Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

আদিম সমাজের ঘর বাড়ি

আদিম সমাজের ঘর বাড়ি

মানবসভ্যতার ইতিহাসে আশ্রয় বা ঘরবাড়ির বিকাশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শুরুতে মানুষ প্রকৃতির সাথে সরাসরি লড়াই করে টিকে ছিল—খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিত। পরবর্তীতে যখন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, তখন পরিবেশ ও আবহাওয়ার ভিন্নতার কারণে আশ্রয়ের ধরনেও পরিবর্তন আসে। কোথাও গুহা হয়ে ওঠে নিরাপদ আশ্রয়, কোথাও তৈরি হয় অস্থায়ী তাঁবু কিংবা মাটির গর্তের ঘর। ধীরে ধীরে মানুষ শুধু শিকার ও খাদ্য সংগ্রহেই নয়, বাসস্থানের কৌশলেও দক্ষতা অর্জন করে—ডালপালা, হাড়, পশুর চামড়া, মাটি, পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করে নানা ধরনের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। আদিম সমাজের এই ঘরবাড়ি মানুষের সৃজনশীলতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের এক অমূল্য দলিল।

আদিম সমাজের ঘর বাড়ি

 

প্রাথমিক আশ্রয়: গুহা থেকে খোলা প্রান্তর

আদিম শিকারী মানুষদের নিয়ে সাধারণ ধারণা হলো, তারা গুহায় বাস করত। কিন্তু একদম শুরুর দিক থেকেই মানুষ গুহাবাসী ছিল—এমন ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়।

 

আগুন আয়ত্ত গুহার ব্যবহার

গুহা যে সবসময় মানুষের আশ্রয়স্থল হতে পেরেছিল—তা নয়।

তবুও সব অঞ্চলে পাহাড় বা গুহা ছিল না, তাই গুহা কখনও সর্বজনীন আশ্রয় হতে পারেনি।

 

যাযাবর জীবন অস্থায়ী আশ্রয়

শিকারী সমাজ স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস করতে পারত না। কারণ—

এই যাযাবর জীবনের কারণে তাদের প্রয়োজন হয়েছিল সহজে বানানো যায় এমন অস্থায়ী ঘর বা তাঁবুর।

 

ম্যামথ শিকারীদের ঘরবাড়ি

চেকোস্লোভাকিয়ায় উচ্চ পুরোপলীয় যুগের (প্রায় ২৫৩০ হাজার বছর আগেকার) ম্যামথ শিকারীদের বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব ঘর ছিল অনেকটা তাঁবুর মতো।

এসব ঘর প্রায়শই গোলাকার ছিল। আশ্রয়কে শক্তিশালী করতে চারপাশে চুনাপাথর ও কাদামাটির প্রাচীর বানানো হতো। এটিই মানুষের তৈরি প্রাচীনতম দেয়ালের নিদর্শন

 

আদিবাসী ঘরবাড়িতে ঐতিহ্যের প্রতিফলন

আজও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের ঘরবাড়ি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, আদিমকালের গৃহনির্মাণ কৌশল কতটা উন্নত ও বৈচিত্র্যময় ছিল। যেমন—

এগুলো প্রমাণ করে, মানুষের গৃহনির্মাণ দক্ষতা যুগে যুগে শুধু শারীরিক চাহিদা নয়, পরিবেশগত অবস্থার সাথেও নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল।

 

 

আদিবাসী ঘরবাড়িতে আদিম ঐতিহ্যের রেশ

আজকের পৃথিবীর নানা অঞ্চলের আদিবাসী ঘরবাড়িতে এখনও আদিমকালের রেশ বিদ্যমান। হাজার হাজার বছর ধরে তাদের নির্মাণ কৌশল প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে।

 

মধ্যোপলীয় যুগে ঘরবাড়ির উন্নয়ন

বরফ যুগের অবসানের পর, প্রায় দশ হাজার বছর আগে, মধ্যোপলীয় যুগ বা মধ্য পাথরের যুগ শুরু হয়। এই যুগ ছিল পুরোপলীয় শিকারী সমাজ ও নবোপলীয় কৃষি সমাজের মধ্যবর্তী একটি পরিবর্তনকাল।

 

জ্বালানি ব্যবহারে বৈচিত্র্য

ঘর ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত জ্বালানিতেও বৈচিত্র্য দেখা যায়।

 

মানব সংস্কৃতির ভিত্তি

আদিম সমাজের বিভিন্ন অংশে উদ্ভাবিত এইসব কৌশলই ছিল মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক ভিত্তি।

 

আদিম সমাজের ঘরবাড়ির বিকাশ মানব সভ্যতার অভিযোজন ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও সংগ্রামী মনোভাবের জীবন্ত সাক্ষ্য। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় থেকে শুরু করে গুহাবাস, অস্থায়ী তাঁবু, চামড়ার ঘর কিংবা বরফের ইগলু—প্রতিটি ধাপই মানুষের প্রয়োজন ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে। শিকারী সমাজের যাযাবর জীবন, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং নতুন উপকরণের আবিষ্কার মানুষকে ঘরবাড়ি নির্মাণে বৈচিত্র্যময় কৌশল শিখিয়েছে। এসব প্রাচীন কৌশল শুধু টিকে থাকার কাহিনি নয়, বরং বিশ্বমানব সংস্কৃতির মূলভিত্তি। আজও পৃথিবীর নানা অঞ্চলের আদিবাসী সমাজে আমরা সেই প্রাচীন কৌশলের প্রতিধ্বনি দেখতে পাই, যা প্রমাণ করে মানুষের ইতিহাস আসলে টিকে থাকার লড়াই এবং ক্রমাগত উন্নতির এক দীর্ঘ যাত্রা।

Exit mobile version