জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব

আজকের আলোচনার বিষয় জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত। জ্ঞাতিত্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে: জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্যের সামাজিক কিংবা | প্রাকৃতিক নির্মাণ। এই অর্থে, জ্ঞাতিত্ব একইসাথে প্রাকৃতিক বা জৈবিক, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। গোড়াপত্তন থেকে বর্তমানকাল, এই দেড়শত বছরের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তি ছিল কিছু শক্তিশালী পূর্বানুমান।

প্রথমত, ধরে নেয়া হয়েছিল জ্ঞাতিত্ব সকল সমাজে বিভাজন তৈরী করে: কারা রক্ত (অথবা, কোন কোন সমাজে জ্ঞাতিবন্ধনের ভিত্তি হচ্ছে হাড়, আর কোথাও বীর্য) সূত্রে জ্ঞাতিবন্ধনে আবদ্ধ এবং কারা জ্ঞাতিকুল না, এটা একটি কেন্দ্রীয় বিভাজন। দ্বিতীয়ত, ধরে নেয়া হয়েছিলো, এই বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে জন্মদান সংক্রান্ত প্রাকৃতিক বিষয়াবলী । প্রজনন (procreation) এবং রক্ত সম্পর্ক (blood-relatedness) – এগুলো হচ্ছে মৌলিক সত্য কারণ এগুলো প্রাকৃতিক (অপরিবর্তনীয়, অনড়, অটল অর্থে) এবং বিশ্বজনীন (সময়কাল এবং স্থানিক ভিন্নতার ঊর্ধ্বে)।

 

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব

 

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব

এ দুটি কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান তৈরী করে দেয় তৃতীয় পূর্বানুমান: জৈবিকতা হচ্ছে জীববিজ্ঞানীদের কার্যক্ষেত্র, নৃবিজ্ঞানীদের কার্যক্ষেত্র হচ্ছে জৈবিকতার সাংস্কৃতিক নির্মাণ। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নৃবিজ্ঞানীদের জন্য কেন্দ্রীয়, কিন্তু এগুলো জৈবিক সম্পর্ক হতে উদ্ভূত, জৈবিকতার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নির্মাণ এক সমাজ হতে আরেক সমাজে ভিন্ন হতে পারে, উদাহরণস্বরূপ: মান্দাই সমাজ হচ্ছে মাতৃতান্ত্রিক, পক্ষান্তরে চাকমারা পিতৃতান্ত্রিক, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে জমি বাপ-চাচাদের সাথে চাষ করা হয়, আবার কোথাও কোথাও মামাদের সাথে; বাঙ্গালী মুসলমানেরা যাকে “ফুপু” ডাকেন, বাঙ্গালী হিন্দুরা তাকে ডাকেন “পিসী” ইত্যাদি ।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। কেন্দ্রীয় হবার কারণ হিসেবে সাধারণত যে বিষয়গুলো নৃবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেন, তা হ’ল: জ্ঞাতিত্বের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অর্থ কেবলমাত্র নৃবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করেন, এ বিষয়ে কেবলমাত্র তাঁরা গবেষণা চালান, লেখালেখি করেন।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান কেবলমাত্র নৃবিজ্ঞানীদেরই আছে, সে কারণে এটা একান্তভাবে নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ইত্যাদি। সাম্প্রতিক কালে এধরনের কথাবার্তা আরও তলিয়ে দেখা হচ্ছে। নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের কেন্দ্রিকতা ও গুরুত্বের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন কিছু নৃবিজ্ঞানী। সেটি এরকম: পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় বিশ্বের সকল সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত: “আদিম” এবং “সভ্য”।

