ক্যালডীয়রা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী, যারা শুধু রাজনীতি ও অর্থনীতিতেই নয়, বরং ধর্ম, জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল কেন্দ্র ছিল জ্যোতিষীয় ধর্ম—যেখানে দেবতারা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতীক হিসেবে পূজিত হতেন, এবং আকাশের গতিবিধি থেকে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হতো।
ক্যালডীয় ধর্ম
জ্যোতিষীয় বিশ্বাস ও গ্রহদেবতা
ক্যালডীয় ধর্মবিশ্বাসে জ্যোতিষশাস্ত্র ছিল একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। তাদের মতে আকাশের প্রতিটি গ্রহের সঙ্গে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দেবতার সম্পর্ক রয়েছে, এবং এই দেবতারা কেবল মহাজাগতিক পিণ্ড নন, বরং মানুষের ভাগ্য ও ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্তা।
উদাহরণস্বরূপ—
-
মারদুক (Marduk) ছিলেন বৃহস্পতি গ্রহের (Jupiter) দেবতা, যিনি শক্তি, ন্যায়বিচার এবং শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে পূজিত হতেন। প্রাচীন কাহিনিতে তাকে প্রায়শই দানব ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক ‘তিয়ামাত’-এর পরাজয়কারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
-
ইশতার (Ishtar) ছিলেন শুক্রগ্রহের (Venus) দেবী, যিনি প্রেম, সৌন্দর্য, উর্বরতা এবং যুদ্ধের দেবী হিসেবে পূজিত হতেন। ইশতারের পূজা শুধু ক্যালডীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমগ্র মেসোপটেমীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তৃত ছিল।
এর পাশাপাশি—
-
সিন (Sin) ছিলেন চন্দ্রের দেবতা, যিনি সময় গণনা, ঋতুচক্র এবং কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
-
শামাশ (Shamash) ছিলেন সূর্যের দেবতা, ন্যায়বিচারের রক্ষক এবং সত্যের প্রতীক।
-
নাবু (Nabu) ছিলেন বুধ গ্রহের (Mercury) দেবতা, যিনি জ্ঞান, লেখনী এবং ভাগ্যলিপির নিয়ন্তা হিসেবে বিবেচিত হতেন।
এইভাবে গ্রহ, নক্ষত্র এবং আকাশীয় ঘটনাবলি ক্যালডীয়দের কাছে শুধুমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় ছিল না—বরং তা ধর্মীয় আচার, ভবিষ্যদ্বাণী, এবং সমাজজীবনের নিয়ম-নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
তবে সময়ের সাথে সাথে বিশ্বাসে এক পরিবর্তন আসে। প্রাচীন যুগে মানুষ মনে করত, দেবতারা তাদের পূজা, বলিদান ও যাদুবিদ্যার মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারেন। কিন্তু ক্যালডীয়দের পরবর্তী যুগে এই ধারণা ধীরে ধীরে বদলে যায়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে দেবতারা আর ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আবেদনে সাড়া দেন না, বরং যান্ত্রিক ও নিরপেক্ষভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করেন। এর ফলে ধর্মীয় আচারের উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে ভক্তি ও পূজা থেকে সরে গিয়ে ভাগ্য মেনে নেওয়া ও ঘটনাপ্রবাহ বোঝা-য় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভাগ্যনির্ভরতা ও হতাশাবাদ
ক্যালডীয় ধর্মবিশ্বাসে দেবতারা ছিলেন মহাবিশ্বের নিয়ন্তা, কিন্তু তাদের প্রকৃত ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য মানুষের বোধগম্যের বাইরে বলে ধরা হতো। এই ধারণা ধীরে ধীরে মানুষের মানসিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
ফলে—
১. ইচ্ছাশক্তির অবক্ষয় – মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বা পরিশ্রমে ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। নিজের জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার মানসিক শক্তি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
