Site icon Anthropology Gurukul [ নৃবিজ্ঞান গুরুকুল ] GOLN

প্রাচীন রাজত্বের যুগ

প্রাচীন রাজত্বের যুগ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাচীন রাজত্বের যুগ

প্রাচীন রাজত্বের যুগ

 

 

প্রাচীন রাজত্বের যুগ

৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা মেনেস্ উত্তর ও দক্ষিণ মিশরকে এক রাজ্যে পরিণত করেন এবং নিজেই তার সম্রাট হন। মেনেস্ই প্রাচীন মিশরের প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এর পর ২৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত আরও পাঁচটি রাজবংশ মিশরে রাজত্ব করে। প্রাচীন মিশরের সম্রাটদের বলা হত ‘ফারাও’। ফারাওরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রাচীন রাজবংশের রাজাদের উপাধি দেয়া হয়েছিল ‘উচ্চ ও নিম্ন মিশরের সম্রাট’।

সম্রাটরা তখন দুটো মুকুট মাথায় পরতেন। একটা সাদা, আরেকটা লাল। ফারাও-এর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন একজন উজির বা মন্ত্রী। শাসন ব্যবস্থার সব দিকে দৃষ্টি রাখতে হত এ মন্ত্রীকে। রাজ্যের শস্যভাণ্ডার, স্বর্ণখনি, আঙ্গুরের বাগিচা, পশু সম্পদ, সামরিক বিষয়াদি, প্রার্থনানুষ্ঠান প্রভৃতি সকল কাজের তদারক মন্ত্রীকে করতে হয়। তা’ ছাড়া ফারাওয়ের যাবতীয় কাজ, তোষাখানা, খাজাঞ্চিখানা বিচার-আচার প্রভৃতির তত্ত্বাবধানও তাঁকে করতে হত।

উজির এবং সব দফতরের অধীনেই বহুসংখ্যক কর্মচারী, লিপিকার, কেরানি প্রভৃতি থাকত। প্রাচীন রাজত্বের আমলেও অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজেই নিয়োজিত ছিল। নতুন পাথরের যুগের মতোই কৃষকদের গ্রামসমাজ কৃষিকাজ পরিচালনা করত। সর্দারের পরিষদ গ্রামসমাজ পরিচালনা করত। নতুন পাথরের যুগের তুলনায় এ সকল গ্রাম সমাজকে একটা সম্পূর্ণ নতুন কর্তব্য পালন করতে হত।

নতুন পরিস্থিতিতে সম্রাটকে কর দিতে হত এবং বিভিন্ন রাজকীয় প্রকল্পের জন্যে অর্থাৎ রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির নির্মাণ, খনি খনন ইত্যাদি কাজের জন্যে কৃষকদের মজুর হিসাবে বেগার খাটতে হত। দাসদের সাধারণত সম্রাট ও অভিজাত রাজপুরুষদের (অর্থাৎ রাজ কর্মচারীদের) বড় বড় বাগিচায় বা খেত-খামারে খাটানো হত। প্রাচীন মিশরে মন্দিরের এবং পুরোহিতমণ্ডলীর বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি ছিল। এ সকল জমিতেও মন্দিরের অধীনস্থ দাসদের খাটানো হত ।

প্রাচীন রাজত্বের ফারাওগণ সিনাই উপদ্বীপ ও নুবিয়া অঞ্চলের মানুষদের বিরুদ্ধে বারবার সামরিক অভিযান চালিয়ে ম্যালাকাইট, তামার আকর, সোনা, হাতির দাঁত ইত্যাদি প্রভূত সম্পদ ও বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী সংগ্রহ করেন। যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো হয়। প্রাচীন মিশরের অত্যাশ্চর্য কীর্তি পিরামিডসমূহ প্রাচীন রাজত্বের আমলেরই সৃষ্টি। পাথরের তৈরি বিশাল পিরামিডগুলো ছিল আসলে ফারাও ও অভিজাত মানুষদের সমাধি মন্দির বা কবর।

ফারাও বা তাঁর উজির সভাসদরা নিজেরা বেঁচে থাকতেই তাঁদের মৃতদেহের বাসস্থানস্বরূপ এসব পিরামিড তৈরি করাতেন। এ রকম সত্তরটি পিরামিড এখন পর্যন্ত টিকে আছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাতটি হচ্ছে খুফু বা কিওপস্-এর পিরামিড। এ পিরামিডটির উচ্চতা ৪৭৫ ফুট এবং তার বর্গাকৃতি ভিত-এর প্রতি পার্শ্বের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৭৫০ ফুট। এটি নির্মাণ করতে ২৩ লাখ পাথরের টুকরো দরকার হয়েছিল, যার প্রতিটির ওজন ছিল ৫০ মণেরও বেশি।

দূরের পাহাড় থেকে পাথর কেটে দাস ও কৃষক শ্রমিকরা এ সব পাথর দড়ি বেঁধে টেনে টেনে নিয়ে আসত। মিশরের গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতি তিন মাসের জন্যে এক লাখ করে লোক সংগ্রহ করা হত এ পিরামিড নির্মাণের জন্য। এ পিরামিডটি তৈরি করতে এক লাখ লোকের কুড়ি বছর লেগেছিল। মিশরীয়দের পিরামিড নির্মাণের রীতি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও পারলৌকিক বিশ্বাসের সাথে জড়িত ছিল।

প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত মানুষ মরে যাবার পরেও যদি তার দেহকে সংরক্ষণ করা যায়, তবে ঐ দেহে তার আত্মা ফিরে আসে। এ জন্য প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষ কৌশলে মৃতের শরীরে মলম মাখিয়ে মৃতদেহকে সংরক্ষণ করত এবং মৃতের কবরে খাদ্য, পানি ইত্যাদি রেখে দিত। এ সংরক্ষিত মৃতদেহকে বলা হয় “মমি” (ইংরেজিতে Mummy)। মমি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘মমিয়াই” শব্দ থেকে। পারসিক ভাষায় মমিয়াই শব্দের অর্থ হচ্ছে মোম বা আলকাতরা।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মৃতদেহকে ঘিরে প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে এ রকম আশ্চর্য চিন্তা ও রীতিনীতির উদ্ভবের বিশেষ কারণ আছে। সব সমাজেই ভাবাদর্শ ও চিন্তাধারা গড়ে ওঠে সমাজ ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে এবং ঐ সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। প্রাচীন পাথরের ও নতুন পাথরের যুগে মৃতদের প্রতি বিশেষ আচরণ করা হত, আমরা আগেই দেখেছি। নিয়াণ্ডার্থাল মানুষ মাটির নিচে পাথরের ঘরে মৃতদেহকে কবরস্থ করত। স্থানীয় অবস্থাভেদে অন্য স্থানে অন্য প্রথা জন্মলাভ করে।

অস্ট্রেলিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলের আদিবাসীরা মৃতদেহকে গাছের ওপর মাচায় রেখে দেয়। প্রাচীন মিশরীয়রা তেমনি মৃতদেহকে পাতায় মুড়ে অগভীর মাটির নিচে কবর দিত। এতে মরুভূমির শুষ্ক উত্তপ্ত বালু মৃতদেহকে সম্পূর্ণ ঘিরে রেখে তার পচনকে রোধ করত এবং ফলে মৃতদেহের চুল, চামড়া ও নরম অংশসমূহ সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকত।

মিশরের প্রাকৃতিক পরিবেশের দরুন মৃতদেহ স্বাভাবিকভাবেই সংরক্ষিত থাকত বলেই হয়তো মিশরীয়দের মনে এ বিশ্বাস ক্রমশ গড়ে ওঠে যে, মৃত্যুর পরেও মানুষের দেহ বেঁচে থাকে। এ বিশ্বাস থেকেই মিশরীয়রা মৃতদেহের কবরে খাদ্য, পানীয়, হাঁড়ি পাতিল, বাসন কোসন সব কিছু রাখতে লাগল, যেন মৃত ব্যক্তিরা মরার পরেও এসব ব্যবহার করতে পারে। এত জিনিসপত্র রাখার জন্যে কবর বড় করতে হল।