সমাজের এই বিভাজন পাশ্চাত্য ইতিহাসে কয়েকশত বছর পুরোনো। পাশ্চাত্যীয় ধ্যান-ধারণায় এটি প্রতিষ্ঠিত যে, আদিম সমাজ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, সভ্য সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। পাশ্চাত্যের ইতিহাসে আদিম এবং সভ্যের এই বিভাজন শুধুমাত্র বিশ্বের সকল সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করেনি, জ্ঞানজগতের একটি শ্রম বিভাজনকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। নৃবিজ্ঞান (এবং নৃবিজ্ঞানীদের) ক্ষেত্র হচ্ছে সরল, জ্ঞাতি ভিত্তিক, রাষ্ট্রবিহীন সমাজ যেখানে আছে উপহার অর্থনীতি, পক্ষান্তরে সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হচ্ছে আধুনিক, শিল্প ভিত্তিক এবং (উৎপত্তি অর্থে) পাশ্চাত্য সমাজ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নৃবিজ্ঞানের গোড়াপত্তনের সময়ে, যখন কিনা “আদিম সমাজ” বিষয়বস্তু হিসেবে স্বীকৃত হয়, সেই একই সময়কালে “সমাজ” মানেই “জ্ঞাতিত্ব”, এই প্রত্যয়গত সমীকরণও ঘটে। এবং এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে আদিম সমাজের গঠনমূলক একক হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব। ক্ষুদ্র পরিসরে আদিম সমাজ কিভাবে সংগঠিত, কিভাবে কাজ করে – এগুলো বোঝার জন্য জ্ঞাতিত্ব অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, পাশ্চাত্য মানসে আদিম সমাজ নামক যে বর্গ ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠে, একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা এই বর্গকে জ্ঞানজাগতিক বৈধতা দান করে। আদিম সমাজ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নৃবিজ্ঞানীরা আদিম সমাজের কিছু মূলনীতি দাঁড় করান, যেটির মধ্যে কেন্দ্রীয় হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব। যেমন ধরুন নৃবিজ্ঞানী ফোর্টসের এই কথাগুলো: আদিম সমাজের সামাজিক জীবনের সাংগঠনিক মূলনীতি হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব, এটি একটি অনস্বীকার্য সত্য। আদিম সমাজে “সমাজ” মানেই জ্ঞাতিত্ব – এই ধারণার ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করেন, এবং বিভিন্ন তত্ত্ব দাঁড় করান।

এর – মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বংশধারা তত্ত্ব: সামাজিক দল গঠনের ভিত্তি হচ্ছে বংশধারা। এই দলগুলো বহির্বিবাহ নীতি অনুসরণ করে, কন্যা বিনিময়ের ভিত্তিতে দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। নৃবিজ্ঞানীরা আরও ধরে নেন যে, জ্ঞাতি পদাবলী সামাজিক সংগঠন প্রকাশ করে। জ্ঞাতি ভিত্তিক আদিম সমাজের যে সামাজিক ব্যবস্থা, সেটি, নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পাশ্চাত্য সমাজ হতে খুব ভিন্ন। আদিম বা অপাশ্চাত্য সমাজে জ্ঞাতিভিত্তিক সংগঠন যে ভূমিকা পালন করে, সেই ভূমিকা পাশ্চাত্য সমাজে পালন করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র।

 

জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব

 

গত দুই দশক ধরে, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের পূর্বানুমান, এবং আরও মৌলিক বিষয় যেমন “আদিম” ও “সভ্যতার” পাশ্চাতীয় বিভাজন নিয়ে, তীব্র সমালোচনা উচ্চারিত হচ্ছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের যেই পাঠ এই পুস্তকের তিনটি ইউনিটে লিখিত হয়েছে, সেখানে দুই ধরনের কাজই উপস্থাপন করা হচ্ছে। গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে একশত বছরের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন এবং হাল আমলের চিন্তাভাবনা যা ভিন্নধরনের কাজের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের শিক্ষার্থী হিসেবে দু’ ধরনের কাজের সাথেই আপনার পরিচিত হওয়া সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী। চতুর্থ ইউনিটের শেষতম পাঠে জ্ঞাতিত্বের যে মূল সংজ্ঞা – জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্যের সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক নির্মাণ – তার – প্রত্যয়গত পূর্বানুমান তুলে ধরা হবে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment