আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন কুষাণ সাম্রাজ্য
প্রাচীন কুষাণ সাম্রাজ্য
প্রাচীন কুষাণ সাম্রাজ্য
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে ইউটি নামে এক যাযাবর জাতি মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষের দিকে আসতে থাকে। ক্রমশ তারা যাযাবরবৃত্তি পরিত্যাগ করে কৃষিকর্ম গ্রহণ করে। ইউচিরা ক্রমে পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে কুষাণ শাখা বিশেষ প্রবল হয়ে উঠেছিল। এই কুষাণরা পূর্ব দিকে বারাণসী থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। কুষাণরা ভারতবর্ষে এসে এদেশের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করেছিল।
কুঞ্জুল কদফিস নিজেকে সমগ্র ইউটি জাতির অধিনায়ক বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি কাবুল ও পাঞ্জাব জয় করে একটি বড় সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাঁর পুত্র বিম কদফিস উত্তর-পশ্চিম ভারতে অনেক অঞ্চল অধিকার করেন। বিম কদফিস বা দ্বিতীয় কদফিসের মৃত্যুর পর কুষাণ রাজ্যের অধিপতি হন কণিষ্ক। বিম কদফিসের সাথে কণিষ্কের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল কি না তা জানা যায়নি।
কণিষ্ক কুষাণ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। তিনি সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারত জয় করেন এবং পূর্বভারতের বহু স্থানও তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কাশ্মীর তাঁর অধীন ছিল। মধ্য এশিয়ার খোটান, ইয়ারকন্দ এবং কাশগড় প্রদেশও তিনি জয় করেন। তাঁর সময়ে কুষাণ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া থেকে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর রাজধনী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ার। প্রথম জীবনে কণিষ্ক হিন্দুধর্মের প্রতি আসক্ত ছিলেন।
কিন্তু শেষ বয়সে বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের ব্যাপারে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি বিদ্যাচর্চারও বিশেষ সমাদর করতেন। তাঁর সভায় বহু বৌদ্ধ পণ্ডিত, লেখক ও দার্শনিক উপস্থিত থাকতেন। কণিষ্কের রাজ্যকাল নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের মতে তিনি ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে শকাব্দের প্রচলন করেন। কণিষ্কের পর বাসিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, বাসুদেব প্রভৃতি রাজা রাজত্ব করেন।
বাসুদেবের পর কুষাণদের অধোগতি শুরু হয়। কুষাণযুগে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষের যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনীভূত হয়েছিল। এ যুগে রোমের সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল— দক্ষিণ ভারতের সাথে জলপথে আর উত্তর ভারতের সাথে স্থলপথে। স্থলপথে একটি রাস্তা চীন থেকে ব্যাকট্রিয়া এবং সেখানে থেকে রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর নাম ছিল রেশমের রাস্তা, তক্ষশীলা থেকে একটি রাস্তা ব্যাকট্রিয়াতে গিয়ে ঐ রেশমের রাস্তার সাথে মিশেছিল।
ভারত থেকে সূক্ষ্ম মসলিন, সাধারণ সুতিবস্ত্র, হাতির দাঁতের জিনিস, মশলা, রেশম ও অন্যান্য বিলাসদ্রব্য বিদেশে, বিশেষত রোমান সাম্রাজ্যে রপ্তানি হত। ভারতের আমদানিদ্রব্যের মধ্যে তামা, টিন, প্রবাল, কাঁচের জিনিস ও রৌপ্যদ্রব্যই উল্লেখযোগ্য। কুষাণযুগের শিল্প ও সংস্কৃতিতে বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। তবে এ যুগের শ্রেষ্ঠ কীর্তি গান্ধারশিল্প। ভারতীয় এবং গ্রীক-রোমানদের শিল্পের আশ্চর্য সমন্বয় এই গান্ধারশিল্প।
আফগানিস্তানে, মধ্য এশিয়ায় এবং পৃথিবীর বিখ্যাত যাদুঘরগুলিতে এ শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলি রক্ষিত আছে। এ যুগে গ্রীক দেবতাদের মূর্তির অনুকরণে বৌদ্ধমূর্তি এবং রোমান মুদ্রার অনুকরণে ভারতীয় মুদ্রার প্রচলন হয়। কুষাণ যুগে সাহিত্যেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। প্রসিদ্ধ কবি ও নাট্যকার অশ্বঘোষ ‘বুদ্ধচরিত’ রচনা করেন। ‘নাগার্জুন’ এ যুগের অন্যতম প্রধান দার্শনিক। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র প্রণেতা চরক ও সুশ্রুত এ যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। এ যুগে বৌদ্ধ সাহিত্যের চরম বিকাশ ঘটে।
কণিষ্কের নির্দেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের উপর বিরাট টীকাগ্রন্থ ‘অভিধর্মকোষ’ রচিত হয়। এছাড়া জ্যোতিষশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রের বহু মূল্যবান গ্রন্থ এ যুগেই রচিত হয়। কুষাণদের পতনের পর উত্তর ভারতে ছোটবড় অনেকগুলি রাজবংশের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটরা এদেশ দখল করে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। অবশ্য মৌর্য যুগের মত সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁদের আধিপত্য স্থাপিত হয়নি।
আরও দেখুন :