২. অদৃষ্টের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা – জীবনের সমস্ত সাফল্য ও ব্যর্থতা ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করা হয়। মানুষ মনে করত, তাদের নিয়তি পূর্বনির্ধারিত এবং দেবতাদের ইচ্ছার বাইরে কিছুই ঘটতে পারে না।
৩. পরকালবিশ্বাসের অনুপস্থিতি – ক্যালডীয় ধর্মে মৃত্যুর পর কোনো চিরস্থায়ী পুরস্কার বা শাস্তির ধারণা ছিল না। তারা ইহজগৎকেন্দ্রিক বিশ্বাসে দৃঢ় ছিল; অর্থাৎ, সবকিছু এই জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এ কারণে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল—
-
যতটুকু সম্ভব পার্থিব সুখ, সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন করা।
-
পরিবার, সন্তান, ও ভোগবিলাসে জীবন উপভোগ করা।
তবে এই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও এক বিরোধ দেখা দেয়। জীবনের অনিশ্চয়তা ও ভাগ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানুষকে এক ধরনের অস্তিত্ববাদী হতাশা ও হীনমন্যতায় নিমজ্জিত করে। তারা বুঝতে পারত, যতই চেষ্টা করুক না কেন, দুঃখ-কষ্ট, রোগব্যাধি এবং অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব নয়।
ফলে ক্যালডীয় সংস্কৃতিতে একদিকে ভাগ্যমানসিকতা এবং অন্যদিকে হতাশাবাদী জীবনদৃষ্টি পাশাপাশি বিকশিত হয়। এই দ্বৈত মানসিকতা তাদের প্রার্থনা-সংগীত, সাহিত্য এবং সামাজিক আচারে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—যেখানে মানুষকে চিরন্তন পাপী, দুর্বল, এবং ভাগ্যের কাছে বন্দী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
মানবপাপ ও আত্মদৃষ্টি
ক্যালডীয় ধর্মীয় সংস্কৃতিতে মানুষের আত্মপরিচয় মূলত এক অনন্ত পাপবোধ ও ভাগ্যনির্ভরতার সাথে যুক্ত ছিল। তাদের প্রার্থনা-সংগীত ও ধর্মীয় স্তোত্রে মানুষের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে প্রায়শই চিরন্তন পাপী এবং হাত-পা বাঁধা বন্দী রূপে—যে নিজের ইচ্ছায় মুক্ত হতে সক্ষম নয়। এই রূপক চিত্র মানুষের উপর এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলত, কারণ এতে মানবজীবনের দুঃখ-কষ্টের প্রধান কারণ হিসেবে পাপকে চিহ্নিত করা হতো।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই গভীর পাপবোধ থাকা সত্ত্বেও ক্যালডীয়রা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের মতো আত্মনিগ্রহ বা আত্মনির্যাতনের পথে হাঁটেনি। তারা নিজেদেরকে উপবাস, চাবুক মারা, বা কঠোর তপস্যার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে ভিন্ন জীবনদর্শন গ্রহণ করেছিল।
তাদের ধারণা ছিল—
১. মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হওয়া অসম্ভব।
২. তাই জীবনের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত পার্থিব সুখ-সুবিধা অর্জন ও বিলাসিতা উপভোগ করা।
৩. দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য নৈতিকতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত দীর্ঘায়ু, সুস্থতা, সন্তান-সন্ততি, সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা লাভের প্রার্থনা।
তাদের প্রার্থনায় একদিকে শ্রদ্ধা, দয়া, পবিত্রতা, সততা ইত্যাদি মানবগুণকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো; অপরদিকে নির্যাতন, মিথ্যা অপবাদ, অন্যায় রোষ প্রভৃতিকে স্পষ্টভাবে দোষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই নৈতিক মূল্যবোধও মূলত সামাজিক সহাবস্থানের প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত ছিল, দেবতার সাথে নৈতিক চুক্তির অংশ হিসেবে নয়।