কিন্তু প্রশস্ত পাথরের কবরে তপ্ত বালুর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকায় মৃতদেহতে আবার জীবাণুর ক্রিয়ায় পচন ধরতে থাকে। এর ফলে কৃত্রিমভাবে মৃতদেহকে সংরক্ষণের চেষ্টা শুরু হয় এবং কালক্রমে মিশরীয়রা এ কাজে বেশ সাফল্য অর্জন করে। মিশরীয়রা অবশ্য সম্পূর্ণ মৃতদেহটাকে মমি বানিয়ে সংরক্ষণ করতে পারত না।

প্রথমে তারা মৃতদেহের মাথা ফুটো করে মগজটা বের করে নিত এবং পেট কেটে ভেতরের অন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গসমূহ বের করে দেহের ভেতরটা ভাল করে ওষুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলত আর অন্ত্র ইত্যাদিকে আলাদা ভাবে কাঁচের পাত্রে ওষুধে ডুবিয়ে রাখত। তারপর শরীরটাকে একটা ওষুধ ভর্তি কাঁচের পাত্রে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা হত। ওষুধের প্রভাবে শরীরের চামড়া ও চর্বি গলে যেত। মৃতদেহটিকে তখন বের করে ভাল করে শুকানো হত।

তারপর এক রকম আঠালো ওষুধ শরীরের ভেতর ভরে দেয়া হত এবং গায়ের ওপর বিশেষ এক ধরনের মলম মেখে তাকে কাপড় দিয়ে ভাল করে জড়িয়ে বাঁধা হত। মমি তৈরির পদ্ধতির আরও উন্নতি হবার পর, শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলোকে আবার ওষুধ মাখা কাপড়ে মুড়ে শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হত। এ ভাবে মমি তৈরি করলে মৃতদেহ আর পচে নষ্ট হত না,মিশরের শুষ্ক ও তপ্ত আবহাওয়ায় শুকিয়ে যেত। সমস্ত কাজ শেষ করতে প্রায় আড়াই মাস সময় লাগত।

মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করা খুবই ব্যয়সাধ্য ছিল। শুধুমাত্র সম্রাট ও অভিজাত দাস-মালিকরাই মমি ও তার উপযুক্ত পিরামিড ও সমাধি-মন্দির তৈরি করাতে পারত। পিরামিড ও সমাধি-মন্দিরে অনেকগুলো ঘর থাকত। একটি ঘরে মৃতদেহের মমি, অন্য ঘরগুলোতে দাসদাসী, রাঁধুনি, কারিগর, দাস পরিচালক প্রভৃতির কাঠের বা মাটির মূর্তি এবং প্রচুর ধনরত্ন রাখা হত। ঘরের দেয়ালগুলোতে শস্যখেত, কামারশালা, চাষরত কৃষক প্রভৃতির ছবি আঁকা থাকত।

 

 

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে কবরের ভেতর এসব ছবি ও মূর্তি প্রাণ পেয়ে সত্যিকার মানুষে পরিণত হয়ে মৃতের সেবা করবে। স্পষ্টতই, অভিজাত মিশরীয়রা মৃত্যুর পরেও অনন্ত কাল দাস-মালিক হয়েই থাকতে চাইত। কৃষক ও সাধারণ মানুষদের জন্যে অবশ্য অন্য ব্যবস্থা ছিল। তাদের কবরে মৃতদেহের সাথে একটা কাঠ খোদাই করা মানুষের মূর্তি রেখে দেয়া হত। এ কাঠের মূর্তিটা ছিল মমির প্রতীক।

মৃতদেহের পাশে পাত্র-ভর্তি খাবারও রাখা হত। দাসদের জন্যে কোনো কবরের ব্যবস্থা ছিল না। অনেকগুলো দাসকে এক একটা বড় গর্তে পুঁতে ফেলা হত, এই ছিল তাদের কবর।

আরও দেখুন :

Exit mobile version