আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় মানুষের চিন্তাধারার সামাজিক ভিত্তি। মানুষের চিন্তাধারার ভিত্তি কি? একটা মানবশিশু যখন জন্মায়, তখন তার মাথাটা থাকে একেবারে চিন্তাশূন্য। তার মাথায় কোনো রকম চিন্তাই থাকে না। তবে তার মাথায় মগজ থাকে, স্নায়ুকেন্দ্র থাকে, সারা গায়ে বিস্তৃত স্নায়ুতন্ত্র থাকে। এর ফলে কালক্রমে শিশু বড় হযে চিন্তা ইত্যাদি আয়ত্ত করতে পারে। প্রথমে তাকে শিখতে হয় ভাষা। কারণ ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব না। তবে ভাষা শেখার সাথে সাথে শিশু চিন্তা করতেও শিখতে থাকে।
চিন্তাধারার সামাজিক ভিত্তি
চিন্তাধারার সামাজিক ভিত্তি
কোনটা ভাল কোনটা মন্দ— এসব কথা শেখানোর মাধ্যমে তার পিতা মাতা, আত্মীয় স্বজন ও আশেপাশের মানুষ সমাজে প্রচলিত চিন্তাই তার মাথায় সঞ্চারিত করে। শিশু যখন বড় হয় তখন সে তাই সমাজে প্রচলিত চিন্তা ও প্রবণতাসমূহ আয়ত্ত করে।
সমাজে প্রচলিত চিন্তা ও প্রবণতা বলতে আমরা কি বুঝি? সমাজে দেখা যায় কেউ স্বার্থপর হয়, কেউ পরের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, কেউ প্রসন্নচিত্ত হয়, কেউ কোপন স্বভাবের হয়। এ রকম বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও প্রবণতা সমাজে আছে। আমরা কিন্তু এ ধরনের চিন্তার কথা এখানে আলোচনা করছি না। এগুলোও চিন্তা ও প্রবণতা বটে৷ তবে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের। এ ছাড়া আরেক ধরনের চিন্তাধারা আছে, তাকে বলা চলে সামাজিক পর্যায়ের চিন্তাধারা বা ভাবাদর্শ।
যেমন অতীতে এক সময়ে পৃথিবীতে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। তখন অবস্থাপন্ন ব্যক্তি বাজার থেকে দাস কিনে আনত। দাস অবশ্য সব হিসেবেই মানুষ, কিন্তু সামাজিক মানদণ্ডে দাস। এবং সে যুগের দাসমালিক শ্রেণীর মানুষরা দাসকে গরু ভেড়ার মতো সম্পত্তি বলে মনে করত। দাসের উপর অত্যাচার করলে বা দাসকে মেরে ফেললে কেউ তাতে দোষের কিছু দেখত না। সে যুগের একজন বিখ্যাত দাসমালিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন যে, দাসরা স্বাধীন মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট।
সে যুগের ভাবাদর্শের বিচারে দাসকে হেয় জ্ঞান করার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু এরিস্টটলের মতো পণ্ডিত না হলেও আমাদের দেশের যে কোনো সাধারণ মানুষও জানে যে, মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই এবং নিকৃষ্ট মানুষ বলেও পৃথিবীতে কিছু নেই। আরও উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে, দুঃখে কষ্টে পড়ে অনেকে এখনও আমাদের দেশে ছেলেমেয়ে বিক্রি করে, এ রকম খবর শোনা গেলেও কেউ কাউকে দাস বানিয়েছে বা বানানোর ইচ্ছা করে এমন কথা বিশেষ শোনা যায় না।
কারো যদি একজন বিনা পয়সার দাস থাকে তবে সে তাকে খাটিয়ে আরাম আয়েশে থাকতে পারে। কিন্তু এ প্রলোভন সত্ত্বেও আমাদের দেশে কেউ কাউকে ক্রীতদাস বানাতে চাইবে কি না সন্দেহ। যদি দু’ একজন এ রকম ইচ্ছা পোষণ করে, তবে সে যে সামাজিকভাবে ধিকৃত হবে তাতে সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে আমরা যে সমাজে বাস করি, তার সামাজিক ভাবাদর্শ দাসপ্রথার বিরোধী ।
আবার অতীতে পৃথিবীতে এমন এক সমাজ ছিল, যাকে বলা হয় সামন্ত সমাজ। সামন্ত সমাজে জমিদার এবং তার তাঁবেদার সামন্তরাই ছিল প্রভু শ্রেণীর মানুষ। সামন্ত সমাজে জমিদাররা প্রজাশোষণ করে নিজেদের ধনবৃদ্ধি করত। শোষণের ধরনটা ছিল বেগার খাটানো। জমিদাররা কৃষকদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে নিজেদের জমি চাষ ও অন্যান্য কাজ করাত।
অথচ আমাদের যুগে যদি শোনা যায় যে কেউ অন্যকে বিনা পারিশ্রমিকে জোর করে খাটাচ্ছে, তবে লোকে যে তাকে ঘৃণা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, যদিও সামন্ত যুগে লোকের কাছে ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিক মনে হত। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের যুগের ভাবাদর্শ সামন্ত ভাবাদর্শের বিরোধী।
অবশ্য আমাদের যুগের ভাবাদর্শের এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু অন্য সমাজের লোকের কাছে আশ্চর্যের মনে হবে। যেমন কেউ যদি কারখানা স্থাপন করে বা ব্যবসা করে ধনসঞ্চয় করে আমরা তাতে দোষের কিছু দেখি না। সহজ হিসেবে দেখা যাবে একজনকে মিলমালিক হতে হলে পাঁচ-সাতশ জনকে শ্রমিক হতে হবে। এরকম যদি একলক্ষ পুঁজিপতি হয় তবে বাকি সাত কোটি মানুষকে তার শ্রমিক বা কর্মচারী হতে হবে।
তথাপি আমরা এতে দোষের কিছু দেখি না। কারণ এ সমাজের ভাবাদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদের অর্থাৎ জমিজমা, সম্পত্তি, কলকারখানার উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ভাবাদর্শ। আমরা সবাই পুঁজিবাদকে ভাল মনে করি এবং মনে মনে আশা করি আমরাও পুঁজিপতি হব। ঠিক যেমন দাস সমাজে বিত্তহীনরাও দাস ব্যবস্থাকে ভাল মনে করত এবং সে যুগে মনে মনে আশা করত দাসমালিক হবার।
তবে আদিম সমাজের কোনো মানুষ যদি শুনত যে দেশের কারখানার উৎপাদিত জিনিস ব্যবহার করবে সারা দেশের মানুষ অথচ সে সম্পদের মালিক হবে অল্প কয়েকজন পুঁজিপতি, তবে তারা আশ্চর্য হত নিঃসন্দেহে। কারণ তাদের ভাবাদর্শ ছিল আদিম সাম্যবাদী সমাজের ভাবাদর্শ। আদিম শিকারীসমাজে উৎপাদনের উপায়সমূহ অর্থাৎ জমি, পশু ইত্যাদি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, তা ছিল সমস্ত ক্ল্যান বা ট্রাইবের সম্পত্তি।
আমরা মোটামুটি বুঝতে পারলাম যে, এক একটা সমাজে এক এক ধরনের চিন্তাধারা বা ভাবাদর্শ প্রসার লাভ করে। ইতিহাসের গতির সাথে সাথে পৃথিবীতে কোন কোন সমাজের উদয় হয়েছিল, সে বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়সমূহে আলোচনা করব। উপরে যেটুকু ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা এমন ধরে নিতে পারি যে, এক এক সমাজে তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুরূপ এক একটা ভাবদর্শ জন্মলাভ করে।
এ ভাবাদর্শ মানব সমাজের অস্তিত্বের পক্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো সমাজ ভাবাদর্শ ছাড়া বাঁচতে পারে না। সমাজের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থির হয় এ ভাবাদর্শের ভিত্তিতে। ভাবাদর্শ ছাড়া সমাজ অচল সমাজের সব লোক কতগুলো মূল বিষয়ে এক রকম বিশ্বাস ও ধারণা পোষণ করে বলেই তাদের মধ্যে মেলামেশা, লেনদেন, কাজ কারবার সম্ভব হয়। আমাদের সমাজে সবাই বিশ্বাস করে এবং জানে যে পারিশ্রমিক নিলে কাজ করতে হয়।
ঋণ করে ঘি খেলে পরিশ্রম করে তা শোধ দিতে হয়, অন্যথায় জেলে যেতে হয়। আদিম সমাজের সব লোক বিশ্বাস করত এবং জানত যে সবাই মিলে পরিশ্রম করে শিকার করা ও ক্ল্যানের সব কাজ করাই নিয়ম। সকলেই এ কথা মানত বলেই কেউ কাজে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা তো করতই না— ফাঁকি যে দেয়া চলে এমন আজব কথাও কারো মনে হত না। সমাজের সব মানুষের মধ্যে এ ভাবাদর্শের মিল ছিল বলেই আদিম সমাজ নির্বিঘ্নে চলতে পারত।
এক এক জন যদি এক এক রকম চিন্তা করত আর জনে জনে বুঝিয়ে বা জবরদস্তি করে যদি কাজ করান হত তবে সে সমাজ টিকতে পারত না। আর বোঝাতই- বা কে? সব সময় সমাজ সম্পর্কেই অবশ্য এ কথা মোটামুটি খাটে। কিন্তু ভাবাদর্শের এ মিল সমাজের মানুষদের মধ্যে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? এটা বুঝতে হলে ভাবাদর্শের প্রকৃত রূপ কি এবং তার উৎপত্তি হয় কিভাবে তা বুঝতে হবে। আমরা অবশ্য আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখব, এক এক দল মানুষ এক এক রকম চিন্তা করে।
