আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় গুপ্তযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
গুপ্তযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
গুপ্তযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
গুপ্তযুগে প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অতি উচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করেছিল। গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যায়িত করা হয়। গুপ্তযুগে দেশের অর্থনৈতিক জীবনে বহু সমৃদ্ধি ঘটেছিল। কৃষিকাজ ছিল দেশে অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তবে গুপ্তযুগে বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটা প্রধান কারণ। ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় উপকূল থেকে বড় বড় নৌকা ও জাহাজে করে বাণিজ্য সম্ভার বিদেশে যেত।
পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্যভূক্ত দেশগুলির সাথে এবং পূর্ব দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে ভারতবর্ষের বাণিজ সম্পর্ক ছিল।
গুপ্তযুগে শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই নতুন প্রয়াস ও সাফল্যের স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায়। গুপ্তযুগে কাব্য ও নাটকের ক্ষেত্রে অসাধারণ উ ৎকর্ষ দেখা গিয়েছিল। মহাকবি কালিদাস, কবি হরিষেণ, নাট্যকার শুদ্রক ও বিশাখদত্ত প্রমুখ ছিলেন গুপ্তযুগের কবি ও সাহিত্যিক।
কালিদাসের রচিত মেঘদূত, শুদ্রক রচিত নাটক মৃচ্ছকটিক, বিশাখদত্ত প্রণীত নাটক মুদ্রারক্ষস প্রভৃতি সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে নন্দিত হয়েছে। শিল্প ও ভাস্কর্যের অপরূপ প্রকাশ গুপ্ত যুগে ঘটেছিল। উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দেওগড়ের দশাবতার প্রস্তর মন্দির ও ভিতগাওয়ের ইস্টক মন্দির এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। গুহা স্থাপত্যেও গুপ্তযুগের বিশেষ অবদান রয়েছে। অজন্তার ২৯টি গুহায় পর্বতগাত্র থেকে বিশাল বুদ্ধমূর্তি, স্তম্ভ, অলিল প্রভৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় ও গ্রীক পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের ফলে গুপ্ত যুগে ভারতবর্ষে ভূগোল, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আর্যভট্ট, বরাহ মিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞদের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। গুপ্তযুগে চিকিৎসাবিদ্যা, শল্যবিদ্যা (অস্ত্রোপচার ), রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতিতে অগ্রগতি ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে রসায়নবিদ নাগার্জুন ও চিকিৎসাবিদ ধন্বন্তরি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
গুপ্তযুগে বৌদ্ধধর্মের প্রভার কমেছিল এবং তার স্থানে হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হিন্দুধর্ম এখন যে রূপ লাভ করেছে তার প্রথম সুস্পষ্ট প্রকাশ গুপ্তযুগেই দেখা গিয়েছিল। নারদ বিষ্ণু, যাজ্ঞবন্ধ ও মনুসংহিতা প্রভৃতি স্মৃতি শাস্ত্র গ্রন্থ গুপ্তযুগেই সংকলিত হয়েছিল। বর্তমান কালে প্রচলিত হিন্দুধর্ম, আচার, নিত্যকর্ম, সমাজ বিধান ইত্যাদি বিষয়ে প্রামাণিক বিবৃতি গুপ্ত শাসনকালে প্রকাশিত হয়েছিল।
রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের কাহিনীগুলি খৃষ্ট জন্মের অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল; কিন্তু রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণকে বর্তমানে যে আকারে দেখা যায় তা গুপ্তযুগেই নির্ধারিত হয়েছিল। গুপ্তযুগে স্বভাবতই রাজতন্ত্র প্রাধান্য ও গুরুত্ব অর্জন করেছিল। গুপ্ত শাসনে সম্রাটই ছিলেন সমস্ত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু রাজাকে কেন্দ্র করে জমিদার প্রভৃতি সামন্তচক্রও গড়ে উঠেছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেলে ক্রমে গ্রামভিত্তিক ও জমিদার-সামন্তপ্রভু নির্ভর সামন্ত ব্যবস্থার উদয় ঘটে।
সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সমাজ ব্যবস্থাকে ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা গুপ্তযুগের পরবর্তী কালের সামন্ততন্ত্রের যুগের ইতিহাসকে মধ্যযুগের ইতিহাস রূপে গণ্য করতে পারি। ইউরোপের ইতিহাসে রোম সাম্রাজ্যের পতনের কালকে প্রাচীন যুগের অবসান রূপে গণ্য করা হয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসেও তেমনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কালকে প্রাচীন যুগের অবসান রূপে গণ্য করা চলে।
ভারতীয় ইতিহাসের কাল বিভাজনের ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদরা সাধারণত সুদুর অতীত কাল থেকে শুরু করে ১২০৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কালকে প্রাচীন যুগ বলে গণ্য করেন। আমরা এ কাল বিভাজনকে ভ্রান্ত মনে করি। বর্তমান গ্রন্থে গুপ্ত যুগের অবসান কালকে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শতকের মধ্য ভাগকে ভারতীয় ইতিহাসে প্রাচীন যুগের অবসান রূপে গণ্য করা হয়েছে।
আরও দেখুন :