Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

দক্ষিণ ভারতে আন্ধ্র বা সাতবাহন সাম্রাজ্য

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় দক্ষিণ ভারতে আন্ধ্র বা সাতবাহন সাম্রাজ্য। সাতবাহন সাম্রাজ্য একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পরবর্তী সাড়ে চারশত বছর ধরে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজ্য হিসেবে সাতবাহনরা গণ্য হলেও মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজবংশের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে তারা পশ্চিমী ক্ষত্রপ রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

দক্ষিণ ভারতে আন্ধ্র বা সাতবাহন সাম্রাজ্য

 

 

দক্ষিণ ভারতে আন্ধ্র বা সাতবাহন সাম্রাজ্য:

শক, পহ্লব প্রভৃতি যত বিদেশি শত্রু ভারতে প্রবেশ করে তাদের অনেকের সাথেই আন্ধ্র বা সাতবাহনদের দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ হয়। এ আন্ধ্ররা মৌর্য-সাম্রাজ্যের পতনের পর দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা প্রথম শতাব্দীতে আন্ধ্র যা হোক, অশোকের মৃত্যুর অল্পকাল পরেই আনুমানিক ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিশাল মৌর্য-সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। মৌর্যদের পতনের সাথে সাথে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক-ঐক্য লুপ্ত হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অশোক যে কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেছিলেন সেই কলিঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয় এবং খারবেল নামে কলিঙ্গের এক রাজা উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ জয় করে নেন।

 

 

দক্ষিণ ভারতে আন্ধ্র বা সাতবাহন বংশের রাজারা এ সময়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, এবং পশ্চিম ও মধ্য ভারতের বহু স্থান তাঁদের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। সম্ভবত সাতবাহনদের হাতেই খারবেলের সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে মৌর্য বংশের পতনের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুঙ্গ বংশ।

 

সাতবাহন সাম্রাজ্যের বংশ ও জাতি পরিচয়, আদি নিবাস ও প্রথম রাজ্য স্থাপন:

ওড়িশায় যখন চেদি রাজবংশের পত্তন ঘটছিল তখন মহারাষ্ট্রে (মতান্তরে অন্ধ্রপ্রদেশে) এক নতুন রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। ক্ষুদ্র এক অঞ্চলের অধিপতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে ধীরে ধীরে এই বংশের রাজারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। প্রায় তিন শতাব্দী কাল এই রাজবংশ পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসে এই রাজবংশ সাতবাহন বা শাতবাহন নামে প্রসিদ্ধ।

সাতবাহন সাম্রাজ্য বংশের নামকরণ :

কেন এই বংশের নাম সাতবাহন তার সঠিক উত্তর আজও মেলেনি। কিছু কিছু উত্তর অবশ্যই এসেছে কিন্তু তা আনুমানিক বৈ তাে নয়। সাতবাহন পদটি মুণ্ডা ‘সাদম’ এবং ‘হপন’ হতে নিষ্পন্ন বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ‘সাদম’-এর অর্থ ঘােড়া, ‘হপন’-এর অর্থ পুত্র। তারা মনে করেন, অশ্বমেধ যজ্ঞ যিনি অনুষ্ঠান করেছেন তার পুত্র এই অর্থে সাতবাহন। আবার কেউ কেউ বলেন, অশােকের অনুশাসনে যাদের সত্যপুত্র বলা হয়েছে তারাই সাতবাহন। দেববাচক তামিলপদ ‘শাওন’ হতে সাতবাহন বা শাতবাহন উদ্ভূত, এরূপ মতও প্রচলিত। আবার অনেকে সাতবাহন কথাটি সূর্যের সপ্তবাহন অভিধা হতে এসেছে বলে মনে করেন। সাত ঘােড়ার রথে চড়ে সূর্যদেব ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা করছেন এ কাহিনি সুপরিচিত। হয়তােবা সাতবাহন রাজারা নিজেদের সূর্য বা ইক্ষ্বাকুবংশীয় বলে মনে করতেন। আবার বিষ্ণুর সপ্তবাহন নাম হতে বংশের নাম সাতবাহন হয়েছে, এমন অভিমতও আছে।

সাতবাহন সাম্রাজ্য জাতি-পরিচয় :

সাতবাহন রাজাদের জাতি-পরিচয় সম্পর্কেও ঐতিহাসিক মহলে বাগ বিতণ্ডা আছে। অনেকে সূর্যের প্রতিশব্দরূপে সাতবাহন পদের ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের ধারণা সাতবাহনরা জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। এই বংশের এক রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণিকে রাজমাতা বলার নাসিক প্রশস্তিতে ‘এক-ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়-দর্প-মান-মর্দন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে সাতবাহনরা ব্রাহ্মণ ছিলেন এরকম একটি মতও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এক ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘ক্ষত্রিয়’ পদ দুটির ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে অন্ধ্ররা ‘দস্যু’ বলে ধিকৃত হয়েছেন। মনু সংহিতায় তাদের নিচ জাতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণে সিমুককে ‘বৃষল’ অর্থাৎ পতিত বা বর্ণচত বা শূদ্র আখ্যা দেয়া হয়েছে। সালিবাহন বা সাতবাহন রাজাদের ধমনীতে যে ব্রাহ্মণ ও নাগ রক্ত প্রবাহিত ছিল তা ‘দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে। সম্ভবত সাতবাহনরা অনার্য গােষ্ঠীর লােক ছিলেন কিন্তু পরে নিজেদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেন। তবে অন্ধ্রদের সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে যেসব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় রক্ষণশীল সমাজ সাতবাহনদের ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করেনি।

 

সাতকর্ণি বা শাতকর্ণি পদের অর্থ :

সাতবাহন রাজাদের অনেকেই সাতকর্ণি বা শাতকণি পদবি গ্রহণ করেছেন। ‘সাতটি তীর’, ‘সূর্যের সাত রশ্মি’, সাত বা শতেক কান আছে যার ইত্যাদি অর্থে পদটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুক্তি নয়, কল্পনাই যেন ব্যাখ্যাগুলোকে আশ্রয় করে আছে। সংস্কৃত ‘শত’ থেকে ‘শাত’ কথাটি এসেছে

আদি নিবাস অন্ধ্রে :

পুরাণাদি গ্রন্থে সাতবাহন রাজাদের অন্ধ্র, অন্ধ্রজাতীয় এবং অন্ধ্রভৃত্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ থেকে অনেকে অনুমান করেন সাতবাহনরা অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। আবার অনেকের ধারণা সাতবাহনরা অন্ধ্রজাতীয় ছিলেন কিন্তু অন্ধপ্রদেশের অধিবাসী নন। তারা মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব যুগে অন্ধ্ররা বিন্ধ্যের দক্ষিণে বিদর্ভ বা বেরারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাস করতেন, অন্ধ্রে তারা বসতি স্থাপন করেন আরও কিছুকাল পর, খ্রিস্টীয় ২য় শতকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন সাতবাহনদের অন্ধ্রপ্রদেশ বা অন্ধ্রজাতি কোনওটির সঙ্গেই সংযােগ ছিল না, পুরাণ সংকলনের সময় তারা অন্ধ্রপ্রদেশে রাজত্ব করায় ভুলক্রমে তাদের অন্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। এই মত যারা পােষণ করেন তারা অন্ধ্রভৃত্য পদটিকে অন্ধ্রদের ভৃত্য অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে সাতবাহন রাজারা কন্নড় ভাষাভাষী ছিলেন, কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় তাদের আদি বাসস্থান ছিল। তবে সাতবাহনরা জাতিতে যে অন্ধ্র ছিলেন তা বােধহয় স্বীকার করাই ভালাে। পুরাণে তাদের শুধু অন্ধ্রভৃত্যই বলা হয়নি, অন্ধ্র ও অন্ধ্রজাতীয় বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। অন্ধ্রভৃত্য কথাটি সম্ভবত যে অন্ধ্ররা ভৃত্য ছিলেন এই অর্থেই কর্মধারয় সমাসরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয় সাতবাহনরা প্রথম দিকে কাণ্ব বা অন্য কোনও রাজবংশের প্রতি অনুগত ছিলেন। অনেকে তাদের মৌর্যদের অধীনস্থ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন আর সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে সময়ের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অন্ধ্রজাতি প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগে বিন্ধ্যাঞ্চলে বসবাস করতেন, এ মত সমর্থনযােগ্য নয়। অনেক পূর্বে এ অঞ্চলে হয়তাে তাদের বাস ছিল। অশােকের লেখমালায় অন্ধ্রকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গােদাবরী-কৃষ্ণা বিধৌত বা তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চলে অশােকের কয়েকখানি অনুশাসনও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশেই সাতবাহন রাজাদের আদি বাসভূমি ছিল বলে মনে হয়।

 

সর্বপ্রথম রাজ্য স্থাপন মহারাষ্ট্রে :

 

সাতবাহন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকাল:

পুরাণ মতে খ্রি.পূ. ৩য় শতক :

সাতবাহন রাজারা ঠিক কতদিন রাজত্ব করেছিলেন, তাদের রাজত্বের শুরুই বা কখন হয়েছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত নন। অনেকে মনে করেন মৌর্য সম্রাট অশােকের মৃত্যুর অল্পকাল পরই অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষ ভাগে এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। এ মতের সমর্থনে যে যুক্তি নেই তা নয়। কোনও কোনও পুরাণে বলা হয়েছে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪ ৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ২২৫ অব্দ নাগাদ সাতবাহন শাসনের যে অবসান ঘটেছিল তা প্রায় সুনিশ্চিত। পুরাণের উক্তি সঠিক হলে বুঝতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের শেষপর্বেই সাতবাহন রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

 

পুরাণ নিয়ে সন্দেহ :

কিন্তু পুরাণােক্ত তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কোনও কোনও পুরাণে সাতবাহনরা ৪৫৬ বা ৪৬০ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এমন পুরাণও আছে যেখানে সাতবাহন রাজারা তিন শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। সাতবাহন রাজাদের সংখ্যা সম্পর্কেও বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। কোনও কোনও পুরাণে ত্রিশজন রাজার কথা বলা হয়েছে। উনিশজনের নামােল্লেখ আছে এমন পুরাণও আছে। এই ধরনের পরস্পর বিরােধী পৌরাণিক তথ্যের উপর নির্ভর করে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকাল নির্ধারণ করা যায় না। সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক কাগরাজ সুশর্মাকে পরাজিত করেছিলেন একথা প্রায় সব পুরাণে বলা হয়েছে। মৌর্যশুঙ্গ বা কাণ্ব রাজারা যে যথাক্রমে ১৩৭, ১১২ ও ৪৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন সে সম্পর্কেও সব কটি পুরাণ মােটামুটি একমত। এই যুক্তিতে ৩২৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ মৌর্যরাজ্য প্রতিষ্ঠার ২৯৪ বছর পর অর্থাৎ ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাতবাহন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে।

 

লেখ ও উৎখনন থেকে অনুমান :

সাতবাহন রাজত্বের একেবারে গােড়ার দিকে নানাঘাট, নাসিক ও সাটীতে কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ হয়েছিল। এই লেখগুলো নিঃসন্দেহে হেলিওডােরাসের বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখের পরবর্তী। হেলিওডােরাসের লেখখানি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের শেষভাগে উৎকীর্ণ হয়েছিল। ফলে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে। মহারাষ্টের আহম্মদনগর জেলার নেভাসায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাহায্যে শান্তারাম বালচন্দ্র দেও (H. D, Sankalia (Ed.), From History to Pre-lis/ory at Nvasa (Poona, 1960), পৃ. ১৬২) সাতবাহন রাজত্বের সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে ধার্য করেছেন। নেভাসায় উৎখননের ফলে যে কয়েকটি জনবসতি-পর্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব দু’টির কালসীমা যথাক্রমে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথমার্ধ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রারম্ভ ও খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর সূচনা হতে ২য় – ৩য় শতক। চতুর্থ পর্বের ভূমিসংস্তরে সাতকর্ণি ও সাতবাহন নামে যে দু’জন সাতবাহন রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে তারা সকলেই আদি পর্বের। পঞ্চম পর্বে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির মতাে উত্তরকালীন দু’জন সাতবাহন নৃপতির মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। নেভাসায় চতুর্থ জনবসতি পর্বের যে কালসীমা নির্দিষ্ট হয়েছে তারই ভিত্তিতে সাতবাহন রাজবংশের অভ্যুদয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-২য় শতকে নির্ধারিত হয়েছে।

 

নেভাসার উৎখনন নিয়ে বিতর্ক :

কিন্তু যে পদ্ধতিতে নেভাসায় আদি-ঐতিহাসিক পর্বগুলোর সময়রেখা নির্ণীত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত, ত্রুটিপূর্ণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যেসব উপাদানের উপর নির্ভর করে এই পর্ব সমূহের কালক্ৰম চিহ্নিত হয়েছে তাদের একটি হল সাতবাহন মুদ্রা। অর্থাৎ মূলত সাতবাহন মুদ্রার সম্ভাব্য তারিখের ভিত্তিতেই নেভাসার জনবসতি-পর্বগুলোর সময়সীমা নির্দিষ্ট হয়েছে যে মুদ্রার তারিখ সম্পর্কে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে সে মুদ্রা ভূ-সংস্তর তথা পর্বের কালক্ৰম ধার্যের দিকচিহ্নরূপে বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া যে যুক্তির ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত খাড়া করা হয়। সেই সিদ্ধান্তকেই আবার সেই একই যুক্তির প্রমাণরূপে উপস্থাপন করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নেভাসায় নির্বাহিত উৎখনন হতে প্রাপ্ত আর একটি তথ্য সাতবাহন রাজত্বের এই প্রাচীনত্বের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। রাজা সাতবাহনের সবকটি মুদ্রাই আবিষ্কৃত হয়েছে চতুর্থ পর্বের উচ্চতম ভূ-সংস্তরে। এই স্তর খ্রিস্টীয় ১ম শতকের অতি নিকটবর্তী।

 

খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্যান্য তথ্য :

খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে সাতবাহন পর্বের শুরু, এ অভিমতের সপক্ষে পুরাণদি ছাড়া আরও কিছু তথ্য আছে –

 

সাতবাহন সাম্রাজ্য রাজবৃত্তান্ত: 

রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক:

সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক বা শ্রীমুখ। কোনও কোনও পুরাণে তাকে কাপ্তদের ভৃত্য বলা হয়েছে। মনে হয় কাণ্বদের অধীনে এক রাজকর্মচারিরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কিন্তু কালক্রমে সম্ভবত মহারাষ্ট্রে তিনি এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিমুক শুঙ্গ এবং কাণ্বদের নির্মূল করে পৃথিবী জয় করেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। অনেকের ধারণা তিনি শুঙ্গ এবং কাদের কাছ থেকে বিদিশা অঞ্চল অধিকার করেন। মগধ বা উত্তর ভারতের অন্য কোনও অঞ্চল যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল না, তা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। জৈন গ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, শেষ জীবনে সিমুক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় পরিণামে তাকে সিংহাসন ও প্রাণ দুই-ই হারাতে হয়। জৈন বিবরণ কতখানি বস্তুনিষ্ঠ তা বলা কঠিন। পৌরাণিক তথ্য অনুসারে সিমুক ২৩ বছর রাজ্য শাসন করেন। ছিমুকের নামাঙ্কিত কতিপয় মুদ্রা অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটলিঙ্গলে আবিষ্কৃত হয়েছে (Numismatic Digesi. Vol. II. Part 1, পৃ. ১০)। ছিমুক নিঃসন্দেহে সিমুক। সিমুকের পর রাজা হন তার অনুজ কৃষ্ণ। তার রাজত্বকালে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের বসবাসের জন্য নাসিকে একটি গুহা খনন করা হয়। পৌরাণিক মতে তিনি ১৮ বছর রাজত্ব করেন।

প্রথম সাতকর্ণি:

পিতা : সাতবাহন বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণি। পুরাণে তাকে কৃষ্ণের পুত্র বলা হয়েছে। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে সাতবাহন রাজপরিবারের অনেক সদস্যেরই মূর্তি খােদিত আছে। প্রতিটি মূর্তির শীর্ষদেশে পরিচয়জ্ঞাপক লেখও আছে। বর্তমানে এই মূর্তি ও লেখগুলোর সিংহভাগই বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাহলেও প্রথম ও দ্বিতীয় মূর্তি যে যথাক্রমে সিমুক এবং প্রথম সাতকর্ণির সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ প্রথম সাতকর্ণির পিতা হলে তার মূর্তি অবশ্যই সিমুক ও প্রথম সাতকর্ণির মূর্তির মাঝখানে খােদিত থাকত। তা না থাকায় অনেকে মনে করেন, কৃষ্ণ নন, সিমুকই সাতকর্ণির পিতা।

 

প্রথম সাতকর্ণির প্রতিপত্তি ও রাজ্যবিস্তার :

প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকালে সাতবাহন রাজবংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। প্রভাবশালী মহারঠি পরিবারের কন্যা নায়নিকা বা নাগনিকাকে বিবাহ করে তিনি আপন শক্তি বৃদ্ধি করেন। তার আমলের একখানি লেখ সাচীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে সাতবাহন রাজ্যের বিস্তারের সপক্ষে এটি একটি জোরালাে প্রমাণ। সাত নামাঙ্কিত মালবশ্রেণির কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। অনেকের মতে এই সাত প্রথম সাতকর্ণি। ফলে মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলসহ উত্তর মহারাষ্ট্র যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল মুদ্রার তথ্যে তার সমর্থন পাওয়া যায়। নানাঘাট গিরিপথের গায়ে মহিষী নাগনিকার একখাটি লেখ খােদিত আছে। ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি একজন অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক ৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন। এই গ্রন্থে সােপারা এবং কল্যাণ নামে থানা জেলার দু’টি বাণিজ্যকেন্দ্রকে বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস-এর রাজ্যভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। স্যারাগেনাস কথাটি সম্ভবত সাতকর্ণি পদের গ্রিক অপভ্রংশ। বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। আবার অনেকে মনে করেন এই বর্ষীয়ান স্যারাগেনাস প্রথম সাতকর্ণি নন, তার এক উত্তরসূরি। লেখে প্রথম সাতকর্ণিকে ‘দক্ষিণাপথপতি’ ও ‘অপ্রতিহতচক্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনার মধ্যে হয়তাে অতিশয়ােক্তি আছে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের বৃহদংশের তিনি অধিপতি ছিলেন, সমগ্র দক্ষিণ ভারতের নয়।

