Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

নতুন রাজত্বের যুগ

নতুন রাজত্বের যুগ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় নতুন রাজত্বের যুগ

নতুন রাজত্বের যুগ

 

 

নতুন রাজত্বের যুগ

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এশিয়া থেকে যাযাবর হিক্সস্ জাতি এসে মিশর আক্রমণ করে লুটতরাজ শুরু করে। হিক্সা সমস্ত মিশর দেশ দখল করে নেয় এবং প্রায় দেড়শো বছর ধরে মিশরকে পদানত করে রাখে। হিক্সসদের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এরা যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া এবং অশ্বচালিত যুদ্ধরথ ব্যবহার করত। মিশরে ঘোড়া এবং রথের প্রচলন এরাই করেছিল। এ ছাড়াও সামরিক পরাক্রমশালী হিক্সদের কাছ থেকে মিশরীয়রা অনেক নতুন ও উন্নত যুদ্ধকৌশল শিখেছিল।

হিক্সসূরা নামে সারা মিশর দেশ অধিকার করলেও তাদের ক্ষমতা সম্ভবত বদ্বীপ অঞ্চলেই সীমিত ছিল। অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয় অভিজাত শাসকরাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিল। আসলে দ্বাদশ রাজবংশের পতনের পর থেকেই কেন্দ্রীয় রাজশক্তি ছিল খুবই দুর্বল। বিদেশী রাজশক্তির বিরুদ্ধে মিশরে বিক্ষোভ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে এবং হিক্সসদের বিতাড়নের জন্যে প্রবল আন্দোলন ও বিদ্রোহ শুরু হয়।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ মিশরের শাসনকর্তাগণ হিক্সসদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। ক্রমে সমগ্র মিশরের মানুষ এ আন্দোলনে যোগদান করে এবং ১৫৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে হিক্সা মিশর থেকে বিতাড়িত হয়। এ মুক্তি-আন্দোলনের নায়ক ১ম আহমোজ অষ্টাদশ রাজবংশ স্থাপন করেন। এর পর থেকে ইতিহাসে নতুন রাজত্বের যুগ শুরু হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ত্রয়োদশ থেকে সপ্তদশ রাজবংশের মধ্যে হিক্সস্ রাজবংশও রয়েছে।

নতুন রাজত্বের যুগকে সাম্রাজ্যের যুগও বলা হয়ে থাকে। কারণ, এ সময়ে মিশর সাম্রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়। এ যুগ ১৫৮০ থেকে ১০৯০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং তিনটি রাজবংশ, যথা–অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিংশ রাজবংশের ফারাওরা এ আমলে রাজত্ব করেন। সাম্রাজ্যের যুগে মিশর পরাক্রমশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। অষ্টাদশ রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রীয় রাজশক্তি তথা সম্রাটের শক্তিও বৃদ্ধি পায়।

হিক্সসদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় অধিকাংশ নোম-শাসক আহমোজের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিলেন। আহমোজের চূড়ান্ত বিজয়লাভের পর তাই আঞ্চলিক শাসকদের শক্তি বিশেষভাবে খর্ব করা হয়। হিক্সদের বিরুদ্ধে জয়লাভের পর মিশরের সামরিক আকাঙ্ক্ষা স্বভাবতই বেড়ে যায়। ফারাও প্রথম আহমোজ মিশরকে হিক্সসদের হাত থেকে মুক্ত করার পর তাদের অনুসরণ করে পশ্চিম এশিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।

এরপর তিনি নুবিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তবে, মিশরের নতুন সামরিক শক্তির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন ‘তৃতীয় তুমোসিস’। ১৫২৫ থেকে ১৪৯১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দব্যাপী রাজত্বকালে তিনি সতেরোটি অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্যালেস্টাইন, লিবিয়া ও নুবিয়া জয় করেন। তৃতীয় তুমোসিস্ সেকালের হিসেবে এক অতি পরাক্রমশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বাহিনীর পদাতিক সৈন্যরা তীর-ধনুক ও বল্লমে সজ্জিত ছিল এবং অশ্বারোহী বাহিনী যুদ্ধরথে সজ্জিত ছিল।

এ ছাড়া তুমোসিস্ এক বিশাল রণতরী বাহিনীরও অধিকারী ছিলেন। এ বিশাল সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস থেকে নীলনদের সুদূর দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকটি জলপ্রপাত পর্যন্ত নিজ অধিকার বিস্তৃত করেন। ফিনিশীয়, কানানাইট (কানান দেশীয়), হিট্টাইট এবং আসিরীয়রা তাঁর আধিপত্য মেনে নিয়েছিল বা তাঁকে কর প্রদান করত। এ সকল অভিযানের ফলে প্রভূত লুণ্ঠিত ধনসম্পদ ও শস্য রাজভাণ্ডারে আনা হল।

এ ছাড়া হাজার হাজার দাস এবং পশুও সংগৃহীত হল। মন্দির এবং পুরোহিতগণ এ সকল ধনসম্পদের ভাগ পেল। যেমন, রাজধানী থিবস্‌ নগরীর জনপ্রিয় দেবতা ‘আমন রা’-এর মন্দিরকে লেবাননের এক বিস্তৃত অঞ্চল ও তিনটি শহর পুরোপুরি প্রদান করা হয়। তুমোসিস্-এর এ সকল বিজয় অবশ্য খুব স্থায়ী হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সিরিয়ায় ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ সকল বিদ্রোহ সাময়িকভাবে দমিত হলেও পরাজিত জাতিগুলোর অসন্তোষ কখনও দুর হয়নি, বিদ্রোহ প্রচেষ্টাও বন্ধ হয়নি।

মন্দির ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে ব্যাপক ধনসম্পদ প্রদান করায় তাদের শক্তিবৃদ্ধি হয় এবং দেশের রাজনীতিতেও পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব বাড়তে থাকে। থি-এর আমন রা দেবতার মন্দিরের কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ মন্দিরের অধীনস্থ দাস, ও ভূসম্পত্তির পরিমাণ ছিল দেশের আর সব মন্দিরের মিলিত সম্পদের চেয়ে বেশি। থিবস্-এর পুরোহিত সম্প্রদায় এর ফলে বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। এমনকি তারা ফারাও-এর হাত থেকেও কিছু কিছু ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ফারাও ইখনাটন পুরোহিতদের ক্ষমতা খর্ব করার মানসে এক ধর্ম সংস্কারের প্রচেষ্টা নেন। এ সম্রাটের আসল নাম হচ্ছে ‘চতুর্থ আমেন হোটেপ’। ১৪২৪ থেকে ১৩৮৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনি অন্য সব দেবতাকে বাদ দিয়ে ‘সূর্যদেবতা এ্যাটনকে’ একমাত্র উপাস্য দেবতা বলে ঘোষণা করেন। সারা দেশে এ্যাটন-এর নামে মন্দির নির্মিত হল। সম্রাটও আমেন হোটেপ নামের পরিবর্তে ইখ্াটন (অর্থাৎ এ্যাটন-এর প্রিয়জন) নাম ধারণ করেন।

কিন্তু ইখ্াটনের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটে এবং ইখনাটনের মৃত্যুর পর এ সংস্কার প্রচেষ্টা বর্জন করা হয়। পুরোহিততন্ত্র এরপর আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। “দ্বিতীয় রামসেস্’-এর রাজত্বকালে (১৩১৭-১২৫১ খ্রিঃপূঃ) মন্দিরের প্রচুর ভূসম্পত্তি হয় এবং পুরোহিততন্ত্র প্রায় একটি স্বতন্ত্র রাজশক্তিতে পরিণত হয়। এ সময়ে প্রধান পুরোহিতের পদটি সম্রাটের পদের মতোই বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠে।

