Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

 

 

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ইতিহাস

১৬০০ খ্রিস্টাব্দের সমকাল থেকেই ইউরোপীয় নাবিক-পর্যটকরা অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহ আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। ১৬২৪ সালে ওলন্দাজ (হল্যাণ্ডের) নাবিক আবেল টাসম্যান অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপটিকে আবিষ্কার করেন; তাঁর নামানুসারে দ্বীপটির নাম দেয়া হয়েছে টাসমানিয়া। কিন্তু ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুকু অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে পদার্পণ করার পর থেকেই ইউরোপীয়রা ক্রমশ অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে শুরু করে।

অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি ইন্দোনেশীয় দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিশাল দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মহাদেশ, আকারে ইউরোপের পৌনে একভাগ। এর আয়তন প্রায় ৩০ লক্ষ বর্গমাইল; পূর্ব-পশ্চিমে তার বিস্তৃতি মোটামুটি ২৪০০ মাইল ও উত্তর দক্ষিণে ২০০০ মাইল। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পুরোপুরি দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত এবং মোটামুটি ১০ থেকে ৪০ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত।

অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগ প্রায় সবটাই মরুভূমি। আর বাকি অংশের মধ্যেও তৃণভূমিই প্রধান-বৃষ্টিপাত কম বলে সেসব অঞ্চলে ঘাস ছাড়া কিছু জন্মায় না। উত্তর এবং উত্তর— পূর্বের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরক্ষীয় বৃষ্টিপাতের দরুন বনভূমি আছে। অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরাও প্রধানত উত্তর ও পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলেই বেশি সংখ্যায় বাস করত। শুষ্ক ও মরু অঞ্চলে আদিবাসীরা ছিল নগণ্য পরিমাণে। ইউরোপীয়রা যখন প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে শুরু করে তখন ১৭৮৮ সালে আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ।

ইউরোপীয়দের উৎপীড়নে তাদের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ১৯৪৭ সালে তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৭ হাজার। অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা বর্তমানে পশ্চিম ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অনুর্বর অঞ্চলে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করছে। পণ্ডিতরা জানতে পেরেছেন যে একদা অস্ট্রেলিয়া পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ অর্থাৎ সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি দ্বীপের মাধ্যমে এশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। বহু কোটি বছর আগে এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এ কারণে অস্ট্রেলিয়াতে অনেক পুরান জাতের প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায় যা এশিয়া-ইউরোপে অনেক আগে লুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে টিকে আছে। আবার অস্ট্রেলিয়াতে প্লাটিপাস নামে এক ধরনের অগুজ স্তন্যপায়ী আছে যারা ডিম পাড়ে কিন্তু বাচ্চাকে স্তন্য পান করায়। সেখানে ক্যাঙারু নামে আরেক ধরনের আধা স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে যারা ভ্রূণ অর্থাৎ অর্ধ পরিণত বাচ্চার জন্ম দেয়; এ বাচ্চারা মায়ের উদরসংলগ্ন একটি থলিতে আশ্রয় নেয় এবং মায়ের স্তন্য পান করে বড় হয়।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে ইউরোপীয়রা গিয়ে মানুষ এবং কুকুর ছাড়া কোনো প্রকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাক্ষাৎ পায়নি। গরু, ঘোড়া, শূকর, বিড়াল, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি আমাদের অতি পরিচিত স্তন্যপায়ী প্রাণী অস্ট্রেলিয়াতে আগে ছিল না, ইউরোপয়ীরা এ সকল প্রাণী সেখানে নিয়ে গেছে। এর অর্থ হল এশিয়া বা আফ্রিকায় স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটার আগেই অস্ট্রেলিয়া অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

তাই সেখানে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী যেতে পারেনি। ১৫-২০ হাজার বছর আগে এশিয়া থেকে শিকারি যুগের আদিম মানুষ নৌকায় চড়ে সাথে করে পোষা কুকুর নিয়ে গিয়েছিল বলেই অস্ট্রেলিয়াতে মানুষ ও কুকুর পৌঁছেছিল। প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, প্রায় সাত কোটি বছর আগে পৃথিবীতে সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছিল। সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যবর্তী পর্যায়ের প্রাণী হল প্লাটিপাস, ক্যাঙারু প্রভৃতি আধা-স্তন্যপায়ী প্রাণী।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অস্ট্রেলিয়া এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ফলেই মাত্র সেখানে ক্যাঙারু প্রভৃতি প্রাণী টিকে আছে, অবশিষ্ট পৃথিবীতে আধা-স্তন্যপায়ীরা লোপ পেয়েছে। X (অনুরূপ কারণে অবশ্য আমেরিকা মহাদেশেও অন্য কয়েক ধরনের আধা-স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে।) এ বিচার থেকে সহজেই বোঝা যাবে যে, অন্তত সাত কোটি বছর আগেই অস্ট্রেলিয়া এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

ফলে এশিয়া থেকে ১৫-২০ হাজার বছর আগে যখন শিকারি যুগের মানুষ ডোঙ্গা, ভেলা প্রভৃতি আদিম জলযানের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে পৌঁছায় তখন তারা অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এশিয়া আফ্রিকা-ইউরোপের মানুষ এর পর যে সকল সভ্যতা-সংস্কৃতি অর্জন করেছে তার কোনো সংবাদ অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কাছে পৌঁছায়নি। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সময় ঐ আদি অস্ট্রেলীয়রা বৃহত্তর মানবসমাজের কাছ থেকে যেটুকু সংস্কৃতি নিয়ে যেতে পেরেছিল তাই ছিল তাদের প্রাথমিক সম্বল।