 

কলিঙ্গরাজ খারবেলের সাথে যুদ্ধ :

প্রথম সাতকর্ণির সময় পূর্ব উপকূলবর্তী কলিঙ্গ রাজ্যটি পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চেদিবংশীয় খারবেল তখন কলিঙ্গের অধিপতি। তিনি তার হাথীগুম্ফা লেখে দাবি করেছেন, সাতকর্ণির কথা না ভেবে তিনি পশ্চিম দিকে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান এবং কৃষ্ণা তীরবর্তী অসিকনগর জয় করেন। হাথীগুম্ফা লেখে যে সাতকর্ণির কথা বলা হয়েছে তিনি সম্ভবত প্রথম সাতকর্ণি। সাতকর্ণির সঙ্গে খারবেলের ঠিক কী সম্পর্ক ছিল হাথীগুম্ফা লেখে তার কোনও স্পষ্ট আভাস নেই। ফলে খারবেলের উক্তির প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। এ সম্পর্কে তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে হয় :

নানাঘাট লেখে বলা হয়েছে প্রথম সাতকর্ণি একটি রাজসূয় ও দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাছাড়া তিনি আরও অনেক যাগযজ্ঞের আয়ােজন করেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ দু’টির মধ্যে প্রথমটি সম্ভবত তার সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পর এবং দ্বিতীয়টি রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খারবেলকে তিনি যদি সত্যই পরাজিত করে থাকেন তাহলে হয়তাে সেই বিজয় উপলক্ষে তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন করেন।

 

দুর্দিনের আবির্ভাব

মনে হয়, প্রথম সাতকর্ণির মৃত্যুকালে তার দুই পুত্র বেদী ও শক্তিশ্রী নাবালক ছিলেন। ফলে তার বিধবা পত্নী নাগনিকা প্রথমে বেদশ্রী এবং পরে বেদশ্রীর মৃত্যুতে শক্তিশ্রীর অভিভাবিকারূপে রাজ্য শাসন করেন। এই সময় থেকে প্রায় শতাব্দী কাল পর্যন্ত সাতবাহন রাজ্যের ইতিহাস অনেকটাই তমসাচ্ছন্ন। পুরাণে শক্তিশ্রীর নাম নেই, সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে সেখানে পূর্ণোৎসঙ্গের উল্লেখ আছে। পুরাণে এর পর দ্বিতীয় সাতকর্ণির নাম করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এই দ্বিতীয় সাতকর্ণি সাঁচী এবং হাথীগুম্ফা লেখের সাতকর্ণি। বলা বাহুল্য, এ মত অনেকে স্বীকার করেন না।

দ্বিতীয় সাতকর্ণির পর যারা ক্রমান্বয়ে সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন পুরাণে তাদের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই রাজাদের প্রকৃত নাম এবং সংখ্যা নিয়ে পরাণে পুরাণে মতভেদ। আর তারা সকলেই অতি সাধারণ মানের রাজা ছিলেন, তাদের না ছিল যােগ্যতা, না ছিল সদিচ্ছা। তাদের দুর্বলতার সুযােগে পরাক্রান্ত শকরা সাতবাহন রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের অধিকারভুক্ত করেন।

‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থখানি থেকে জানা যায়, সােপারা এবং কল্যাণ বন্দর দুটি পূর্বে সাতবাহন রাজাদের অধীন ছিল কিন্তু পরে তা স্যান্ডারেস-এর হস্তগত হয়। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মাঝামাঝি সময় এই রাজনৈতিক পালা বদল ঘটে। স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন।

কোঙ্কণ উপকূলসহ মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই শক আধিপত্য বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। শক রাজা নহপানের (খ্রিস্টাব্দ ১০০-২৪) বেশ কিছু মুদ্রা এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। নহপানের জামাতা ঋষভদত্তের কয়েকখানি লেখ পুণা জেলার নাসিক ও কার্লেতে পাওয়া গেছে। মনে হয়, অধিকৃত মহারাষ্ট্রের শাসনভার নহপান জামাতার হাতে তুলে দেন। সাতবাহন রাজারা এই সময় মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। সেখানেও নহপানের পূর্বেই ক্ষত্রপ ভূমক শক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।

 

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি

সিংহাসনে আরোহন :

নহপানের ক্ষত্রপপদে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি সাতবাহন সিংহাসনে আরােহণ করেন। আনুমানিক ১০৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩০ অব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন বলে অনেকে মনে করেন। ইতিহাসে গৌতমীপুত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সাতবাহনরাজরূপে স্বীকৃত।

শকরাজ নহপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ :

যে সাফল্যের জন্য তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সেই সাফল্য এসেছিল তার রাজত্বের শেষ পর্বে। তার রাজত্বের প্রথম সতেরাে বছর তাকে শক্তি সঞ্চয়ের কাজে ব্যয় করতে হয়। নহপান ও তার জামাতা ঋষভদত্ত সাতবাহন ভূখণ্ডের এক বিস্তীর্ণ অংশ অধিকার করে আছেন। অধিকৃত ভূখণ্ড হতে শকদের উচ্ছেদ করা সহজসাধ্য ছিল না। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল পরিপূর্ণ প্রস্তুতির। সে কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে সাফল্যের বাতায়ন খুলে যায়। তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছর থেকে বিজয়লক্ষ্মী তার প্রতি প্রসন্ন হন। ওই বছরে উৎকীর্ণ তার নাসিক লেখ থেকে জানা যায়, ক্ষহরাতগণের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সসৈন্যে কিছুকাল নাসিক জেলার বেনাকটক গ্রামে অবস্থান করেন। তখন ত্রিরশ্মি পর্বতবাসী সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি একখণ্ড জমিও প্রদান করেন।

জমিখানি পূর্বে ঋষভদত্তের অধিকারভুক্ত ছিল। ওই একই বছরে উৎকীর্ণ তার কার্লা লেখ থেকে জানা যায়, তিনি বলুরকগুহাবাসী সন্ন্যাসীদের মামাল আহারের অন্তর্ভুক্ত করজক গ্রাম দান করেন। এই গ্রামটিও পূর্বে ঋষভদত্তের অধীনস্থ ছিল। নাসিক ও কালার লেখ দুখানি গৌতমীপুত্রের সাফল্যের দু’টি সুনিশ্চিত প্রমাণ। এই লেখ দু’টি হতে জানা যায়, গৌতমীপুত্র তার রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে অর্থাৎ আনুমানিক ১২৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্র হতে নহপানদের উচ্ছেদ করেন। গৌতমীপুত্র যে নহপানকে যুদ্ধে পরাজিত করেন তা নাসিক জেলার জোগলথেম্বি গামে পাওয়া মুদ্রার সাক্ষ্যেও প্রমাণিত। এই গ্রামে সর্বসমেত ১৩২৫০টি রূপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।

এই মুদ্রাগুলোর এক তৃতীয়াংশ নহপানের। বাকি মুদ্রাও নহপানের কিন্তু সেগুলো গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত। মহারাষ্ট্রের ক্ষহরাত অধিকারভুক্ত অঞ্চলে নহপানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। সে অঞ্চলে নিজের অধিকার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পুরােনাে মুদ্রায় নিজের নাম এবং প্রতীক অঙ্কিত করে গৌতমীপুত্র সেগুলো পুনরায় প্রচার করেন। পুত্র গৌতমীপুত্র ক্ষহরাত বংশ নিধন করেছেন বলে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রী নাসিক প্রশক্তিতে দাবি করেছেন। গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নহপান সম্ভবত নিহত হন।

শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার :

নহপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ গৌতমীপুত্রের একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তিনি শক, যবন ও পহ্লবদের সংহার করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে (সক-পহলব-যবন-নিসুদনস)। ক্ষহরাতরাই শক। যে গ্রিক ও পহ্লবগণকে গৌতমীপুত্র পরাজিত করেন তারা সম্ভবত নহপানের বেতনভুক সৈন্য ছিলেন। নাসিক প্রশস্তিতে ঋষিক (কৃষ্ণা তীরবর্তী), অশ্মক (মহারাষ্ট্রের গােদাবরী-তীরবর্তী অঞ্চল বা অন্ধ্রপ্রদেশের বােধন অঞ্চল), মূলক (ঔরঙ্গাবাদ জেলা), সুরাষ্ট্র, কুকুর (গুজরাতে অবস্থিত), অপরান্ত (উত্তর কোঙ্কণ), অনূপ (নর্মদা তীরবর্তী মান্ধাতা বা মহেশ্বর অঞ্চল), বিদর্ভ (পূর্ব মহারাষ্ট্র), আকর (মধ্য মধ্যপ্রদেশ) এবং অবন্তি (দক্ষিণ-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান) অঞ্চল গৌতমীপুত্রের রাজ্যভুক্ত বলা হয়েছে। অপরান্ত, অনূপ, সুরাষ্ট্র, কুকুর, আকর ও অবন্তি পূর্বে নহপানের অধীনস্থ ছিল। উত্তরে গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ হতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পূর্বে বিদর্ভ থেকে পশ্চিমে কোঙ্কণ উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিপতি হলেন গৌতমীপুত্র। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এত বড় রাজ্য এর আগে কখনও গড়ে ওঠেনি।

নাসিক প্রশস্তি :

নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রের রাজ্যকে অবশ্য আরও বর্ধিত আকারে দেখানাে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তার যুদ্ধের অশ্ববাহিনী তিন সমুদ্রের জল পান করেছিল। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরকে নিয়েই তিন সমুদ্র। নাসিক প্রশস্তিতে আরও বলা হয়েছে, বিন্ধ্য, পারিযাত্র, মলয়, মহেন্দ্র, চকোর প্রভৃতি পর্বত গৌতমীপুত্রের রাজ্যমধ্যে অবস্থিত ছিল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার দক্ষিণ ভাগের নাম মলয় পর্বত। পূর্বঘাট পবর্তমালার মহানদী ও গােদাবরী নদীর মধ্যবর্তী অংশ মহেন্দ্র। চকোর পর্বতের অবস্থান ছিল সম্ভবত পূর্বঘাট পর্বতমালার দক্ষিণাংশে। নাসিক প্রশস্তির বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন ওড়িশা এবং অন্ধপ্রদেশ গৌতমীপুত্রের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এ ধারণা যথার্থ নয়; প্রশস্তিকার নিঃসন্দেহে গৌতমীপুত্রের কার্যকলাপের এক অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছেন।

শকরাজ চষ্টনের নিকট পরাজয় :

গৌতমীপুত্রের এই সাফল্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। জীবনের একেবারে পড়ন্তবেলায় তিনি মহাক্ষত্রপ চষ্টনের নিকট পরাজিত হন। প্রতিষ্ঠান শহরটি শ্রীপুলুমাবি এবং উজ্জয়িনী চষ্টনের রাজধানী বলে গ্রিক লেখক টলেমি তার ভূগােল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় চষ্টনের বাজত্বকালে কার্দমকরা সাতবাহন-অধিকারভুক্ত অবন্তি অধিকার করেন। রুদ্রদামার জুনাগড় লেখে দাবি করা হয়েছে, শুধু অবন্তি নয়, আকর, অনুপ, অপরান্ত, সুরাষ্ট্র এবং আনর্তও (গুজরাতের দ্বারকা অঞ্চল) কার্দমকরা অধিকার করেন। এসব অঞ্চল এক সময় গৌতমীপুত্রের শাসনাধীন ছিল। সম্ভবত গৌতমীপুত্রকে পরাজিত করে চষ্টন এসব অঞ্চলে আপন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। জুনাগড় লেখে এসব অঞ্চল জয়ের কৃতিত্ব যদিও রুদ্রদামার উপর অরােপিত হয়েছে, তবু মনে হয় চষ্টনের আমলেই এসব ঘটনা ঘটেছিল। রুদ্রদামা সম্ভবত তা পিতামহ চষ্টনকে গৌতমীপুত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় সহযােগিতা করেছিলেন।

শকরাজ রুদ্রদামার সাথে সম্পর্ক :

জুনাগড় লেখে সাতকর্ণির সঙ্গে রুদ্রদামার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উল্লেখ আছে (জুনাগড় লেগের সাতকর্ণি যে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি তা র‍্যাপসন স্বীকার করেন না। তার মতে এই সাতকর্ণি বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি (Catalogue of the Coins of The Andhra Dynasty, The Western ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty, পৃ. ৫১))। কানহেরি লেখ থেকে জানা যায়, বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি এক মহাক্ষত্রপের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। এই মহাক্ষত্রপ সম্ভবত রুদ্রদামা। বাশিষ্ঠীপুত্র গৌতমীপুত্রেরই এক সন্তান ছিলেন। সম্ভবত আত্মরক্ষার তাগিদে গৌতমীপুত্র নিজ সন্তানের সঙ্গে রুদ্রদামার কন্যার বিবাহ দেন।

 

স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগতা :

তার রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে গৌতমীপুত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে রাজ্য পরিচালনায় অপারগ হয়ে পড়েছিলেন, এরূপ সম্ভাবনার ইঙ্গিত মেলে তার রাজত্বের চতুর্বিংশতি বছরে উৎকীর্ণ নাসিক গুহালেখে এই লেখে রাজমাতা গৌতমী বলশ্রীকে ‘জীবসূতা’ (যার পুত্র জীবিত) বলা হয়েছে। গােবর্ধনের অমাত্যকে রাজমাতা তার পুত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত করছেন, এ ধরনের কথাও এই লেখে বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হয়, পুত্রের অসুস্থতার কারণে গৌতমী বলশ্রী সাময়িকভাবে রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে ধারণ করেছিলেন। এই অসুস্থতাই সম্ভবত শেষ পর্যন্ত গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে তথ্য এত অপ্রতুল যে এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না।

পণ্ডিতমহলে ভ্রান্ত ধারণা : গৌতমীপুত্র সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে –

 

বাশিষ্ঠীপত্র পুলুমাবি

রাজ্যবিস্তার : গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি আনুমানিক ১৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অভিষিক্ত হন। তিনি তিন দশকের কিছু কম সময় রাজত্ব করেছিলেন বলে পুরাণে উল্লেখ আছে। শক-কার্দমকদের কবল হতে পুলুমাবি অধিকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তারই রাজত্বকালে সাতবাহন রাজ্য পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করে। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার অমরাবতী গ্রামে তার লেখ পাওয়া গেছে। তার নামাঙ্কিত অসংখ্য মুদ্রা করমণ্ডল উপকূল সহ অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত পুলুমাবির রাজত্বকালেই অন্ধপ্রদেশ সাতবাহনদের অধিকারে চলে আসে। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার পুলুমাবির আর একটি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব। কর্ণাটকের বোরি জেলায় তার একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজিত অঞ্চল ‘সাতবাহনীয় আহার’ নামে পরিচিত হয়। মহারাষ্ট্র তাে পুলুমাবির রাজ্যভুক্ত ছিলই। নাসিক ও কার্লাতে তিনি বেশ কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন।

রুদ্রদামার কাছে পরাজয় : অনেকে মনে করেন, গৌতমীপুত্র নন, বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবিই রুদ্রদামার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। জুনাগড় লেখ থেকে জানা যায় রুদ্রদামা সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। পুলুমাবি সাতকর্ণি নাম ধারণ করেছিলেন বলে জানা যায় না।

 

পরবর্তী সাতবাহন রাজন্যবৃন্দ ও পতন:

শিবশ্রী সাতকর্ণি : পুলুমাবির পর রাজা হন তার সহােদর শিবশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৫৯-১৬৬ খ্রি.)। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতাে তিনিও বাশিষ্ঠীপুত্র নামে পরিচিত ছিলেন। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় তার নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। তার কানহেরি লেখ থেকে জানা যায় তিনি জনৈক মহাক্ষত্রপের এক কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। কানহেরি লেখে সেই মহাক্ষত্রপের সম্পূর্ণ নামের উল্লেখ নেই, আছে তার নামের আদ্যাক্ষর রু-এর উল্লেখ। এই লেখে তিনি কার্দমক বলে বর্ণিত হয়েছেন। এ থেকে মনে হয় সাতবাহনরাজ বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণি মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামার কন্যারই পাণিগ্রহণ করেছিলেন। শ্বশুরের মৃত্যুর পর সাতকর্ণি সম্ভবত শক রাজ্যের কিছু অঞ্চল অধিকার করেন।

শিবস্কন্দ সাতকর্ণি : তারপর শিবস্কন্দ সাতকর্ণি (আনু. ১৬৬-১৭৪ খ্রি.) সিংহাসনে আরােহণ করেন। পুরাণের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি, অমরাবতী লেখের শিবস্কন্দ সাতকর্ণি এবং মুদ্রার স্কন্দ সাতকর্ণি সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি।

 

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি ও শকদের বিরুদ্ধে জয় :

শিবস্কন্দের পর যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণি (আনু. ১৭৪-২০৩ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহন করেন। যজ্ঞশ্রীর লেখ মহারাষ্ট্রের নাসিক ও কানহেরিতে এবং অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। যজ্ঞশ্রী শুধু দাক্ষিণাত্যের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রান্তে রাজত্ব করেননি, কার্দমকদের নিকট হতে ওজরাতের একাংশও অধিকার করেন। কার্দমকদের বিরুদ্ধে তার সাফল্য মুদ্রার সাক্ষ্যেও পরােক্ষ ভাবে সমর্থিত হয়। তার রূপার মুদ্রা রুদ্রদামার মুদ্রার প্রায় হুবহু অনুকরণ। গুজরাতের যে অঞ্চল হতে যজ্ঞশ্রী কার্দমকদের উচ্ছেদ করেন সেই অঞ্চলে প্রচলনের উদ্দেশ্যেই সাতবাহনরাজ এই মুদ্রা চালু করেন। এই সময় গৃহবিবাদের ফলে কার্দমাক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিরােধ ছিল জীবদামা এবং প্রথম রুদ্ৰসিংহের মধ্যে। তারা প্রথমে একযােগে কাজ করে পরে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মহাক্ষত্রপ ঈশ্বরদত্তের অভ্যুত্থানের ফলে কার্দমকরা আরও হীনবল হয়ে পড়েন। কার্দমক শক্তির দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে যজ্ঞশ্রী গুজরাতের একাংশে নিজের অধিকার বিস্তার করেন। যজ্ঞশ্রী সম্ভবত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলও সম্ভবত যজ্ঞশ্রীর রাজ্যভুক্ত ছিল। অনেকে মনে করেন রাজত্বের শেষপর্বে যজ্ঞশ্রী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাদের ধারণা রাজা ঈশ্বরসেন যজ্ঞশ্রীকে পরাজিত করে উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রে আভীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মধ্যভাগে আবিভূর্ত হয়েছিলেন, ২য় শতকের শেষ-পর্বে নয়।

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির উত্তরাধিকারী রূপে পুরাণে বিজয়, চন্দ্ৰশ্ৰী বা চণ্ডশ্রী এবং পুলােমা বা পুলুমাবির উল্লেখ আছে। পুরাণের বিজয় এবং মুদ্রার বিজয় সাতকর্ণি সম্ভবত একই ব্যক্তি। চন্দ্র বা চণ্ড সাতকর্ণির একখানি লেখ গােদাবরী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চলে তার নামাঙ্কিত মুদ্রাও পাওয়া গেছে। পুলুমাবির অষ্টম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে রুদ্র সাতকর্ণির মুদ্রা পাওয়া গেছে। পুরাণে রুদ্র সাতকর্ণির নাম নেই। এই রাজার সমগ্র সাতবাহন রাজ্যের, না তার খণ্ডিত অংশের রাজা ছিলেন, তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। এই পর্বের একজন রাজা মাঠরীপুত্র শকসেন। তার একখানি লেখা কানহেরিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। কৃষ্ণা ও গােদাবরী জেলায় প্রাপ্ত শকসেন বা শকসাত নামাঙ্কিত মুদ্রা সম্ভবত তিনিই উৎকীর্ণ করেন। তার রাজ্যটি আয়তনে বেশ বড়ই ছিল বলে মনে হয়। বাশিষ্ঠীপুত্র চতরপন সাতকর্ণি নামে জনৈক রাজার ত্রয়ােদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ একখানি লেখ নানাঘাটে পাওয়া গেছে। পূর্ববর্তী রাজগণের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল তা জানা যায় না।

 

সাতবাহন রাজত্বের অবসান :

আনুমানিক ২২৫ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশে সাতবাহন শাসনের অবসান ঘটে। শান্তমূলের নেতৃত্বে সেখানে স্বাধীন ইক্ষ্বাকু রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সময় কর্ণাটকেও সাতবাহন আধিপত্যের অবসান হয়। সেখানে মহারঠিদের বিতাড়িত করে প্রথমে মুডানন্দ (মতান্তরে মুলানন্দ) এবং পরে চুটুকুলানন্দ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে মনে করেন চুটুরা অপরান্তও অধিকার করেন। শেষােক্ত মত অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। সাতবাহনরা তখনও মহারাষ্ট্রে এবং সম্ভবত মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশে রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরসেন খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মাঝামাঝি সময় মহারাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আভীর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্যপ্রদেশে বাকাটক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী কাল অস্তিত্ব ও প্রভুত্বের লড়াই করে সাতবাহন রাজ্য এভাবে ধসে পড়ল।

 

প্রশাসন, সমাজব্যবস্থা, কৃষি ও কারিগরি শিল্প

প্রশাসন-ব্যবস্থা

সামাজিক জীবন

কৃষি 

বৃত্তি ও কারিগরি শিল্প

রোম ও পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য

ব্যবসা-বাণিজ্য : ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ নামের গ্রন্থখানি, টলেমি কৃত ‘ভূগােল’ এবং রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া রােমক ও দেশীয় মুদ্রা সেযুগের ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির পরিচয় বহন করে। প্রথম গ্রন্থখানি থেকে জানা যায় সাতবাহন রাজ্যের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ছিল জনবহুল ও সমৃদ্ধশালী কিন্তু মধ্যাঞ্চল তুলনায় অনগ্রসর ছিল। মরু ও পর্বতসংকুল মধ্যাঞ্চলে বাঘ, হাতি, সাপ প্রভৃতি বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তুর বাস ছিল। এসময় পশ্চিমাঞ্চলে যেসব বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে সােপারা, কল্যাণ, পৈঠান, টগর (বর্তমান টের), জুন্নার, নাসিক ও বৈজয়ন্তী বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। অমরাবতীর লেখসমূহে কেবুরুর, বিজয়পুর, কুদুর প্রভৃতি কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্রের উল্লেখ আছে। টলেমির বিবরণে মাসালিয়া (আধুনিক মসুলিপত্তন) ও ঘণ্টকশালের মতাে পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি সমৃদ্ধশালী বন্দরের উল্লেখ আছে। স্থলপথে ও নদীপথের মাধ্যমে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় উভয় অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু যে পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তা নয়, দক্ষিণ ভারতীয় বন্দর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোও পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত ছিল। সাতবাহনদের রাজধানী প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পথ টগর, নাসিক, সেতব্য, বনসভয়, উজ্জয়িনী ও সাঁচী হয়ে উত্তরে একেবারে শ্রাবস্তী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পশ্চিম উপকূলের বিখ্যাত বন্দর ভৃগুচ্ছ হতে আর একটি পথ মালব, গাঙ্গেয় উপত্যকা, তক্ষশিলা ও পুষ্কলাবতী হয়ে কাবুল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনাগমন সহজসাধ্য হয়। সমকালীন লেখমালায় দেখা যায় দশপুরের বণিক নাসিকে, বৈজয়ন্তী, ধান্যকোট ও সােপারার পণ্যবিক্রেতা জুন্নারে এবং সােপারার ব্যবসায়ী নানাঘাটে দানধ্যানাদি কাজে অংশগ্রহণ করছেন। এসব ঘটনায় বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রমাণিত হয়।

মুদ্রা : সাতবাহন রাজারা সিসা, তামা, রূপা ও মিশ্ৰধাতুতে অনেক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তারা। কোনও স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন বলে জানা যায় না। দ্রব্যাদির দৈনন্দিন ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রেই তামা বা সিসার মুদ্রা ব্যবহার করা হত, দুরপাল্লার বাণিজ্যে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। তবে আন্তর বা দৈনন্দিন বাণিজ্য যে শুধুমাত্র মুদ্রার মাধ্যমেই সম্পন্ন হত তা নয়, পণ্যবিনিময় প্রথাও প্রচলিত ছিল।

রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক : সাতবাহন রাজ্যের সঙ্গে রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ ভারতে যে সব খাদ্যশস্য ও বিলাসসামগ্রী উৎপন্ন হত রােমের বাজারে তার প্রচণ্ড চাহিদা ছিল। প্রথম প্রথম রােমক বণিকেরা মিশরীয় ও আরবি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যাদি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রােমক সম্রাট অকটেভিয়াস অগাস্টাসের মিশর জয়ের পর রােমক বণিকরা সরাসরি ভারতে আসতে শুরু করেন। ভারতীয় বণিকরাও যে সমুদ্র পাড়ি দিতেন না তা নয়। সাঁচীস্তূপের ভাস্কর্যে ভারতীয় বণিকদের সমুদ্রপথে যাতায়াতের কাহিনি রূপায়িত আছে। ঘন্টকশাল ও গুণ্ডুপল্লিতে প্রাপ্ত কয়েকখানি সমকালীন লেখে মহানাবিকের উল্লেখ আছে। মহানাবিক পদটিতে সমুদ্রযাত্রার ইঙ্গিত আছে। ৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস মৌসুমি বায়ুর প্রবাহপথ আবিষ্কার করে ফেলেন। ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে রােমের বাণিজ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

পূর্ব আফ্রিকা ও রোমে রপ্তানি পণ্যসমূহ : দক্ষিণ ভারত থেকে যেমন চাল ও গমের মতাে খাদ্যশস্য পূর্ব আফ্রিকা তথা রােমে রপ্তানি হত তেমনি গােলমরিচ ও দারুচিনির মতাে মসলাপাতি, চন্দন, সেগুন ও মেহগনির মতাে দামি কাঠ, কার্পাস ও রেশমের বস্ত্র, মসলিন, সুতা, দামি ও আধাদামি পাথর, সুগন্ধি মসলা, গজদন্ত ইত্যাদি শৌখিন দ্রব্যাদিও রপ্তানি হত। রােমের বাজারে ভারতীয় দ্রব্যের চাহিদা এতই তীব্র ছিল যে ভারতীয় পণ্য সেখানে একশাে গুণ চড়াদামে বিক্রি হত। অন্যদিকে রােম তথা বিদেশ থেকেও কম জিনিস আমদানি হত না। আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল সুরা, তামা, টিন, সিসা, প্রবাল, পুষ্পরাগ মণি, স্বচ্ছ কাচ, মােমছাল, সুর্মা, স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা, গায়ক ও ক্রীতদাসীর দল। দক্ষিণ ভারত তথা ভারতের বাজারে ব্যাবিলােন ও আলেকজান্ড্রিয়ার সূচিশিল্পশােভিত কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। বলতে দ্বিধা নেই, রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনে লাভের পাল্লাটা ভারতের দিকেই ঝোকানাে ছিল। ২২ খ্রিস্টাব্দে রােমক সম্রাট টাইবেরিয়াস তাে স্পষ্টই অভিযোগ করেছিলেন, বিলাসব্যসনের জোগান দিতে রােমের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর প্লিনি আক্ষেপের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ভারতীয় পণ্যের পেছনে রােমের বছরে ৫৫০, ০০০, ০০০ সেস্টারসেস পরিমাণ অর্থ বিনষ্ট হচ্ছে। সাতবাহন রাজ্য তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে সােনা ও রূপার অসংখ্য রােমক মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উপলক্ষে বুলিয়নরূপে এই মুদ্রাগুলো আমদানি হয়েছিল। রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে লাভের পাল্লাটা যে ভারতের দিকেই নত ছিল তা এই মুদ্রাগুলোর সাক্ষ্যে সুপ্রমাণিত।

রোমের সাথে বাণিজ্যে ভাটা : মুদ্রার সাক্ষ্যে আর একটি সত্য উদঘাটিত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলোর বেশির ভাগই ৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (রােমক সম্রাট অগাস্টাসের সিংহাসন আরােহণ) হতে ৬৮ খ্রিস্টাব্দের (সম্রাট ২৮ নীরাের মৃত্যু) মধ্যে উৎকীর্ণ। আবার কিছু মুদ্রা ক্যারাকালা (২১৭ খ্রিস্টাব্দ) ও ম্যাক্রিনাস (২৩৬ – ৩৮ খ্রিস্টাব্দ)–এর সমকালীন। এর থেকে বােঝা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত রােম–ভারত বাণিজ্যে যে জোয়ার এসেছিল, খ্রিস্টীয় ২য় – ৩য় শতকে তাতে ভাটা পড়ে। স্তিমিত গতিতে হলেও আরও প্রায় দুই শতাব্দী ধরে রােমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চলে। সম্রাট মার্সিয়ান (৪৫০ খ্রিস্টাব্দ), লিও (৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ), এনাস্টেসিয়াস (৪৯১-৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং জাস্টিন (৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) – এর নামাঙ্কিত রােমক মুদ্রাও ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে।

শকদের সাথে সংঘর্ষের ফলে রোমের সাথে বাণিজ্যে অধপতন : শকদের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের সংঘর্ষ ভারত–রােম বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুভ হয়নি। ‘পেরিপ্লাস্ অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ এবং টলেমির ‘ভূগােল’ গ্রন্থখানিকে একসঙ্গে পাঠ করলে এই সত্য ধরা পড়ে। পেরিপ্লাস–এ ক্যালিয়েনা নামে কোঙ্কণ উপকূলের এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের উল্লেখ আছে। ক্যালিয়েনা নিঃসন্দেহে আধুনিক কল্যাণ। পেরিপ্লাস্–এর বর্ণনা থেকে মনে হয় বন্দরটি সাতবাহন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পেরিপ্লাসের লেখক জানাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ স্যারাগেনাস অর্থাৎ সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির রাজত্বকাল পর্যন্ত ক্যালিয়েনা একটি সমৃদ্ধ বন্দর ছিল, দেশি বিদেশি বণিকদের আনাগােনায় সে স্থান ছিল সতত মুখর। কিন্তু স্যান্ডারেস কর্তৃত্ব লাভ করার পর মামবারাস এই বন্দরের উপর নৌ অবরােধ জারি করেন। ফলে কোনও গ্রিক জাহাজ এই বন্দরে প্রবেশ করতে পারত না। যদি–বা কোনও গ্রিক জাহাজ ভুলক্রমে অবরুদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ত, ম্যামবারাসের নৌবাহিনী সেটিকে জোর করে ব্যারিগাজা বা ভৃগুকচ্ছে নিয়ে যেত। পেরিপ্লাসের এই বর্ণনা হতে মনে হয় সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে কল্যাণ বন্দরটির ব্যবসা–বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই মনে করেন, যে ম্যামবারাসের আগ্রাসী ভূমিকার ফলে কল্যাণ বন্দরে অরাজকতা নেমে আসে, তিনি শক ক্ষত্ৰপ নহপান। তারা আরও মনে করেন, পেরিপ্লাসে বর্ণিত স্যান্ডারেস হলেন সাতবাহনরাজ সুন্দর সাতকর্ণি। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। স্যান্ডারেস সম্ভবত একজন শক শাসক ছিলেন, আর ম্যামবারাসও নহপান নন। পেরিপ্লাস রচিত হওয়ার অন্তত দুই দশক পর নহপানের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। ম্যামবারাস সম্ভবত একজন শক প্রশাসক ছিলেন এবং তিনি খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগ নাগাদ পশ্চিম ভারতের কিয়দংশে তার শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (স্যান্ডারেস সম্ভবত অপরান্ত অঞ্চলে ম্যামবারাসের প্রতিনিধি ছিলেন)। ১৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ টলেমি যখন তার ‘ভূগােল’ গ্রন্থে পশ্চিম ভারতীয় বন্দরগুলোর তালিকা দেন তখন তিনি কল্যাণের কোনও উল্লেখ করেননি। অনুমান করতে দ্বিধা নেই, ততদিনে কল্যাণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

শঙ্গম সাহিত্যে ভারত-রােম বহির্বাণিজ্য : শঙ্গম সাহিত্যে ভারত–রােম বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যবন জাহাজগুলো মুচিরিপত্তনম বন্দরে স্বর্ণমুদ্রা ভরে নিয়ে আসত আর। পরিবর্তে গােলমরিচ ভর্তি করে দেশে ফিরে যেত। শঙ্গম সাহিত্যে যে বন্দরটিকে মুচিরিপত্তনম বলা হয়েছে পেরিপ্লাস্–এর লেখক এবং টলেমি তাকেই মুজিরিস আখ্যা দিয়েছেন। বন্দরটি আধুনিক ক্র্যাঙ্গানােরের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিল। মুজিরিসে শুধু যে রােমক জাহাজগুলোর আনাগােনা ছিল তা নয়, এখানে সম্ভবত রােমক বণিকদের একটি স্থায়ী বসতিও গড়ে ওঠে। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের রচনা ট্যাবুলা বিউটিনজেরিয়ানা গ্রন্থে মুজিরিসে রােমক সম্রাট অগাস্টাসের স্মৃতিতে গড়া এক মন্দিরের উল্লেখ আছে। রােমকরা তাদের সম্রাটদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেন। মুজিরিসে রােমকদের স্থায়ী বসতি না থাকলে সেখানে ওই জাতীয় মন্দির গড়ে উঠত না। পণ্ডিচেরীর নিকটবর্তী আরিকমেড়তেও রােমক বণিকদের আর একটি স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতকের রােমক মৃৎপাত্র, পানপাত্র, বাতিদান ও কাঠের পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক আরিকমেডু নিঃসন্দেহে পেরিপ্লাস-এর লেখক ও টলেমি বর্ণিত প্রাচীন পােডুকার স্মৃতি বহন করছে। আরিকমেডুর মতাে আর একটি বিখ্যাত বন্দর কাবেরীপট্টিনম যার উল্লেখ আছে শঙ্গম সাহিত্যে। এই কাবেরীপট্টিনমই টলেমির ভূগােল গ্রন্থে খাবেরােস নামে উল্লিখিত হয়েছে। কাবেরী নদীর মােহনায় অবস্থিত এই বন্দরটি চোল রাজ্যে অবস্থিত ছিল।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য : পশ্চিম দিকে যেমন রােমক সাম্রাজ্যের সঙ্গে, পূর্ব দিকে তেমনি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যগুলোর সঙ্গে এসময় দক্ষিণ ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পেরিপ্লাস্ ও টলেমির বিবরণে এই বহির্বাণিজ্যের কিছু ছবি ধরা পড়েছে। চিকাকোলের কাছাকাছি এক বড় বন্দরের উল্লেখ আছে গ্রন্থ দু’টিতে। পণ্যসম্ভার সাজিয়ে জাহাজগুলো এই বন্দর থেকে যাত্রা করে আড়াআড়িভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছত। দ্বিতীয় পুলুমাবি ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির অন্যান্য মদ্রার সঙ্গে বিশেষ এক শ্রেণির মুদ্রা করমণ্ডল উপকুলে পাওয়া গেছে। এই শ্রেণির মুদ্রায় দুই মাস্তুলযুক্ত জাহাজের ছবি অঙ্কিত রয়েছে। মুদ্রাগুলো সাতবাহন যুগের সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপের স্মৃতি বহন করছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সে অঞ্চলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিও প্রসার লাভ করে।

ধর্মীয় জীবন

বৈদিক যাগযজ্ঞ : সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন। তারা ছিলেন বৈদিক যাগযজ্ঞের একান্ত অনুরাগী। একজন সাতবাহনরাজ তাে যজ্ঞশ্রী নামই ধারণ করেছিলেন। প্রথম সাতকর্ণি অশ্বমেধ, রাজসূয়, অগ্ন্যাধেয় প্রভৃতি বিবিধ বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। যাগযজ্ঞাদি উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে প্রথম সাতকর্ণির প্রচুর দানধ্যানের কথা নানাঘাট লেখে সবিস্তারে বর্ণিত আছে।

