” হল ইংরেজী ‘ এ্যান্থোপলজি’-র (anthropology) বাংলা এতিশব্দ। খযান্থো পলজি কথাটির মূলে রয়েছে একটি গ্রীক শব্দ * এ্যান্থোপস” (anthropos), যার অর্থ মানুষ। সংস্কৃত শব্দ ‘নৃ” মানেও তাই। কাজেই নৃবিজ্ঞান’ কথাটির অর্থ দাঁড়ায় ‘মানব বিষয়ক বিজ্ঞান” ॥

মানব বিষয়ক অন্যান্য বিজ্ঞানের তুলনায় এর বিষয়বস্তু ব্যাপকতর পরিধিসম্প্ন ও অধিকতর বেচিত্রাপূর্ণ। সম কালীন প্রেক্ষাপটে হাবিজ্ঞান হচ্ছে বিভিন্ন উপবিভাগ সঙ্চলিত এমন একটি ভ্ঞানকান্ড যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানুষ’কে অধ্যয়ন করে। নৃবিজ্ঞানে একাধারে মানব সভার জৈবিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা কর! হয়।

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

একটি প্রজাতিহিসেবে মানুষের উৎপতি ও ব্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে শুরু করে অতীত ও বতর্মানকালের বিভিন্ন ধরনের মানব সমাজের সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতির সাদৃশ; ও বৈসাদৃশ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন হৃবিজ্ঞানে কর] হয়।

বিষয়-বৈচিত্যের দিক থেকে বিশাল পরিধির অধিকারী জ্ঞানকান্ডের স্বভাবতই রয়েছে বিভিন্ন উপবিভাগ ও বিশেষায়িত ক্ষেব্র। মাকিনি ধারার হৃবিজ্ঞানে সচরাচর চারটি প্রধান উপবিভাগ চিহিত করা হয়, এগুলি হল, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, প্রতেতাততিক নৃবিজ্ঞান, ভাষাতাতিক নৃবিজ্ঞান ও দৈহিক নৃবিজ্ঞান।

নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞা

বিটিশ তথা ইউরোপীয় ধারার হৃবিজ্ঞানে ‘সংস্কৃতি’ ধারণার চাইতে ‘সমাজ’ ধারণার উপর বেশী গুরণ্ত দেওয়া হয়েছে, ফলে এই প্রেক্ষিতে “সামাজিক হৃবিজ্ঞান’ কথাটি অধিকতর এ্রচলিত।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান তথা হৃবিত্ঞানের অন্যান্য উপবিভাগের সাথে অন্যান্য ভ্ঞানকান্ডের রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান, ধর্মের নৃবিজ্ঞান, এতিবেশগত নৃবিজ্ঞান, চিকিওসা নৃবিজ্ঞান, ফলিত নৃবিজ্ঞান ইত্যাদি। বিভিন্ন নামে অভিহিত নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাবিভাগ ও বিশেষায়িত ধারার মধ্যে সাধারণভাবে কিছু অভি যোগসূত্র লঙ্গয করা যায়।

এগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ধারণার ব্যবহার, সমগবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, মাঠকর্ম ও তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment