মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক তত্ত্ব | নৃবিজ্ঞান

মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক তত্ত্ব আজকের আলোচনার বিষয়। “মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক তত্ত্ব [ Morgan’s Theory of Cognitione ]” যাবতীয় বিষয়াবলী তুলে ধরা হয়েছে। “নৃবিজ্ঞান [ Anthropology ]” হল মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতির অধ্যয়ন। এটি একাডেমিক এবং ফলিত অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। “নৃবিজ্ঞান [ Anthropology ]” বিষয়টি আক্ষরিক অর্থে মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। নৃবিজ্ঞানের [ Anthropology ] লক্ষ্য হলো অতীত ও বর্তমানের মানব সমাজ ও মানব আচরণকে অধ্যয়ণ করা । বিশ্বের সকল অঞ্চলের, সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে এই বিজ্ঞানে গবেষণা করা হয়।

 

মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক তত্ত্ব

প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী এবং বিবর্তনবাদী লুইস হেনরি মর্গান ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Ancient Society’ তে পরিবারের উৎপত্তি তথা বিবর্তন ধারাটি অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, “বর্তমান পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি নানা বিবর্তনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে।

 

 

আদিম সমাজে যৌন জীবনের উপর কোন সামাজিক নিয়ম কিংবা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ স্তরটিতে ছিল প্রাক–বিবাহ ও প্রাক– পরিবার জীবন। তখন প্রত্যেকটি স্ত্রীলোক সমানভাবে প্রত্যেকটি পুরুষের এবং তেমনি প্রত্যেকটি পুরুষ প্রত্যেকটি স্ত্রীলোকের পতি–পত্নী ছিল।” তিনি পরিবারের বিবর্তনকে নিম্নোক্তভাবে দেখিয়েছেন–

১. কনস্যাঙ্গুইন (Consanguine) বা রক্ত সম্পর্কিত জ্ঞাতি পরিবার।

২. পুনালুয়ান (Punaluan) বা দলগত বিবাহ সৃষ্ট পরিবার।

৩. সিনডিয়াসমিয়ান (Syndyasmian) বা জোড়া পরিবার।

৪. পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal family)।

৫. একক পরিবার (Monogamian family)।

নিম্নে এগুলো সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:

কনস্যাঙ্গুইন বা রক্ত সম্পর্কিত জ্ঞাতি পরিবার

এল. এইচ. মর্গানের মতে, আপন জ্ঞাতি সম্পর্কের ভাইবোনের মধ্যে বিবাহের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পরিবারকে রক্ত সম্পর্কযুক্ত বা কনস্যাঙ্গুইন পরিবার বলা হয়। তাঁর মতে, এটাই মানবসমাজে প্রথম ও আদি পরিবার, কিন্তু যৌন সম্পর্কের দ্বিতীয় স্তর। কারণ এ পরিবারের পূর্বে অবাধ যৌন সম্পর্ক পর্যায়ের অস্তিত্ব ছিল, তখন অবশ্য কোন বিবাহ ব্যবস্থা ছিল না। এ সময়ে সম্পত্তিতে যৌথ মালিকানার অস্তিত্ব ছিল।

পুনালুয়ান বা দলগত বিবাহ সৃষ্ট পরিবার

মর্গান বর্ণিত পরিবারের বিবর্তন ধারায় এ পরিবারটি দ্বিতীয় পর্যায়ের। পরিবার সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ যদি হয় মাতাপিতার সঙ্গে সন্তান সন্ততিদের যৌন সম্পর্ক রহিত করা, তাহলে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে ভ্রাতা ও ভগিনীদের যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা। প্রত্যেকটি আদি পরিবার বড়জোর কয়েক পুরুষের পরই বিভক্ত হতে বাধ্য হতো। বিনা ব্যতিক্রমে বর্বর যুগের মধ্যবর্তী স্তরের শেষদিকে যে আদিম সাম্যতন্ত্রী সাধারণ গৃহস্থালির ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তাতে পারিবারিক গোষ্ঠীর একটা সর্বোচ্চ আয়তন নির্ধারিত হয়ে যায়, অবস্থা বিশেষে কিছু ইতরবিশেষ হলেও প্রত্যেকটি স্থায়ী এলাকায় তা কম–বেশি সুনির্দিষ্ট ছিল।

