Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

প্রাচীন চু-রাজবংশ

প্রাচীন চু-রাজবংশ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন চু-রাজবংশ

প্রাচীন চু-রাজবংশ

 

 

প্রাচীন চু-রাজবংশ

খ্রিস্টপূর্ব এগার শতকে উত্তর-পশ্চিমের এক যোদ্ধা জাতি শাং বংশকে উৎখাত করে চু-রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে। চু-জাতির মানুষরা শাং যুগের সংস্কৃতির কদর বুঝত, তাকে শ্রদ্ধা করত। তাই চু-রাজবংশের আগমনের পরও চীনের সংস্কৃতির বিকাশে কোনো ছেদ পড়েনি। চু-রাজবংশের শাসনকাল চীনের ইতিহাসে দীর্ঘতম। আনুমানিক ১০২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৪৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর ধরে চু-বংশীয় সম্রাটরা চীনে রাজত্ব করেছেন।

তবে এ সমগ্র শাসনামল নিরবচ্ছিন্নভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল। না। চু-সম্রাটরা সামরিক শক্তির জন্য অভিজাত ভূস্বামীদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ৭৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ অভিজাতরা একজোট হয়ে রাজধানী আক্রমণ করে সম্রাটকে হত্যা করে। চু-বংশের একজন সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং তিনি পূর্বদিকে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এখানে থেকে চু-বংশ আরও ৫০০ বছর রাজত্ব করে। চু-রাজত্বের শেষ কয়েক শতাব্দী ‘যুদ্ধমান রাষ্ট্রের’ যুগ নামে পরিচিত।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকেই চীনে পাঁচটি রাজ্যের উদ্ভব হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে পশ্চিম সীমান্তবর্তী চিন রাজ্যই সমধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চু-রাজবংশকে উৎখাত করে চিন রাজ্যের রাজারাই চীন রাজবংশ স্থাপন করেন।
চু-রাজবংশের ৮০০ বছরের রাজত্বকালে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা অব্যাহত ছিল। চু-যুগের সংস্কৃতি শাং যুগের অনুরূপ, কিন্তু সমৃদ্ধতর ছিল।

চু-যুগের হস্তশিল্প আরও বিকাশ লাভ করে। চু-আমলে চীনের ইতিহাসে নতুন একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। এ যুগেই চীনে লোহার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। চীনে অবশ্য লোহা পুরোপুরিভাবে ব্রোঞ্জের স্থান অধিকার করতে পারেনি, লোহার পাশাপাশি ব্রোঞ্জের ব্যবহারও টিকে ছিল। আমরা জানি, পশ্চিম এশিয়ার হিট্রাইটরা সর্বপ্রথম ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে লোহা নিষ্কাশনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল।

পশ্চিম এশিয়া থেকেই লোহা নিষ্কাশনের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। চীনে লোহার প্রচলন ঘটেছিল চু-আমলে, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, লৌহযুগের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যথা, লোহা, বর্ণমালা, মুদ্রা প্রভৃতিকে অবলম্বন করে ফিনিশিয়া, গ্রীক ও রোমে উন্নত ধরনের লৌহযুগের সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

ফিনিশিয়া, গ্রীস ইত্যাদি স্থানে অবশ্য জলপথে সহজে যাতায়াতের সুবিধাও ছিল, যা চীনে ছিল না। কিন্তু তা ছাড়াও চীন লৌহযুগের সবগুলি সুযোগের সদ্ব্যবহার করেনি। যেমন, চীনে বর্ণমালাভিত্তিক লেখনপদ্ধতি কখনও প্রচলিত হয়নি। চীনে অনেক আগেই ব্রোঞ্জ যুগের আবিষ্কৃত চিত্রলিপি প্রচলিত হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে আর বর্ণমালার প্রচলন হতে পারেনি। চিত্রলিপি আর বর্ণমালার পার্থক্য আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।

চীন বর্ণমালাকে গ্রহণ না করার ফলে চিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও সমাজের বিকাশের। দিক থেকে গ্রীস প্রভৃতি দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছিল। চীনে অবশ্য খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে তামার মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল, কিন্তু গ্রীসের মতো সামগ্রিকভাবে লৌহযুগের উন্নত সভ্যতার প্রচলন এখানে কখনও হয়নি। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে, চীনে কখনও ব্যবিলনীয় বা গ্রীস বা রোমের মতো দাসপ্রথার উদয় হয়নি।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