২য় রাসেস্-এর আমলে বড় বড় সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। সিরিয়াতে মিশরীয়দের প্রথম বারের মতো এক নতুন পরাক্রমশালী শক্তির সম্মুখীন হতে হল। এ নতুন শক্তি হল ‘হিট্টাইট’। হিট্টাইটরা ততদিনে প্রায় সমগ্র সিরিয়া করতলগত করেছে। হিট্টাইটদের সাথে মিশরীয়দের লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল, কিন্তু এর কোনো চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত হিট্রইটরা উত্তর সিরিয়া এবং মিশরীয়রা দক্ষিণ সিরিয়া অধিকার করেই সন্তুষ্ট থাকে।

মিশরের শেষ পরাক্রমশালী ফারাও ছিলেন ‘তৃতীয় রাসেস্’। ১১৯৮ থেকে ১১৬৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তারপর আরো কয়েকজন সম্রাট রাসেস্ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু তাঁরা কেউই এ নামের যোগ্য ছিলেন না। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই দুর্বল মিশর বর্বর জাতিগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকে এবং মিশরের সামাজিক অবক্ষয়ের লক্ষণসমূহও ফুটে উঠতে থাকে।

লিবিয়া এবং নুবিয়ার বর্বর অধিবাসীরা পালে পালে মিশরে প্রবেশ করে বাস স্থাপন করতে থাকে এবং তাদের প্রভাবে মিশরের সাংস্কৃতিক মান ক্রমশ নিচে নামতে থাকে। এ সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে মিশর সব রকম মননশীল প্রেরণা হারিয়ে ফেলে। মিশরের সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে এ সময় ধর্মান্ধতা,যাদুবিদ্যা ও কুসংস্কারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। যাদুবিদ্যার সাহায্যে অমরত্ব লাভই তাদের একমাত্র কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। পুরোহিততন্ত্র এ অবক্ষয়ের প্রক্রিয়ায় সর্বপ্রকারে সাহায্য করে।

শেষ পর্যায়ে পুরোহিত সম্প্রদায় এত শক্তিশালী হয়েছিল যে, রাজক্ষমতা তাদের করায়ত্ত হয়েছিল এবং সম্রাটের ফরমান পর্যন্ত পুরোহিতদের নির্দেশে রচিত হত। ২০তম রাজবংশের শেষ সম্রাট ছিলেন ‘একাদশ রাসেস্’। এ রাজবংশের অবসানের সাথে সাথে মিশরে নতুন রাজত্বকালেরও অবসান ঘটে। এরপর মিশরে গৃহযুদ্ধ এবং অরাজকতা শুরু হয়।

১০৮৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে থিবস্-এর প্রধান পুরোহিত সিংহাসন দখল করেন। এ সময়ে আবার উত্তরের বদ্বীপ অঞ্চলে অপর এক রাজা নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে ২১তম রাজবংশ স্থাপন করেন। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ (আনুমানিক ৯৫০খ্রিঃ পূঃ) থেকে অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগ (আঃ৭৩০ খ্রিঃপূঃ) পর্যন্ত লিবিয়ার বর্বর জাতি মিশরের সিংহাসন দখল করে রাখে। এ লিবীয়রাই মিশরে ২২তম রাজবংশ স্থাপন করেছিল। এরপর ইথিওপিয়ার মানুষরা এসে মিশরের সিংহাসন অধিকার করে।

 

 

৬৭০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আসিরীয়গণ স্বল্পকালের জন্য মিশর দখল করে নেয়। তবে ৬৬২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আসিরীয়দের পতনের পর মিশরীয়রা হৃত স্বাধীনতা ফিরে পায় এবং সাময়িক ভাবে মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটে। কিন্তু ৫২৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর অধিকার করলে তার সভ্যতা শেষ বারের মতো অস্তমিত হয়। এর পরে আর প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার পুনরুদয় ঘটেনি।

এরপর অবশ্য মাঝে মাঝে পারসিক শাসন ব্যাহত হয়েছে। বস্তুত ৩০তম রাজবংশ ছিল সর্বশেষ মিশরীয় রাজবংশ। কিন্তু তারপর আবার ৩৪১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পারসিকরা মিশরের সিংহাসন অধিকার করে ৩১তম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে।

আরও দেখুন :

Exit mobile version