কেউ মনে করে পুঁজিবাদ ভাল, কেউ মনে করে সমাজতন্ত্র ভাল, কেউ বা অন্য কিছু। একই সমাজে এত রকম ভাবাদর্শের সৃষ্টি হল কিভাবে? এ রকম হওয়ার কারণ হচ্ছে পৃথিবীতে যখন একটা সমাজ ভেঙে আরেকটা সমাজের সৃষ্টি হয়, তখন পুরান সমাজের ভাবাদর্শ, কিছু কিছু নতুন সমাজেও টিকে থাকে।
ফলে পৃথিবীতে ইতিহাস কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর একটা উৎসের পরিবর্তে একটা সমাজের ভাবাদর্শের দুটো উৎস দেখা দেয়— একটা হচ্ছে নতুন সমাজের ভাবাদর্শ আরেকটা হচ্ছে আগের সমাজের ভাবাদর্শের রেশ। এ দুয়ের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজের ভাবাদর্শ গড়ে ওঠে। আবার এমনও হতে পারে যে, পৃথিবীর একাংশে সমাজ এগিয়ে গিয়ে নতুন সমাজের সৃষ্টি করল। এখন এ অগ্রসরমান সমাজের ভাবাদর্শ সমসাময়িক অন্যান্য পশ্চাৎপদ সমাজের উপর প্রভাব ফেলবে।
যেমন ইউরোপে ষোল থেকে আঠার শতকের মধ্যে যখন হল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা জন্ম নিল তখন নতুন পুঁজিবাদী ভাবাদর্শ ইউরোপের অবশিষ্ট দেশের সামন্ত ভাবাদর্শের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করল। আমাদের দেশেও বর্তমানে সামন্ত ভাবাদর্শ এবং পুঁজিবাদী ভাবাদর্শের প্রভাব পড়েছে।
কিন্তু অতীতে যখন পৃথিবীতে প্রথম মানবসমাজের উদয় ঘটেছিল, যাকে আমরা পুরোপলীয় শিকারী সমাজ বলেছি, তখন আর কোনো প্রাচীনতর বা অগ্রসরতর সমাজ পৃথিবীতে ছিল না। তখন কিভাবে এবং কোন ভাবাদর্শের উৎপত্তি হয়েছিল? এ কথাটা বুঝলে আমরা সাথে সাথে আরও বুঝতে পারব, পরবর্তী কালের সমাজ সমূহের নতুন নতুন ভাবাদর্শের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল।
মানুষ সব সময় দলবদ্ধ হয়ে বাঁচে, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে, উৎপাদন করার জন্য তদের মধ্যে কাজের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এ সহযোগিতা কার্যকর করতে গিয়ে মানুষ ভাষা আয়ত্ত করেছিল অতীত কালে, একথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ভাষার সাথে সাথে মানুষ চিন্তাশক্তিও আয়ত্ত করেছে। চিন্তার সাহায্যে মানুষ ক্রমশ এক ভাব জগতের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ ভাব জগৎ বস্তু জগৎ থেকে সম্পূর্ণ সংযোগহীন নয়।
কারণ দেখা যায়, যে, চিন্তাধারা মানুষের জীবন ধারণ এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে সম্ভবপর এবং সহজতর করে তুলত, আদিম মানুষ সেসব চিন্তাধারাই আয়ত্ত করত। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, চোখের সামনে খাবার বা বল্গা হরিণের পাল দেখলে আদিম মানুষ যতখানি কর্মতৎপর হতে পারত ঠিক ততখানি কর্মপ্রেরণা তারা পেত নিজেদের কল্পিত ধ্যান-ধারণা থেকে। বস্তুময় জগৎ মানুষকে যতখানি অনুপ্রাণিত করতে পারে, তার ভাবাদর্শ বা ভাব জগৎও তাকে ততখানি অনুপ্রাণিত করতে পারে।
এ সকল ভাব ও চিন্তাধারা যে বাস্তবানুগ হতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। অবাস্তব ধারণাও মানুষের প্রেরণার উৎস হতে পারে। ভাবাদর্শের এহেন শক্তির কারণ হচ্ছে ভাবাদর্শ একটা সামাজিক সৃষ্টি। প্রথম কথা হচ্ছে, যেসব শব্দ বা কথা দিয়ে ভাবাদর্শ চিন্তাধারা গঠিত হচ্ছে, সে শব্দগুলো সমাজেরই সৃষ্টি এবং সমাজ জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলেই সেসব কথা বা চিন্তা অর্থপূর্ণ হয়।
তা ছাড়াও ঐ সব চিন্তাধারা মানুষকে প্রভাবিত করার শক্তি লাভ করে এবং নিজে একটা বাস্তবতা হিসাবে পরিচিত হয় শুধু এ কারণেই যে, সমাজ তাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। নিতান্ত অসম্ভব কথাও সমাজে সত্য বলে পরিগণিত হতে পারে, যদি সমগ্র সমাজ অর্থাৎ দলের সমস্ত মানুষ তাকে সত্য বলে গ্রহণ করে এবং ছোটকাল থেকে সবাইকে সেটা শেখানো হয়। সমস্ত লোকে যা বিশ্বাস করে তা অবিশ্বাস করার কথা কারো মনে কখনই জাগবে না।
কিন্তু আজগুবি যেনো কোনো চিন্তা মানুষের মাথায় এলে তাই কি সমাজের সকলের কাছে ভাবাদর্শ বলে গৃহীত হবে? তা হবে না। ভাবাদর্শের প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজকে সংহত করা বা একত্রে ধরে রাখা এবং তার কাজকর্মকে সহজ ও বিঘ্নশূন্য করা। আবার সমাজ টিকে থাকে উৎপাদন ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে। তাই এক একটা সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে তার ভাবাদর্শের সৃষ্টি হয়। উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখাই ভাবাদর্শের প্রধান কাজ।
উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য সমাজের মানুষদের মধ্যে যে রকম পারস্পরিক সম্পর্ক দরকার, ভাবাদর্শ সে ধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজেই সহায়তা করে। এসব ভাবাদর্শ বা চিন্তাধারা তাই সব সময় যে বিজ্ঞানসম্মত বা বাস্তবসম্মত হবে তার কোনো কথা নেই বরং তার বিপরীতটাই সত্যি। বিশেষত আদিম সমাজের ভাবাদর্শ কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞানতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
তা সত্ত্বেও আদিম গণতান্ত্রিক সমাজ পরিচালনায় সে ভাবাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুধু আদিমকালেই নয়, আমরা পরে দেখতে পাব যে, তার পরবর্তীকালের অনেক সমাজের ভাবাদর্শই অজ্ঞানতা ও অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেবলমাত্র আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভবের পরই মানুষের ধ্যান ধারণা বিজ্ঞান সম্মত হতে শুরু করেছে। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে ভাবাদর্শের সম্পর্ক ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টা উল্লেখ করে ভাবাদর্শের প্রসঙ্গ আপাতত শেষ করব।
আদিম সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে তার ভাবাদর্শের সৃষ্টি হয়েছিল। আদিম সমাজ ভেঙে যখন পরবর্তীকালের সভ্য সমাজ উদিত হয়েছিল, তখন এ ভাবাদর্শকে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত করে বা বর্জন করে নতুন ভাবাদর্শ সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দিল। নতুন ভাবাদর্শকে উৎপাদনব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়েছিল।
নতুন সমাজে পুরান ভাবাদর্শ অবশ্য একেবারে লোপ পেয়ে যায় না, তার রেশ রয়ে যায় কিছু কিছু লোকের চিন্তায় ও স্মৃতিতে এবং সেগুলো সঞ্চারিত হয় নতুন যুগের ভাবাদর্শেও। তা ছাড়া পৃথিবীর একাংশে যখন সভ্যতার উদয় হয়েছিল, বাকি পৃথিবীতে তখনও অনগ্রসর বনা ও বর্বর সমাজ রয়ে গিয়েছিল। এ সকল বন্য বা বর্বর সমাজকে অবলম্বন করে প্রাচীন ভাবাদর্শ অনেক কাল পৃথিবীতে টিকে ছিল।
বস্তুত আমরা বর্তমানকালে যে গণতন্ত্রের এত বড়াই করি, আদিম মানুষদের কাছেই আমরা তার জন্য অনেকাংশে ঋণী। মধ্য যুগে ইউরোপে সভ্য রোমক মানুষ এবং বর্বর জনগোষ্ঠীর মিলন ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে সামন্ত সমাজের উদয় হয়েছিল।
এ বর্বর জনগোষ্ঠী তাদের আদিম গণতান্ত্রিক চিন্তা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রবর্তন করেছিল ইউরোপের সামন্ত সমাজে এবং সে সকল গণতান্ত্রিক প্রথাই শেষ পর্যন্ত ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।