আজকের আলোচনার বিষয় প্রচলিত ধ্যান-ধারণা – যা সামাজিক কাঠামো ও জ্ঞাতিত্ব এর অর্ন্তভুক্ত, সঠিক-বেঠিকের ধারণা শক্তিশালী, এবং সামাজিক। এই ধারণার শক্তিমত্তার ভিত্তি প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগ নয়। তার মানে, কেউ আমাদের নিরন্তর মারধর করে এসব ধারণা গ্রহণে বাধ্য করছে না। তবে বলপ্রয়োগ, অথবা চাপপ্রয়োগ শর্ত হিসেবে কাজ করে। বিশেষ সময়কালে, বিশেষ সমাজ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জীবনযাপন প্রণালী স্বাভাবিক মনে হয়।
স্বাভাবিকত্বের ধারণা সামাজিক ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত, যেমন: শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিসত্তা ইত্যাদি। অনেকে বলবেন, স্থানিক সামাজিক সমস্যা বিশ্বব্যাপী বৈষম্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, বহু ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ ভাবে। সাম্প্রতিক কালের নৃবিজ্ঞানের একটি ধারা স্বাভাবিকত্বের (normalcy) ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী মনে করছে। এই মহলের নৃবিজ্ঞানীদের যুক্তি হ’ল, বিশেষ কিছু ক্ষমতার সম্পর্ক এবং সামাজিক স্বার্থ কিভাবে টিকে আছে, এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে – সেটি বোঝা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই সাথে তারা উদ্ঘাটন করছেন কিভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীরা তাদের নিজ সমাজের স্বাভাবিকত্বের ধারণা নিয়ে ইউরোপের বাইরের (অ-ইউরোপীয়) সমাজে গবেষণা করেছিলেন।
প্রচলিত ধ্যান-ধারণা
ইউরোপীয় সমাজের স্বাভাবিকত্বের ধারণার মাপকাঠিতে অন্যান্য সমাজের রীতি-নীতি, প্রথা, মূল্যায়ন ও বিচার করেছিলেন। সামাজিক স্বার্থ উদ্ঘাটনের একটা রাস্তা হ’ল, এই দৃষ্টিভঙ্গির নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ভাষা বিশ্লেষণ প্রাত্যহিক জীবনে উচ্চারিত ভাষা মতামত, ভাবনা সমাজের সকল মানুষের অভিজ্ঞতা, কিংবা – – ভাবনা, কিংবা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ বা প্রকাশ করে না।
সমাজে ক্ষমতাশালী যারা – অর্থবিত্তের দিক দিয়ে, মান-মর্যাদায়, লিঙ্গীয় বা জাতিগত পরিচয়ে – তাদের ভাবনাচিন্তাও শক্তিশালী। তাদের সামাজিক – অস্তিত্ব নিবর্গের মানুষজনের জীবনযাপন শুধু নয়, চিন্তাকেও প্রান্তিক বা কোণঠাসা করে তোলে। এবং এই নৃবিজ্ঞানীরা বলবেন, ভাষা যেহেতু জীবনযাপন প্রণালীকে, অভিজ্ঞতাকে আকৃতি দেয় (“বাবা মারা যাওয়াতে পুরো পরিবার পথে বসে গেছে”, “মামা’দের অবস্থা ভালো ছিল, ওদের অসুবিধা হয় নাই”) ভাষা বিশ্লেষণের রাস্তা হল, কোন উক্তি, অভিমত বা বক্তব্যকে সকলের জন্য প্রযোজ্য, কিংবা তা সকলের মতামতকে প্রতিফলিত করে এটা ধরে না নেয়া।
অর্থাৎ, যা উচ্চারিত হয় সেক্ষেত্রে এই – প্রশ্নগুলো করা জরুরী: কে বলছে? কার/কাদের সম্বন্ধে বলছে? বলার মধ্যে দিয়ে কি প্রকাশিত হচ্ছে, কি উহ্য থেকে যাচ্ছে? তাঁরা বলবেন, জরুরী হচ্ছে প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত, দুটো বক্তব্যকেই নির্দিষ্ট সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করে সেটির বিশ্লেষণ করা। বিষয়টাকে স্পষ্ট করার জন্য আবার পূর্বের উদাহরণে ফিরে যাই: “বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব তার মায়ের”। এই বাক্যে মায়ের দায়িত্ব যেমন উপস্থিত করে তোলা হচ্ছে, বাবার দায়িত্বকে অনুপস্থিত করে রাখা হচ্ছে। আবার, মা বলতে জৈবিক মা-কেই বোঝান হয়েছে।
আমাদের সমাজে প্রচলিত, এবং শক্তিশালী, এ ধরনের কিছু বক্তব্য নিচে হাজির করা হচ্ছে। আপনার কাজ হচ্ছে এগুলো নিয়ে ভাবা। যেমন ধরুন, পরিবার নিয়ে একটা কথা প্রায় উচ্চারিত হয়ে থাকে: “যুগ যুগ ধরে পরিবার ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রূপে টিকে আছে” ।
এ ধরনের ভাবনা কি প্রকাশ করে? কোন পরিস্থিতিতে এটা কে বা কারা উচ্চারণ করে থাকে? পরিবারের অপরিবর্তনশীলতার এই ধারণা কি আমরা সঠিক বলে ধরে নিতে পারি? আবার খেয়াল করে দেখেন, জ্ঞাতি-পরিবার-বিয়ে, এসব বিষয়ে নানান কথা অহরহ উচ্চারিত হয় “বর্বর” এবং সভ্য এই মানদন্ড অনুসারে। এর নানান কাল্পনিক নমুনা উপস্থাপন করা যায়। যেমন:
“পৃথিবী জুড়ে ট্রাইবালরা অসভ্য। ওদের নীতি-নৈতিকতা বোধ কম…। ওদের সভ্য করে তোলা হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের দায়িত্ব”। সাম্প্রতিক কালের কিছু নৃবিজ্ঞানীদের অবস্থান হচ্ছে: সভ্য-অসভ্যতার মানদন্ড তৈরী হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে। আফ্রিকা এবং এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। কয়েক শ বছরের ঔপনিবেশিক সময়কালে এই শক্তিশালী ধারণাগুলো প্রতিষ্ঠা পায় যে, পাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে “সভ্য” এবং অপাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে “অসভ্য”।

এবং এই ধারণাগুলো স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে। মজার ব্যাপার হ’ল বিংশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপীয় শাসনের অবসান ঘটে এবং তারপর, যখন একটি গড়ে ওঠা দেশীয় শাসক গোষ্ঠী স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তাঁরা নিজ দেশের গরিব, নিপীড়িত মানুষজনকে একই ভাষায় চিত্রিত করা, কিংবা গাল-মন্দ করা, আরম্ভ করেন।
নিবর্গের মানুষজন যেমন কিনা গরিবদের ক্ষেত্রে এধরনের বিদ্বেষমূলক কথা প্রায়-প্রায় শুনে থাকি আমরা: “ছোটলোকেরা শুধু বাচ্চা পয়দা করতে পারে, কিন্তু কই, তাদের তো মানুষ করতে পারে না” “গরিবের বিয়ের কি আর ঠিক-ঠিকানা আছে? এই মুহূর্ত বিয়ে করে, পর মুহূর্তে ছাড়ে; “আচার-আচরণ দেখলেই বোঝা যায় কে ভদ্র ঘরের সন্তান” ।
সমস্যা ভদ্রতা নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে, ধরে নেয়া হয় যে, একটি বিশেষ শ্রেণী (বড় লোক)-র মানুষ ভদ্র। এবং সমাজে কেবলমাত্র তারাই ভদ্র। ভদ্রতার যে মাপকাঠি যেমন পোশাক-আশাক, স্বাস্থ্য, চেহারা-সুরত, আত্মবিশ্বাস এগুলো মূলত শ্রেণীগত ব্যাপার। এধরনের প্রত্যক্ষ, দৃশ্যমান বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করলে অপ্রত্যক্ষ এবং মৌলিক বিষয় থেকে আমাদের দৃষ্টি সরে যায়। এটি সামাজিক বিষয়াদি বুঝতে সমস্যা তৈরী করে। শ্রেণী হচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যভিত্তিক একটি ব্যবস্থা। আবারো উল্লেখ্য করা জরুরী, সমস্যা ভদ্রতা নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে, সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে উচ্চ শ্রেণীর মানুষজন, এবং কেবলমাত্র তারাই, ভদ্র। অন্যান্য শ্রেণীর মানুষজন – দুঃস্থ, খেটে-খাওয়া মানুষজন মাত্রই অভদ্র। গরিব,
“সভ্য-অসভ্য”, “ভদ্র-অভদ্ৰ” যেমন শক্তিশালী মানদন্ড, একইভাবে “পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্য” – এটাও একটা শক্তিশালী মানদন্ড হিসেবে কাজ করে থাকে এবং প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এই মানদন্ড ভাষার মাধ্যমে স্বতঃসিদ্ধ করে থাকি। পাশ্চাত্য দেশ সম্বন্ধে প্রায়শই দুই ধরনের ঢালাও মন্তব্য শোনা যায়:
“পাশ্চাত্য দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত কিন্তু পরিবারে স্থিতিশীলতা নাই…. । ওখানে তো শুনি কথায় কথায় ডিভোর্স হয়….। আমাদের দেশ উন্নত না হলেও কি হবে, অন্ততঃ ওদের মতন বিশৃঙ্খল তো আর না। অবশ্য আজকাল লক্ষ্য করা জরুরী, কে বলছে, কোন প্রেক্ষিতে বলছে? এটা বলে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তিনি? আবার, পাশ্চাত্য দেশ সম্বন্ধে একেবারে ভিন্ন, ইতিবাচক, ঢালাও মন্তব্য শোনা যায়, যেমন: “পাশ্চাত্য দেশগুলি ভালো: নারী-পুরুষের সমান অধিকার আছে, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা রয়েছে … আমাদের দেশে তো সবকিছু চাপিয়ে দেয়া হয়….”
ঢালাও মন্তব্য কিংবা সাধারণীকরণ সামাজিক সম্পর্ক বুঝতে আমাদের সাহায্য করে না। বরং, বহু ক্ষেত্রে, ঢালাও মন্তব্য করা হয় বিদ্যমান কোন সমস্যার উপস্থিতি অস্বীকার করতে। এই কারণে, যে কোন বক্তব্য কিংবা উক্তি কিংবা মন্তব্যের ব্যাপারে, চিন্তাভাবনার ব্যাপারে, আমরা কি প্রক্রিয়ায় ভাবি, কোন ধরনের জিনিসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকি এগুলো নিয়ে ভাবা জরুরী।
আরও দেখুনঃ