কিন্তু একমায়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌন সম্পর্কের অবৈধতার ধারণা আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুরানো গৃহস্থালি গোষ্ঠীর বিভাগ এবং নতুন গৃহস্থালি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার উপর এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। একটি গৃহস্থালি গোষ্ঠীর কেন্দ্র হতো এক বা একাধিক ভগিনী দল, তাদের সহোদর ভাইয়েরা হতো আর একটি গোষ্ঠীর কেন্দ্র। এভাবে অথবা অনুরূপ কোন উপায়ে একরক্ত সম্পর্কের পরিবার থেকে মর্গান যাকে পুনালুয়ান পরিবার বলেছেন তার উৎপত্তি হলো।

হাওয়াই প্রথা অনুযায়ী সহোদররা অথবা সমান্তরবর্তী (অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় বা ততোধিক স্তরের কাজিন বোনেরা) কয়েকজন ভগিনী হতো তাদের সাধারণ স্বামীদের সাধারণ স্ত্রী, কিন্তু এ সম্পর্কের মধ্য থেকে তাদের ভাইয়েরা বাদ পড়তো।

এ স্বামীরা এখন আর পরস্পরকে ভাই বলে সম্ভাষণ করে না, বস্তুত তাদের এখন আর ভাই হওয়ার দরকার নেই, পরন্তু তারা পরস্পরকে ডাকে ‘পুনালুয়া‘ অর্থাৎ ‘ঘনিষ্ঠ সাথী‘ বলা যেতে পারে অংশীদার। ঠিক একইভাবে একদল সহোদর অথবা সমান্তরবর্তী ভাইয়েরা একত্রে এমন একদল স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হতো যারা তাদের ভাগিনী নয় এবং এ স্ত্রীলোকেরা পরস্পরকে ‘পুনালুয়া‘ বলে ডাকতো। এটাই হচ্ছে পরিবার গঠনের চিরায়ত রূপ।

পরে যার অনেক রকম পরিবর্তন হয় এবং একটি অপরিহার্য মূল বৈশিষ্ট্য হলো একটি নির্দিষ্ট পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে একদল পুরুষ ও একদল স্ত্রী যৌথ পতি পত্নী সম্পর্ক, যে সম্পর্ক থেকে প্রথমে স্ত্রীদের সহোদর ভাইদের এবং পরে সমান্তরবর্তী ভাইদেরও বাদ দেয়া হতো এবং এভাবে বাদ দেয়া হতো স্বামীদের বোনদের। এভাবে আপন ও জ্ঞাতি ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধকরণ রীতি প্রচলিত হয় এবং একদল ভাইয়ের সঙ্গে একদল মেয়ের অথবা একদল বোনের সাথে একদল পুরুষের বিবাহ প্রথার আবির্ভাব ঘটে।

স্বাভাবিকভাবে স্বামীরা পরস্পর ভাই হলে স্ত্রীরা পরস্পর বোন নয় এবং স্ত্রীরা পরস্পর বোন হলে স্বামীরা পরস্পর তাই নয়। তারা পরস্পর ‘পুনালুয়া‘ অর্থাৎ ‘ঘনিষ্ঠ সাথী‘ যাকে বলা যেতে পারে অংশীদার। এখানে একদল ভাই ও বোনের বিবাহ অনুপস্থিত। এ প্রথার নাম পুনালুয়ান পরিবার প্রথা।

 

মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক

 

সিনডিয়াসমিয়ান বা জোড়া পরিবার

“সিনডিয়াসমিয়ান‘ শব্দটা সিনডিয়াজ্যো বা জোড়া দেয়া ও সিনডিয়াসমস বা দু‘জনকে জোড়া লাগান থেকে এসেছে। এল. এইচ. মর্গান বর্ণিত পরিবারের উৎপত্তির তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে সিনডিয়াসমিয়ান পরিবার। এ পর্যায়ে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা অস্থায়ী ভিত্তিতে যুগল জীবন শুরু করে। সমষ্টি বিয়ের আমলে অথবা তারও আগে কম বেশি সময়ের জন্য জোড়া ইধা পরিবার দেখা যেত, বহু পত্নীর মধ্যেও একজন মানুষের একটি প্রধান পত্নী থাকতো এবং মানুষটি হতো আবার অনেক পতির মধ্যে তার প্রধান পতি।

এ ধরনের জোড়া বাঁধার অভ্যাস অবশ্য গোত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এবং যাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ সেই ‘ভাইদের‘ ও ‘বোনদের‘ শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবত ক্রমেই বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। রক্ত সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করার যে প্রেরণা দেখা দেয়, গোত্র তাতে ঘটনাবলি আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। বিয়ের এ নিষেধাজ্ঞার ক্রমবর্ধিত জটিলতা সমষ্টি বিয়েকে ক্রমেই অসম্ভব করে তার স্থলে প্রবর্তিত হয় জোড়া বাঁধা পরিবার। এ জোড়া বাঁধা পরিবার থেকে স্থায়ী একপতি–পত্নী প্রথায় পরিণতির জন্য ইতঃপূর্বে যেসব কারণগুলো সক্রিয় ছিল তাছাড়াও পৃথকীকরণের প্রয়োজন।