এভাবে ক্যালডীয় ধর্মে পাপ ও নৈতিকতা ধারণাটি ছিল তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী—তারা স্বীকার করত যে মানুষ অপরাধপ্রবণ, কিন্তু সেই দুর্বলতা সত্ত্বেও জীবন উপভোগ করাই মানবজীবনের মূল উদ্দেশ্য।
দেবতার কাছে প্রার্থনার উদ্দেশ্য
ক্যালডীয় ধর্মে প্রার্থনা ও উপাসনার মূল লক্ষ্য ছিল না নৈতিক শুদ্ধতা অর্জন বা আত্মার উন্নতি সাধন, বরং ছিল পার্থিব সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ। তাদের দৃষ্টিতে দেবতা ছিলেন এক ধরনের শক্তিশালী রক্ষক ও কল্যাণদাতা, যিনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সম্পদ, স্বাস্থ্য ও পারিবারিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম।
তারা দেবতার কাছে যে প্রার্থনা করত, তার মধ্যে প্রধান চাওয়াগুলো ছিল—
১. দীর্ঘায়ু – সুস্বাস্থ্য ও বার্ধক্য পর্যন্ত নিরোগ জীবন।
২. সন্তান-সন্ততি – পরিবার ও বংশবৃদ্ধি, যা সামাজিক মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রতীক।
৩. সম্পদ ও সমৃদ্ধি – কৃষি উৎপাদন, ব্যবসায়িক সাফল্য ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য।
৪. বিপদ থেকে মুক্তি – রোগ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা।
তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল মূলত এই পার্থিব চাহিদাগুলো পূরণের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা। এই আচারগুলোতে যজ্ঞ, উপহার, পশুবলি, সঙ্গীত ও মন্ত্রপাঠ ব্যবহার করা হতো দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য। ক্যালডীয়দের বিশ্বাস ছিল, যদি দেবতারা সন্তুষ্ট হন, তবে তারা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন এবং আশীর্বাদস্বরূপ কাঙ্ক্ষিত সুফল দান করেন।
এই ইহজগৎভিত্তিক জীবনদর্শন ক্যালডীয় ধর্মকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে—তারা পরকাল বা আত্মার মুক্তির ধারণায় তেমন মনোযোগ দেয়নি, বরং বর্তমান জীবনের সাফল্য ও আনন্দকেই মানবজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে দেখেছে। ফলে তাদের প্রার্থনা ও ধর্মীয় চর্চা ছিল বাস্তববাদী ও উপযোগবাদী স্বভাবের, যা তৎকালীন মেসোপটেমীয় সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ক্যালডীয় সভ্যতা ও পুনরুত্থান প্রচেষ্টা
আসিরীয় সাম্রাজ্যের প্রভাবকালে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পরিবর্তন ঘটলেও ক্যালডীয়রা নিজেদের ঐতিহ্য পুরোপুরি ত্যাগ করেনি। তারা—
- প্রাচীন আইন ও সাহিত্যের পুনর্জাগরণ ঘটায়।
- পুরোনো ব্যাবিলনীয় শাসনপদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন করে।
- শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
তবে তাদের নবজাগরণ প্রচেষ্টা পূর্ণ সফলতা পায়নি, কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বহিরাগত শাসনের প্রভাব সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত করেছিল।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার
ক্যালডীয় ও মেসোপটেমীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছিল—
- পারসিক সভ্যতা (Persian civilisation)
- হিট্টাইটরা (Hittites)
- ফিনিশীয়রা (Phoenicians)
- হিব্রুরা (Hebrews)
এমনকি আজও আমাদের জীবনে মেসোপটেমীয় অবদান বিদ্যমান—
- সময় মাপার পদ্ধতি (যেমন ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের ধারণা)
- কোণ মাপার পদ্ধতি (৩৬০ ডিগ্রিতে পূর্ণ বৃত্ত, চার সমকোণ)
- কোষ্ঠিগণনা ও রাশিচক্র (astrology)
- জ্যোতিষশাস্ত্রসংক্রান্ত অনেক কুসংস্কার