চীনে অবশ্য ক্রীতদাসের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু উৎপাদনে কখনও ব্যাপকহারে দাসদের নিয়োগ করা হয়নি। এর কারণ হয়তো এই যে, চীনে বিলম্বে ব্রোঞ্জযুগের আবির্ভাব ঘটায় সেখানে একবারেই ব্রোঞ্জ যুগের উন্নত হাতিয়ার ব্যবহারের দরুন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল, অর্থাৎ অল্প শ্রমেই অধিক উৎপাদন করা চলত। এ কারণেই হয়তো চীনে দাসশ্রমের প্রচলন কখনই হয়নি। মনে রাখা যেতে পারে যে, চীনের অন্তত দুই হাজার বছর আগেই মিশর-ব্যবিলনে ব্রোঞ্জ যুগের আবির্ভাব ঘটেছিল।

মিশর-ব্যাবিলনীয় ব্রোঞ্জযুগের শুরুতে হাতিয়ার এত অনুন্নত ছিল যে, দাসপ্রথার প্রচলন ছাড়া সভ্যতার প্রাথমিক বিকাশই সম্ভব হত না। অবশ্য চীনে দাসপ্রথার প্রচলন কেন ঘটেনি তার কারণ সম্পর্কে এ ব্যাখ্যা সঠিক কি না তা বলা কঠিন। কারণ চীনে দাসপ্রথা ছিল কি ছিল না এবং না থাকলে তার কারণ কি এ বিষয়ে পণ্ডিতরা এখনও একমত হতে পারেননি। জোসেফ নীড়হাম প্রমুখ চীন-তাত্ত্বিকরা অবশ্য মনে করেন যে, চীনে গ্রীস বা রোমের মতো দাসপ্রথার প্রচলন কখনও হয়নি।

চু যুগে অধিকাংশ মানুষ অবশ্য ছিল গ্রামীণ কৃষক; কিন্তু এ যুগে অনেকগুলি বড় বড় শহর গড়ে উঠেছিল এবং সমাজে বণিক শ্রেণী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। এ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য কেবল চীনের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মাল পরিবহণের কাজে প্রথমে গাধা এবং পরে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উটের প্রচলন ঘটায় মধ্য এশিয়া অতিক্রম করে খাদ্যশস্য, লবণ, রেশম ও অন্যান্য পণ্য দূরদেশে চালান দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

এ প্রয়োজনে চীন থেকে পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বাণিজ্যপথ (রেশম সড়ক) গড়ে উঠেছিল; এ পথে উটের ক্যারাভান যাতায়াত করত। চু যুগে রেশমের উৎপাদন বেড়েছিল এবং কয়েক রকম গাছের আঁশ থেকে কাপড় তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। আদিমকাল থেকেই চীনে চিন্তা ও দর্শনের বিকাশ ঘটেছিল। চু এবং তার পরবর্তী চিন রাজবংশের আমলে প্রাচীন চীনের তিনজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাবিদের উদয় হয়। এঁরা হলেন লাওৎসে, কনফুশিয়াস এবং মেনশিয়াস।

এঁদের মধ্যে লাওসে ছিলেন। প্রাচীনতম। লাওসে ছিলেন তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তাওবাদ বস্তুজগৎকে অবজ্ঞা করত বলে বাস্তব কার্যকলাপের কোনো সুযোগ এ ধর্মে ছিল না। লাওৎসের অনুসারীরা ক্রমে তাঁর শিক্ষাকে বিস্তৃত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাওবাদ চীনের বৌদ্ধধর্মের সাথে মিশে। যায়। প্রাচীন চীনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দার্শনিক ছিলেন কনফুশিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খ্রিঃ পূঃ)। কনফুশিয়াস ছিলেন নৈতিক দার্শনিক। সৎ জীবন এবং সৎ সমাজ ছিল তাঁর কাম্য।

 

 

তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে দেশাচার হিসাবে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু ধর্মীয় বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতেন না; এ বিষয়ে তিনি বলতেন, “আমরা জীবনকেই জানি না, মৃত্যুকে বুঝব কি করে?” কনফুশিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল চীনের প্রাচীন প্রথায় ফিরে গিয়ে সমাজকে রক্ষা করা। এ উদ্দেশ্যে তিনি নৈতিক শিক্ষা ও সদাচার পালনের শিক্ষা দিতেন। মেনশিয়াস (৩৭২-২৮৯ খ্রিঃ পূঃ) ছিলেন কনফুশিয়াসের অনুসারী। তাঁর দর্শন ছিল মূলত রাজনৈতিক।

তিনি বলতেন যে, রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষকে কর প্রভৃতি দ্বারা নির্যাতন করার জন্য নয়। তিনি উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করতেন।

আরও দেখুন :

Exit mobile version