জোড়া বাঁধা পরিবারের ক্ষেত্রে সমষ্টি কমে এসেছে একেবারে তার শেষ এককে, তার দুই পরমাণু সমন্বিত এক অণুতে– একটি পুরুষ ও একটি নারীতে। অর্থাৎ সিনডিয়াসমিয়ান প্রথায় মানবসমাজে আধুনিক একক বিবাহ ভিত্তিক পরিবারের বীজ অঙ্কুরিত হয়।

ধন্যবস্থা ও বর্বরতার সীমারেখায় জোড়া বাঁধা পরিবার দেখা দেয়, প্রধানত বন্যবস্থার ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এবং কোথাও কোথাও বর্বরতার নিম্নতম স্তরে। পরিবারের এ রূপটিই বর্বর যুগের বৈশিষ্ট্য, ঠিক যেমন সমষ্টি বিবাহ হচ্ছে বন্যবস্থার বৈশিষ্ট্য এবং একপতি–পত্নী প্রথা সভ্যতার।

জোড়া বাঁধা বিবাহ পরিবারের মধ্যে একটি নতুন উপাদান এনেছিল। এ ব্যবস্থায় গর্ভধারিণী মায়ের জন্মদাতা প্রামাণ্য পিতাকেও পাওয়া যেত, যিনি আধুনিক যুগের অনেক ‘পিতার চেয়ে সম্ভবত বেশি প্রামাণ্য ছিলেন। আবার এ স্তরে একজন মানুষ একটি মাত্র স্ত্রীলোকের সঙ্গে বাস করে, কিন্তু সেটা এমনভাবে যে পুরুষের পক্ষে বহুপত্নীক এবং কখনো কখনো বিশ্বাস ভঙ্গের অধিকার থাকে।

পুরুষের পক্ষে বহুপত্নী গ্রহণের প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক। প্রথম প্রথম জোড়া বাঁধা পরিবার এত দুর্বল ও অস্থায়ী ছিল যে, এর জন্য স্বতন্ত্র গৃহস্থালি বাঞ্ছনীয় ছিল না। এ বিবাহ সম্পর্ক অবশ্য যে কোন পক্ষ থেকেই সহজে ভেঙে যেত এবং সন্তান সন্ততিরা আগের মতো কেবল মায়েরই অধিকারভুক্ত থাকতো।

পিতৃতান্ত্রিক পরিবার (Patriarchal family)

মর্গান বর্ণিত পরিবার ব্যবস্থায় এটি হচ্ছে চতুর্থ স্তরের পরিবার এবং পঞ্চম পর্যায়ের যৌন জীবন। এ পরিবার গড়ে উঠে একজন পুরুষের সাথে একাধিক স্ত্রীর বিবাহের ভিত্তিতে। এ পরিবারে স্বামী, পিতা বা বয়স্ক পুরুষের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং স্ত্রীর স্বাধীনতা লোপ পায়। বর্তমান সমাজব্যবস্থার অধিকাংশেই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বিদ্যমান। তবে বহু স্ত্রী গ্রহণ করার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।

একক পরিবার (Monogamian family)

মর্গান বর্ণিত পরিবারের উৎপত্তি তত্ত্বে এটি হচ্ছে শেষ ধাপ। সাধারণত একজন পুরুষের সাথে একজন মহিলার বিবাহের মাধ্যমে এ পরিবার গঠিত হয়। এটি হচ্ছে আধুনিক পরিবারের সর্বজনীন রূপ এবং সভ্যতার সূচনার অন্যতম লক্ষণ। এ স্তরেই ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব ঘটে।

মর্গানের ধারণায় এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, পরিবার হলো একটি সতি ব্যাপার। এটি কখনো অচল নয়, সমাজ যেমন নিম্নতর থেকে উচ্চতর অবস্থায় যায়, তেমনি পরিবারও নিম্নতর থেকে উচ্চতর রূপে পৌঁছায়। পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে মর্গানের তত্ত্বকে একমাত্রিক বা একসূত্রীয় ব্যাখ্যা বলে গণ্য করা হয়। সমাজতন্ত্রী লেখকেরা পরিবার বিবর্তনের ব্যাখ্যায় মর্গানের সূত্র বহুলাংশে গ্রহণ করেন এবং পরিবার সম্পর্কে তার গবেষণাকেই পথিকৃতের মর্যাদা দেন।

 

মর্গানের জ্ঞাতি সম্পর্ক তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত ঃ

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment