আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পাত্র, প্রদীপ, গয়না পরিচ্ছেদ
পাত্র, প্রদীপ, গয়না পরিচ্ছেদ
পাত্র, প্রদীপ, গয়না পরিচ্ছেদ
পুরোপলীয় যুগের শেষ দিকে মানুষ সম্ভবত পানি, দুধ ইত্যাদি বহন করার জন্য চামড়ার পাত্র বা সেলাই করা চামড়ার ব্যাগ ব্যবহার করতে শিখেছিল। আগে একবার যে মধু সংগ্রাহিকার ছবির কথা বলা হয়েছে ঐ ছবিতে মেয়েটি সম্ভবত একটা চামড়ার পাত্রেই মধু সংগ্রহ করছিল। পণ্ডিতদের ধারণা, মাটির পাত্র সম্ভবত পরবর্তীকালের অর্থাৎ নবোপলীয় যুগের আবিষ্কার। মানুষের উদ্ভবের পর বহু লক্ষ বছর পর্যন্ত সম্ভবত মানুষ কৃত্রিম আলো ব্যবহার করতে শেখেনি।
সবচেয়ে প্রাচীন যে প্রদীপের নিদর্শন পাওয়া গেছে তা উচ্চ পুরোপলীয় যুগের পশ্চিম ইউরোপের শিকারী মানুষের ব্যবহৃত প্রদীপ। অন্ধকার গুহার ভিতরে দেওয়ালে ছবি আঁকার জন্য সম্ভবত এ সকল প্রদীপ ব্যবহার করা হত। প্রদীপগুলো ছিল পিরিচের মতো এক ধরনের পাত্র। আধুনিক এস্কিমোরাও এ ধরনের তবে বড় আকারের প্রদীপ ব্যবহার করে। এস্কিমোরা
উচ্চ পুরোপলীয় যুগের গলার হার। এ হারটা মাছের মেরুদণ্ডের হাড়, ঝিনুক ও হরিণের দাঁত গেঁথে তৈরি করা হয়েছে।
প্রদীপ জ্বালাতে সীল মাছ বা সিন্ধুঘোটকের চর্বি এবং শ্যওলার পলতে ব্যবহার করে। পাথর যুগের মানুষরাও সম্ভবত একই কৌশলে প্রদীপ জ্বালাত। পোশাক-পরিচ্ছদ কখন কি ভাবে মানুষ আবিষ্কার করেছিল তা আমরা জানি না। এ বিষয়ে পণ্ডিতরা একমত হতে পারেননি। অনেকের ধারণা, প্রথমে খাদ্য, হাতিয়ার প্রভৃতি মাথায়, কাঁধে বহন করতে করতে মানুষ ক্রমশ পালক, হাড়, চামড়া প্রভৃতির গয়না বা অলঙ্কার ব্যবহার করতে শুরু করে।
ক্রমশ তারা আবিষ্কার করে যে, পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখলে শীত কম লাগে। এভাবে পোশাকের আবিষ্কার হোক বা না হোক, এ বিষয়ে অধিকাংশ পণ্ডিত একমত যে, নিয়াণ্ডার্থাল মানুষরা শীত নিবারণের জন্য পশুর চামড়া ব্যবহার করত। এবং একথাও ঠিক যে, গুরুত্বের দিক থেকে হাতিয়ার এবং আগুনের ব্যবহারের পরেই এই পোশাক বা পরিচ্ছদের স্থান।
পোশাকের আবিষ্কার করতে পারার দরুনই মানুষের পক্ষে সারা পৃথিবীর সব রকম আবহাওয়াতেই বসবাস করা সম্ভব হযেছে। চামড়ার পোশাক এবং পাদুকা আবিষ্কার করতে পারার ফলেই এস্কিমোরা অতি প্রাচীনকালেই উত্তর মেরুর প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জীবন যাপন করতে পারত। আদিম মানুষ প্রথম প্রথম হয়তো চামড়া গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণ করত। কিন্তু ক্রমশ তারা চামড়া সেলাই করতে শিখেছিল।
উচ্চ পুরোপলীয় যুগের একটা হাতির দাঁতের মূর্তি সাইবেরিয়াতে পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, একটি মানুষ সেলাই করা লোমশ চামড়ার পোশাকে মাথা এবং সমস্ত শরীর আবৃত করে রেখেছে। প্রাচীন অনেক গুহাচিত্রে দেখা যায়, কিশোরীরা পশুচর্মে শরীর ঢেকে শিকারীর নাচে অংশ নিচ্ছে।
আরও কিছু কিছু পশুচর্মে ঢাকা মানুষের ছবির সন্ধান পাওয়া গেছে, যা দেখে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে ঐ শিকারীরা পশুর চেহারা নকল করে শিকারযোগ্য পশুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাদের শিকার করত। পশুর চামড়া পরে পশুর চেহারা নকল করা থেকে পোশাকের আবিষ্কার হয়েছিল কি না তা অবশ্য বলা কঠিন। একেবারে আদিকালের মানুষ ছিল রীতিমতো অসহায়। বনের বড় বড় পশুর তুলনায় মানুষ ছিল শক্তিহীন।