ঐ আদি সংস্কৃতি ছিল শিকারি যুগের সংস্কৃতি বা পুরাতন পাথরের যুগের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির বিবরণ আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে প্রদান করেছি। বস্তুত, অস্ট্রেলিয়ার শিকারি সমাজের আচরণ থেকেই আমরা আদিম সমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা শিকারি যুগের সংস্কৃতি নিয়ে সেখানে গিয়েছিল এবং শিকারি যুগেই তারা আটকে ছিল। এমনকি কৃষিকাজ পর্যন্ত তারা আবিষ্কার করতে পারেনি।

এ জন্য অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মগজে বা বুদ্ধিতে তারা আমাদের মতোই আধুনিক মানুষ, কিন্তু এ ধরনের যুগান্তকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক আবিষ্কার কোনো একটা বিচ্ছিন্ন জাতি করতে পারে না। সমগ্রভাবে মানবসমাজই মাত্র এ রকম আবিষ্কার সাধনে সক্ষম। বৃহত্তর মানবসমাজের ব্যাপক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পশ্চিম এশিয়ার কোনো এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলেই সেখানে কৃষি, পশুপালন ও অন্যান্য নবোপলীয় আবিষ্কার সাধন সম্ভব হয়েছিল।

পশ্চিম এশিয়ার মানুষ বিশেষ বুদ্ধিমান ছিল বলেই ঐ সব আবিষ্কার করতে পেরেছে একথা ভাবা ঠিক নয়। আসলে ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের দরুন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেছিল। এ সকল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা যেখানে কেন্দ্রীভূত হয়।

সেখানে যদি অনুকূল সামাজিক পরিস্থিতি থাকে তবেই সেখানে নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, সমাজ সংগঠন ইত্যাদির আবিষ্কার হতে পারে। নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন সংস্কৃতি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হওয়ার পর তা অন্যত্র সহজেই বিস্তার লাভ করতে পারে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতির পক্ষে পৃথক পৃথকভাবে নতুন করে ঐ সব আবিষ্কার সাধন সম্ভব নয়। কারণ ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন জাতির অভিজ্ঞতার পরিসর বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে খুব কম।

এ কারণেই পশ্চিম এশিয়া থেকে নবোপলীয় কৃষি সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছিল তখন তা এমনকি এশিয়া থেকে চার হাজার মাইল দূরে হাওয়াই দ্বীপে পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূলের নিকটবর্তী নিউগিনি রূপে পর্যন্ত নবোপলীয় কৃষি সংস্কৃতি পৌঁছেছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তার আগেই এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছিল বলে সেখানে নতুন পাথরের যুগের সংস্কৃতির উদ্ভব হয়নি।

এ কারণেই নিউগিনির মানুষ মাটির পাত্রের ব্যবহার জানে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা জানে না। কারণ মাটির পাত্র নির্মাণের কৌশল মানুষ আবিষ্কার করেছিল নবোপলীয় যুগে অর্থাৎ আজ থেকে আট-দশ হাজার বছর আগে, আর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সেখানে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ১৫-২০ হাজার বছর আগে। মাটির পাত্র এবং কুমোরের চাক আমাদের কাছে যত সাধারণ বা তুচ্ছই মনে হোক না কেন, অনুকূল পরিবেশে মানবসমাজ একবারই তার আবিষ্কার করতে পেরেছিল।

তারপর থেকে অনুকরণের মাধ্যমে এর নির্মাণকৌশল সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। কোনো বিচ্ছিন্ন মানবগোষ্ঠীর পক্ষে দ্বিতীয় বার স্বতন্ত্রভাবে মাটির পাত্র নির্মাণ বা কুমোরের চাক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, বা তা সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের দৃষ্টান্ত নিয়ে এ কথাটা অনুধাবন করতে পারলে আমরা মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে একটা সত্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হব।

এ সত্য হল, কোনো জাতি বা গোষ্ঠী যদি বৃহত্তর মানবসামজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনুন্নত সংস্কৃতির স্তরে আটকে থাকে তবে উচ্চতর সমাজের সংস্পর্শ বা সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বা নিজ প্রচেষ্টায় উচ্চতর পর্যায়ের সমাজে উত্তরণ সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা বহু হাজার বছর ধরে শিকারি সমাজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল, এ গণ্ডি ছাড়িয়ে উচ্চতর অর্থাৎ কৃষি বা পশুপালক সমাজের পথে অগ্রসর হওয়ার কোনো প্রবণতা বা লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি।

 

 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা বা ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলতার বাধার দরুনও অনেক জাতি পারিপার্শ্বিক জগৎ বা বৃহত্তর মানব জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। যেমন, আমাদের দেশের অনেক উপজাতি উন্নততর সভ্যজাতির ভৌগোলিক সংস্পর্শে থাকলেও, সামাজিক রীতিনীতির রক্ষণশীলতার প্রাচীর দ্বারা বিচ্ছিন্ন বলে উন্নত জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

আরও দেখুন :

Exit mobile version