আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচিন যুগের মাতৃতন্ত্র
প্রাচিন যুগের মাতৃতন্ত্র
প্রাচিন যুগের মাতৃতন্ত্র
আদিমসমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা দরকার। আমরা যে সমাজে বাস করি তাতে পুরুষ মানুষের প্রাধান্য রয়েছে। আজকের পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশেই পরিবারের কর্তা হচ্ছে পুরুষ মানুষ। শুধু পরিবারের মধ্যেই নয়, সমাজের সবক্ষেত্রেই পুরুষ মানুষদের প্রাধান্য দেখা যায়। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোতে সাধারণত মেয়েরা ঘর সংসারের কাজ করে, পুরুষরা কলে কারখানায় বা অফিস আদালতে চাকরি করে উপার্জন করে।
কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশসমূহে মেয়েরা ঘর সংসারের দায়িত্ব পালন করেও জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের মতোই সমান ভাবে কাজ করে। কিন্তু তারাও পুরষদের সমান মর্যাদা পায় না। এখনও ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে সমান সমান কাজ করেও মেয়েরা পুরুষের চেয়ে কম বেতন পায়। এমনকি অনেক দেশেই মেয়ে বৈজ্ঞানিকরা পুরুষ বৈজ্ঞানিকের চেয়ে কম বেতন পান, যদিও তাঁরা কাজ করেন একই রকম।
এ ধরনের সমাজকে বলা হয় পুরুষপ্রধান সমাজ বা ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ’। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা পুরুষদের হাতে নিগৃহীত এবং অবহেলিত হয়। অবশ্য আমাদের সমাজে ধনী দরিদ্রের প্রভেদও রয়েছে। এবং একথাও সত্য যে, ধনী বা অভিজাত মহিলা গরিব শ্রেণীর পুরুষমানুষের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারে। কিন্তু অভিজাত সমাজের মধ্যেও আবার মেয়েরা পুরুষের অধীনে থাকতে বাধ্য হয়।
সমাজে এ রকম পুরুষদের প্রাধান্য বহু হাজার বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে পুরুষপ্রধান সমাজে বাস করার ফলে এবং মেয়েদের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর অভ্যাসের দরুন পিতৃপ্রধান সমাজের পুরুষ মানুষদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, পুরুষরা মেয়েদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে সবদিক দিয়ে নিকৃষ্ট।
আর পুরুষ কর্তা, পুরুষ পণ্ডিত, পুরুষ দার্শনিকদের কাছে যুগ যুগ ধরে শুনতে শুনতে পিতৃপ্রধান সমাজের মেয়েদেরও ধারণা হয়ে গেছে যে পুরুষরা বুঝি মেয়েদের চেয়ে বেশি গুণের অধিকারী। কিন্তু এ সকল কথায় কোনো সত্যতা নেই। মেয়ে ও পুরুষের দৈহিক আকৃতিতে যেটুকু সামান্য পার্থক্য আছে তা ধর্তব্যই নয়। এ কথা ঠিক যে, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের শরীর সামান্য ছোট, কিন্তু অন্য হিসেবে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী।
মানুষের দেহের সবচেয়ে শক্তিশালী দেহযন্ত্র রয়েছে মেয়েদের শরীরে। এটা হচ্ছে মেয়েদের জরায়ু। জরায়ুতে মেয়েরা সন্তান ধারণ করে। জীবনী শক্তির হিসেবে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে কম নয়। বরং মেয়েদের আয়ু পুরুষের চেয়ে কিছু বেশি। বাঙালীরা আকারে খর্ব, রঙে কালো।
এজন্য হিটলার আমাদের মানুষ মনে করত না কিন্তু বাঙালী বৈজ্ঞানিকরা নানা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে এবং বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়ে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেছেন যে, বাঙালীরা বুদ্ধিতে খাটো নয়। তেমনিভাবে, মাদাম কুরী প্রমুখ মহিলা বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন যে, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে, ক্ষমতায় বা দক্ষতায় কম নয়।
চৈনিক এবং জাপানীদের মতো এস্কিমোরাও আজকাল প্রমাণ করেছে যে, গুণের বা দক্ষতার বিচারে তারা পৃথিবীর যে কোনো উন্নত জাতির মানুষের চেয়ে হীন নয়। তা সত্ত্বেও যে বিশ্বসভ্যতায় এস্কিমোদের অবদান নগণ্য, তার কারণ হচ্ছে অনুন্নত সমাজ ব্যবস্থার গণ্ডির মধ্যে থাকার দরুন এস্কিমো মানুষদের জ্ঞান এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
দীর্ঘকাল পিতৃপ্রধান সমাজে সামাজিক ভাবে অবহেলিত এবং অবদমিত থাকার দরুন, প্রাচীন, মধ্য বা আধুনিক যুগে মেয়েরা তাদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। বর্তমানে উন্নত দেশসমূহে মেয়েদের অগ্রগতির পথে কৃত্রিম সামাজিক বাধাসমূহ যত দূর হচ্ছে মেয়েরা ততই বেশি করে তাদের প্রতিভার পরিচয় দিতে পারছে। ইউরোপ আমেরিকার মেয়েরা, জাপানের মেয়েরা, সোভিয়েত ইউনিয়নের মেয়েরা আজকাল জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
ইতিহাসের দিক থেকে বিষয়টার বিচার করলে আমরা দেখব, যদিও সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, অতীতে চিরকাল ধরেই পৃথিবীতে পিতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থা চলে এসেছে, আসলে একদম শুরুতে সমাজে মাতৃতন্ত্র প্রচলিত ছিল। একদম শুরুতে মানুষ যখন শিকারে খুব বেশি দক্ষতা লাভ করেনি তখন তারা ছিল জোগাড়ে অর্থাৎ তারা ফলমূল, ছোটখাট প্রাণী ইত্যাদি খাদ্য জোগাড় করত। এ অবস্থায় মেয়ে ও পুরুষের কাজে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না।
মেয়ে পুরুষ সবাই মিলে একসাথে খাদ্য সংগ্রহ করত। কিন্তু তা ছাড়াও মেয়েদের একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। মেয়েরা সন্তানের জন্ম দিত এবং তাদের লালন পালন করত। আদিকালে মানুষের জীবন ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল আর মানুষের সংখ্যা ছিল কম। সন্তানের জন্ম দিয়ে মেয়েরা বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করত। এর ফলে মানুষের দলের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হত। মেয়েরা সন্তান লালন পালনের জন্য আস্তানার কাছাকাছি থাকত এবং ঘর সংসারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করত।
ক্রমে হাতিয়ারের কিছু উন্নতি হলে পুরুষরা যখন দূর দূর অঞ্চলে যেত, তখনও মেয়েরা কাছাকাছি থেকে ফলমূল, বিচি ইত্যাদি জোগাড় করত। এবং শিকার যখন ছিল খুবই অনিশ্চিত ব্যাপার, মেয়েরা তখন ঘাস, লতা-পাতা, গাছ ইত্যাদি থেকে নিশ্চিতভাবে খাদ্য সংগ্রহ করত। সমাজের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে একান্ত জরুরি কাজগুলো মেয়েরা দক্ষতার সাথে করত বলে স্বভাবতই তারা সমাজের কর্তা হয়ে দাঁড়িযেছিল। এটা একান্ত স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল।
মেয়েরা যে দাপট ফলানোর জন্য কর্তৃত্ব করত তা নয়, কাজ এবং দক্ষতার গুণেই তারা সমাজের পরিচালনার ভার পেয়েছিল। কিন্তু হাতিয়ারের উন্নতির ফলে যখন মানুষ ম্যামথ প্রভৃতি শিকার করতে শিখল তখন শিকার একান্ত ভাবেই পুরুষের কাজ হয়ে দাঁড়াল, কারণ মেযেরা ঘর সংসার ফেলে বড় বড় শিকারে অংশ গ্রহণ করতে পারত না। মনে রাখা দরকার, মানবশিশুকে চার পাঁচ বছর ধরে সযত্নে লালন পালন না করলে তাদের বাঁচিয়ে রাখাই সম্ভব হয় না।
বল্লম, তীর, ধনুক ইত্যাদি আবিষ্কারের পর শিকার কৌশলের উন্নতির ফলে মানুষ খাদ্য সংগ্রহের সুনিশ্চিত উপায় আবিষ্কার করল। এর ফলে সমাজের অস্তিত্বের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব পড়ল পুরুষদের উপর। ক্রমশ তাই উচ্চতর শিকারী সমাজে পুরুষরা প্রধান হয়ে উঠল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরাই ছিল দলের মধ্যে প্রধান। মাকে মনে করা হত দলের আদিপুরুষ, অর্থাৎ তার থেকে দলের উদ্ভব হয়েছে।
আদিপুরুষ কথাটার মধ্যে অবশ্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চিন্তার ছাপ রয়েছে। আদিপুরুষ যে কোনো মেয়ে হতে পারে, আমাদের ভাষায় তার কোনো স্বীকৃতি নেই। আদিম যুগে আজকালকার মতো একজন পুরুষের সাথে একজন মেয়ের বিয়ে হত না। তখন যৌথ বিবাহের প্রচলন ছিল। একটা দলের সব পুরুষ আরেকটা দলের সব মেয়েকে বিয়ে করত। সন্তানের জন্ম হলে সে তার মায়ের নামেই পরিচিত হত এবং মায়ের দলেই থাকত।
ক্রমশ যখন সমাজে পুরুষের কর্তৃত্ব বাড়ল তখন পুরুষরা হয়ে দাঁড়াল সমাজের কর্তা, দলপতি হল পুরুষ এবং সমাজ হয়ে দাঁড়াল পিতৃতান্ত্রিক । আবার মেয়েরা গাছপালা, ঘাসপাতা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে করতে এক সময় আবিষ্কার করেছিল যে, বুনো ঘাস ইত্যাদির বিচি থেকে নতুন ঘাসের জন্ম হয় এবং ঐ বিচি খাদ্য হিসেবে খুবই ভাল। ঐ বুনো ঘাস হচ্ছে গম, যব ইত্যাদির পূর্বপুরুষ। মানুষ এ ভাবেই প্রথম কৃষির আবিষ্কার করেছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের উপকথা বিশ্লেষণ করে এবং অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে বৈজ্ঞানিকরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, কৃষিকাজ সম্ভবত মেয়েদের আবিষ্কার এবং অনেক দিন পর্যন্ত প্রধানত মেয়েরাই দক্ষতার সাথে কৃষিকাজ করত। শিকারের উন্নতি হওয়ার পরও যে সব মানুষের দল জোগাড়ের পর্যায়ে রয়ে গিয়েছিল সেসব মানুষের দলই সম্ভবত কৃষিকাজের পথে অগ্রসর হয়েছিল।
এ সকল সমাজে তাই মাতৃতন্ত্রই বজায় ছিল। কিন্তু কৃষিকাজ কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর যখন কৃষিতে হাল বলদের প্রচলন হল তখন থেকে কৃষি পুরুষের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এ সমাজেও তাই পিতৃতন্ত্র দেখা দেয়। এ সম্পর্কে পরে আমরা আরো ব্যাখ্যা করব।