তবে তার ছিল কাজ করার মতো, হাতিয়ার গড়ার মতো দুখানি হাত আর উন্নত ধরনের মগজ ও বুদ্ধি। তবুও মানুষ তখন ছিল দুর্বল আর অসহায়। অতি কষ্টে ফলমূল বা ইঁদুর প্রভৃতি ছোট ছোট প্রাণী সংগ্রহ করে সে জীবন রক্ষা করত। জীবন তখন ছিল কঠোর আর বিপদপূর্ণ। মানুষের আয়ু তখন ছিল সংক্ষিপ্ত। অনেক মানুষ তো ২০ বছরের গণ্ডিই পার হতে পারত না— কিছু যেত বাঘের পেটে, কিছু মারা যেত রোগে বা অনাহারে।
প্রকৃতির মুখাপেক্ষী এ আদি মানবরা বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিল একসাথে দল বেঁধে থেকে। দলবদ্ধ না হয়ে সেকালে মানুষের পক্ষে হিংস্র পশুর হাত থেকে আত্মরক্ষা বা খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হত না। এ কারণে আদিকালে মানুষরা দল বেঁধে বাস করত, এবং এক সাথে খেয়ে বাঁচত। এক একটা দলে সাধারণত কয়েক কুড়ি মানুষ থাকত। এরচেয়ে বেশি লোকের উপযুক্ত খাদ্য এক জায়গায় পাওয়া কঠিন। আদিম মানুষের এ দলগুলোকে নাম দেওয়া চলে আদি দল।
একই বন বা অঞ্চলের বিভিন্ন দল সাধারণত আলাদা আলাদা থাকত। একসাথে মিলে বড় দল করত না। আদিম মানুষরা সবাই মিলে খাদ্য সংগ্রহ করত। দলের ভিতরে বিভিন্ন মানুষের কাজের ধরনে কোনো পার্থক্য ছিল না, সবাই একই ধরনের কাজ করত। কিন্তু হাতিয়ারের উন্নতি, বিশেষত বল্লম ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা অর্থাৎ পশু শিকারের ও খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেল। এর ফলে দলের মধ্যে কাজের বিভাগ দেখা দিল।
দলের সংগঠনেও অনেক পরিবর্তন এল। হাতিয়ারের উন্নতির ফলে দলের সব লোককে আর শিকার সংগ্রহে না গেলেও চলত। আগে যে খাদ্য সংগ্রহ করতে পঞ্চাশজন দরকার হত, এখন পঁচিশ জনেই তা পারে। তাই পুরুষেরা যখন শিকারে যেত, মেয়েরা আস্তানার কাছাকাছি থেকে ফলমূল, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহ করত আর ঘর সংসারের নানা কাজ করত। তিন চার বছর বয়স থেকে বাচ্চারাও মায়েদের কাজে সাহায্য করত। ঘরের কাজ নিতান্ত কম ছিল না।
পুরুষরা শিকার করে নিয়ে এলে পশুর মাংস কাটা, রান্নাবান্না করা, চামড়া চর্বি ছাড়িয়ে রাখা, হাড়ের সুই আর পশুর রগের সুতোর সাহায্যে চামড়া সেলাই করে পোশাক বানানো, সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি সব কাজ মেয়েদের করতে হত। গুহায় বা আস্তানায় আগুন জিইয়ে রাখাও ছিল মেয়েদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আগুন ব্যবহারের পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার পরও বহুদিন পর্যন্ত মানুষ কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালাতে শেখেনি।
তাই আগ্নেয়গিরি বা দাবাগ্নি (অর্থাৎ সূর্যের তাপে জ্বলে ওঠা বনের আগুন) থেকে পাওয়া আগুনকে গুহাবাসী মানবরা নিবতে দিত না, কাঠকুটো দিয়ে বাঁচিয়ে রাখত, এমনকি হাজার হাজার বছর ধরে তারা এ ভাবে আগুনকে বাঁচিয়ে রাখত। নতুন অবস্থায় কাজের বিভাগের ফলে মানুষের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
পুরুষরা শিকারের কাজে এবং মেয়েরা ফলমূল আহরণ ও অন্যান্য কাজে দক্ষতা অর্জন করেছিল। দলের একাংশ অর্থাৎ বয়স্ক পুরুষরা যা শিকার করত, দলের মেয়ে পুরুষ বাচ্চা সবাই তা খেত। ফলে বৃদ্ধ ও শিশু কিশোররা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ যথা, হাতিয়ার বানানো, পোশাক তৈরি ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করতে পারত ।