পৌরাণিক দেবতারা : সমাজে, বিশেষকরে অভিজাত মহলে, বৈদিক যাগযজ্ঞ যেমন সমাদর লাভ করেছিল তেমনি বাসুদেব এবং পশুপতির মতাে পৌরাণিক দেবতারাও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। নানাঘাট লেখে বাসুদেবের উল্লেখ আছে। লক্ষ করবার বিষয়, সেখানে কেবল বাসুদেবের নামেরই উল্লেখ নেই, বাসুদেবের সঙ্গে সংকর্ষণের নাম যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে বাসুদেবের নামের পূর্বেই সংকর্ষণের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত সাতবাহন রাজ্যে সংকর্ষণ বাসুদেবের যৌথ পূজার প্রচলন ছিল। এই যৌথ পূজায় সংকর্ষণেরই প্রাধান্য ছিল। বাসুদেবের অগ্রজ বলেই হয়তাে সংকর্ষণ বা বলরামের এই প্রাধান্য। সমকালীন যুগে রচিত গাথাসপ্তশতীতে কৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক কাহিনির অবতারণা আছে। গাথাসপ্তশতীতে লক্ষ্মী ও নারায়ণের উল্লেখ আছে। সমকালীন লেখ ও সাহিত্যে আর যে সকল ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে তাদের। মধ্যে ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, যম, বরুণ, কুবের এবং গৌরী বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তখনকার দিনে সাধারণ মানুষদের মধ্যে তীর্থযাত্রা, কূপ–পুষ্করিণী খনন, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদি কাজে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যায়। এসব কাজ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হত।

জৈনধর্ম : মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের নানা স্থানে প্রাচীন বহু জৈন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের অনেকগুলোই সাতবাহন আমলের। সাতবাহন রাজ্যে জৈনরা সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন না।

মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার, জন সাধারণের উদ্যোগ : এসময় মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। মহারাষ্ট্রের পিটল-খােরা, নাসিক, কার্লে, কানহেরি, জুন্নার, মাহার, কোল, ভাজা ও কোলাপুর এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ঘণ্টকশাল, জগ্‌গয্যপেটা, অমরাবতী ও ভট্টিপ্রোলুতে অসংখ্য বৌদ্ধ নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন বৌদ্ধ গুহাগুলোর প্রায় সবকটিই এই পর্বে নির্মিত হয়। ব্রাহ্মণ্য–ধর্মের অনুরাগী হয়েও সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। বৌদ্ধ শ্ৰমণদের তত্ত্বাবধানের জন্য রাজা কৃষ্ণ নাসিকে একজন মহামাত্র নিযুক্ত করেছিলেন। রাজমাতা গৌতমী বলশ্রী ভদ্রযানীয় ভিক্ষুদের অনুকূলে একটি গুহা দান করেছিলেন। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি ত্রিবশি পবর্তবাসী ভিক্ষুদের দ্বিশত নিবর্তনের একখণ্ড জমি প্রদান করেন, বলশ্রী ও গৌতমীপুত্র সমবেত ভাবে একশাে নিবর্তনের জমি তিরশ্নি পর্বতবাসী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করেন। দ্বিতীয় পুলুমাবির রাজত্বকালে কালার মহাসংঘিক ভিক্ষুদের ভরণপােষণের জন্য একখানি গ্রাম প্রদত্ত হয়। শুধু রাজা বা রাজপরিবারের সদস্যগণ নন, ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি জন সাধারণেরও সজাগ দৃষ্টি ছিল। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বসবাসের জন্য জনসাধারণের উদ্যোগেও প্রচুর লেণ বা গুহা এবং চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়। ক্রমশ বিহার নির্মাণও শুরু হয়। ভিক্ষু সম্প্রদায়ের খাদ্য ও পরিধানের সংস্থানের জন্য কখনও কখনও জমি বা সমগ্র গ্রাম দান করা হত, তাদের নতুন বস্ত্রও দেয়া হত।

বুদ্ধের পদ, স্তূপ, প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ প্রভৃতির উপাসনা : গাথাসপ্তশতীতে বুদ্ধের পদ–উপাসনার উল্লেখ আছে। বৌদ্ধরা প্রথম দিকে স্তুপ, শূন্য সিংহাসন সহ বােধিবৃক্ষ, বুদ্ধের পাদুকা, ত্রিশূল, ধর্মচক্র এবং বুদ্ধ ও তার প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ পূজা করতেন কিন্তু মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভগবান বুদ্ধের মূর্তিপূজা শুরু হয়।

বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায় : বৌদ্ধধর্মের কিছু কিছু বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ভিক্ষু–ভিক্ষুণীদের মধ্যে মতবিরােধ ও পরিণামে বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। সাতবাহন রাজ্যে কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়–উপসম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা সবিশেষ লক্ষণীয়। নাসিক এবং কানহেরি অঞ্চলে ভদ্রযানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়, মহাসংঘিকদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় কার্লা ও সন্নিহিত অঞ্চলে, ধর্মোত্তরীয়দের সােপারায় ও জুন্নারে, চৈত্যকদের অমরাবতীতে এবং পূর্ব শৈল ও অপর শৈলদের নাগার্জুনীকোণ্ডাতে। এদের মধ্যে ধর্মোত্তরীয় এবং ভদ্রযানীয়রা স্থবিরবাদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, অন্যান্যরা ছিলেন মহাসংঘিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমােক্তরা ছিলেন রক্ষণশীল, অন্যরা সংস্কারপন্থী বা উদারবাদী। কী রক্ষণশীল, কী উদারপন্থী, সকল সম্প্রদায়েরই বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি মৌল বিষয় সম্পর্কে মনােভাব মােটামুটি একই ছিল। তারা সকলেই চারটি আর্যসত্যে বিশ্বাস করতেন, অষ্টাঙ্গিক-মার্গে তারা আস্থাবান ছিলেন, তারা কর্মকে জন্মান্তরের কারণ বলে মনে করতেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় ধীরে চলার নীতি বা প্রতীত্যসমুৎপাদ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতবিভেদ ছিল। স্থবিরবাদীরা মনে করতেন, বুদ্ধ বিরলদৃষ্ট এক মহামানব, তিনি একবারই জন্মেছেন, ভবিষ্যতে আর জন্মাবেন না। মহাসংঘিকদের দৃষ্টিতে বুদ্ধ লােকোত্তর, অলৌকিক, সর্ব শক্তিমান এক সত্তা, মানবসাধারণের হিতার্থে তার শাক্য গৌতমের রূপকায় ধারণ, জন্ম–মৃত্যুর অতীত বুদ্ধ সর্বদাই সমাধিস্থ। বুদ্ধত্ব অর্জনই মহাসংঘিকদের লক্ষ্য, পক্ষান্তরে অর্হৎত্ব অর্জনকে স্থবিরবাদীরা জীবনের চরম সার্থকতা বলে মনে করেন। স্থবিরবাদীদের ধারণা বুদ্ধত্ব অর্জন মানুষের সাধ্যাতীত। মহাসংঘিকরা বােধিসত্ত্বের রূপ কল্পনা করেছেন। তারা মনে করেন বােধিসত্বের পর্যায় অতিক্রম করলেই বুদ্ধত্ব অর্জন সম্ভব হয়। তাছাড়া স্তুপ ও চৈত্যপূজার উপযােগিতা মহাসংঘিকরাই প্রথম তানুধাবন করেন।

মহাযান মতের উদ্ভব ও নাগার্জুন : বুদ্ধ ও ধর্ম সম্পর্কে মহাসংঘিক সম্প্রদায়ের মনােভাবের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। অষ্টসাহত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার মূল গ্রন্থখানি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থখানিতে দক্ষিণাপথকে মহাযান বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবস্থল বলা হয়েছে। এই উক্তি সত্য হলে সিদ্ধান্ত করতে হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক নাগাদ অন্ধ্র-মহারাষ্ট্র অঞ্চলে মহাযান বৌদ্ধধর্ম অঙ্কুরিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকে নাগার্জুনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মহাযান ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাতবাহনপতি যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির সমকালীন এই বৌদ্ধ আচার্য শূন্যতা তথা মাধ্যমিক দর্শনের প্রবক্তারূপে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দক্ষিণ ভারতে জীবন শুরু করলেও পরের দিকে তিনি নালন্দায় সংঘের আচার্যপদে বৃত হন। শুয়েন চাঙের বিবরণী হতে জানা যায়, তার জীবনের শেষ দিনগুলো সাতবাহনরাজের আনুকূল্যে দক্ষিণ কোসলে অতিবাহিত হয়েছিল। মধ্যমপন্থাকে নির্দেশ করে বলে নাগার্জুনের মতবাদকে মাধ্যমিক মতবাদ বলা হয়। এই মতবাদ অনুসারে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান তিনই শূন্য – কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এই মত অনুসারে জ্ঞেয়রূপ বাহ্য বস্তু মিথ্যা ও ক্ষণিক। যেহেতু জ্ঞেয় বস্তু বা বাহ্য জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। সেহেতু জ্ঞাতা বলে কোনও স্থায়ী চেতনার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। নাগার্জুন দেখিয়েছেন সব কিছুই পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী ও অনিত্য, সব কিছুই আপেক্ষিক, সব কিছুই শূন্যে পর্যবসিত।

সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য

সাহিত্য

স্থাপত্য

বৌদ্ধ স্তুপ : অমরাবতী, ভটিপ্রােলু, জগ্‌গয্যপেটা, ঘণ্টকশাল, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানে এ যুগে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মিত হয়। কালের প্রভাবে এদের কোনওটিই আজ আর অক্ষত নেই। কয়েকটির আবার বেদিকার অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে পাথরের ফলকে স্তুপের চিত্র থেকে এ অঞ্চলের স্তুপগুলোর গঠনাকৃতির কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। চিত্রগুলো দেখে মনে হয় শুঙ্গযুগের মতাে এযুগেও ধূপের বেদি, অণ্ড, হমিকা ও ছত্র – এই চারটি অঙ্গ। এখানেও অণ্ড নিঃসন্দেহে প্রধানতম অঙ্গ। স্তূপের চারদিকে চারটি আয়তক্ষেত্রাকার মঞ্চ। প্রতিটি মঞ্চে পাঁচটি করে আর্যকস্তম্ভ। প্রতি মঞ্চের দু‘ধারে প্রদক্ষিণা পথে ওঠার সিঁড়ি। প্রদক্ষিণা পথ কারুকার্যখচিত পাথরের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। স্তূপের বেদি এবং অণ্ড অপরূপ কারুকার্যে মণ্ডিত।

সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপ : ২৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপটির প্রস্তর বেষ্টনী এবং তার সুদৃশ্য চারটি তােরণ এই পর্বেই নির্মিত হয়। প্রস্তর বেষ্টনীর উচ্চতা ৩.২ মিটার। তােরণগুলোর মধ্যে দক্ষিণেরটিই সবচেয়ে পুরােনাে। প্রতি তােরণের দুদিকে দু’টি চতুষ্কোণ স্তম্ভ। এক একটি স্তম্ভের শীর্ষদেশে তিনটি করে হাতির মূর্তি। হাতিগুলোর পৃষ্ঠদেশে তােরণের উপরের অংশ স্থাপিত। উপরের অংশে আছে তিনটি সমান্তরাল ফলক। শীর্ষ ফলকটির উপরে রয়েছে সিংহমূর্তি, দু’টি চক্র এবং ত্রিশূল বা বজ্র।

চৈত্যগৃহ : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গা কেটে সাতবাহন যুগে বেশ কয়েকটি চৈত্যগৃহ নির্মিত হয়। এদের মধ্যে ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগৃহগুলো বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ভাজার চৈত্যগৃহটি এ আমলে নির্মিত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

বিহার : নাসিকে পাহাড়ের গা কেটে এযুগে কয়েকটি বিহারও নির্মিত হয়। এদের মধ্যে ঋষভদত্ত বিহার ও গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি বিহার সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। প্রতিটি বিহারে রয়েছে একটি করে স্তম্ভবিহীন প্রশস্ত হলঘর, তিনদিকে তিনটি ঘর আর সামনে সস্তম্ভ বারন্দা। কার্লাতে পাহাড় কেটে কয়েকটি বিহার নির্মাণ করা হয়। এদের কয়েকটি একাধিক তলবিশিষ্ট। পাহাড়কাটা বহুতল বিহার ভারতে পরবর্তিকালে খুবই জনপ্রিয় হয়। বস্তুত, বহুতল বিহার নির্মাণের সূত্রপাত ঘটে এই কার্লাতেই।

অজণ্টায় গুহা খোদাই : এ সময় অজণ্টায় ইন্ধ্যাদ্রি নামে এক অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের গা কেটে নবম ও দশম গুহা দু’টি খােদিত হয়। গুহা দুটির প্রতিটিতে রয়েছে এক একটি করে লম্বাটে চৈত্যকক্ষ। তাতে দু’দিকে দু’সারি স্তম্ভ। ছাদের ভার বহনের কাজে স্তম্ভগুলোর কোনও উপযােগিতা নেই। এ শুধু অলংকরণ। চৈত্যকক্ষের প্রবেশপথের উপরে একটি গবাক্ষ। একে বলে সূর্য গবাক্ষ। নবম গুহাটির শেষ প্রান্ত অর্ধগােলাকৃতি কিন্তু দশমটির শেষ প্রান্ত চৌকোণা। চৈত্যকক্ষের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি স্তুপ। স্তুপের সর্বনিম্ন অংশ বর্গাকার বেদিকা। এরপর ক্রমান্বয়ে অণ্ড, হমিকা, ছত্রাবলি ও কলশ। অজণ্টায় গুহাস্থাপত্যের কাজ শুরু হয় সাতবাহন রাজাদের আমলে। একাজ সম্পূর্ণ হয় খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে। অজণ্টা গুহাস্থাপত্যের প্রারম্ভিক পর্বরূপে সাতবাহন যুগকে চিহ্নিত করা যায়।

শিল্পীদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তি ও অমরাবতী

ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগৃহে এবং অমরাবতী, নাগার্জুনীকোণ্ডা প্রভৃতি স্থানের স্তুপে এ যুগের শিল্পীরা তাদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যকীর্তির সাক্ষ্য রেখে গেছেন। ভাজার চৈত্যগৃহে উৎকীর্ণ দ্বারপাল, সূর্যদেব ও ঐরাবতের পিঠে উপবিষ্ট ইন্দ্র এবং কার্লার চৈত্যগৃহের দম্পতিমূর্তি সুঠাম দেহ–গঠনে ও দৃপ্ত, বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে সমুজ্জ্বল। তবে ভাজায় বা কার্লাতে নয়, অমরাবতীর ভাস্কর্যেই এ যুগের শিল্পসাধনার চরম অভিব্যক্তি ঘটেছে।ঈষৎ সবুজ চুণাপাথরে খােদিত অমরাবতীর ভাস্কর্যে আছে বিষয়-বৈচিত্র্য। বুদ্ধ ও জাতকের কাহিনি, পরিদৃশ্যমান প্রকৃতি ও চলমান জীবনপ্রবাহ সবই এখানে উপস্থাপিত। তবে ভারহুতের শিল্পে প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতার যে সুর অনুরণিত অমরাবতীতে তা ব্যাহত। এখানে প্রকৃতি গৌণ, মানুষই মুখ্য, পটভূমিরূপেই প্রকৃতির যা সার্থকতা। শিল্পী বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন সত্য কিন্তু সংযম, ব্রহ্মচর্য, ত্যাগ ও নির্বাণের মতাে বুদ্ধ প্রচারিত শাশ্বত সত্যের প্রতি তিনি উদাসীন। ধনৈশ্বর্যময়, আনন্দমুখর জীবনের তিনি জয়গান করেছেন। আধ্যাত্মিকতা নয়, ভােগবাদই মূর্ত হয়ে উঠেছে তার শিল্পকর্মে। সম্ভোগ বর্ণনায় শিল্পীর এই অত্যাসক্তির সংগত কারণ আছে বৈকি। একদিকে রােমক সাম্রাজ্য ও অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে এ সময় দক্ষিণ ভারতে অভূতপুর্ব আর্থিক সমদ্ধি ঘটে। অঢেল অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে বণিক ও অভিজাত মহলে জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণা গড়ে ওঠে। এ ধারণা বিলাসব্যসনের ধারণা, ভােগৈশ্বর্যময় জীবনযাপনের ধারণা। বাণিজ্যসমৃদ্ধ নাগর সভ্যতার ছবি প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পীর শিল্পকর্মে। বৃক্ষ, লতা, পাখি ও মানবদেহকে পাথরে রূপায়ণে শিল্পী যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্রাণশক্তি, গতিশীলতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে অমরাবতীর ভাস্কর্য অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত। উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান, অবনত, দোদুল্যমান, নৃত্যরত, গমনশীল প্রভৃতি বিভিন্ন দেহভঙ্গি এবং উত্তেজনা, আনন্দ, অবসাদ, ক্রোধ ইত্যাদি জীবনের নানা মুহুর্ত উৎকীর্ণ নরনারীর মূর্তিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। নারীদেহের রূপায়ণে উচ্চারিত হয়েছে প্রেম, যৌবন ও সুন্দরের জয়গান। আধ্যাত্মিকতা নয়, পরিশীলিত ইন্দ্রিয়পরায়ণতার অভিব্যক্তি দেখা দিয়েছে অমরাবতীর ভাস্কর্যে। বুদ্ধের মূর্তিতেও সে আত্মনিমগ্ন ভাব নেই, পরিবর্তে আভাসিত হয়েছে পরিবেশ সচেতনতা। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে শিল্পীর রুচি ও অনুভূতির পরিপূর্ণ বিকাশ। কিন্তু পরবর্তিকালের ভাস্কর্যে সে ছন্দ ব্যাহত হয়েছে, অসংযম ও সুলতায় সে ভাস্কর্য মলিন। সাতবাহন রাজাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসময় শুধু যে দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল তাই নয়, এই অঞ্চলের সমাজজীবনে, অর্থনীতিতে, ধর্মে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে এবং ভাস্কর্যেও গঠনমুখী, সৃজনধর্মী কর্মকাণ্ডের অভিব্যক্তি দেখা দিল।

গ্রন্থপঞ্জি

 

আরও দেখুন :

Exit mobile version